অন্যদিন

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

রনীল
  • ১৩
  • ২৫


স্কুলে ভর্তি হব শুনে প্রথম প্রথম বেশ আনন্দ হচ্ছিল। কতদিন আর এমনি এমনি ঘরে শুয়ে বসে থাকা যায়! দুনিয়ার যত বুদ্ধি- কুবুদ্ধি দিনরাত মাথায় গিজগিজ করে, সেগুলোকে বরং কাজে লাগানো যাক।
রাতে ঠিকঠাক ঘুম হলনা, সকালবেলা ও সবার আগে উঠে ফিটফাট হয়ে বসে রইলাম।
বিপদটা টের পেলাম ক্লাসে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তটিতে। সাথে আম্মা এসেছিল। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি একগাদা ছেলেমেয়ে বসে আছে, সব আমার সাইজের।
এদের কারো সাথেই বাবা-মা টাইপের কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ আমাকে একা একাই ক্লাসে ঢুকতে হবে, আম্মাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম- বড় হয়ে গেছি।
আমার গলা শুকিয়ে গেল, চোখে জল টলমল করছে, আশেপাশে কেউ হাঁচি দিলেই গড়িয়ে পড়বে।
আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম- আম্মা, তুমি কিন্তু কোথাও যাবানা, এখানে, এই বারান্দাতেই থাকবা ...
কেন যেন আম্মা নিজেও নার্ভাস ছিলেন, তুই টেনশন করিসনা, আমি এখানেই আছি।
আমি ক্লাসে ঢুকে গেলাম, জীবনের প্রথম ক্লাসে কি হয়েছিল- সেটা এতদিনে খুব বেশি মনে নেই। পুরো ক্লাস জুড়ে আমি কেবল একটা ব্যাপারই ভেবেছি- আম্মা বারান্দায় আছে তো?
স্কুল শেষে বের হয়ে দেখি- বারান্দায় কেউ দাড়িয়ে নেই। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চোখের জল আটকাতে সারাদিন অনেক খাটা খাটনি করতে হয়েছিল, এবার আর পারলামনা। কদিন ধরে শুনছি- দুপুরের দিকে নাকি শহরের গলিগুলোতে বার্মিজ মহিলারা (রোহিঙ্গা) বের হয়ে আসে, সুযোগ বুঝে ছোট ছোট বাচ্চাদের বস্তায় ভরে ফেলে।
আমি বেশিদূর যাবার সাহস পেলামনা, স্কুলের বারান্দাতেই গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। দেখতে দেখতে আমাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল। উৎসুক জনগণের বেশিরভাগই উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী, দুইএকজন বয়স্ক মানুষ ও উঁকি মেরে যাচ্ছেন মাঝেমধ্যে। আশার কথা হচ্ছে- এ পর্যন্ত কোন বার্মিজ মহিলাকে ভিড়ে দেখা যায়নি।
- এই পিচ্চি, তোর বাসা কই? কেউ আসে নাই নিতে?
- এই ট্যামারে স্কুলে ভর্তি করাইলো কেডা? এর তো এখনো চোখই ফুটেনাই।
- ওই! তোর নাম কি? কথা কসনা ক্যান? দিমু নাকি মাথায় একটা...

প্রবল অভিমানে আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। গেল সপ্তাহেই পাশের বাসার সাইফুল ভাই আমাকে আড়ালে নিয়ে স্বরযন্ত্রের ভঙ্গিতে বলেছিলেন- জানো রনিই, তুমি যাদের বাপ মা বলো, এরা কিন্তু তোমার আসল বাবা মা নন। এরা তোমার পালক বাপ-মা। তোমার আসল বাবা বিদেশ থাকে, আর আসল মা...
তখন বিশ্বাস করিনি, এখন মনে হচ্ছে সাইফুল ভাই মিথ্যা বলেননাই। আসল মা হলে কি আর আম্মা এভাবে আমাকে একা ফেলে চলে যেতেন!
ক্লাইম্যাক্স আর আবেগে একেবারে মাখোমাখো অবস্থা, প্রশ্নকারী সিনিয়র ভাইরাও ইতিমধ্যে আমার নিরবতাকে বেয়াদবি হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
এমন ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মাঝে দৈববাণীর মত কেউ একজন বলে উঠলেন- আরে! একেতো আমি চিনি, এতো শিখার ভাই। এই কেউ যাতো, শিখাকে ডেকে নিয়ে আয়...
- ম্যাডাম, শিখাতো আর এখানে পড়েনা, ও তো হাইস্কুলে চলে গেছে অনেকদিন হল।
- তাহলে... কুদ্দুস! কুদ্দুসকে কেউ ডেকে আন, ক্লাস থ্রির কুদ্দুস... আরে এতো কাঁদার কি আছে, গাধা ছেলে কোথাকার!

কিছুক্ষণ পর মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কুদ্দুস এসে হাজির হল। কুদ্দুসকে দেখে আমি ঠিক আশ্বস্ত হতে পারলামনা, সকালেই মিথ্যা কথা বলে ওকে আম্মার হাতে মার খাইয়েছিলাম।
- কুদ্দুস, এইটা না শিখার ভাই? যাতো, এরে একটু বাসায় পৌছে দিয়ে আয়।
- আই সি!
আমি কুদ্দুসের পিছু পিছু হাঁটতে থাকি,
- রনি শুন...
- কি?
- জোগী বোগী... ওহ মাই ট্যামজু!

