কবি সুকান্ত হাফিজের বাগান তুল্য বাড়ি থেকে থেকে বের হয়ে আমাদের ডজন খানেক কবির দল বড় রাস্তায় উঠে যখন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককে পরিনত হয়ে নিরের দিকে প্রত্যাবর্তন পালা শুরু করলাম তখন ঘড়ির হিসেবে রাত ১০টা পেরিয়ে গেছে।
ডিসেম্বরের শেষের দিক, শীত আজ তাই ভালোই জেঁকে বসেছে। গতকালও এতবেশি শীত ছিলনা। কুয়াশাও ছিলনা এত বেশি। আজ যেন হঠাৎ আমাকে গিলে এল খেতে কুয়াশার পাল বেশি পরিমানে ঘিরে ধরেছে। অথবা মূল শহর থেকে বেশ দূরে, টঙ্গীর এই দিকটা কুয়াশার হয়তো অভয় অরণ্য। অথবা আমি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি সেটা এই শীত রাতে বেশ নিরিবিলি, কুয়াশার নিরিবিলি বেশি পছন্দ, সেটা আমার মত একজন ক্ষুদ্র কবি ভালোই জানে। কুয়াশার চাদর কবিদের চরম কবিতার উপাত্ত তো আবহমান কাল ধরেই। হাইওয়ের ঐ সমানের দিকে আলো দেখতে পাচ্ছি। একটু বেশি একাকীত্ব বোধ হচ্ছে, ভয় এই একাকীত্বের প্রেমের কাননসম, একটু ভীতিও তাই কাজ করছে। আশে পাশে কোন লোকজনও দেখতে পাচ্ছিনা।
সুকান্ত হাফিজ ভাই রাতটা থেকে যেতে বলেছিলেন। অন্য কবিগণ রাজী হলেন না , আমিও তাল মেলালাম। বাসা আমার তো কম দূরে না। সেই মীরপুর ১ নম্বরের এক গহীন গলিতে। অনেকটা পথ যেতে হবে এই শীতের রাতে। কিন্তু মনটা ভালো। সুকান্ত হাফিজ ভাইয়ের পরিকল্পনা একটা উচ্ছাস জাগিয়েছিল, আর এখন কবিতার বইটি একটা মাত্রা পেতে যাচ্ছে ভেবে উচ্ছাসটা পূর্ন আনন্দে মনকে জয় করেছে।
যখন কবি হয়ে উঠিনি, অথচ কবিতা লিখতাম নেই সময়ই শিখেছিলাম কিছু কবিত্বের নীতি তত্ব। কবি , এই শব্দটির সাথে অনেক কিছু জড়িত। জাগতিক ইতিহাসের পাতায় বহু জ্ঞানী গুণিমানুষ এ বিষয়ে বলেও গেছেন। কবিরা নাকি সৃষ্টি কর্তার সবচেয়ে নিকটের। কবিদের নকি লোভ, লালসা, ঈর্ষা এসব থাকতে নেই। একটু ভুল প্রমান পেয়েছি নিজেকে দিয়েই, এই যেমন কবি হওয়ার যে বাসনা সেটাও তো লোভের পর্যায়ে পরে। এই বাসনা ছাড়া কর্মযোজ্ঞ্য কিভাবে হবে। অবশ্য কবি হওয়া কি যায়, সে যে হয়ে যায়, সেতো অঘটন ঘটন পটিয়সী ধরনের বিষয়। সে হিসেবে ও কথা ঠিকই আছে হয়তো? বাসনা সেখানে বাহুল্য কি তবে? মনে হতো এমনই। এখন হয়না। এখন মনে হয় কিঞ্চিৎ কবি হয়েছি। তবুও কবিদের কবিতার বিক্রি বাটা নেই। বইমেলায় অনেক কবিরই বই বের হয় প্রতি বছর, প্রকাশকদের লাভবান করা যায়না, বিক্রি হয় কই, কবিদের কি হয়, কবিদের কি তবে হারিয়ে যেতে হবে? নাকি নতুন যুগের নতুন নতুন চালে তাল দিতে হবে?..সুকান্ত হাফিজের পরিকল্পনা তাই এসব চিন্তা হতে মুক্ত হবার একটা নতুন কিছু তো বটেই।
