অপরা‎‎হ্ণ প্রসূন

প্রশ্ন (ডিসেম্বর ২০১৭)

মনজুরুল ইসলাম
  • ১৪
  • ১৫
শাহরিক যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ কৃত্রিম জীবনে প্রবাহিত স্রোতের দিকে ভাসতে ভাসতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অনাবিল ইসলাম। প্রতিনিয়ত প্রত্যাশা করে আসছিলেন একটুখানি নিস্তব্ধতা এবং সারল্যে আবৃত জীবনপ্রবাহ। বাস্তবতার প্রকট চিত্রের সামনে এতদিন অসহায় হয়ে পড়লেও অবশেষে ছুটির ঘণ্টাটি বেজে উঠেছে। মুক্তি মিলেছে শাহরিক যন্ত্রণার বিরক্তিকর বন্ধন থেকে। পুঞ্জ পুঞ্জ কষ্ট দিয়ে সঞ্চিত জীবনীশক্তির মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নিশ্চিত হয়েছে মফস্বল শহরে বসবাসের সাম্প্রতিক প্রবণতা। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় পদায়ন পেয়েছেন। পদবি উপজেলা সমাজসেবা অফিসার। যোগদান করেছেন গত মাসের দুই তারিখ। দীর্ঘ দশ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন ঢাকায়। গ্রামের বাড়ী সবুজ অরণ্যের লীলাভূমি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায়। প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রেখেছিলেন অত্যন্ত আড়ষ্টতার মোড়কে আবৃত ছিলেন। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বাস্তব জীবন থেকে অর্জিত জীবনবোধের মাধ্যমে নিজেকে করে তুলেছেন অত্যন্ত পরিণত। বয়স ২৬ -২৭ এর বেশি হবে না। দীর্ঘ নাক, লোমশ ভুরু, অবিন্যস্ত লম্বা চুল, গায়ের তামাটে রং এবং হালকা গড়নে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটে নি। অনেকটা আগের মতই রয়ে গেছেন। টি-শার্ট ও ঢিলেঢালা জামা পরে স্বচ্ছন্দ বিচরণের স্বভাবটি ধরে রেখেছেন সমান গতিতে। একইভাবে ধরে রেখেছেন জ্ঞান চর্চার অভ্যেসটি।
উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী উপজেলা হিসেবে পরিচিত ডিমলার পরিবেশ অত্যন্ত প্রশান্ত। নেই যানবাহনের সমারোহ কিংবা জনগণের কোলাহল। উপজেলা পরিষদে অবস্থিত প্রতিটি পৃথক অফিসের সামনে বৃক্ষরাজির সমারোহ সমৃদ্ধ করেছে উপজেলার সৌন্দর্য। নির্বাহী অফিসারের কক্ষের সামনেই বিস্তীর্ণ পুকুর পাড় জুড়ে প্রকা- শিমুল বৃক্ষ মূল রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। পুকুর পাড়ে ইট সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত ক্ষুদ্র্র্র ক্ষুদ্র বসার স্থানগুলিতে দূর-দূরান্তর থেকে কাজের জন্যে ছুটে আসা লোকজন বিশ্রাম নিয়ে থাকেন। অনাবিলের অফিসটি বিস্তীর্ণ পুকুর থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত। একতলা বিশিষ্ট ভবনে তিনিই প্রধান কর্মকর্তা। পুরো অফিস জুড়ে রয়েছে মোট পাঁচটি কক্ষ। মূল কক্ষটির প্রবেশ পথেই নেমপ্লেটে বড় আকারে লেখা রয়েছে তার নাম এবং পদবি। কাঁঠাল কাঠের অপেক্ষাকৃত লম্বা চেয়ারটিতে আসন গ্রহণ করেন তিনি। বৃহৎ টেবিলের সামনেই সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে দশটি চেয়ার। নিয়মিতই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যবৃন্দ যাতায়াত করবার কারণে এ ধরনের আসন বিন্যাস। টেবিলের ডান পাশে টেলিফোন সেট এবং বাম পাশে একটি ফাইল বক্রা। তিনটি বৃহৎ আকারের আলমিরা ঠিক তার পেছনেই অবস্থিত। ব্যক্তিগত ল্যাপটপ কম্পিউটারটি নিজের কাছেই রাখেন সবসময়। টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে ল্যাপটপটি। অফিসের ঠিক সামনেই একটি বৃহৎ কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষটির স্বাস্থ্যবান শাখা-প্রশাখাগুলির ছায়া অফিসের প্রায় প্রতিটি কক্ষের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রখর তাপদাহেও খুব একটা কষ্ট পেতে হয় না সেই শাখা-প্রশাখাগুলির স্নিগ্ধতা জুড়ানো ছায়ায়।
প্রতিদিন ঠিক ন’টাতেই অফিসে বসেন অনাবিল। অবস্থান করেন অফিসের ঠিক পেছনের দ্বি-তল বিশিষ্ট অফিসার্স কোয়াটার-এ। পুরোনো একটি চৌকিতে কোনোরকমে রাত কাটাচ্ছেন। এখনও তিনি মোটামুটিভাবেও গুছিয়ে উঠতে পারেন নি বলে সমস্যা হচ্ছে। তবে যে সমস্যাটি তাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অস্থিরতার দিকে ধাবিত করছে সেটি হলো-চিন্তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগের সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা। ঢাকায় অবস্থানকালীন প্রায় সময়ই সমমনা বন্ধু অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকবৃন্দের সাথে ভাব বিনিময় করবার সুযোগ পেতেন। কিন্তু এখানে আসবার পর থেকেই সেই সুযোগটি কোনোভাবেই সৃষ্টি করতে পারছিলেন না। একদিন হঠাৎ অফিস থেকে বেরুবেন এমন সময় স্থানীয় একজন কবি এসে তাকে একটি সাহিত্য পত্রিকা দিয়ে যান। পত্রিকাটিতে সব লেখাই ছিল স্থানীয় লেখকবৃন্দের। পুরো পত্রিকাটি মনোযোগ দিয়ে পড়বার পর সাহিত্যের ওপর রচিত একটি প্রবন্ধ তাকে বিশেষভাবে বিমোহিত করেছিল। মফস্বল এলাকায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় যে এত উঁচু মানের প্রবন্ধ ছাপানো হতে পারে, সেটি ছিলো তার কল্পনারও বাইরে। কবির সহায়তায় সেই লেখকের সাথে পরিচিত হয়ে তার নিয়মিত সাহচর্যে অস্থিরতার মাত্রা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
লেখকের নাম সরদার আনোয়ার হোসেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। দীর্ঘাকৃতির একজন মানুষ-এখন বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পাটি আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে তাকে হাঁটতে হয় বাম পায়ের ওপর ভর দিয়ে। সঙ্গে কেউ থাকলে সবসময়ই বাম হাতটি তার কাঁধে রেখে বাম পায়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমাবার চেষ্টা করেন। দুটি গাল ভরপুর মাঝারি আকারের সাদাকালো দাড়ি দিয়ে। কপালের ভাজগুলি স্পষ্ট হয়ে এসেছে। মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল লেন্সের চশমা পড়েন তিনি সবসময়ই। দীর্ঘ চুল এলোমেলো। বোধকরি এলোমেলো চুলকেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। কারণ যখনই দেখা হয়েছে তখনই লক্ষ করেছে অনাবিল, লোকটির চুলগুলি বিন্যস্ত নয়। আর অবিন্যস্ত দেখতে দেখতে অবিন্যস্ত চুলগুলিকেই সৌন্দর্যের আবহ দিয়ে নিজের মনে গেঁথে নিয়েছে অনাবিল। স্থুল গোঁফের দু’প্রান্তই দাড়ির সঙ্গে একাকার। ভ্রুতেও দু’একটি সাদা চুল লক্ষিত। প্রায় সবসময়ই লুঙ্গি এবং শার্ট পরিধান করে থাকেন। শারীরিক অবস্থা খুব যে ভালো তা বলা যাবে না, আবার একেবারেই যে খারাপ তাও নয়। কিছুদিন আগে হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু এখন আর নেই-কেটে গেছে।
