সকাল বেলা মেলায় বই এর স্টলের সামনে বিশিষ্ট নামকরা উপন্যাসিক ও গল্পকার জুনায়েদ হারিস কে দেখে প্রকাশক খন্দকার আজিজুর রহমানের মুখ খুশিতে তেলতেলে হয়ে গেল। তার প্রতিষ্ঠান ‘অনির্বান প্রকাশনী’র অনেক নামডাক সারা দেশ জুড়ে। আর তারাই সবচাইতে বেশী জুনায়েদ হারিসের বই প্রকাশ করে। জুনায়েদ সাহেবের বই বাজারে ছাড়া মাত্রই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এবার বই মেলায় জুনায়েদের তিনটি বইই তারা প্রকাশ করেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম প্রকাশের সবগুলা বই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আরো একবার ছাপাতে হয় বইগুলো। হু হু করে বিক্রি হতে থাকে জুনায়েদ সাহেবের বইগুলা। এখন উনাকে দেখলে মেলার প্রায় সব মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে সন্দেহ নাই। তাই উনাকে দেখে কিভাবে সমাদর করবে সেটা ভাবতে গিয়ে আজিজ সাহেবের কালঘাম ছুটে যাবার যোগাড় হয়ে গেল। আজিজ সাহেবের ভাবভঙ্গি দেখে জুনায়েদ ভীষণ বিরক্ত। বরাবরই বিরক্ত হয়। রাগের মাথায় অনেক কিছু বলেছেও। মুখের সামনে একবার চায়ের কাপ ছুঁড়ে দিয়েছে। এরপরেও তাকে দেখলে এমন পাগলামি করে।
-স্যার বসেন। কি খাবেন বলেন। আজিজ সাহেবের তৈলাক্ত মুখ আরো বেশী তেলতেলে হয়ে গেল।
-কিছু খেতে আসি নি আমি সেটা আপনি খুব ভাল করেই জানেন। চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে রাগী রাগী চোখে বললো জুনায়েদ।
-একটু তো বসেন স্যার।
-বই কেমন বিক্রি হচ্ছে সেটা বলেন আগে। প্রায় ধমকের সুরে বললেন জুনায়েদ।
-আর মাত্র তিরিশটার মত কপি আছে স্যার। এখন আপনাকে দেখলে তাও সব বিক্রি হয়ে যাবে।
-তৃতীয় সংস্করণ বের করার ইচ্ছা আছে কি?
-সেটা তো স্যার করতেই হবে। পাবলিক ডিমান্ড যে।
-পাবলিক ডিমান্ড তাই না? কেমন যেন একটু উদাসীন হয়ে কথাটা বলল জুনায়েদ।
মূহুর্তের মধ্যে দোকান লোকে ভরে গেল। কোথা থেকে এক বেসরকারী টিভি চ্যানেলের লোক ক্যামেরা নিয়ে হাজির। সাক্ষাৎকার নিতে চায়। ওদের দেখা মাত্রই জুনায়েদের রাগ তিরিক্ষে উঠে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সবকিছু দেখতে লাগলো। কিভাবে এইখান থেকে সরে যেতে পারে সেতা ভাবতে লাগলো। এমন সময় নীল রঙের সেলাওয়ার কামিজ পরা এক তরুণী একটা খাতা নিয়ে হাজির। কত হবে বয়স? বেশী হলে ১৫ থেকে সতের এর মধ্যে। অবশ্য এখনকার তরুণীদের বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। মেয়েটি জুনায়েদের দিকে খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, স্যার একটা অটোগ্রাফ দিন না।
-আমি আটোগ্রাফ দেই না। অন্য একদিকে তাকিয়ে জুনায়েদ চিবায়ে চিবায়ে কথাগুলা বললো।
-স্যার দিন না একটা। প্লিজ স্যার। মেয়েটা একেবারে নাছোড়বান্দা।
-বললাম তো আমি দিবো না। কিছুতেই না।
-প্লিজ স্যার প্লিজ।
-তোমার নাম কি?
