বাতাসে লাশের গন্ধ

গণহত্যা (অক্টোবর ২০২৪)

রনি হক
  • 0
  • ১৯
১.ঘড়িতে বাজে তিনটা পঁচিশ। থানার দায়িত্বে থাকা এসআই জহুরুল হক কাকে যেন একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছেন আর ভ্রু কুঞ্চিত করে কথা বলছেন। এএসআই নাজমুল সাহেব মোটাসোটা মানুষ। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন তার সামনের চেয়ারে। বাইরে চার জন কনেস্টেবল রাইফেল তাক করে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে আছে। থানার মেইন গেটে আছে আরো দুজন। সর্বসাকুল্যে আটজন মানুষ তারা থানায়।

সরকার ইতিমধ্যে পতন হয়েছে কিন্তু উপর থেকে কোন নির্দেশনা এখনো তারা পাননি। তারা কি থানা তালা দিয়ে সিভিল ড্রেসে কোথাও আত্মগোপনে চলে যাবে, নাকি থানাতেই অবস্থান করবে, এ ব্যাপারে এখনো দোলাচলে আছে তারা।


২.রাইসা আধাশোয়া হয়ে আছে বিছানায়। পাশেই ঘুমুচ্ছে তাদের পাঁচ বছরের মেয়ে অনি আর সাত বছরের ছেলে রাহাত মোবাইলে গেম খেলছে।

রাইসা কল দিল জহুরুল সাহেবকে।

-হ্যালো!
-কি করছো?
-বসে আছি।
-থানায় নাকি হামলা করছে লোকজন?
-খবর পেয়েছি। আমাদের থানায় এরকম কিছু হয়নি এখনো।
-হয়নি, হতে কতক্ষণ। তুমি এখুনি বাসায় চলে আসো।
-উপরের কোন অর্ডার ছাড়া আমি এটা কি করে করি?আমি এখন অন ডিউটি। উপরের মহল থেকে কোন অর্ডার এলেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব।
-কে করবে তোমাকে অর্ডার? সরকার যেখানে পতন হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে চেইন অব কমান্ড। সেখানে তুমি আছো ডিউটি নিয়ে। নিজের জীবনের চেয়ে বড় আর কি আছে?
-তুমি বুঝবে না। নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্বহীন একটা কাজ করতে পারব না আমি। তাছাড়া এখানে আমি ছাড়া আর সাতজন মানুষ আছে। তাদের জানমাল আমার জিম্মায়।
-তাদেরকেও তুমি নিরাপদ স্থানে যেতে বলো।
-দেখি, আমি যোগাযোগের চেষ্টা করছি। অনি কোথায়?
-ঘুমুচ্ছে।
-রাহাত?
-ও মোবাইলে গেম খেলছে।
-দাওতো একটু।
-রাহাত! এই রাহাত! এই নাও তোমার বাবা কথা বলবে।

রাহাত মোবাইল নিল।

-হ্যালো, বাবা, কেমন আছো তুমি?
-আছি বাবা, আমি ভালো আছি। কি করতেছ?
-গেম খেলছি।
-তোমাকে না বলেছি বেশি গেম খেলবে না। চোখে সমস্যা হবে।
-আর একটু খেলবো।
-শোনো, প্রয়োজনে আজ সারাদিন রুমে বসে গেম খেলবে, বাইরে কিন্তু বের হবে না।
-আচ্ছা।
-তোমার আম্মুকে দাও।

রাইসা আবার ফোন নিল।

-বলো।
-শোনো, অনি রাহাত কাউকেই বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না।
-আচ্ছা। তুমি কখন আসবে সেটা বলো।
-বললাম তো ডিউটি শেষ হলে চলে আসব।
-নিজের দিকে খেয়াল রেখো, সর্তক থেকো কিন্তু।
-আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। বাচ্চা দুইটার দিকে খেয়াল রেখো।
-আমরা তো বাসায় আছি, চিন্তা হলো তোমাকে নিয়ে। আমি কিন্তু এক ঘন্টা পর পর কল দেবো।
-তার প্রয়োজন নেই রাইসা। আমিই তোমাকে কল দিয়ে খবরাখবর জানাবো।