সুকান্ত হাফিজের খুব নিকটের এই আমরা ডজন খানেক কবি যারা, তাদের ডেকেছিলেন তার এই টঙ্গীর নির্ভৃতে নিরালার গাছগাছালি ঘেরা টিনের চালের রূপসী গৃহে। উনি এই সকলের সমন্বয়ে একটি কবিতার বই প্রকাশ করবেন। বইটির নাম হবে -‘মুহূর্ত কবিতার ভাগাড়’।
আমরা ক’জন কবি সেই বিকেল হতে একসাথে বসে এক আসরে দু’টি করে কবিতা লিখেছি। এইগুলো হলো মুহূর্ত কবিতা। বেশ একটা ভূমিকা লিখেছেন সুকান্ত ভাই এই মূহূর্ত কবিতার আদ্যেপান্ত নিয়ে। কিছুটা নতুনত্ব আনা গেছে। এই নতুনের যদি কিছুটা গতি হয় বইমেলায়। উনি প্রচারের বেশ এক পরিকল্পনাও এঁটেছেন। এসব ছাড়া কবিতার বই বিক্রির আর কি উপায়।
কিন্তু কবিদের যে লোভ থাকতে নেই। আমাদের এই যে প্রকাশের লোভ, আমরা কি তবে কবি নই! কবিদের নাকি ঈর্ষাও থাকতে নেই, কিন্তু এই যে বই বিক্রি হওযা কবি লেখকদের সাথে আমরা অবিক্রিত বইয়ের অধিকারী কবিগণের একটা ঈর্ষা পরোক্ষ প্রতীয়মান হচ্ছে, সেটা কি তবে?
তবে আমি মানিনা। মনে আছে যখন আমার নুন্যতম কবি পরিচিতি ছিলনা, সেই সময় একদা এক কবিতা পাঠের আসরে কবিতা জমা দিয়েছিলাম, নিজের কাছে নিজের সেরা মনে হওয়া কবিতাই ছিল সেখানা। সেই আসরে কবি হিসেবে সুখ্যাত দু’জন কবি ছিলেন । তারা ছিলেন মূলত কবিতা বাছাইয়ের বিচারক হিসেবে। আমার কবিতা তাদের কারও মনঃপুত হলোনা। আমি নাছোর বান্দা। আমি তখন পূত পবিত্র কবি। আমি ধর্না দিলাম। আমাকে জানানো হলো-কবিতার ভাব ঠিকাছে, কিন্তু সংগঠন আর শব্দ চয়ন ঠিক হয়নি; জানানো হলো-মাত্রা ত্রুুটি আছে, কবিতার ব্যাকরণ মান হয়নি, আমাকে আরও শিখতে হবে।
কিন্তু সেই কবিতা আসরের যে ক্রোড় পত্রিকা প্রকাশিত হলো, সেখানে বাছাইকৃত কেয়েকটি কবিতা পড়ে মনে হলো সে গুলো যেন কেবল কয়েকটি লাইন একের পর এক লেখা হয়েছে, না কোন মাত্রা না কোন ভাব।
আরে বাবা এই যে মাত্রা আর কবিতার ব্যবকরণে দোহাই দিচ্ছিলেন, তারা নিজেরাই কতুটুক মানেন। নিয়ম মেনে অংক হয়, কম্পিউটারের পোগ্রাম লেখা চলে , কবিতা নয় মোটেও। নিয়ম থাকবে, নিয়ম আছে, সেটাতো সাবর্জনীন সূত্র, প্রকৃত কবির কাজ সেই সূত্র আর মাত্রার মাছে যত জ্ঞাপ সেগুলো পূরণ করা। সেগুলে যে পূরণ করে সেই কবি, প্রতিজন কবিই স্বতন্ত্র, কবিরা কি একই অংকের সূত্রব্ধ হতে পারে নাকি! কি আজব!