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়বার। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এবং আর্থিক সচ্ছলতা কোনোটিই ছিল না বলে তা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। শিক্ষার সেই দীনতা কাটিয়ে উঠবার জন্যে প্রকৃতি এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন সবসময়। এক পর্যায়ে এসে লিখতেও শুরু করেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য এবং নাটকের ওপর লিখবার ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। মূলত এই লেখালেখির অভ্যেসটি তার অধ্যয়নের গতি এবং প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছিল ভিন্ন মাত্রা।
সংসার জীবনে মোটেই সচ্ছল ছিলেন না। ব্যবসা করতেন গ্রন্থ বিক্রয়ের। ডিমলা সদরেই ছিল তার গ্রন্থ বিক্রয়ের কেন্দ্র- যে কেন্দ্রটির নাম তিনি নিজেই দিয়েছিলেন ‘গ্রন্থ বিতান’। অন্যান্য বইয়ের দোকানের সাথে তার দোকানের পার্থক্য ছিল চোখে পড়বার মতো। যদিও উপজেলা পযার্য়ের বইয়ের দোকানগুলিতে সৃজনশীল গ্রন্থ খুব একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু তার বইয়ের দোকানে স্কুল, কলেজের তালিকাভুক্ত মূল বইয়ের পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল বই। বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ সংগ্রহ করতে তিনি বেশি উৎসাহিত হতেন। সেটি তার গ্রন্থ কেন্দ্রে গেলেই বোঝা যেত। এ ধরনের কোনো বই যদি কোনো শিক্ষার্থী পাঠে আগ্রহী হতো সামান্য কিছু অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করবার মাধ্যমে তার চাহিদাটুকু মেটাবার চেষ্টা করতেন আনোয়ার হোসেন। পাশাপাশি সুযোগ পেলেই শিক্ষার্থীদের এ ধরনের গ্রন্থ কিনে পড়বার পরামর্শ প্রদান করতেন। এই প্রক্রিয়াটি চালু রাখবার মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সকাল থেকে রাত অবধি দোকানেই অবস্থান করতেন তিনি। বিক্রির চাপ স্কুল, কলেজে ভর্তির সময় থাকলেও প্রায় সারা বছরই বিক্রি হতো অতীব মন্থর গতিতে। সৃজনশীল গ্রন্থের বিক্রি একেবারেই শূন্যের কোঠায় অবস্থান করলেও পুরোনো লাইব্রেরি থেকে গ্রন্থ ক্রয় করে নিজে পড়বার জন্যে নিয়ে আসতেন রংপুর কিংবা ঢাকা থেকে। এবং দিনের পুরো সময় জুড়ে ব্যাপৃত থাকতেন সৃজনশীল গ্রন্থ পাঠে। স্ত্রীর চাকরি এবং বই বিক্রির সামান্য উপার্জন থেকে তিন সন্তানের পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হলেও সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হতো। বর্তমানে প্রত্যেক সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। আর এ কারণেই বইয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে নিমগ্ন রেখেছেন নিজেকে। সন্তানরা তাদের বাবার সেই ইচ্ছেটুকু পূরণ করবার জন্য সব ধরনের ব্যয় নির্বাহ করছেন।
একজন মানুষ যখন সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানের প্রকৃত নির্যাস উপলব্ধি করবার সক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারেন তখন তিনি ক্ষুদ্র সীমায়তির ভেতর অবস্থান করেও দৃষ্টিভঙ্গিকে দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত রাখতে সক্ষম হন। গ্রন্থের ভেতর দিয়ে পরিব্রাজন করতে থাকেন ভূখন্ডের পর ভূখন্ড। চূড়ান্ত অর্থে এরই অভ্যন্তরে অনুভব করেন অবিনাশী এবং অকৃত্রিম সুখবোধ। এই সুখ প্রাপ্তির অনুভূতিটি ইচ্ছে করলেও কাউকে বোঝানোও সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজে গভীর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সেই উপলব্ধিকে অনুভব করতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারবেন। বর্তমানে যে কক্ষটিতে আনোয়ার হোসেন অবস্থান করছেন সে কক্ষটির পরিবেশ যে সে ধরনের অনুভূতির প্রসব ঘটাবার জন্যে অতি উত্তম দৃষ্টান্ত সেটি খুব সহজেই লক্ষ করা যায়। আজীবন পঠিত সব ধরনের সৃজনশীল গ্রন্থ দ্বারা সাজিয়ে রেখেছেন তার কক্ষটিকে। পাশাপাশি সন্তানরাও তার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্রন্থের সংস্থান করে যাচ্ছেন। কক্ষের তিনদিকের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মোট ছয়টি বুক সেলফ। প্রতিটি বুক সেলফে রক্ষিত বইগুলি ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজানো। কক্ষের একদম মাঝখানে রয়েছে একটি বৃহদাকার টেবিল এবং রিভলভিং চেয়ার। টেবিলে রয়েছে একটি ডেস্কটপ, একটি ল্যাপটপ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি। টেবিলের পাশেই অপর দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত কারুকার্যময় একটি পুরোনো চকলেট রংয়ের খাট। এই কক্ষটিতেই সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রশান্তির অনুভব নিয়ে দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই অবস্থান করেন।
বাসাটির অবস্থান ডিমলা শহরের সবুজ পাড়াতেই। অনাবিলের কোয়াটার থেকে তিন কি.মি. দূরে। সন্ধ্যা হবার পূর্ব মুহূর্ত থেকেই এক ধরনের প্রফুল্লতা বিরাজ করতে থাকে অনাবিলের মনোমুকুরে। আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তার বাসায় যাতায়াত করেন। অবস্থান করেন সন্ধ্যা থেকে রাত ন’টা অবধি। কখনো কখনো সেই সময়টিও উত্তীর্ণ হয়ে যায়। জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখা-প্রশাখা নিয়ে আলোচনা করবার এমন দুর্লভ মুহূর্ত যে ডিমলার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে সৃষ্টি হয়ে যাবেÑ এটি কখনো ভাবতেই পারেন নি অনাবিল। যতই আনোয়ার সাহেবের কাছাকাছি এসেছেন ততই তার জ্ঞানের পরিধি অনুধাবন করে বিস্মিত হয়েছেন। ভেবেই পাচ্ছেন না একজন মানুষ কোনো ধরনের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন এমনকি প্রকাশনা ব্যতীত কীভাবে এত দুর্দান্ত গতিতে জ্ঞানচর্চা এবং লেখালেখির অভ্যেসটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন! অনাবিল নিজেও লেখালেখির চর্চা করেন এবং এ কারণেই অতীতে সবসময়ই এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে সিক্ত হবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আনোয়ার সাহেবের অপ্রকাশিত অজস্র লেখা এবং সেই লেখার গভীরতা পর্যবেক্ষণ করবার পর এখন তার মননে সেই আত্মতৃপ্তির বিষয়টি কোনোভাবেই ক্রিয়া করে না। এমনকি তিনি যে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটি পর্যন্ত কারো সামনে মুখ ফুটে বলবার সাহসই পান না।
প্রথম দিকে অনাবিল আনোয়ার সাহেবকে স্যার হিসেবে সম্বোধন করলেও অন্তরঙ্গের গভীরতায় বর্তমানে সেটি আঙ্কেল-এ এসে উপনীত হয়েছে। পাশাপাশি আনোয়ার সাহেবের জন্যে কিছু করবার অভিপ্রায় নিয়ে নিজের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন চেতন দায়বদ্ধতা। চেষ্টাও করছেন আনোয়ার সাহেবের সমগ্র সৃষ্টিকর্মগুলিকে একটি ফ্রেমে নিয়ে এসে প্রকাশের ব্যবস্থা করবার। অনাবিলের এমন মেধা এবং দায়বোধ প্রত্যক্ষ করবার পর তার প্রতি দুর্বল হবার পাশাপাশি বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছেন আনোয়ার সাহেব। যদিও প্রথম দিকে অনাবিলের ওপর খুব বেশি আগ্রহ বোধ করতে পারেন নি তিনি। তার এ জীবনে অনাবিলের মতো অসংখ্য ব্যক্তি এসেছিলেন কিন্তু কিছুদিন পেরিয়ে যাবার পর সম্পর্ক ঠিক থাকলেও জ্ঞানভিত্তিক আলোচনাগুলি আর স্থায়ী হতে পারে নি। আজ এত বেলা পেরিয়েও এজন্য আনোয়ার সাহেবের মনে নেই বিন্দুমাত্র অনুশোচনা। একটা সময় ছিলো যখন বিষয়গুলো তাকে কষ্ট দিতো। কিন্তু এখন তিনি এমন ধরনের স্থিতিশীলতায় পৌঁছে গেছেন যে, নিজের কক্ষে বসেই লেখালেখি ব্যতীত অন্য কিছু ভাববার সুযোগ পান না।