-স্যার আমার নাম চৈতি। গদগদ সুরে বললো মেয়েটি।
-সরি, আমি অটোগ্রাফ দেবো না।
-স্যার প্লিজ দিন না। একটা মাত্র।
রাগে জুনায়েদ মেয়েটার হাত থেকে খাতা নিয়ে ঠাস করে টেবিলের উপরে রেখে দিলো। উপস্থিত সবাই জুনায়েদের এই আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। ক্যামেরাম্যান মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলো জুনায়েদের দিনে। কিছু বলা তো দূরে থাক, হাত দিয়ে একরকম থাবা দিয়ে মাইকটা সরিয়ে ভিড় ঠেলে দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা যথেষ্ট অপমানিত বোধ করে। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দোকান থেকে বের হয়ে আসে।
পরদিন জুনায়েদ সকাল বেলা টেবিলে চা খেতে বসে মুচকি মুচকি হেসে খবরটা দেখতে থাকে। খবরের ক্যাপসন হল, ‘বিশিষ্ট লেখকের প্রকাশ্যে অসৌজন্যমূলক আচরণ’। ঘটনার একেবারে সবিস্তারে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তার একটা ছবিও আছে। পড়ে খবরের কাগজটা আবার টেবিলের পাশে ভাজ করে লিখে দিল। এসব পড়ে মাথাব্যথা করার কোন দরকার নেই। সমালোচনা দেখতে ভালই লাগে। টেবিল থেকেই জোরে জোরে ডাক দিল জুনায়েদ, ‘মা, ও মা। কই তুমি’?
-আমি রান্নাঘরে। কিছু লাগবে? ফাইজা বেগম জবাব দিলেন রান্নাঘর থেকে।
-মা এদিকে একটু আসো না।
-আসছি। তুই বল তোর কি লাগবে? আজকে বুয়া আসে নাই। রান্না ঘরে অনেক কাজ আমার। বলতে বলতে টেবিলের কাছে চলে এলেন।
-মা শোন, আমার মাথায় একটু তেল দিয়ে দাও না। মাথা কেমন যেন লাগছে।
-এই তোর জরুরী কাজ? ফাইজা বেগম হেসে দিলেন।
-দাও না মা, প্লিজ! বাচ্চাদের মত করে আহ্লাদ করে বললো জুনায়েদ।
-একটা দাঁড়া। সোফায় গিয়ে বস। আমি তেল নিয়ে আসছি।
জুনায়েদ বড় সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মা মাথায় যখন তেল দিয়ে দেয় তখন অনেক্ষণ ধরে চুল টেনে টেনে মাথা বিলি করে। মজাই আলাদা! জুনায়েদের আরামে ঘুম এসে যায়। মাঝে মাঝেই সে এই আবদার করে মায়ের কাছে। ফাইজা বেগম তেল এনে ছেলের মাথায় লাগাতে শুরু করেন। ‘জুনায়েদ তোর নামে পত্রিকায় কি লিখেছে এইসব?’
-তুমি পড়ে ফেলেছো মা?
-পড়লাম তো। প্রথম পাতায় লিখলে চোখে তো পড়বেই। তা এমন কেন করিস? মানুষ কি বলবে? এরাই তো তোর বইয়ের পাঠক।
-মা তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কেন অটোগ্রাফ দেই না।
-জানি। কিন্তু দেশের সবাই কি জানে তোমার মনের কষ্ট? তুই এমন করলে লোকে তোকে যে খারাপ বলবে।
-যার যা খুশি বলুক মা। আমার ভাল লাগে না এইসব। মায়ের কোলে মাথা রেখে জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে আছে।
কলিং বেল বেজে উঠলো। জুনায়েদ খুব বিরক্ত। এই সময়ই লোক আসতে হবে? ফাইজা উঠে বললেন দেখি কে এলো। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললেন, একটা মেয়ে এসেছে জুনায়েদ। কি জরুরী একটা কাজ বলল। ‘যত্তসব! গজগজ করতে করতে জুনায়েদ বলল। তুমি বললে না কেন মা যে এখন আমি কথা বলতে পারবো না’।
-আরে বাবা, মেয়েতা খুব অনুরোধ করে বলল, না করি কি করে?