আরও আজব হয়েছিলাম যখন সেই একই কবিতাখানি আমার আরও বছর খানেক পরে এই সুকান্ত হাফিজ ভাইযের সুনজরে আসায় একটি কবিতার প্রতিযোগীতায় প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিল সেখানে সেই সে একই কবি যে আমরা কবিতা নিয়ে হীন মন্তব্য করেছিল, ভুলের বর্ষা ঝরিযেছিল ইতোপূর্বে সেই তিনিই বিশেষণের আপ্ত বাক্যে মুখরিত করেছিল মাইক্রোফোনের নির্দোষ কার্বন। আমি হেসেছিলাম। আমি বুঝেছিলাম, আজকের বিখ্যাত কবিরা ঈর্ষার উর্ব্ধে উঠতে পারেনি। তাই আমার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা সৃষ্টি হয়ে গেলো- কবিরাও ভীষন স্বার্থপর।
সে কবিতায় কবিরা কেউ কেউ আমার উপর ক্ষেপেছিল, বুঝেছিলাম, কবিরা কেউ কেউ আমার উপর ঈর্ষা করছিল। আমি সেই ঈর্ষার সিঁড়িতে কযেকটি পা বাড়িয়ে কবি পরিচিতি পেয়ে গেলাম। সাহিত্য পাতায় কবিতারা আমার ঠাঁই পেতে শুরু করল। বইমেলায় বইও প্রকাশিত হলো। কেবল বিক্রিটা হলোনা। কবিদেরও টাকার প্রয়োজন হয় এটা অকবিরা বুঝলোনা।
সুকান্ত হাফিজের মহূর্ত কবিতার অংশীদার হবার আমন্ত্রন তাই ি নদ্বিধায় লুফে নিতে ছুটে এসেছিলাম । আমি আমার মন প্রাণ উজাড় করে দু’টি মুহূর্ত কবিতা স্পটে বসে লিখে দিয়ে এলাম। আমি এই সম্মিলিত কবি যজ্ঞকে খুব পছন্দ করি। ঈর্ষাকে এখনও পুঁজি করতে পারিনি। তাই নিজ খরচে আমিও দুখানি কবিতার ছোট কাগজ প্রকাশ করার চেষ্টা করে চলেছি। নতুন নতুন কবিদের মনটাকে অনুভব করি বলেই তাদের কাছে কবিতার জন্য ধর্না দেই। তাদের কবিতাকে স্থান দেয়ার চেষ্টা করি নিজের ছোট কাগজে।
...মূল হাইওয়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি মনে হচ্ছে। বাস ট্রাক চলতে দেখা যাচ্ছে। বেশ শীতও লাগছে। ফুল হাতা টি শার্টের উপরে উলের একটা মোটা সোয়োটার গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। সুকান্ত ভাইযের বাসায় সেটা খুলেও রেখেছিলাম। অথচ সেটায় শীত আর মানাচ্ছে না। ক্রমে ক্রমে শীতটা আরও যেন চেপে বসছে। কুয়াশাও গাযে এসে চুমু দিচ্ছে বারংবার। কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটাতে একটা চাদর আমার সব সময়ই থাকে। আশা করছি আছে। সেটা বের করার জন্য চেন খুলতে যাব ঠিক তখনই একটা ছেলে এসে হাত পাতল। ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে বারো। রাস্তার ছেলে। এই কনকনে শীতেও তার গায় মাত্র একটা ছেড়া হাত হাতা টি শার্ট আর একটা জিন্সের ময়লা চির্ণ হাফপ্যান্ট। শীতে কাঁপবে সেটাই স্বাভাবিক। সে কাঁপছিল। আসলে শীতও বেসরম, হঠাৎ করেই চলে আসে। গতকালও এত শীত ছিলনা। এই গরীব দুস্থ মানুষগুলো কিভাবে এই হঠাৎ চলে আসা শীতের আপায়্যন করবে সে কথা শীত মহাশয় ভাবেনা?