প্রতিদিনের মতো আজও হেঁটেই আনোয়ার সাহেবের বাসার দিকে যাত্রা করেছেন অনাবিল। টি-শার্ট, সুতি গ্যাবার্ডিন প্যান্ট এবং ফিতেওয়ালা ছ্যান্ডেল পায়ে দিয়েই বের হন তিনি। এই গেট আপ তার কাছে বহুদিনের পরিচিত এবং এতেই সর্বোচ্চ প্রশ্বস্তি অনুভব করে থাকেন। ডিমলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় আবহ হাঁটবার সময় অতিরিক্ত প্রশান্তি যোগ করে। এতটা দীর্ঘ পথ হাঁটলেও কোনো ধরনের ক্লান্তি কাজ করে না শরীরজুড়ে। প্রশান্তি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই আনোয়ার সাহেবের বাসার সামনে চলে এলেন। মূল সড়ক থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত বাসাটি। রাস্তা থেকেই লোহার ফ্রেম দিয়ে ডিজাইন করা ধূসর হলুদ রংয়ের গ্রিল দ্বারা বেষ্টিত বারান্দাটি খুব সহজেই দেখা যায়। গ্রিলের সামনে কিছু খোলা জায়গা থাকলেও নেই কোনো প্রাচীর। বারান্দায় শৃঙ্খলভাবে সাজানো রয়েছে তিনটি বেতের চেয়ার। বিদ্যুৎ চলে গেলে সেই চেয়ারে পাশাপাশি বসে গল্প করেন দুজনই। বারান্দার সামনেই আনোয়ার সাহেব লাগিয়েছেন একটি শেফালী ফুলের গাছ। দীর্ঘ দিন ধরে পরিচর্যা করে আসছেন কাক্সিক্ষত ফুলটির সন্ধান পেতে। প্রথমদিকে বাসার ভেতরে প্রবেশ করবার জন্য নক করলেও এখন আর করেন না। নিয়মিত যাতায়াতের কারণে নিজেই গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। সবার সাথে সখ্যতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যেন তাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছেন অনাবিল। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেফালী ফুলের গাছটি প্রত্যক্ষ করবার পর ড্রইং রুম পেরিয়ে সরাসরি আনোয়ার আঙ্কেল-এর রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন অনাবিল।
রিভলভিং চেয়ারে বসে কম্পিউটারে লিখছিলেন আনোয়ার সাহেব। অনাবিলকে দেখবার পর উৎফুল্ল চিত্তে কাছে ডেকে বসতে বললেন। তার মুখে হাসির রেশটি দীর্ঘ সময় অবধি অটুট রইলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর নিজে থেকেই অনাবিলকে আজকের আলোচনার বিষয় সম্পর্কে অবহিত করলেন। আজকের এই মুহূর্তটি দুজনের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনাবিলের যেহেতু লেখালেখির ওপর প্রচ- আগ্রহ রয়েছে সেহেতু অবশ্যই তিনি উপকৃত হবেন কীভাবে লেখালেখি করতে হয় সে বিষয়ে জানতে পারলে। পাশাপাশি আনোয়ার সাহেবের প্রচ- ইচ্ছে-তার হাত ধরে যদি কোনো লেখক উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম রচনায় সক্ষম হন তবে নিজেকে সার্থক ভাবতে পারবেন তিনি। তাছাড়া তার কাছ থেকে প্রদত্ত জ্ঞান ধারণ করবার মতো যোগ্যতা অনাবিলের রয়েছে বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন বিধায় প্রত্যাশাটি বেড়ে গেছে। বিছানার পূর্ব প্রান্তে আলোচনা শুনবার প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে বসে আছেন অনাবিল। রিভলভিং চেয়ারটি খানিকটা ঘুরিয়ে নিয়ে অনাবিলের মুখোমুখি হয়ে আনোয়ার সাহেব বলতে শুরু করলেন-‘সাহিত্য হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে শুদ্ধতম কাজ, মিথ্যের কোনো আশ্রয় এখানে নেই। যদি তুমি প্রকৃতই সাহিত্য করতে চাও তবে এ বিষয়টিকে প্রথমেই মনে প্রাণে ধারণ করতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, লেখনীর মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা দুর করাই লেখকদের একমাত্র ব্রত।’
‘কিন্তু ঠিক কোন ধরনের সাহিত্য আবিলতা দুর করে স্থিতিশীল পৃথিবী সৃষ্টি করবার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে’- ডান হাতের কনুইটি ডান উরুতে রেখে ডান হাতটি ডান গালে রেখে জিজ্ঞেস করলেন অনাবিল।
‘অবশ্যই উৎকৃষ্ট সাহিত্য। প্রশ্ন করতে পারো উৎকৃষ্ট সাহিত্য কীভাবে সৃজন করা সম্ভব? প্রথম শর্তেই ডেভোশন থাকতে হবে। আর ডেভোশন তখনই সৃষ্টি হবে যখন সেই কাজের ওপর প্রকৃত ভালোবাসার সৃষ্টি হবে। কবিতার একটি পঙক্তি অথবা প্রবন্ধের একটি অনুচ্ছেদ লিখবার পর যদি কোনো লেখক তার মননে আনন্দানুভূতির সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন তবে বুঝতে হবে সেই সৃষ্টিটির ওপর উচ্চ মাত্রার কোনো আসক্তি কিংবা প্রচেষ্টাই ছিলো না। ধরো, তুমি যদি কবিতার ওপর কাজ করতে চাও এবং শুধু নির্দিষ্ট কিছু কবিতা পাঠের মাধ্যমেই কবিতা লিখতে উদ্যত হও সেক্ষেত্রে কোনোভাবেই তোমার কবিতাটি উৎকৃষ্ট কবিতার পদবাচ্য হয়ে উঠবে না। কারণ কবিতা লিখবার মাধ্যমে তুমি জাতির ওপর যে দর্শনটিকে প্রক্ষিপ্ত করতে চাও সেই দর্শনটিকে তোমার বোধের মাধ্যমে উপস্থাপন করবার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধরন তোমার আয়ত্ত্বে আনবার লক্ষ্যে অবশ্যই তোমাকে বহুমাত্রিক বিষয়ের ওপর লিখিত প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং কবিতা পাঠ করে যেতে হবে। কারণ প্রতিটি উৎকৃষ্ট লেখাই, সেটি প্রবন্ধ, গল্প কিংবা নাটক-যাই হোক না কেন, তার মধ্যে অবশ্যই দর্শন অন্তরিত রয়ে যায়। এখন উক্ত বিষয়ে অনবরত অধ্যয়ন করবার মাধ্যমে যদি সেখান থেকে প্রকৃত দর্শনটিকে চিহ্ণিত করে তুমি তোমার মননকে ঋদ্ধ করতে পারো, সেক্ষেত্রে তুমি তখন যে কবিতাটি লিখবে অবশ্যই সেই কবিতাটি উৎকৃষ্ট কবিতা হিসেবে সবার মাঝে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। এটি করতে না পারলে তোমার লেখার মধ্যে কোনো ধরনের উপযোগিতাই সৃষ্টি হবে না। আর নান্দনিক শব্দ শৈলীর মাধ্যমে লেখাটিকে ঋদ্ধ করবার ক্ষেত্রে অবশ্যই তোমাকে শব্দ ভা-ার সমৃদ্ধ করতে হবে।’ অনর্গল কথা বলবার পর কিছুক্ষণ পূর্বে টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া চায়ের একটি কাপ অনাবিলকে দেবার পর নিজে একটি কাপ নিয়ে চুমুক দেয়া শুরু করলেন।
‘তাহলে কি আঙ্কেল, গদ্য রচনা করবার ক্ষেত্রেও একজন লেখককে কবিতার ওপর যথেষ্ট পড়াশুনো করতে হবে?’ চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটি দেবার পর প্রশ্ন রাখলেন অনাবিল।