-ধুর মা! তুমিও না! মেয়েটা বলল আর ওমনি তুমিও গলে গেলে।
-আরে বাবা, যা না। তাড়াতাড়ি কথা বলে বিদায় করে দিয়ে আয়। ঝামেলা গেল তাহলে।
ড্রইং রুমের পর্দা সরিয়ে জুনায়েদ চমকে গেল। আরে এতো সেই মেয়ে। কাল যাকে বই মেলায় অটোগ্রাফ দেয় নি।
-আপনি? এখানে কি মনে করে? আমার ঠিকানা পেলেন কি করে? রাগত স্বরে বলল জুনায়েদ?
-আপনার মত একজন বড় লেখকের ঠিকানা জোগাড় করা এমন কঠিন কিছু না স্যার।
-ভালো কথা। বলুন আমি কি করতে পারি?
-স্যার কাল আপনি আমার সাথে ঐরকম ব্যবহার কেন করলেন? আমি কি আপনার সাথে খারাপ কিছু করেছি?
-দেখুন আমি ওই ব্যাপারে কিছু বলতে আগ্রহী নই।
-আগ্রহী নই বললেই তো হবে না স্যার। আজকের পত্রিকাটা দেখেছেন নিশ্চই?
-দেখলাম। তো?
-লোকে আপনাকে কি বলবে ভেবে দেখেছেন?
-শুনুন। আমরা লেখন বলেই নিজেদের একজন বিকিয়ে দেই নি। আমাদেরও মন বলে কিছু আছে। ভাললাগা মন্দলাগা বলে কিছু আমাদেরও থাকতে পারে তাই না?
-হ্যা তা পারেই। কাল না হয় আপনার মন ভাল ছিল না, কিন্তু আজ? আজ কি দেবেন একটা অটোগ্রাফ?
-আবার সেই একই প্রসঙ্গ? দেয়ার ইচ্ছা হলে তো কালই দিয়ে দিতাম।
-দয়া করে বলবেন কি কেন আপনি অটোগ্রাফ দেন না?
-এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই।
-স্যার। এমন কেন করছেন? আমি আপনার ভক্ত আপনার প্রথম লেখা থেকেই। আপনার সবগুলা লেখা আমি পড়েছি। একজন প্রিয় লেখকের কাছ থেকে আমি কি এইটুকু আসা করতে পারি না?
-পারেন। কিন্তু আমার কাছে নয়।
-কেন নয় স্যার?
-আপনার কি কাজ হয়েছে? কাজ হয়ে থাকলে আপনি আসতে পারেন।
-একজন অতিথি কে এভাবে তাড়িয়ে দেবেন স্যার?
-আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা বসুন। আমার কাজ আছে। আর দয়া করে আমাকে অটোগ্রাফের কথা বলবেন না। বলেই জুনায়েদ উঠে গেল ঘর ছেড়ে। চৈতি অবাক হয়ে লেখকের প্রস্থান দেখতে পেল কিছু বলার আগেই। নিজেকে আবার অপমানিত মনে হল চৈতির। কিন্তু সেও মনে মনে জিদ করে নিয়েছে। এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে। উঠার ঠিক আগ মূহুর্তে ফাইজা বেগম ড্রইং রুমে ঢুকলেন।
-তোমার নাম কি? ফাইজা বেগম প্রশ্ন করলেন।
-আমার সাম চৈতি। সালাম দিয়ে উত্তর দিল চৈতি।
-আমি একটু আগে তোমাদের কথা শুনেছি। তুমিই তাহলে সেই মেয়ে কাল যাকে নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল?
-জ্বি। আমার জন্য স্যার কে নিয়ে পত্রিকায় এসব লিখেছে সেজন্য আমি খুবি লজ্জিত।
-লজ্জিত হতে হবে না। ও একটু এমনই। ওর জীবনে দু’টা বড় বড় দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। এরপর থেকে ও একটু একরোখা হয়ে গেছে।
-কি হয়েছে আমাকে বলতে পারেন?
-তুমি কেন জানতে চাইছো মা?
