আবু তালেব অপেক্ষা করছে। এখন সকাল পাঁচটা পঁচিশ। ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশে স্যার বোধি বৃক্ষের নীচ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাবেন। ব্রিস্ক ওয়াকিং। তারপর বাম দিকে ঘুরবেন। দশ গজ হেঁটে আবার বাম দিকে নব্বুই ডিগ্রী মোচড় নিবেন। আরও তিন শ’ গজ হেঁটে ভিসির বাড়ির পাশ দিয়ে ফুলার রোড পার হলেই একটু দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার। গায়েবী হুজুর বলেছেন ভোর সকালে হাঁটা স্যারের অনেকদিনের অভ্যাস। সাত দিন ধরে আবু তালেব তাইই দেখছে।
কাজটা করতে হবে ইউ টার্নের সময়। একমাত্র এই যায়গাটাই দু দিক থেকে ঘন ঝোপে ঘেরা। হুজুর এও বলে দিয়েছেন ‘একদম খিচ্চা কোপাবি’।
আবু তালেবের খুব ইচ্ছে ছিল এই সুযোগে রিভলবারটা পরীক্ষা করার। ভারতীয় রিভলবার। .২২ ক্যালিবার। হুজুর বলেছেন রিভলবারটা হিন্দু, তবে খারাপ জিনিস হিন্দু হলে ক্ষতি নাই। আবু তালেব কুমিল্লায় থেকে নিজেই এনেছে। আবু তালেবের পুরনো সহপাঠী সুন্দর বাবুর বড় চাচা আলতাফ খান অত্র এলাকার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনীতিক। তার কারনেই আবু তালেব লুইচ্চা কাদেরের কাছ থেকে মালটা ন্যায্য মুল্যে কিনতে পেরেছে। আবু তালেব যখন লুইচ্চা কাদেরে বৈঠক খানায় অপেক্ষা করছিল তখন তার বোন (বোনই হবে বোধ হয়, কারন লুইচ্চা কাদেরের মতই চেহারা, শুধু চুলগুলি বড়) ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এলো। তিন জনের জন্য তিন গ্লাস ফেন্সিডিল। ‘কষ্ট কইরা আ্সলেন ভাই, এইবার আরাম কইরা ডাইল খান’। এমন কিসিমের আতিথেয়তা আর আপ্যায়ন আবু তালেবের পূর্ব অভিজ্ঞতায় নাই। আবু তালেব জানে মদ খাওয়া হারাম। ফেন্সিডিলের মত গুরুত্বপূর্ণ কাশির ঔষধ খাওয়া হারাম কিনা ভাবতে ভাবতে এক ঢোকে পুরো গ্লাসটা আবু তালেব নিঃশেষ করে ফেলে। বাসের কান্ডটা না ঘটলে ব্যাপারটা সে ভুলেই যেত। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আগত বাসগুলোতে পুলিশ নিয়মতই তল্লাশি চালায়। ভারত থেকে সিগারেট, মদ আর ফেন্সিডিলের চালান আসে। মনটা নেশাগ্রস্ত থাকায় আবু তালেব সার্চের সময় নার্ভাস হয়নি। কিন্তু কি হতো যদি পুলিশটা গায়ের চাদর আর কোমর হাতানোর পর হাঁটু অব্দি এসে থেমে না যেত? আল্লাহ মালিক, তিনিই মুশকিলের আসান।
রিভলবারটা ব্যবহারের মোক্ষম সুযোগ ছিল আজ । কিন্তু হুজুর বলেছেন স্যারকে কষ্ট দিয়া মারিতে হইবে। কোপায়ে কোপায়ে মারিতে হইবে। তাতে ছোয়াব অনেক বেশী। চাইনিজ কুড়াল জাতে বৌদ্ধ, ধর্মে অহিংস। কিন্তু কর্ম সাধনে এর চেয়ে হিংস্র কিছু কী হয়? ‘আপনে নিউজ পড়েন না? বৌদ্ধ হুজুররা শ্রীলঙ্কা আর বর্মা মুল্লিকে কি করিতেছে?’ হুজুরের কথার উপরে কোন কথা নাই। আবু তালেব তাই তার প্রিয় চটের বস্তায় চাইনিজ কুড়াল ভরে তীর্থের কাকের মত স্যারের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। গত পরশু এই চটের বস্তাতেই একটা মেনী বেড়াল ধরে হুজুরকে গিফট দিয়েছিল। হুজুর বহুত খুশ হয়েছিল। এবার নাস্তিক স্যারের আস্ত মাথা গিফট দিয়ে হুজুরকে তার তিন ডাবল খুশ করবে আবু তালেব।