‘শুধু কবিতা কেন, সব বিষয়েই পড়তে হবে। মনে রাখবে, সাহিত্যের মধ্যে যত শাখা-প্রশাখা রয়েছে তার মধ্যে প্রবন্ধ হচ্ছে সবচেয়ে কঠিনতম শাখা। মৌলিক চিন্তা আর গবেষণার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। গবেষণালব্ধ আবিষ্কার এবং মৌলিক চিন্তা- দুটি বিষয়ই ভিন্নভাবে মানুষের উপযোগিতা নিশ্চিত করে। এখন তুমি যদি মৌলিক প্রবন্ধ লিখতে ব্রতী হও সেক্ষেত্রে বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার অধ্যয়নের গভীরতা কত দূর অবধি বিস্তৃত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের ওপর তুমি প্রবন্ধ লিখতে চাও, প্রথমত সেটি অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। আর কবিতা পাঠের কথা বলছো, প্রবন্ধ মানেই প্রকৃষ্ট বন্ধন, একটি শব্দের সাথে আর একটি শব্দের মেলবন্ধন। মৌলিক প্রবন্ধ ছাড়াও যে ধরনের প্রবন্ধই লিখতে চাও না কেন, অবশ্যই সেই লেখার মধ্যে গতি নিয়ে আসতে হবে। আর কবিতার ওপর দক্ষতা ব্যতীত কীভাবে প্রত্যাশা করতে পারো যে, প্রবন্ধটি গতিময় হবে। আর প্রবন্ধে যদি গতি না থাকে সেক্ষেত্রে পাঠকের কাছে সহজে উপস্থাপন করা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না।’
‘সেক্ষেত্রে ভাষাশৈলী কিংবা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত?’ আনোয়ার সাহেবের কথার মাঝখানেই আবারও প্রশ্ন করলেন অনাবিল।
চেয়ারটি ঘুরিয়ে নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে জবাব দেয়া শুরু করলেন আনোয়ার সাহেব- ‘ভালো প্রশ্ন করেছো অনাবিল। আসলে প্রবন্ধের ভাষা কিংবা স্টাইল পুরোপুরি নির্ভর করবে লেখকের পাপ্তি এবং বাস্তবতাবোধের ওপর। তিনি যদি মনে করেন তার লেখা শুধু একটি নির্দিষ্ট উচ্চমার্গীয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে হবে সেক্ষেত্রে তার ক্ষমতা অনুযায়ী ভাষাশৈলী কিংবা উপস্থাপনভঙ্গি অতি উচ্চমাত্রায় উন্নীত করতে হবে। আবার তার লেখা যদি সব পাঠকের জন্যে হয় সেক্ষেত্রে ভাষাশৈলী এবং উপস্থাপনভঙ্গি তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, প্রত্যেক লেখকেরই ভাষাশৈলী আদর্শ মানের হওয়া উচিত। কেউ যদি পাঠকের কথা চিন্তা করে লেখার মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ অর্থাৎ ভাষার শিল্পমান ক্ষুন্ন করেন সেটি কখনোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। আর এ ধরনের লেখা বেশিদিন স্থায়ীত্বও লাভ করতে পারবে না। আবার অতিমাত্রায় পাপ্তি প্রদর্শনের জন্যে যদি কোনো লেখক দুবোর্ধ্য শব্দ আরোপ করে নিজের পাপ্তি জাহির করবার চেষ্টা করেন তবে সেই রচনাটি তখন কৃত্রিম অথবা আরোপিত হয়ে যাবে। একটি লেখা যে ধরনের ভাষা ডিমান্ড করবে ঠিক সেভাবেই লিখতে হবে।’
‘কিন্তু সব পাঠক যদি উঁচু মানের না হয় সেক্ষেত্রে লেখকের কি সে দিকটির প্রতি দৃষ্টি রেখে লিখবার ক্ষেত্রে সরলীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত নয়?’- দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও সাহস নিয়ে জানতে চাইলেন।
‘অবশ্যই উচিত, কিন্তু ওই যে বললাম শিল্পমান, লেখার শিল্পমান ঠিক রেখে যদি কোনো লেখক সরলভাবে উপস্থাপন করতে পারেন তবে অবশ্যই তিনি করবেন। কিন্তু শিল্পমান কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। পাশাপাশি লেখার গঠনগত আদর্শটিকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। এখন কোনো লেখক যদি নতুন কোনো স্টাইল কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা অন্য কোনো শাখাতে প্রয়োগ করতে পারেন সেটি ভিন্ন বিষয়। আর পাঠক যদি বুঝতে ব্যর্থ হন সেটি তো লেখকের দায় নয়। আর ভবিষ্যতে যে পাঠকের গুণগত মানের ঊর্ধ্বায়ন অথবা অবনমন যাই হোক না কেন সেটি তো ভবিতব্য। অনিশ্চিত ভবিতব্যকে লক্ষ্য করে সাহিত্য রচনা যতটা না হবে বাস্তব তার চাইতে বেশি আনুমানিক। আজকে এ পর্যন্ত থাক, ক্লান্ত লাগছে। কালকে এসো, অন্য বিষয়ে কথা বলা যাবে। ’
তন্ময় হয়ে আনোয়ার সাহেবের কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনবার সাথে কখন যে দশটা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেন নি অনাবিল। তিনি এতটাই ছন্দোবদ্ধভাবে বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন, যেন ছবির মতোই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসছিল তার কাছে। দ্রুত আনোয়ার সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরলয়ে হাঁটতে থাকলেন। হাঁটবার সময় লেখালেখির যে দর্শন লাভ করলেন তাই নিয়ে ভাবতে থাকলেন। সাহিত্যচর্চা যে সত্যিই একটি কঠিন কাজ সেটিও বুঝতে পারলেন। যদিও নিজের ভেতরের সীমাবদ্ধতাগুলি উপলব্ধি করতে পারলেন তবুও কোনো নেতিবাচক বিষণœতায় আচ্ছন্ন হলেন না। বরং ভবিষ্যতের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করবার লক্ষ্যে পড়াশুনার গতি বৃদ্ধির স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সময় দশটা পেরিয়ে যাবার কারণে একটি রিকশা নিয়ে বুক-বাইন্ডিং এর দোকান থেকে বাইন্ডিংয়ের জন্য রাখা আঙ্কেল এর দুটি গ্রন্থের পান্ডুলিপি নিয়ে সরাসরি কোয়াটারের সামনে চলে এলেন।
কক্ষটি এখনো অগোছালোই রয়ে গেছে। জামা কাপড় রুমের ভেতর দুই প্রান্তে টানানো রশির মাঝেই রাখা রয়েছে। রুমের সদর দরজার পাশেই রাখা খাবার খেয়ে নিয়ে ঘুমোবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন অনাবিল। বিছানার পাশেই ঢাকা থেকে নিয়ে আসা গ্রন্থগুলি স্তুপ করে সাজিয়ে রেখেছেন। স্তুপের পাশেই রাখা আঙ্কেলের পান্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে থাকলেন। দুটি গ্রন্থেরই দু’বার করে প্রুফ দেখা হয়ে গেছে। এখন প্রিন্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। প্রকাশকের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। ঢাকায় অবস্থানকালীন প্রুফের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবার কারণে অনেক প্রকাশকের সাথে পরিচয় রয়েছে তার। তাই গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নেবার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয় নি অনাবিলকে। বরং এত উচ্চ মার্গীয় লেখার সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবার পর থেকেই অজস্র লেখা পাঠের পর সেগুলির মধ্যে থেকে আপাতত প্রকাশের জন্য কিছু লেখা নির্ধারণ করেছেন অনাবিল। এবং তার এই নির্বাচনকে আনোয়ার সাহেব ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন যে বিষয়টিও পুলকিত করে অনাবিলকে। সঙ্গত কারণেই নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রয়োগ করে পান্ডুলিপি দুটি নিঁখুত করবার চেষ্টা করেছেন।
প্রুফ এবং বাইন্ডিং এর কাজ শেষ হবার কারণে অফিসে এসেই পান্ডুলিপির কপিদুটি পিয়নকে দিয়ে কুরিয়ারে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও সফট কপি ই-মেইল করলেন। কুরিয়ার এবং ই-মেইল করবার কারণে অনেকটাই প্রশস্তি বোধ করছেন আজ। ল্যান্ড ফোন থেকে বিষয়টি আঙ্কেলকে জানিয়ে দিলেন। অফিসে কাজের ব্যস্ততা থাকলেও মনে মনে কাক্সিক্ষত সন্ধ্যের কথা ভেবে সন্তুষ্টি বোধ করলেন। দুপুরের পর অচিনপুর ইউনিয়নে ত্রাণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। তাই দ্রুত রুমে এসে কাপড় পরিবর্তন করে আনোয়ার আঙ্কেলের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে একটি ডাইরিও নিলেন।