-আমি স্যার এর বিরাট ভক্ত। উনার সব লেখা আমি অন্ধের মত পড়ি। আমার এত ভাল লাগে। সেইজন্যই উনার একটা অটোগ্রাফ চেয়েছিলাম।
-সে আমি বুঝতে পেরেছি। বাসা পর্যন্ত যখন এসেছো, তখন ওর লেখা তোমার অনেক ভালো লাগে বলেই এসেছো। সেটা বুঝতে পেরেছি। বেশ শোন তাহলে-
ছোট বেলালে থেকেই জুনায়েদের লেখালিখির প্রতি আগ্রহ অনেক বেশী ছিল। ওর বাবা ওকে সবসময় উৎসাহ দিত লেখালিখির প্রতি লেগে থাকার জন্য। আমিও মানা করতাম না। ওর বাবাই ওকে অনেক কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। মজার কথা কি জানো? ওর বৌএর নামও ছিলো চৈতি। খুব ভালোবাসতো ও চৈতিকে। এরপর জুনায়েদের বাবা মারা যান হঠাৎ করে। এরপরেও আমাদের তিনজনের সংসার ভালই ছলে জাচ্ছিলো। জুনাদেয়ের তখনি বেশ নামডাক। অন্তত আমাদের চারটে ডালভাত ঠিকমতই জুটে যাচ্ছিলো। ওর বিয়ের প্রায় চার বছর পার হয়ে গেল। ওদের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। বাচ্চার জন্য চৈতিই জুনায়েদকে চাপ দিত। কিছুতেই কিছু হল না। অবশেষে ওরা ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারি রিপোর্টে এলো, জুনায়েদের সমস্যা নাই কিন্তু বৌমা কখনও মা হতে পারবে না। এমনই সমস্যা। জুনায়েদ রিপোর্ট নিয়ে এসে আমাদের কাউকে জানালো না এই কথা। বৌমা শুনলে মনে কষ্ট পাবে, ভেবে জুনায়েদ সব দোষ নিজের মাথায় নিয়ে নিলো। বাসায় এসে জানালো চৈতির কোন সমস্যা নেই। দোষ ওর নিজের। শুনে অনেক কষ্ট পেলাম। কিন্তু আসতে আসতে বৌমার চেহারা পালটে যেতে থাকে। সংসারে নিত্য নতুন অশান্তি তৈরি করতে থাকে। জুনায়েদ ওকে অনেক বোঝায় কিন্তু চৈতি কেমন যেন আমূল পালটে গেল। এর মধ্যে ও ওর আগের এক বন্ধুর সাথে খারিত তৈরি করে। পরে একদিন আমাদের কিছু না জানায়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সেই ছেলের সাথে। যাবার আগে, জুনায়েদ কে জানায় যে, ওর সাথে সংসার করবে না। জুনায়েদ কিছুই বলে নাই। হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। আমাকেই উলটা সান্ত্বনা দিত। বলতো, মা! ও একটা মেয়ে। বাচ্চা তো চাইতেই পারে। ওকে দোষ দিও না মা। যা করেছে ভালই করেছে। কষ্টে আমার মনের ভেতরটা জ্বলে জেত। উপর দিয়ে খুব হাসি খুশি থাকলেও, আমি মাঝে মাঝে আড়াল দিয়ে দেখতাম, লেখার টেবিলে বসে জুনায়েদ চোখে রুমাল চাপা দিয়ে আছে। আমাদের কিছুই বুঝতে দিত না।
চৈতি চলে যাবার মাস খানেকের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পাঠায়ে দেয়। এর কয়েক মাস পরে শুনি ঐ ছেলেকে চৈতি বিয়ে করেছে। এটা শুনেও জুনায়েদ খুশি। বলে কি, মা ও ভালো থাকলেই ভাল। কিন্তু কপ্লাএর লিখন না যায় খন্ডন। ঐঘরে গিয়ে ধরা পড়লো চৈতি কখনই মা হতে পারবে না। চৈতি ভিষন ভেঙ্গে পড়ে। লজ্জায় অপমানে মুষড়ে পড়ে। তখন বুঝতে পারে, ও যেন কষ্ট না পায়, সেজন্য জুনায়েদ ওকে মিথ্যা কথা বলেছিল। মনে মনে ভীষণ অপরাধবোধে বুগতে থাকে। এদিকে ওর স্বামী আবার বিয়ের পায়তারা শুরু করে দেয়। মনের কষ্টে একদিন শুনতে পাই হতভাগী আত্মহত্যা করেছে। জুনায়েদ ওর মৃত্যুর কথা শুনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে। ওকে ছেড়ে চলে গেলেও চৈতিকে কখনই ভুলতে পারে নি। নাওয়া