স্যারের নামটাও হিন্দুয়ানী। আকাশ চৌধুরী। বড় মেয়ের নাম মৃত্তিকা। কাল থেকে আকাশ চৌধুরী থাকবে মৃত্তিকার তলে। আকাশ চৌধুরীকে সবাই চিঠি লিখবে আকাশের ঠিকানায়। যেমন নাম তেমন ঠিকানা। চাইলে ওনার নাম এখন অবকাশ চৌধুরীও দেয়া যায়। কথাটা ভেবে আবু তালেব আপন মনেই খ্যাক করে হেসে উঠলো।
যখন আবু তালেব বোধি বৃক্ষের নীচে চাইনিজ কুড়াল হাতে অপেক্ষমান তখন প্রফেসর আকাশ চৌধুরী তার তিন হাজার স্কয়ার ফিট এপার্টমেন্টের ঝুল বারান্দার চেয়ারে বসে জুতোর ফিতের গিট ছাড়াচ্ছেন। আঙ্গুলের নখ কেটেছেন বলে গিট খুলতে কিছুটা গলদঘর্ম হচ্ছেন। তবে গিট্টূ লাগানো কিম্বা ছাড়ানো তার পুরনো অভ্যাস। ভাগ্যিস জীবনে যত গেঁড়ো তিনি খুলেছেন, তারচেয়ে বেশী গেঁড়ো লাগিয়েছেন। তা না হলে শুধু লেখালেখি আর ডিগ্রী দিয়ে কী ফুল প্রফেসর হওয়া সম্ভব? এত কম বয়সে? ছাত্র জীবনে তার মেধা ছিল মধ্যম মানের। তখন বিভাগের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন আরিফুল হাসান। আরিফুল হাসান যখন লেকচার দিতেন তখন ক্লাসরুম ভক্তের ভিড়ে জন্মদিনের বেলুনের মত ফুলে উঠত। অগাধ পান্ডিত্যের কারনে যে কোন একটা বিষয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা চালিয়ে যেতে পারতেন। কোন এক কারনে আকাশ চৌধুরীকে আরিফুল হাসান অত্যন্ত স্নেহের নজরে নিলেন। এই স্নেহ বর্ষণের কোন যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আকাশ চৌধুরী কখনই খুঁজে পাননি। হয়তো স্নেহ ব্যাপারটা যুক্তির ধার ধারে না। তবে ঘনিষ্ঠ হবার এই সুযোগটি আকাশ চৌধুরী হাত ছাড়া করেননি। আরিফুল হাসান যদি হয় সক্রেটিস, তিনি বনে গেলেন প্লেটো। স্নাতক পরীক্ষায় খুব একটা লাভ হলো না ঠিকই কিন্তু মাস্টার্স আর পিএইচডিতে ফল ফললো। পিএচডি স্কলারশীপটা আরিফুল হাসানই জোগাড় করে দিলেন। আর পিএইচডি থিসীসটা আকাশ চৌধুরী আরিফুল হাসানকে দিয়েই একরকম লিখিয়ে নিলেন। আকাশ চৌধুরী যদি এক পৃষ্ঠা লিখে দেখান, আরিফুল হাসান সে লেখায় কাঁটাছেঁড়া করে আপন মনে আরও চার পৃষ্ঠা লেখেন। অথচ আরিফুল হাসানের নিজের কোন পিএচডি ডিগ্রী নাই। আমেরিকার একটা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ডিগ্রীর জন্য গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এই সব ফালতু ডিগ্রীফিগ্রী অর্জনের চেয়ে অবারিত জ্ঞান চর্চার সুযোগ ও সুবিধাই তাকে বেশী বিমোহিত করল। দু বছর পর পিএইচডি না করেই তিনি দেশী ফিরে এসেছিলেন জাহাজ ভরা বই আর মাথা ভরা বিদ্যা নিয়ে।