প্রতিদিনের মতো স্বভাবজ ভঙ্গিতে কম্পিউটারে বসে লিখছিলেন আনোয়ার সাহেব। অনাবিলকে দেখবার পর স্বভাবজ হাসির রেখাটি ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো। পা-ুলিপি পাঠাবার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন-‘আমি তো লেখালেখি ছেড়েই দিয়েছিলাম, কখনো কল্পনাও করিনি গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। আগে যে চেষ্টা করিনি তা নয় কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠে নি। তুমি যে এমনভাবে শেষ বেলায় এসে আলো জ্বালাবে সেটি কখনোই ভাবতে পারি নি।’
‘না, না। আমি না আসলেও অন্য কেউ এসে ঠিকই প্রকাশের ব্যবস্থা করতো।’-শান্ত স্বরে আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন অনাবিল।
‘প্রকৃত বিষয়টি কী জানো অনাবিল, তুমি না আসলে কোনোভাবেই গ্রন্থদুটি প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। এতগুলি হাতে লেখা পা-ুলিপি কি আমার পক্ষে কম্পোজ করা সম্ভব ছিল, আর কেইবা প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করতো? এখন এত ভালো লাগছে যে তোমাকে ভাষায় বোঝাতে পারবো না। কখন যে গ্রন্থদুটি হাতে আসবে এই ভেবে প্রতিটি মুহূর্ত অস্থিরতায় কাটছে। তবে তোমার কাছে আমার একটিই অনুরোধ, আমার এই সৃষ্টিগুলি যাতে বেঁচে থাকে সে চেষ্টা তুমি কোরো। আর তুমি ছাড়া এর মর্ম কেউ বুঝতেও পারবে না। আমার বিশ্বাস আমার এই সৃষ্টিগুলি কাল কে উত্তীর্ণ করে যাবেই।’- আবেগতাড়িত কণ্ঠে অনাবিলের চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে গেলেন আনোয়ার সাহেব।
‘তা তো অবশ্যই, আর আপনার সৃষ্টিকর্মের ঋদ্ধতার সূত্র ধরেই তো আপনার সাথে আমার পরিচয়। আর আমিও বিশ্বাস করি, আপনার সৃষ্টিকর্মগুলি অবশ্যই কালোত্তীর্ণ হবে। আপনার যে বর্ণনা, যে যুক্তি তা তো একদম ক্ল্যাসিক্যাল রাইটারদের সমমানের।’- কথাগুলি বলবার সময় বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠলো অনাবিলের চোখে মুখে।
‘তোমার কথাটিই যেন সত্যি হয়।’- অনেকটাই নির্ভার হয়ে বলবার পর গল্পের ওপর বর্ণনা প্রদানে উদ্যত হলেন আনোয়ার সাহেব।
‘গল্প লিখবার ক্ষেত্রে প্রথম শর্তেই বহুমুখী জীবনাচরণের সাথে পরিচয় থাকতে হবে। একজন লেখক যত পরিমাণে সাধারণ মানুষের বাস্তবজীবন প্রসূত আবেগ, অনুভূতি, দুঃখ, কষ্ট কিংবা অর্জিত আনন্দের নেপথ্যের ঘটনাগুলি জানতে পারবেন, তার জীবন দর্শন ততই তীক্ষè হবে এবং লিখবার ক্ষেত্রে অজস্র বিষয়বস্তু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। এবং সেই বাস্তব বিষয়বস্তুগুলি যখন তিনি তার গল্পে প্রয়োগ করবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই গল্পগুলি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
‘কিন্তু এই যে বাস্তব জীবনবোধ, সেটি অর্জন করা যাবে কীভাবে? আর গল্পের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলি হৃদয়গ্রাহী এবং বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কী করতে হবে?’- কিছুটা চিন্তান্বিত হয়েই প্রশ্ন করলেন অনাবিল।
ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে কিছু সময় অবধি তাকিয়ে রইলেন আনোয়ার সাহেব। চিন্তা করতে থাকলেন। হাতের মধ্যে একটি কলম ছিল। কলমটি টেবিলের ওপর রেখে আবারো অনাবিলের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়া শুরু করলেন-
‘পড়তে হবে, শুধুই পড়তে হবে। মনে রাখবে, একজন লেখক কিন্তু একদিনেই লেখক হয়ে ওঠেন না। প্রথমত তিনি পাঠ করেন। অনবরত পাঠের মাধ্যমে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রকৃতি-প্রেম, তিনি ভ্রমণ করেন সমাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এভাবেই জীবনে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলিকে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে চলমান সমাজের সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেন। শনাক্তকৃত সমস্যাগুলো সমাধানের অভিপ্রায়ে এক সময় তিনি লিখতে বাধ্য হন অথবা মস্তিষ্কে স্থিত ভাবনাগুলোকে প্রকাশ না করা পর্যন্ত স্থির থাকতে পারেন না। তিনি যত বেশি পড়বেন, সমাজকে যত পরিমাণে পাঠ করতে পারবেন, দৃষ্টিভঙ্গিকে যতটা বৈশ্বিক করতে পারবেন তার লেখার বিষয়বস্তু ততই উন্নত হবে। এবং সেই বিষয়বস্তুর ওপর লিখিত গল্পের উপযোগিতা ততই বিস্তৃত হবে। সময় আসবে, সেই ধরনের লেখকের গল্প শুধু তার নিজ দেশের মধ্যেই বৃত্তাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বজুড়ে। আর পাঠ করতে করতে লেখক নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন, কীভাবে গল্প লিখতে হবে।’
‘তবুও লিখবার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে? যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন’- অনুনয়ের সাথে শুধালেন অনাবিল।
অনেক ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে আজ আনোয়ার সাহেবকে। ঢাকা থেকে পাঠানো মেজ মেয়ের উপহার দেয়া একটি ধূসর বাদামী রংয়ের কটি পড়েছেন। হালকা নীল রংয়ের শার্টটি কটির সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। লুঙ্গিটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্রায় নতুন। মুখম-লজুড়ে বিরাজ করছে সতেজতার ভাব। অনাবিলের প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার কথা বলে পাশের রুমে গেলেন আনোয়ার সাহেব। এই মুহূর্তে উত্তেজনা বোধ করছেন অনাবিল। তার উত্থিত প্রশ্নের উত্তর শুনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে আবারো চেয়ারে বসলেন আনোয়ার সাহেব। দু’হাত দিয়ে দাড়ির দু’প্রান্ত আলতো করে বুলিয়ে নিলেন। আঙ্কেলের কথা শুনবার প্রতীক্ষায় নিশ্চুপ রইলেন অনাবিল। মাথাটি চেয়ারের শীর্ষ প্রান্তে ঠেকিয়ে দিয়ে আবারো মৃদু স্বরে বলতে থাকলেন -
‘শোনো, প্রথমত, গল্পের বর্ণনা হতে হবে পোক্ত বাঁধনের, তুমি গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে কী উপস্থাপন করতে চাও পূর্বাহ্ণেই তোমার অন্তরে সেটি এঁকে নিতে হবে। এবং বর্ণনার মাঝে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে যাতে পাঠক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবার আগ্রহ খুঁজে পায়। দ্বিতীয়ত, চরিত্রটিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলবার প্রয়োজনে তার বর্ণনাটি অবশ্যই স্পষ্ট এবং সূক্ষ্ম হতে হবে। তৃতীয়ত, সংলাপ সৃষ্টি করতে অত্যন্ত সাবধানী হয়ে। যখন যেখানে যেই মুহূর্তে সংলাপের প্রয়োজন হবে তখন সেখানে সেই মুহূর্তেই সংলাপ দিতে হবে। অপ্রয়োজনে সংলাপ ব্যবহার করা যাবে না।’
স্পষ্ট ধারণা পাবার পরও কিছুটা সংকোচ জড়ানো কণ্ঠে আবারো প্রশ্ন করলেন অনাবিল-‘গল্পের আকার নিয়ে যদি কিছু বলতেন আঙ্কেল?’