৩.থানা ঘেঁষে বামপাশে একটি বহুতল আবাসিক ভবন। এই ভবনের তিন তলার বেলকোনিতে বসে আছে একজন তরুণী। তরুণীর নাম সৃষ্টি। তার পড়নে সাদা কামিজ। গত কয়েকদিন থেকে সে অসুস্থ। জ্বরে ভুগে তার চেহারা হয়ে আছে ম্লান। তবু সে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। বাইকে তার বয়সী ছেলে মেয়েরা বিজয়ের আনন্দ নিয়ে উল্লাসিত ভঙ্গিতে যাচ্ছে। ক্রমেই রাস্তায় বাড়ছে মানুষের চলাফেরা। তার নিজেরও ইচ্ছে করছে বাইরে বেড়িয়ে পড়তে। কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না মোটেই।

আধা ঘন্টাকে আগে তার বন্ধু মৃদুল তাকে ফোন করেছিল। তাকে নিয়ে বের হতে চাচ্ছিল। সে না করে দিল। এখনও দাঁড়ালে মাথা তার টলমল করে, চোখ অন্ধকার করে আসে।

একই ভবনের পাঁচ তলায় লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরে একজন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মোবাইল। মোবাইলে সে নিউজ দেখছে। নিউজে দেখাচ্ছে, গণভবন ইতিমধ্যে চলে গেছে আমজনতার দখলে। সেখানে শুরু হয়েছে লুটপাট। যে যা পারছে হাতে করে নিয়ে আনন্দিত ভঙ্গিতে বের হচ্ছে। একজনের হাতে দেখা যাচ্ছে রাঁজহাস। আরেকজনের হাতে চেয়ার। কিছু ছেলেপেলে আবার নেমে পড়েছে লেকে। জল ছিটাছিটি করে আনন্দ করছে তারা।

সৃষ্টি এখন তাকিয়ে আছে থানা কম্পাউন্ডের দিকে। কিছু লোক জড়ো হয়েছে থানার গেটে। গেট বন্ধ থাকায় ঢুকতে পারছে না তারা। এ নিয়ে হৈচৈ।

একটু পরেই ছোটখাট একটা দঙ্গলের মত দেখা গেল। শুরু হলো হৈ-হুল্লোড়। লোকজন থানার পকেট গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করল। লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে যাচ্ছিল তারা। শুরু হলো গোলাগুলি। চারজন লুটিয়ে পড়ল সেখানেই। আর একজন গেটের কাছাকাছি যেতে না যেতেই পড়ে গেল। চিৎকার, চেঁচা-মেচি, ছোটাছুটি... আরো কয়েকজন ছুটে এলো ইট পাটকেল নিয়ে। একটা পাটকেল এসে লাগল মাসুদ নামে এক কনেস্টেবলের মাথায়। সে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তার দিকে তাকানোর সময় নেই কারো। গোলাগুলি চলছেই। অবস্থা বেগতিক দেখে অবশেষে লোকজন ছুটে পালালে শান্ত হলো পরিস্থিতি। গেট লাগিয়ে দেওয়া হলো আবার।

সৃষ্টি এখন আর ব্যালকোনিতে বসে নেই। গুলির শব্দ শুনে তার মা তাকে ভিতরে নিয়ে গেছে। দরজা জানলা বন্ধ করে চলে গেছে তারা ভিতরের রুমে।


৪.জহুরুল সাহেব ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। থানা কম্পাউন্ডের ভিতরে পরে আছে ছয় ছয়টি লাশ। অতি দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তার মাথা কাজ করছে না। এরকম পরিস্থিতিতে এর আগে কখনো হ্যাণ্ডেল করতে হয়নি তাকে। কারনে অকারনে ধমকাচ্ছেন এএসআই নাজমুল সাহেবকে।

-আমি বলেছি গুলি করতে?
-স্যার, উপায় ছিল না। লোকের হাতে আমাদের সবাইকে আজ মারা পড়তে হতো।
-এখন এই লাশগুলির কি গতি করবেন?
-আজহার ভাইকে একবার ফোন দিবেন স্যার, তিনি হয়তো কোন বুদ্ধি দিতে পারেন।
-ফোন দিয়ে এখুনি থানায় ডাকুন তাকে।

আজহার সাহেবকে ফোনে পাওয়া গেল।

-ভাই, ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছে।
-কি হয়েছে বলেন।
-ছয়টা লাশ থানার ভিতরে। স্পট ডেড। খুব দ্রুত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নইলে ভয়াভয় বিপদে পড়বো আমরা।
-লাশগুলি আগে কোন রুমে ঢুকিয়ে ফেলুন, আসছি আমি।