আরিফুল হাসানের সুপারিশেই ডক্টর আকাশ চৌধুরীর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীটা হয়। এই সময় আরিফুল হাসানের রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি সুপারনিউমেরারী পোস্টে দু’বছর এক্সটেনশনের জন্য অ্যাপ্লাই করেন। একজন সিনিয়র শিক্ষক আরও দুবছর থাকে মানে অন্য কারো প্রোমোশন দুবছর পিছিয়ে যাওয়া। টিচার্স রুমে বসে ডক্টর আকাশ চৌধুরী টের পেতেন আরিফুল হাসানের বিরুদ্ধে গভীর একটা চক্রান্ত ঘনীভুত হচ্ছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলে বিষয়টা আরিফুল হাসানের গোচরে আনবেন না। শুধুমাত্র বেঈমানরাই জানে কৃতজ্ঞটার ভারী ও ক্লান্তিকর বোঝা থেকে নিষ্কৃতির সেরা উপায় হলো কৃতঘ্নতা। ঠিক ছ’ মাস পড়েই আরিফুল হাসানকে বিদায় হলেন। নানা ধরণের গিট্টু মেরে চার বছরের ভেতরেই ডক্টর আকাশ চৌধুরী ফুল প্রফেসর হয়ে গেলেন।
মাঝে মধ্যে ডক্টর চৌধুরীর বিবেকে লাগে। বিবেক থেকে মুক্তির একটা বড় উপায় হলো নিজের স্খলনগুলোকে ফিলোসফাইজ করা। ডক্টর আকাশ চৌধুরীও তার সব গ্লানি আর ম্লানিমার এক দার্শনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। মানুষের জীবন একটা জামার মত। আপনি ঝকমকে সুন্দর একটা জামা পরে ভোর সকালে বের হবেন। কখনো রাস্তায় চলন্ত গাড়ি কাঁদা ছিটিয়ে দিয়ে যাবে, কখনো বেশী ‘খাইতে’ গিয়ে জামায় ঝোল লাগবে, ধীরে ধীরে জামাটা মলিন হবে। কেউ আপনাকে আদর করে জড়িয়ে ধরবে, কেউ শার্টের কলার ধরে বেধড়ক টানবে,এতে জামায় উল্টোপাল্টা ভাঁজও পড়বে। কিন্তু ঠিকই কোন এক শুক্রবার আপনি জামাটা কাপড় কাচার সাবান দিয়ে ধুবেন, ইস্ত্রি দিয়ে সব ভাঁজ সমান করে দেবেন। আবার সেই জামা পড়ে বের হবেন। মানুষ বার বার এভাবেই ভুল করে আর বার বার শোধরায়। তো তার জীবনে এখন ইস্ত্রি করার সময়। আর এটা তিনি শুরু করেছেন মৌলবাদের বিপক্ষে কলম চালিয়ে। এই সব স্ট্রেইটফরোয়ার্ড লেখালেখি তাকে খুব দ্রুত লাইমলাইটে নিয়ে আসবে। প্রোভাইস চ্যান্সেলর হবার সম্ভাবনাটাও সুগম হবে। ঝুঁকি অবশ্যই আছে। বড় বড় ঘটনাচক্র হলো ব্ল্যাক হোলের মত। এর আশ পাশ দিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত ঘুর ঘুর করলে ঘটনাচক্র ঠিকই আপনাকে তার গহবরে টেনে নেবে। ইতোমধ্যে কারা ছড়িয়ে দিয়েছে তিনি নাকি একজন কট্টর নাস্তিক।
জুতোর ফিতা ঠিক মত বেঁধে পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে ডক্টর চৌধুরী বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। বোধি বৃক্ষের নীচে চাইনিজ কুড়াল হাতে আবু তালেব তখন ভাবছে ‘নাস্তিক স্যার কি আসিবেন না? নাস্তিক স্যার গোপন সুত্রে খবর পেয়ে ডরাইলেন নাকি?’