বাবা, ছবিটা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে
অবৈধভাবে ফুটপাতে দোকান তোলার অপরাধে হানিফ গ্রেপ্তার হয় গুলিস্তান থেকে। অবশেষে হয় জেল। তার মতোই অনেক আসামীদের সাথে জেলখানার ছোট্ট একটি কুঠুরিতে রাখা হয় হানিফকে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা তার। তার উপর পুলিশের বেদম প্রহার! ডান হাতের মাঝের আঙ্গুলে একটা মারাত্মক চোট লাগে। ব্যথায় এখনো টনটন করছে জায়গাটা। এর আগেও সে দুবার পুলিশের মার খেয়েছিল। দোকান ফেলে কোনোমতে দৌড়ে পালিয়ে রৰা পেয়েছিল সেবার। কিন্তু এবার! সে তো সরাসরি জেলখানায় বন্দী।
হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে ওঠে হানিফের। হৃদয়ে যেন আচমকা একটা ধাক্কা খায়। পকেটে হাত দিয়ে সে তার মানিব্যাগটা পায় না। কোন ফাঁকে কোথায় হারিয়ে গেছে কিছুই ভেবে পায় না হানিফ। বেদনায় হানিফের মনটা হু হু করে ওঠে। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে জলে।
হানিফ আজ বার বছর যাবত যে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে তার আদরের সেই ছোট্ট মেয়ের ছবিটি ছিল মানিব্যাগে। যত্ন করে লেমিনেটিং করা ছিল ছবিটি। দোকান খোলার আগে ছবিটি হাতে নিয়ে চুমো খেত হানিফ। বলতো, 'মা, তোর আশীর্বাদ রইল আমার কাছে। দোয়া করিস।
কোনো এক রাতে হানিফ যে বস্তিতে থাকে, সেখানে আগুন লাগল । হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল মানিব্যাগটির কথা। সেটি উদ্ধার করতে গিয়ে তার ডান কপালের খানিকটা পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ মানিব্যাগ হারিয়ে হানিফের যেন পুরো কপালই পুড়ে গেল।
মেয়ের ছবি হারিয়ে আবেগে বেদনায় হানিফের অতীত স্মৃতিগুলো একটার পর একটা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল হৃদয়ের তীরে। একটা সময় ছিল তার, পড়া আর খেলাই ছিল তার কাজ। হঠাৎ দুরারোগ্য ব্যাধিতে বাবাকে হারিয়ে ঘরছাড়া হানিফ। জীবনের নানা ধকল পেরিয়ে রাজধানীতে এসে এক সময় আশ্রয় নেয় হানিফ। বন্ধুত্ব হয় তার মতো এমন অনেকের সাথে, যারা জীবনের বাস্তবতার চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে যেতেও কোনোমতে বাঁচার ভরসা খুঁজে পায় রাজধানীতে এসে।
পেশা হিসেবে প্রথমে হানিফ রিকসা চালানোকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু জ-িসের নির্মম ছোবলে তাকে শেষ পর্যন্ত ছাড়তে হয় সে-পেশা। শুরু হয় নতুন জীবন-সংগ্রাম। গ্যাস বেলুনের ব্যবসা শুরু করে হানিফ। মেলায় মেলায় চলতো এ ব্যবসা। কিছু টাকাও জমিয়েছিল এ ব্যবসার মাধ্যমে। তারপর বিবাহ। পাশের গ্রামের একটি মেয়েকে প্রস্তাবের মাধ্যমে বিয়ে করে শুরু করল দাম্পত্য জীবন। নববধূকে নিয়ে এলো ঢাকায়। এরপর ঘর আলো করে এলো সন্তান। কয়েক বছর পর সংসার-নদী মোড় নিতে শুরু করল অন্য দিকে।
বড় ছেলে রাজ, মেয়ে তুলি ও আসমাকে নিয়ে তাদের যাত্রার ম্যাপ আঁকতে হয় ভিন্নভাবে। স্ত্রীকে গার্মেন্টসে কাজ নিতে হয় বাধ্য হয়ে। ঘরভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সব খরচ মেটাতে তাদের আগের চেয়ে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
তিন ভাইবোনকে বস্তির একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সব ছেলেমেয়েরই নতুন নতুন স্কুলে যাওয়ার কৌতূহল নিজের থেকেই তৈরি হয়। এরপর যেন পোষ মানতে চায় না মন। কিছুদিন পর রাজ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর তুলিও। কিন্তু আসমা যেন একটু কেমন। হয়তো পাঠের আনন্দটা তার মতো করে কেউ পায়নি। তার যেন এ পথে চলতেই হবে। এমনই তার প্রতিজ্ঞা। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে রাজ বখাটেপনা শুরু করে। ধীরে ধীরে পা বাড়ায় অন্ধকার জগতের দিকে।
সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকায় রাজের কোনো কিছুই টের পায় না তার মা-বাবা। তুলিও বান্ধবীদের সাথে গাল-গল্প করে সময় কাটায়। হানিফ তার ছেলেকে কিছুটা শাসন করে, কিন্তু মেয়েদেরকে সে কিছুই বলতে পারে না। একসময় বড় ছেলে রাজ গেলাস ফ্যাক্টরিতে কাজ নেয়। তুলিও বেছে নেয় মায়ের পথ। কেবল আসমা বাসায় থাকে। পড়া আর সেলাইয়ের কাজ করেই সময় কাটায় সে। বাবার প্রতি তার প্রচুর ভালোবাসা। এসএসসি পরীক্ষার জন্য তোলা এককপি সাদাকালো ছবি একদিন লেমিনেটিং করে হানিফের হাতে দিয়ে বলল, 'বাবা আমার এটা শ্রেষ্ঠ উপহার।' হানিফও মেয়ের ভালোবাসা সবিনয়ে গ্রহণ করে। এমনই ছন্দোবদ্ধ জীবনে একদিন ছন্দপতন হয় হানিফের। স্ত্রীটি তার এক গার্মেন্টস কর্মীর হাত ধরে চলে যায় অন্যত্র। সেই সাথে রাজ ও তুলিও মায়ের পক্ষ নেয়। লজ্জায় বিরহে হানিফের যেন মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নগর-জীবনের বাস্তবতা এমনই। এখানে যেন কেউ কারো নয়। বস্তাপচা এক একটা সম্পকের্র আড়ালে যেন বিষধর সাপের মতো লুকিয়ে থাকে মানুষ নামের অসুরের হিংস্র স্বার্থপরতা।
বেদনাতুর হৃদয়ে সান্ত্বনার পরশপাথর বুলিয়ে আসমা তার বাবাকে বোঝাতে থাকে। আর কেউ না থাকুক, সে তো তার বাবার সাথে আছে। হানিফ যেন আবার নতুন করে বাঁচার ভরসা পায়।
কিন্তু বেঁচে থাকাটা যেন অর্থহীন হানিফের কাছে। কেবলই তার মনে হয়, সব স্বপ্ন; মতিভ্রম। চারপাশটা মনে হয় শুধু ছলনা। জীবনের পদে পদে হারতে হারতে এবার সত্যিই যেন হেরে গেল হানিফ। গভীর রাতে বস্তিতে আগুন লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সবকিছু। তার আশা আকাঙ্ৰা, তার ভালোবাসার ধন, গোবরে পদ্মফুল হয়ে ফোটা আদরের আসমাও আগুনের কাছে নত হয়। মৃত্যুর আগে আসমা হানিফকে একটি কথাই বলেছিল _ 'বাবা, আমার ছবিটা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।' এটাই শেষ কথা ছিল আসমার। হানিফ আসমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল শুধু। সে-চোখে একটুও বেদনা ছিল না। বাবাকে মনের কথাটা বলতে পেরে সে যেন হাসিমুখেই বিদায় নিল। হানিফ কাঁদতে পারল না। শুধু পাথর হয়ে রইল। অথচ কোনো কোনো পাথর ফেটে ঝরনা-ধারাও সৃষ্টি হয়
'কয়েদি নং- ২২১, মোঃ হানিফ, পিতা জব্বার তালুকদার' _ জেলের দরজার কাছে এসে একজন পুলিশ উচ্চস্বরে ঘোষণা দেয়। হঠাৎ বজ্রপাতের মতো কেঁপে ওঠে হানিফের জীর্ণ শরীর। এতৰণ সে নিজেকে অতীতের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। বাস্তবে ফিরে এসে হানিফ এদিক ওদিক তাকায়। আগের চেয়ে কয়েদি অনেক কম। জামিন নিয়ে চলে গেছে বোধহয়।
পুলিশটি আবার জোরে হাঁক মারে _ 'হানিফ কে, হানিফ?' কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় হানিফ। পা বাড়ানোর শক্তি যেন নেই তার। পুলিশ এবার বিরক্ত হয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ে, 'শালা, কানে শুনস না? জলদি আয়! সই কর এখানে।' হানিফ এবার সত্যিই কেঁদে ফেলে। অঝোর ধারায় অশ্রু বয়ে যায় দু'গালে। ভিজে যায় বুকের জামাও। দুই হাত জোড় করে শুধু একটি আকুতিই তখন করে হানিফ, _ 'সার, আমারে জেলের বাইরে নিয়েন না। আমি জেলের মদ্যেই মরবার চাই' _ বলেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হানিফ। হানিফের এ অনাকাঙ্ৰিত আচরণ দেখে পুলিশটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বোধ হয়, সে তাকানোয় কোনো বিরক্তি নেই। আছে কেবল হানিফের কষ্টেরই কিছু জলছাপ।
২২ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