মাথাটি চেয়ারের শীর্ষ প্রান্ত থেকে নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বলতে থাকলেন আনোয়ার সাহেব-‘গল্পের আকার ছোট না বড় হলো সেদিকে কখনোই দৃষ্টি দেয়া যাবে না। গল্প যে গতিতে চলবে সেভাবেই চলতে দিতে হবে। কখনোই হঠাৎ করে গতি রোধ করা যাবে না। গল্প বড় হলে পাঠক পড়বে কি পড়বে না এ ধরনের চিন্তা যদি কাজ করে তাহলে গল্প লিখবারই দরকার নেই।’
‘আমার গল্পটি যে মানসম্মত হলো সেটি বুঝতে পারবো কীভাবে? -আনোয়ার সাহেবের কথা শেষ হলে বললেন অনাবিল।
‘দেশি এবং বিদেশি সাহিত্যের ধ্রুপদী লেখকবৃন্দের গল্পগুলি পাঠ করো, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে। শোনো অনাবিল, ঘুরে ফিরে যে কথাটি বারবার বলতে হয় সেটি হলো -পড়তে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। আর একটি গ্রন্থ প্রকাশের আগে সেই গ্রন্থ যোগ্য সমালোচক দ্বারা মূল্যায়ন করে নিতে হবে। সমালোচক যদি ত্রুটি বের করেন সেটি গ্রহণ করবার মতো সামর্থ্য থাকাও জরুরি। ’ - উত্তর প্রদানে আনোয়ার সাহেবের মধ্যে স্বতস্ফূর্ততার ভাব ফটে উঠলো।
স্পষ্ট উত্তর শুনবার পর কিছু বলবার উপক্রম করতেই আনোয়ার সাহেব নিজে থেকেই আবার বললেন-‘ তা কতদিন লাগতে পারে বই প্রকাশ করতে?’
‘প্রকাশক তো বলছেন দশ দিন লাগবে। কিন্তু, আমি ধরে নিয়েছি বিশ দিন। হয়ত কমও লাগতে পারে’- হাই তুলবার পর তৃতীয় বাক্যটি উচ্চারণ করলেন অনাবিল।
‘এক মাস লাগলেও সমস্যা নেই, বেরুচ্ছে তো।’- কথা বলতে বলতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে দুজনই বারান্দার দিকে এগুতে থাকলেন।
উপন্যাস লিখবার বিষয়ে এই মুহূর্তে কোনো পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করলেন না অনাবিল। একদিন আনোয়ার সাহেব তাকে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, ন্যূনপক্ষে চল্লিশ বছর এবং পাঠের অভিজ্ঞান ঋদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে এগুনোর দরকার নেই। বরং ছোট গল্প লিখে লিখে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই হবে শ্রেয়।
টানা দু’দিনব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা শুনবার পর নিজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন অনাবিল। কক্ষে অবস্থানের সময় পড়াশুনা করবার পাশাপাশি অফিসে যখনই সময় পাচ্ছেন তখনই অধ্যয়নে ব্যাপৃত থাকবার চেষ্টা করছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পড়াশুনাই যে মূল নিয়ামক সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আনোয়ার সাহেবের বর্ণনায়। প্রতিদিন যাই পড়েন তাই নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করবার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছেন। এবং সবসময় যে বিষয়টি তাকে আনন্দ প্রদানের পাশাপাশি সর্তক করে তুলছে সেটি হলো-আনোয়ার সাহেবের গ্রন্থ দুটির সার্থক প্রকাশ। এই ভাবনাকে নিজের ভেতর গ্রন্থিত করে প্রকাশকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেই চলেছেন। ট্রেসিং, প্লেট, ছাপার কাজ যে সময়ই সম্পন্ন হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে আঙ্কেলকে জানাচ্ছেন। প্রচ্ছদ কেমন হয়েছে, পৃষ্ঠাগুলি কি মানসম্মত হয়েছে, প্রচ্ছদে বইয়ের নামটি কোন কালার দিয়ে লেখা হয়েছে ইত্যাদি অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছেন অনাবিল। এক একটি পর্যায়ের খবর শুনবার পর আঙ্কেল-এর উচ্ছ্বাস তার ভেতরের তৃপ্ততাকে কোনো দ্বিধা না রেখেই অকপটে প্রকাশ করছেন তার হাসির মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে সতের দিন পেরিয়ে গেছে। দশ দিন পেরিয়ে যাবার পর থেকেই অনাবিল প্রকাশকের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বই প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নির্ধারিত অর্থও প্রদান করেছেন। আজ কালের কথা বলে অবশেষে আঠারোতম দিনে এসে প্রকাশক নিজেই ফোন করে অনাবিলকে জানিয়েছেন কুরিয়ারে করে বই পাঠানো হয়েছে। প্রত্যাশিত সংবাদটি শুনবার পর থেকে দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত প্রশান্তি বোধ করবার পাশাপাশি পুলক বোধ করলেন আনোয়ার আঙ্কেলের কথা মনে করে। যে মানুষটি প্রতিটি মুহূর্ত ওই একটি খবর শুনবার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। একবার ভাবলেন ফোন করে জানাবেন। কিন্তু সেটি না করে সরাসরি তার বাসায় চলে গেলেন। চেয়ারে বসেই ছিলেন তিনি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অনাবিলকে দেখবার পর আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে অনাবিল যখন প্রত্যাশিত সংবাদটি তাকে জানালেন তখন চেয়ার থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। লম্বা হবার কারণে অনাবিলকে মাথা নিচু করতে হলো। অনাবিলের বুক থেকে নিজেকে মুক্ত করে উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকলেন- ‘মেনি মেনি থ্যাঙ্কস, ইয়াংম্যান. মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। আই ওয়াজ ওয়েটিং এভরি মোমেন্ট ফর হেয়ারিং দ্যাট পারটিকুলার নিউজ। রিয়ালি আই এ্যাম টোটালি ইম্প্রেসড নাউ।’ অনাবিলকে বসিয়ে রেখে বাসার সবাইকেই বিষয়টি জানিয়ে আবারো এসে চেয়ারে বসলেন। অতি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘কাল তাহলে কখন পাচ্ছি?’ প্রশ্নটি করবার পর দু’ঠোঁটের কোনায় ¯স্নিগ্ধ হাসির রেখা ফুটিয়ে যেভাবে তিনি তাকালেন অনাবিলের দিকে, তাতে মনে হলো এই প্রাপ্তিটির জন্যে তিনি কতদিন থেকে না জানি চরম ঔৎসুক্য নিয়ে তৃষিত রয়ে গেছেন।
‘আশা করছি এগারোটা থেকে একটার মধ্যেই পেয়ে যাবো।’- অত্যন্ত আস্থার সাথে জানিয়ে আরো একটি প্রশ্ন করলেন।
‘আচ্ছা আঙ্কেল, এই যে দীর্ঘদিন ধরে আপনার কোনো লেখাই প্রকাশ হয় নি এবং কোনো সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয় নি তবুও লিখে গেলেন কীভাবে বলুন তো, একটুও কষ্ট কিংবা হতাশা কি কখনো কাজ করে নি?