। ভাবতে ভাবতেই দেখত পেলো দূর থেকে সফেদ গেঞ্জি আর সফেদ পাৎলুন পরে আকাশ চৌধুরী হেঁটে আসছে। এর মাঝে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্যার ইউ টার্নের কাছে আসতেই বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে নামল। আবু তালেবের হাত এখন নিশপিশ করছে। আবু তালেব আর অপেক্ষা করতে পারছে না। চাইনিজ কুড়ালটা বের করে আবু তালেব ‘নারায়ে তাকবীর’ বলে ডক্টর চৌধুরীর দিকে ছুটে গেলো। কুড়ালটা উঠিয়ে ঘাড়ে প্রথম কোপটা মেরেছে কি মারে নাই হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছটার উপর বিকট শব্দে বাজ পড়ল। নীলাভ বৈদ্যুতিক আলোয় দিক্বিদিক ধাঁধিয়ে গেলো। আর ইয়া মাবুদ, ইয়া সোবানাল্লাহ, রাস্তার ঠিক মাঝ দিয়ে সেই নীলাভ আলো ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এক নূরানী-ধবল চতুশ্চক্রযান। আবু তালেবের পায়ের কাছে এসে সেই নূরানী-ধবল চতুশ্চক্রযান সুস্থিত হলো। মুহূর্তের মধ্যেই সেই গায়েবী শকটের স্লাইডিং দরজা বেহেস্তের দ্বারের মত খুলে গেলো। একদিকে বজ্র ও বিদ্যুৎ, অন্যদিকে প্রবল বর্ষণ, তারই মাঝে সেই স্বর্গের দ্বার দিয়ে নেমে এলো কতগুলো অমল ধবল ফেরেস্তা নাকি মানুষ কে জানে। ওনারা সবাই মিলে ডক্টর হাসানকে ঊর্ধ্বে উত্তোলন করলেন। তারপর ওনারা ডক্টর হাসানকে শকটের ভেতরে সমান্তরালভাবে স্থাপন করলেন। চক্ষের নিমেষে স্বর্গের দ্বার বন্ধ হয়ে গেলো। আবুল তালেবের কান ঘেঁষে বেহেস্তী শকট শা করে হাওয়া হয়ে গেলো। আবু তালেব স্তব্ধ, কুড়াল ধরা হাত তখনো উত্তোলিত। হঠাৎ দেখে মনে হবে অপারাজেয় বাংলার এতো কাছে পাগলা কাঠুরিয়ার ভাস্কর্য আবার কে বানালো? আবু তালেবের ঘোর কাটল টেক্সট মেসেজের টুরুং টারুং আওয়াজে। গায়েবী হুজুর লিখেছেন ‘খেল কি খতম?’।
গায়েবী হুজুর টেকস্ট মেসেজের কোন জবাব পাননি। তিনি আরও তিনবার মেসেজ রিসেন্ড করেছেন। দু ঘন্টা অপেক্ষা করে গায়েবী হুজুর আবু তালেবকে একটা মিস্ড্ কল দিলেন। তবুও কোন নড়াচড়া নাই। এবার তিনি প্রপার কল করলেন। । ফোন অনেকবার রিং হয়ে মেসেজে চলে গেলো। ‘আবু তালেব ধরা খাইলো নাকি?’ বিরক্ত হয়ে গায়েবী হুজুর ফ্রিজ থেকে একটা আপেল বের করলেন। গতকাল ওনার খালাতো ভাই সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছেন। তিনি গায়েবী হুজুরকে একটা জেনুইন সুইস নাইফ গিফ্ট্ করেছেন। বহুমুখী নাইফ। উপরের সাদা ক্রস সাইনটা পছন্দ হয় নাই, বাকা চাঁদের ছবি থাকতে পারতো। তিনি এই বহুমুখী নাইফের ভেতর থেকে চিকন ছুরিটা কট্ করে মোচড় দিয়ে বের করলেন। এক পিস আপেল কেটে মুখে দিতেই শুনতে পেলেন দরোজায় কে যেন নক করছে।
দরজার বাইরে আবু তালেব দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দেখে মনে হয় লাল কন্টাক্ট লেন্স পড়েছে । চাইনিজ কুড়াল এখনো আবু তালেবের ডান হাতে। কুড়ালের ফলায় কালচে রক্ত।
‘কি আবু তালেব। ধাওয়া খাইছেন নাকি? কাজ হইছে? ফোনের জবাব দ্যান নাই ক্যান?’