খাওয়াও ছেড়ে দেয় এমন অবস্থা। চৈতি মারা যাবার পরে একদিন আমি জুনায়েদের ঘর গোছাতে গিয়ে ডাক্তারের রিপোর্ট গুলা দেখতে পাই। বুঝতে পারলাম আসল ঘটনা। তখন আর কি করার আছে? পরে জুনায়েদকে জিজ্ঞাসা করেছি, কিছু বলে না, শুধু হেসে আমাকে বলেছে, এত চিন্তা কর কেন মা? আমি আছি না? মনে মনে ভীষণ গর্ব হল এমন একটা ছেলেকে পেটে ধরেছি বলে। শুধু একটা মেয়েকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে সব অপমান নিজের ঘাড়ে তুলে নিলো।
এরপর অনেকবার ওকে বিয়ের কথা বলেছি। কিছুতেই রাজী হয় না। বলে, মা আমার আর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না। আরেকটা বৌ ঘরে আনলেও বারবার চৈতির কথা মনে পড়বে। এটা কি ঠিক হবে মা? আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নাই। ওকে বেশী চাপাচাপিও করতে পারি না। খুব খেয়ালী ছেলে।
-এরপর কি হল? এতক্ষণ পরে মুখ খুললো ফাইজা বেগমের সামনে বসা চৈতি।
-এরপরের কথা আরো করুন মা! চোখ মুখে বললেন ফাইজা বেগম।
একতিন হুট করে কথা থেকে ৩-৪ বছরের এক বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির জুনায়েদ। বলে, মা এই নাও তোমার নাতিকে নিয়ে এসেছি। তোমার না নাতি দেখার অনেক শখ? আমি তো অবাক? কোথাকার ছেলে কার ছেলে কিছুই আমাকে বললো না। অনবেকবার জিজ্ঞাসা করেছি। আজও আমাকে বলে নাই। সারাদিন বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম অনেক দুষ্টু ছিল। বাচ্চাটার নাম দিয়েছিল, পুলক। অনেক দুষ্টু ছিল। ওকে সামাল দিতে দিতে আমাদের দিন চলে যেত। জুনায়েদ ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল আমাকদের পুলক। জুনায়েদ কে, আব্বু আর আমাকে দাদাভাই ডাকতো। কারণ আমি যে ওকে দাদাভাই ডাকতাম।
বাচ্চাটার বয়স তখন সাত বছরের মত হবে। ক্লাস টু তে পড়ে। একদিন জুনায়েদ ওকে স্কুলের সামনে আনতে গেল। স্কুলের ঠিক উলটা দিকে, একটা দোকান থেকে ছেলের জন্য আইস্ক্রিম কিনছিলো। বাপ বেটা প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পরে আয়েশ করে আইস্ক্রিম খেত। ঐদিন, জুনায়েদ দোকানে কেনাকাটা করছিল। এমন সময়, পুলক গেট থেকে বের হয়ে, ‘আব্বু আব্বু তোমার অটোগ্রাফ দাও’ বলতে বলতে হাতে খাতা নিয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড় দিল। জুনায়েদ কেবল ঘুরে তাকিয়েছে, চিৎকার দিয়ে ওঠার আগেই ওর চোখের সামনে একটা গাড়ী এসে পুলক কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পুলকের হাতে তখনো আব্বুর অটোগ্রাফ নেয়ার খাতা। প্রতিদিন পুলক ওর বাবার কাছ থেকে একটা একটা করে অটোগ্রাফ নিয়ে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ওর বন্ধুদের দিত। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। পুলকের জ্ঞান আর ফিরলো না। চলে গেল পুলক আমাদের ছেড়ে।
ফাইজা বেগম এবার একা নয়, সামনে বসা চৈতিও ওড়না দিয়ে চোখ মুছলো। ফাইজা বেগম বলে চললেন, এই ঘটনার পর মা জুনায়েদের মাথা খারাপের মত হয়ে যায়। এক বছরের মত ডাক্তার ওর চিকিৎসা করে। কড়া ঘুমের অষুধ খাওয়াকে ওকে রাখা হত। জেগে উঠলেই আবোল তাবোল ছড়া বলত। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে......’