প্রশ্নটি শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ভাববার পর পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা অনাবিলের কাঁধের উপরে নিজের হাতটি রেখে বললেন-‘ কিছুটা খারাপ লাগা তো স্বাভাবিক, নয় কি তাই? কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে প্রকাশের বিষয়টি আর কখনোই ভাবায় নি আমাকে। মনের আনন্দে অনবরত লিখেই গিয়েছিলাম। তুমি যখন প্রকৃতই সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করবে তখন বুঝতে পারবে, বৈষয়িক কোনো কিছুই তোমার সৃষ্টির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’
‘রাষ্ট্রীয় অথবা অন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের চিন্তা কি কখনো আসে নি?’-প্রশ্নটি করবার সময় অনাবিলকে অনেক মসৃণ দেখাচ্ছিল। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সর্বোচ্চ ভঙ্গিটি তার মুখাবয়ব থেকে প্রতিফলিত হচ্ছিলো।
মাথা নিচু করা ছিলো আনোয়ার সাহেবের। বেশ কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় থাকবার পর মাথা উঁচু করে অনাবিলের দিকে তাকিয়ে অনবরত বলতে শুরু করলেন- ‘সত্যি বলতে এসব কোনো কিছুই আমাকে কখনোই ভাবায় নি। যে বিষয়টি সর্বোচ্চ মাত্রায় আমার ভাবনা জুড়ে ক্রিয়াশীল ছিল সেটি হলো-সময়। আমার সৃষ্টি যেন দীর্ঘ সময় একটি সত্তা থেকে অসংখ্য সত্তা জুড়ে বিরাজমান থেকে সেই সত্তাগুলির মূল্যবোধকে বিকশিত করতে পারে। এজন্য অতীতের কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিগুলিকে বহুবার বিশ্লেষণ করেছি এবং ভবিষ্যৎ সময়কে আমি আমার চিন্তার সর্বোচ্চ মাত্রা দিয়ে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেছি। একটি কথা মনে রাখবে-তোমার লেখা যদি উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে তবে জীবদ্দশায় কেউ মূল্যায়ন করুক বা না করুক, সময় তার প্রয়োজনেই কাল থেকে কালান্তরে সেটিকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবে। ’
প্রচ- ক্লান্ত লাগছিল অনাবিলের। ইচ্ছে করছিল আরো কিছু বিষয়ে জানবার। কিন্তু ক্লান্তির কারণে থাকতে পারছিলেন না। আনোয়ার সাহেবও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে নিজে থেকেই অনাবিলকে আজকের মতো আসতে বললেন। আঙ্কেলকে চেয়ারে বসতে বলেই যাত্রা করলেন অনাবিল।
অব্যাহতভাবে না পাবার উৎকণ্ঠা, উৎকণ্ঠার সাথে জড়িত আবেগ এবং প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসকে চিন্তাস্রোতের ভেতর একীভূত করে যদিওবা ঘুমোবার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না অনাবিল, ব্যর্থ হলেন। এই ব্যর্থতা আরেক দিক থেকে তার চিন্তারাশিতে আপনা আপনি স্থিত করে দিলো কুরিয়ারের অফিসটিকে। কখন অফিসটি খুলবে, গাড়িটি আসবে এবং গাড়িটি থেকে কাক্সিক্ষত গ্রন্থগুলি গ্রহণ করবেন তিনি। এভাবে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন, জানেন না অনাবিল। যখন ঘুমটি ভাঙলো তখন ঘড়িটি দেখেই অস্থির হয়ে উঠলেন। দশটা বেজে ইতোমধ্যেই কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। হয়ত গাড়িটি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে অফিসের সামনে। আর দেরি করলেন না অনাবিল। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে জামা কাপড় পড়ে নিয়ে যাত্রা করলেন কুরিয়ার অফিসে। এবং দ্রুতই পৌঁছে গেলেন সেখানে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনাবিলের, গাড়িটি তখনও এসে পৌঁছোয় নি। অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, আজকে বিকেলের আগে গাড়িটি আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আহত হলেন অনাবিল। এ মুহূর্তে একমাত্র অপেক্ষা করা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্পই আর নেই। কিন্তু এ অপেক্ষাটি যে কত কষ্টের, কত যন্ত্রণার তা অনাবিল ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অফিসে গিয়ে বিকেল হবার অপেক্ষা করতে থাকলেন। তিনটে বাজতেই আবারো যাত্রা করলেন কুরিয়ার অফিসের দিকে। অফিসের সামনে গাড়িটি দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলে‌ন। দাঁড়ানো গাড়ীতেই বই রয়েছে বিধায় গাড়ির সামনে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রতিটি কার্টুনের দিকে তীক্ষè দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে থাকলেন। কুলিদের কার্টুন নামাবার দৃশ্যটি আজ অন্যরকম উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। বেশ কিছু কার্টুন নামাবার পরেও যখন তার কার্টুনটি দেখতে পেলেন না তখন বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেলেন। এক পর্যায়ে একজন মজুরকে বলেই ফেললেন-‘আমার কার্টুন আছে তো?’
গামছা দ্বারা আবৃত মাথা, পেশীবহুল সুঠাম দেহের অধিকারী একজন মজুর কর্কশমাখা কণ্ঠে যা বললেন তার সারমর্ম এই যে-‘এত অস্থিরতার কিছু নেই, একটু ধৈর্য ধরুন পেয়ে যাবেন।’
মজুরের কথাগুলি শুনবার পর লজ্জা বোধ করলেন অনাবিল। এরপর কার্টুনগুলির দিকে না তাকিয়ে পাশের ফাঁকা রাস্তায় পায়চারি করতে থাকলেন। কিন্তু তার এই পায়চারির ভঙ্গিটি স্পষ্টই বলে দেয় তিনি প্রচ- আগ্রহ নিয়ে কোনোকিছুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। পায়চারির মাঝেমাঝেই গাড়িটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে চাইছেন-গাড়ির সবগুলি কার্টুন আনলোড করা হয়েছে কিনা। পায়চারি থেমে থাকলো না। এই পায়চারির মধ্যেই সংশ্লিষ্ট কুরিয়ারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি অনাবিল আহমেদের নামটি ধরে ডাকলেন। এরপর কার্টুনগুলি দুটি রিকশাতে তুলে নিয়ে নিজে অন্য একটি রিকশায় যাত্রা করলেন আঙ্কেলের বাসার দিকে। ইতোমধ্যে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। আকাশেও নেই কোনো তারার আলো- যেহেতু আকাশটি সম্পূর্ণই মেঘাচ্ছন্ন। কিছু সময়ের মধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়বার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। কিছুদূর আসবার পর টিপ টিপ করে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করেছে। অনাবিলের আশঙ্কা কার্টুনের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে ফোঁটাযুক্ত অংশটি কার্টুনের মূল রং থেকে ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। সেদিকে তাকিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন অনাবিল। কার্টুনের ওজন স্বাভাবিকতার তুলনায় অতিরিক্ত হবার কারণে রিকশার গতিও মন্থর হয়ে পড়েছে। মানবিক কারণ বিবেচনায় জোরে চালাতে বলতেও পারছেন না। উপায়হীনভাবে শুধুই কার্টুনগুলির দিকে তাকাতে থাকলেন। অনুমিত সময় থেকে বেশি সময় নিয়ে অবশেষে বাসার একেবারে বারান্দার সামনে এসে পৌঁছলো রিকশা। বইগুলি রিকশাতেই রইলো। যথেষ্ট প্রসন্নতার সাথে নির্ভারতার একটি পৃথক সুখবোধ অনুভব করলেন অনাবিল।
রিকশা থেকে নেমেই তার দৃষ্টি পড়লো শেফালী ফুলের গাছটির দিকে। সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। দু’একটি করে শেফালী ফুলও ফুটতে শুরু করেছে। প্রস্ফুটিত ফুলগুলি দেখবার পর অনাবিলের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সাদা পাপড়ির মাঝখানে হলুদ কুঁড়িটি ফুলগুলির সৌন্দর্যকে মোহনীয় মাত্রায় শোভনীয় করে তুলেছে। শেফালীর অভূতপূর্ব স্নিগ্ধ সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ডান হাতের প্রায় সবকটি আঙ্গুল দ্বারা ফুলগুলিকে একবার স্পর্শ করলেন অনাবিল। অতঃপর মাথা নিচু করে প্রস্ফুটিত ফুলগুলি প্রাণভরে দেখবার সাথে সুঘ্রাণও গ্রহণ করবার চেষ্টা করলেন।