আবু তালেব নীরব।
‘ভেতরে ঢুকেন। কুড়াল ওপেন ক্যান? ব্যাগ কই?’
আবু তালেব ঘরের ভেতরে ঢুকলো। তারপর ভাবলেশহীন গলায় বললো ‘মহানবী কয়েছিলেন: শেষ জমানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হইবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করিবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের সাধুতা প্রকাশ ও মানুষকে প্রভাবিত করিবার জন্য ভেড়ার চামড়ার পোষাক পড়িবে। তাদের রসনা হইবে চিনির চেয়ে মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হইবে নেকড়ের হৃদয়ের মতো হিংস্র’।
‘কি বলতেছেন মিয়া? কাজ খতম করিছেন?’
‘পরফেসর স্যারকে নূরানী গাড়ি ওঠায়ে নিয়েছে। চৌধুরী স্যার নাস্তিক নয়। নাস্তিক আপনে। শেষ জমানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হইবে। আপনে তেমন প্রতারক।’
‘কি বলতেছেন তালেব মিয়া। কিসের নূরানী গাড়ি? আপনারে জীন ধরেছে।’
‘আপনে ভণ্ড।’
আবু তালেব এবার কুড়াল ঘুরাতে ঘুরাতে গায়েবী হুজুরের দিকে এগিয়ে আসছে। গায়েবী হুজুর একবার তাকাচ্ছেন আবু তালেবের কুড়ালের দিকে আরেকবার নিজে হাতে ধরা দুই ইঞ্চি সুইস নাইফের দিকে। আবু তালেবকে শান্ত করতে হবে। তাকে শান্তির মর্ম বানী শোনাতে হবে।
‘আবু তালেব শোনেন, সূরা আল মায়েদা পড়েন নাই? বত্রিশ নম্বর আয়াত স্মরণ করেন। জানের বদলা জান অথবা দুনিয়ায় অনর্থ সৃষ্টি করার কারন ছাড়া কাউকে হত্যা করা মানে সমস্ত মানব জাতিকে হত্যা করা।’
‘আপনে ভণ্ড, আপনেই তো অনর্থ সৃষ্টি করেছেন।’
গায়েবী হুজুর কিছু একটা জবাব দিতে গেলেন। কিন্তু তার আগেই ওনার গায়ে শিলা বৃষ্টির মত কুড়ালের কোপ পড়তে লাগলো। গায়েবী হুজুর মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। হুজুরের বিস্ফোরিত দৃষ্টি ঝাপসা হতে হতে হঠাৎ পাথরের মত স্থির হয়ে গেলো।
এর পাঁচ বছর পরের ঘটনা। ভোর পাঁচটা পয়ত্রিশ। প্রফেসর আকাশ চৌধুরী বারান্দায় বসে জুতার ফিতার গিট খুলছেন। ভিসির বাংলোর ভেতরে কম করে হলেও তিন একর যায়গা। মর্নিং ওয়াকের জন্য বাইরে বেরোতে হয় না। আকাশ চৌধুরীর মেয়ে মৃত্তিকা এক কাপ চা হাতে পাশে এস বসল। মৃত্তিকার হাতে বাবা লেখা আত্মজীবনী ‘ফস্কা গেঁড়ো’। এই প্রথন বাংলাদেশে কারো আত্মজীবনী বেস্ট সেলার হয়েছে।
‘আব্বু কাল রাতে তোমার অটোবায়োগ্রাফি পড়ে শেষ করলাম’
‘কেমন লাগলো?’