বলতে বলতে কুদ্দুস ঠোঁটদুটো ছুঁচলো ধরনের করে ফেলে, অনেকটা চুমুর ভঙ্গি। সমকামিতার ব্যাপারটা তখন ঠিক বুঝতামনা। কুদ্দুসের আচার-আচরণ দেখে অবচেতনভাবেই দীর্ঘদিন একধরনের শঙ্কা অনুভব করেছি। পরিণত বয়সে অবশ্য কুদ্দুস একটার পর একটা প্রেমে পড়ে ( অবশ্যই নারীদের) কৃতিত্বের প্রমান দিয়েছিল, অবসান হয়েছিল সকল সংশয়ের।
এখন যতদূর বুঝতে পারি, ইংরেজিতে কথা বলার অদম্য বাসনা থেকেই কুদ্দুসের এমন বিদঘুটে দেহভঙ্গির উৎপত্তি ঘটেছিল। খুব শৈশব থেকেই তার ইংরেজিতে কথা বলার খুব শখ। সাধ ছিল, অথচ সম্বল কয়টামাত্র ইংরেজি শব্দ। ঘাটতি পূরণের জন্যই কুদ্দুস হয়তো এই উৎকট শারীরিক ভঙ্গীটির আমদানি করেছিল (উৎস হিসেবে হলিউডি সিনেমা ছাড়া অন্য কিছুর কথা মাথায় আসছেনা)।
অর্ধেক পথ যেতেই শিখা আপুর সাথে দেখা হয়ে গেল। কুদ্দুস বিদায় নিল, শিখা আপু কিছুটা তটস্থ।
- রনি, শুন ভাইয়া, আম্মাকে কিন্তু বলিসনা যে আমার দেরি হয়ে গেছিল ...
- নাহ! আমি আম্মাকে সব বলে দিব।
- ভাইয়া ভালোনা!
- নাহ...!
- আচ্ছা, ঠিক আছে, দে কামড়... আপু ডান হাতটা এগিয়ে দিতেই আমি আঁখের মত করে ইচ্ছেমত সেটি চিবিয়ে দিলাম ...




সেদিন রাতে কলঘরে একা পেয়ে আম্মার মুখোমুখি হলাম- ‘আম্মা, সবাই বলে তুমি নাকি আমার মা না... আমার আসল মা নাকি মারা গেছে?’
আম্মার হাত থেকে এলুমিনিয়ামের মগটা পড়ে গেল। সবাই শুয়ে পড়েছে, শুধু কুদ্দুসটা বিকটস্বরে গলা ফাটাচ্ছে। ইংরেজি ছাড়া ওর নাকি আর কিছু পড়তে ইচ্ছে করেনা।
শোবার আগে শিখা আপু রুমের দরজা আটকে আয়নার সামনে শেষবারের মত নেচে নিচ্ছিল। আপুর কোন নূপুর নেই, তবুও ওর নাচের ব্যাপারটি আমি ঠিক টের পেয়ে যাই।
শীর্ণ কাকটাও আসে নিঃশব্দে, অনেকটা ভুতের মত। নারকেল গাছের ডগায় বাঁধা ঘরটিতে ছানাগুলো নড়ে চড়ে ওঠে। খুব সন্তর্পণে সে ঘরের উত্তরসূরি অদলবদল হয়ে গেছে, দরিদ্র জননীর ভালবাসায় তাতে অবশ্য কিছু কমবেশি হয়না...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম বরাবরের মত একটি সফল সুন্দর সাবলীল গল্প ভাল লাগল । শুভকামনা সতত
ওয়াহিদ মামুন লাভলু খুব সন্তর্পণে সে ঘরের উত্তরসূরি অদলবদল হয়ে গেছে, দরিদ্র জননীর ভালবাসায় তাতে অবশ্য কিছু কমবেশি হয়না... ভালো লিখেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
ছন্দদীপ বেরা Choto galper ekta sundor udahoron dilam tai onek suveccha O ovinandan........
আখতারুজ্জামান সোহাগ ‘শীর্ণ কাকটাও আসে নিঃশব্দে, অনেকটা ভুতের মত। নারকেল গাছের ডগায় বাঁধা ঘরটিতে ছানাগুলো নড়ে চড়ে ওঠে। খুব সন্তর্পণে সে ঘরের উত্তরসূরি অদলবদল হয়ে গেছে, দরিদ্র জননীর ভালবাসায় তাতে অবশ্য কিছু কমবেশি হয়না... ’ অসাধারণ! অপূর্ব! শুভকামনা লেখকের জন্য।
Lutful Bari Panna তোমার নিজস্ব বর্ণনারীতি যেটা খুব টানে, কোন প্লট ছাড়া আগডুম বাগডুম লিখলেও যা ভাল লাগে সেটুকু বাদ দিয়েও যদি বলি অভিনব একটা প্লট। আর সমাপ্তিতে রহস্য রেখে দেওয়ার ধরণটাও খুব ভাল লাগল। রনীল একটা বই করে ফেলতে পারে বোধ হয়।
রোদের ছায়া অল্প পরিসরে ভিন্ন স্বাদের গল্প, ভালো লাগা পুরোটাই থাকলো । শুভকামনা সতত।
সাদিয়া সুলতানা খুব অল্প পরিসরে ছোট গল্পের পুরো রেশ। শেষ বাক্য কয়টির কাব্যিকতা আর জীবনবোধ আচ্ছন্ন করে রাখল অনেকক্ষণ। শুভকামনা।
Salma Siddika শেষ হয়েও হলো না শেষ...এরকমটাই লাগলো।
এশরার লতিফ আপনার গল্প সব সময়ই স্বতন্ত্র . একটা পালিত বালকের বেড়ে ওঠার আর বুঝে ওঠার অনুভুতি খুব সংবেদনশীলতার সাথে চিত্রিত হয়েছে.
ধন্যবাদ লতিফ দা।
অপদেবতা ভাই এ গল্পটা ভাল লাগছে, গল্পর মজাটা পেলাম , শুভ কামনা থাকল
আপনাকেও অনেক শুভ কামনা।

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