ছেলেটা আমার কাছে টাকা চাইল- বলল, স্যার শীতে মইরা যাইতাছি, একটা কাপড় কিনমু, কয়ডা টাকা দ্যান। আমি ভাবছি, আমার কি করা উচিৎ। সে এখন কাপড় কোথা থেকে কিনবে এই রাত নিশিথে। কবিরা নাকি শুদ্ধ হয়। নিজেকে শুদ্ধ ভাবার গর্ব অনুভব করছি আর শিশুটির শীত নিবারণে আমার কর্তব্য খুঁজে বার করছি। কিন্তু কিছু কুল কিনারা করতে পারছি না।
একটু এ পাশ ওপাশ তাকালাম। বাস ষ্ট্যান্ডা আরও পনের বিশ গজ দূরে। ওদিকে কিছু মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জায়গাটা কিঞ্চিৎ নীরবই বটে। একটা ছাউনী আছে রাস্তার পাশে, সেটার উপরে একটা টিমটিম করে জ্বলা আলো। সে আলোতে ছাউনির ছায়া দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। সেই ছায়ার উপরে দাঁড়িয়ে আছি। ছেলেটা আরেকবার টাকা চাইল। আমি তখনও ভেবে চলেছি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাঁচ টাকার একটি নোট পেলাম। সেটা বের করতে করতে ভাবলাম, এই রাতের শীতে পাঁচটাকায় শীত নিবারণ কি আদৌ সম্ভব!
ছেলেটার দিকে তবুও অজান্তে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা কুকুরের ডাক শুনলাম। সেদিকে চোখ ফেরাতেই দেখি, ছেলেটাকে একটা মহিলা ডাকছে। উস্কখুস্ক চুল সে মহিলার। বয়স মধ্যবয়সী। চেহারায় সুস্থ মানুষের মত ভাবনেই। খুব সহজেই তাকে পাগলী বিশেষণে ডাকা যায়। ছাউনীর পাশে একটু উঁচু জায়গা। সেখানে একটা ছেঁড়া কাঁথা গায়ে চড়িয়ে সে শুয়ে আছে , তার কাঁথার এক পাশে একটা মোটাসোটা কুকুরও ঢুকে জড়সড় হয়ে। এই শীত কুকুরকেও ছাড়ছে না। তাই সে পাগলীর কাঁথা সহভাগিদার।
কাঁথাটা খুব মোটাও নয় আবার খুব নয় খুব চওড়াও। তবুও একটু কুকুর আর এক পাগলীর দেহকে ঢাকতে যথেষ্ট। তৃতীয় কোন প্রাণী ঢুকলে কিঞ্চিৎ টানাটানি পড়তে পারে। তবুও পাগলী ছেলেটাকে ডাকছে। ছেলেটা ছুটছে সেদিকে। আমি ততক্ষণে চাদরটচা বের করে গায়ে জড়িয়ে মাথাটাও ঢেকে নিচ্ছি। ছেলেটা ততক্ষণে সেই টানাটানির কাঁথার নিচে ঢুকেও গেছে দেখলাম। একদিকে কুকুর আররেকদিকে ছেলেটা। মাঝখানে জড়সড় পাগলী, খুব নৈকট্যে তিনটি পথের প্রাণী।
আমার মন হঠাৎ ভাবল-চাদরটা ছেলেটাকে দিয়ে দিলেও হতো। কিন্তু আমি সেটা দিতে পারলাম কই। আমিও তো স্বার্থপর মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবি। আমিও তো ভাবুকের দলে কেবল। পাঁচ টাকা দান করেই আমি শুদ্ধ কবি হয়ে উঠতে চাই। তারপর মনে হলো আমি একটা কবিতার উপাত্ত পেয়ে গেলাম-কবিতার লাইন আওড়াতে আওড়াতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম-
আমারও একবার ঈর্ষা হইলো
ভাবিলাম কোনো পথের ঐ নিঃস্ব পাগলী হইলাম না!