‘এক্সসাইটিং আব্বু। বিশেষ করে তোমার মর্নিং ওয়াকের ঘটনা। মৌলবাদীরা আক্রমন করল আর সি আই এর এজেন্টরা ঝড়ের বেগে এসে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলো।’
‘সি আই এ তো সেই ঘটনা স্বীকার করে না মা। ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন পঞ্চাশ বছরের আগে রিলিজ হয় না।’
কথাটা বলতে বলতেই ডক্টর চৌধুরী ভাবছিলেন সেদিনের ঘটনা। আবু তালেবের কোপটা কাঁধে পড়ার সাথে সাথে একটা এ্যাম্বুলেন্স এসে থামে। অ্যাপ্রন পরা তিনজন লোক তাকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে মুখ বেঁধে ফেলে। পথে একটা ফার্মেসী থেকে ব্যান্ডেজ এনে তার ক্ষতস্থান ঢেকে দেয়। তারপর একটানে গাড়ি চলে যায় চানখারপুল। দোতালা যে বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ায় সেটা আকাশ চৌধুরীর পূর্বপরিচিত। মাজেদ সর্দারের বাড়ি। মাজেদ সর্দার ওনাকে দেখে হাতের ইশারায় সোফায় বসতে বল্লেন।
‘ব্যান্ডেজ কিল্লায়?’
‘আপনার লোকদের জিগেস করুন’
‘আমার লোক তো আপনারে কুপায় নাই। আমার লোক তো এইভাবে জিগির দিয়া কুপায় না। আপনারে উল্টা আমরা সেইভ করলাম। থ্যাঙ্কু দ্যান।’
আকাশ চৌধুরী চুপ করে রইলেন।
‘আদাবরের জমিটা নিয়া আপনে তো কোন ডিসিশন দিতে পারলেন না। জলা জমি। দুই লাখের উপর কাঠা হয় নাকি?’
‘আমি খোঁজ নিয়েছি। আট লাখ করে কাঠা। মাটি ভরলে পনেরো লাখ’
‘এই সব কদর্য ব্যাপার নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নাই। আমিই আপনার হয়ে একটা ডিসিশন দিলাম। আপনার দুই বিঘা জমি হাজী মাজেদ কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ হলো। আপনে দান করলেন।’
একটার পর একটা ঘটনা আকাশ চৌধুরীকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। তিনি এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারলেই বাঁচেন। আকাশ চৌধুরীকে চুপ থাকতে দেখে মাজেদ সর্দার বললো,
‘এফিডেভিটে সাইন করেন। তারপর বাসায় গিয়ে আরামে রেস্ট করেন। জীবন বড় না জমিজাতি বড়? আপনে তো ফিরোজ মিয়া না। ফিরোজ মিয়া মূর্খ ছিল। সামান্য জমির জন্য মূর্খের মত ইটের ভাটার জ্বালানি হয়েছে।’
আকাশ চৌধুরী কাগজে সাইন করলেন। পর দিন ভোর বেলা আকাশ চৌধুরীকে বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের কাছে নামিয়ে দেয়া হলো। তবে বিরাট ক্ষতির ভেতর থেকে কিভাবে বিরাট লাভ বের করে আনতে হয় তা আকাশ চৌধুরীর চেয়ে ভালো কে বোঝে। তিনি রটালেন মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সিআইএ তাকে উঠিয়ে নিয়েছিল। এক দিন সেইফ হাউজে রেখে নামিয়ে দিয়ে গেছে। এমন মোচড় না থাকলে আত্মজীবনী কি কেউ পড়ে? জমির দাম ওঠে? ভিসি হওয়া যায়?
মৃত্তিকা আর আকাশ চৌধুরী পূব আকশের দিকে তাকিয়ে আছে। হাল্কা লাল আভা। সূর্যটা উঠি উঠি করেও উঠছে না।
০১ মার্চ - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