এরপর থেকে জুনায়েদ সুস্থ হবার পর থেকে, কাউকে অটোগ্রাফ দেয় না। চাপা স্বভাবের বলে, নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলেও না। লোকে মনে করে জুনায়েদ অহঙ্কারী। কিন্তু আমি ওর মা, আমি জানি, ওর মধ্যে কোন অহঙ্কার নেই। অহঙ্কার থাকলে বৌমা’র সমস্যা নিজের ঘাড়ে এভাবে তুলে নিতে পারতো না। যাই হোক, তুমি বস, আমি তোমাকে একটু চা করে দেই।
-না না। তাড়াতাড়ি চৈতি বলে উঠে। আজ নয়। আমি নে বুঝে স্যারকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমার ভীষণ কষ্ট লাগছে। আজ নয়, আমি কয়েকদিন পরে এসে স্যারের কাছে নিজে ক্ষমা চেয়ে যাবো। আমি আজ উঠি খালাম্মা। আমাকে একটু ভার্সিটি যেতে হবে।
এক সপ্তাহ পরের কথা। হাতে একগোছা গোলাপ নিয়ে চৈতি রিক্সা থেকে নামলো জুনায়েদের বাসার সামনে। কিন্তু বাসার সামনে এতো লোকজন আর মিড়িয়া’র লোকজন দেখে ঘাবড়ে গেল। স্যার কি কোন বিশেষ পুরস্কার পেলেন নাকি? তাহলে তো ভালই হয়। ফুলগুলা আনা সার্থক। সামনের ক্যামেরাম্যান এর কাছে এগিয়ে গেল চৈতি। তখন দেখতে পায়, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নিউজ রিপোর্টার বলে চলেছে, ‘আজ সকালে দেশের খ্যাতনামা লেখক, জুনায়েদ হারিসের মৃত্যু হয়েছে। উনাকে উনার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কিভাবে উনার মৃত্যু হল সেই বিষয়টা এখনো অজ্ঞাত। পারিবারিক সূত্রে এখনো আমরা কিছু জানতে পারি নি......’
চৈতির মনে হল এটা মনে হয় সত্যি না। কোন একটা নাটক দেখছে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের সব অনুভুতি মনে হল অবশ হয়ে গেছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে এক দৌড়ে ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকে গেল চৈতি। খালাম্মার সাথে কথা ওকে বলতেই হবে। ঘরে লোকে লোকারন্য। ড্রইং রুমের মাঝখানে জুনায়েদের দেহ একটা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। পাশে অনেক লোক বসা। এরমধ্যে ফাইজা বেগমকে খুজে বের করলো। একদিনেই মনে হল মহিলা বুড়ি হয়ে গেছেন। একটু একটু পর পর চিৎকার করে উঠছেন ছেলের নাম ধরে। চৈতি এগিয়ে গিয়ে ফাইজা বেগমের হাত ধরলো।
চৈতি কে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সব শেষ হয়ে গেল মা। জুনায়েদ আর নেই। জুনায়েদ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে রে মা... ফাইজা বেগমের কান্না দেখে হাতের থেকে ফুলগুলো এলোমেলো হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। পাশের টেবিল থেকে একটা খাম উঠিয়ে ফাইজা চৈতি’র হাতে দিলেন। খামের উপরে লেখা, ‘মা, চৈতি এলে ওকে দিও এটা’। চোখের পানিতে সব কিছু ঝাপসা লাগছে। মাথা কাজ করছে না ঠিকমত। চৈতি কি করবে না করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। খামটা খুলে ফেলল। ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চিরকুট বের হল। জুনায়েদের নিজের হাতের লেখা। সম্ভবত এটাই শেষ লেখা তার-
‘তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমার দোষ ছিল না। দোষ আমারই। আমাকে ক্ষমা করে দিও। -------- জুনায়েদ হারিস’।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।