লাশগুলি ডানপাশের একটি রুমে নিয়ে জড়ো করা হলো। এদিকে মাসুদ নামে যে কনেস্টেবলের মাথায় গুলি লেগেছিল তাকে অতি দ্রুত হসপিটালাইজড করা দরকার। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিছুই করার নেই। সবাই আছে প্রবল উত্তেজনার ভিতর। খুব দ্রুত কিছু একটা করতে হবে।

আজহার সাহেব চলে এলেন মিনিট দশেকের ভিতরে। সোজা চলে গেলেন জহুরুল সাহেবের কাছে।

-যা করার তাড়াতাড়ি করুন ভাই।

আজহার সাহেব সিগারেট টানতে টানতে বললেন, পুড়িয়ে ফেলে দেন। এ ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই।
-সেটা কিভাবে সম্ভব?
-পিকআপে তুলে আগুন ধরিয়ে দিন। মানুষ বুঝবে অগ্নিকাণ্ড। ব্যস, ঝামেলা চুকে গেলো।
-যা করার করুন, আমার কোন সেন্স কাজ করছে না।

করা হলো তাই। পিকআপ ভ্যানে তোলা হলো লাশগুলি। সাতটি লাশ। ছয়জন সাধারণ মানুষ আর কনেস্টেবল মাসুদ, যে কিছুক্ষণ আগেই মারা গেল। পিকআপ রাস্তার সাইডে নিয়ে এসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো।


৫.আহাদকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। চারটার পর থেকে তার ফোন বন্ধ। আহাদের বাবা তরিকুল সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। আহাদের মা আফসানা বেগম বড় ভাই আরিফ সবাই চিন্তা করছেন। আরিফ পরিবার নিয়ে থাকে দিনাজপুরে। এরমধ্যে সে বেশ কয়েকবার ফোন করে আহাদের খবর জানতে চেয়েছে।

কিন্তু তারা তো কেউ জানে না যে, আহাদ দগ্ধ হয়ে পরে আছে একটি পিকআপ ভ্যানের উপর। জীবনে মাত্র আটাশটি বসন্ত পার করে চিরদিনের জন্য চলে গেছে সে না ফেরার দেশে।


৬.রাত প্রায় বারোটা। অনি আর রাহাত ঘুমিয়ে পড়েছে। একলা জেগে বসে আছে রাইসা। সন্ধ্যার পর থেকে জহুরুল সাহেবের ফোন বন্ধ। লোকটা যে কোথায় আছে? কেমন আছে? তা জানার কোন উপায় নেই। এদিকে রাত বাড়ছে। ক্রমেই নিঝুম হয়ে আসছে চারপাশ।

দুরে কোথাও কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা গেল। একটুপর দিগন্ত কাঁপিয়ে শোনা গেল আতশবাজির শব্দ। তারপর আবার সুনশান নীরবতা। ঘড়ির কাঁটা এখন একটার ঘর পেরিয়ে দুইটার কাঁটা ছুঁইছুঁই। এখনো রাইসা ঘরে বাতি জ্বেলে বসে আছে। সে কি সত্যিই ফিরবে? নাকি আর কখনোই ফিরবে না?

সকাল পৌনে আটটার দিকে টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখা গেল চারজন পুলিশ সদস্য নিহিত। তাদের মধ্যে দুজনকে পাওয়া গেছে ওভারব্রিজে উল্টো দিকে ঝুলন্ত অবস্থায়। পা উপরে দিকে মাথা নিচের দিকে। এদের একজন এসআই জহুরুল হক, অন্যজন এএসআই নাজমুল।

চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো রাইসার দৃষ্টি। রাহাতের ঘুম ভেঙ্গেছে একটু আগে। সে বলল, কি হয়েছে মা?

রাইসা কোন উত্তর দিতে পারলো না। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল শুধু।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী চমৎকার লিখেছেন ভীষণ ভালো লাগলো

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পে কিছু মৃত মানুষকে পিকআপে তুলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, দগ্ধ হয় লাশ, সেই গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

১৪ আগষ্ট - ২০২৪ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "যানজট”
কবিতার বিষয় "যানজট”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৮ অক্টোবর,২০২৪