আনোয়ার সাহেবের বাড়ির প্রথম কক্ষটিই ড্রইংরুম। রুমের দরোজাটি খোলা। ভেতরে অনেক লোকের সমাবেশ। চাপা কথাবার্তা, মাঝে মাঝে নারীদের চাপা কান্নার শব্দ অনাবিলের শ্রবণে এসে আঘাত করছে। ভাবতে পারছেন না অনাবিল কী ঘটেছে আঙ্কেলের বাসায়। আর কাল বিলম্ব না করে দ্রুত ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই চমকে উঠে দু’পা পিছিয়ে আসলেন। লক্ষ করলেন, ড্রইং রুমের ঠিক মাঝখানে একটি স্ট্রেচারে দুগ্ধ ফেননিভ সাদা চাদরে আবৃত হয়ত কোনো ব্যক্তির লাশ। এবার আঁতকে উঠলেন অনাবিল। লাশটি আঙ্কেলের নয়তো! ভাবতে থাকলেন-দুপুরেও তো কথা হলো। ওনার কথায় তো কোনোকিছুর ইঙ্গিত অনুভব করা গেল না। অথচ এখন মনে হচ্ছে সেটিই ঘটে গেছে। চরম আতঙ্ক আর প্রবল উত্তেজনা অনুভব করতে থাকলেন নিজের মধ্যে। সামনে এগিয়ে গিয়ে কাউকে কিছু না বলে চাদরের একটি অংশ সরালেন। দেখলেন তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটেছে-লাশটি আঙ্কেলের। সেই মুখ, সেই নাক, সেই প্রশস্ত ললাট, সেই ঠোঁট-সেই ঠোঁটে পূর্বের মতো হাসিটি যেন লেগেই রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি এইমাত্র ঘুমিয়েছেন। চোখ দুটি মুদিত। হয়ত এখনই তিনি চোখ মেলে জেগে উঠবেন। আর সহ্য করতে পারলো না অনাবিল। চোখ দিয়ে অবিরল পানি ঝরতে শুরু করলো। অনাবিলকে দেখে বাড়ীর সবাই বিশেষত তার স্ত্রী এবং কন্যাদের কান্নার মাত্রা যেন তিন চার গুণ বেড়ে গেল। ওদের মুখে কোনো কথা নেই। শুধু জ্যোষ্ঠ কন্যাটি একটি কথাই উচ্চারণ করলো, বললো- ‘তোমার আঙ্কেল আর নেই, অনাবিল। আর কার কাছে আসবে তুমি?’ সহ্য করতে পারলো না অনাবিল। ঝরঝর করে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। কেউই চিরদিন থাকে না। কাউকেই চিরদিন ধরে রাখা যায় না।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসছে। এখন হয়ত আঙ্কেলের লাশটিকে দাফনের জন্যে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। বৃষ্টির তীব্রতা কমলেও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। টিপটিপে বৃষ্টিতেই লাশটিকে যখন বের করা হলো তখন বারান্দার সামনেই শেফালী গাছটির নীচেই আনোয়ার হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের কার্টুনগুলিও ভিজছে। গ্রন্থের কার্টুনগুলির দিকে তাকিয়ে অনাবিলের হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, যিনি এই গ্রন্থের রচয়িতা সেই আনোয়ার হোসেনের লাশটি বৃষ্টিতে যেমন ভিজছে ঠিকই একইভাবে তার সৃষ্টিও যেন ভিজে যাচ্ছে। এই দুটি বিষয়ের সাথে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার যে এক অদ্ভুত সমন্বয় এটি বোধকরি আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইতিহাস হয়ে থাকবে। এর মধ্যেই লাশটি নিয়ে সবাই যাত্রা করলেন কবরস্থানের দিকে। পেছনে পড়ে রইলো শুধু হাহাকার আর স্মৃতির অফুরন্ত ভা-ার।
এক সময় দাফন শেষ হয়ে গেল। সবাই তার আত্মার শান্তি কামনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মোনাজাত করলেন। এরপর এক এক করে সবাই চলে যেতে থাকলেন, চলেও গেলেন একসময় সবাই। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো অনাবিল। এক সমুদ্র অশ্রু চোখে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আঙ্কেলের কবরের কাছে। আঙ্কেলের মৃত্যুর বেদনা যেন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে সিক্ত করতে থাকলো তাকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি শেফালীর অভূতপূর্ব স্নিগ্ধ সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ডান হাতের প্রায় সবকটি আঙ্গুল দ্বারা ফুলগুলিকে একবার স্পর্শ করলেন অনাবিল। অতঃপর মাথা নিচু করে প্রস্ফুটিত ফুলগুলি প্রাণভরে দেখবার সাথে সুঘ্রাণও গ্রহণ করবার চেষ্টা করলেন।......// পড়তে হবে,পড়ার কোন বিকল্প নেই....খুবভালো গল্প....শুভ কামনা রইলো, সেই সঙ্গে পাতায় আমন্ত্রণ....
ওয়াহিদ মামুন লাভলু কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না, কাউকে চিরদিন ধরে রাখা যায় না ঠিকই কিন্তু কাউকে শেষ বিদায় জানানোটা খুবই যন্ত্রণার। চমৎকার লেখনী। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন। শুভেচ্ছা রইলো। ভাল থাকবেন।
নূরনবী সোহাগ ভাল লেখা বলে পাঠে ধৈর্য হারা হইনি। ভোট রইল
Farhana Shormin ভাল লাগল। ধন্যবাদ
মাইনুল ইসলাম আলিফ গল্প আর কবিতা লেখার সুন্দর কিছু উপদেশ, বই পড়ার যে কোন বিকল্প নেই সে বিষয়ে জোর গলায় বলা কথাটাই এ গল্পে গুরুত্বপূর্ণ।লেখক তার সৃষ্টি কে দেখে যে কি আনন্দ পান তা শুধু লেখক নিজেই জানেন।শুভ কামনা।আমার গল্পে আমন্ত্রণ।
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া বেশ ভালো লাগল... ধন্যবাদ...
সাইয়িদ রফিকুল হক ভালোলাগা রইলো। তবে কিছু বিষয়ে কথা ছিল। কখনও দেখা হলে বলবো। এখানে, এতো কথা লিখে বোঝানো কষ্টকর। শুভকামনা রইলো।
সাদিক ইসলাম অনেক ভালো লাগলো। চালিয়ে যান। শুভো কামনা।
প্রজ্ঞা মৌসুমী পড়ার পর মনে হচ্ছে 'খাঁটি গদ্য' পড়লাম। শুরুতে মন বসাতে পারছিলাম না কিন্তু তন্ময় হয়ে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা পড়েছি। উপন্যাসের জন্য চল্লিশ বছর এই সীমাবদ্ধতা মানতে পারি নি। The sun also rises, the god of small things, the kite runner, বিরাজবৌ, কপালকুণ্ডলা, দুর্গেশনন্দিনী এইসব অসাধারণ উপন্যাসগুলো তো প্রকাশ হয়েছে চল্লিশের আগে। লেখক যদি মনে করেন তিনি প্রস্তুত তবে যে কোন বয়সেই শুরু করা যায়। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে, যারা জীবনের অনেকটা সময় কাগজে লেখে, সত্তর বছরে কম্পিউটার লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না সচরাচর। অবশ্য আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। মিস করছিলাম সত্তর বছর একজন লেখকের একটা চশমা। চশমার কথা কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। শেষে চিন্তা হচ্ছিল আনোয়ার সাহেব শেষ পর্যন্ত নিজের বই দেখে যেতে পারবেন কি... পরিনতি বেশ ভালো লেগেছে। শেফালী ফুল, বই আর লাশের উপর বৃষ্টি ঝরে যাওয়া ক্রিয়েটিভ ছিল। কাক্সিক্ষত শব্দের মানেটা জানলাম আপনার গল্পের সুবাদে। অনেক শুভ কামনা
01. Apnar sathe ami puropuri akmot. Gorky, Tolstoy, chekov, dickens soho onekei 30 er niche novel likhechen abong bikkhato hoechen. ekhane boyoser bisoyti shudhumatro anabiler khetre bojhano hoeche. Anwar hossain onabiler porasuna abong oviggota protokkho korbar por tar uddesshe bolechen je tar 40 bochor na perule abong porasunar bapti govir na hole uponnas lekhar dorkar nei. Ar anwar saheb chaichilen anabil preparation nie uponnas likhuk. eti sobar jonno noi. 02. chamsar bisoyti hoyto apnar dristi erie geche-মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল লেন্সের চশমা পড়েন তিনি সবসময়ই। 03. Apnake dhonnobad jananor vasha amar jana nei. Ato oshadhoronvabe apni bisleson korechen sotti ovutopurbo. Sotti onek kritoggota roilo apnar proti.Apnar jonno roilo onek onke suvo kamona. Valo thakben nirontor.
মোঃ মোখলেছুর রহমান কয়েকটি গল্প পড়ে শেষ করেছি,তার মধ্যে এটি একটি,আপনার পাতায় যাব যাব করে সময় খুজছি,ইতোমধ্যে আপনি আমার পাতায় চলে এলেন,এ জন্য রইল ধন্যবাদ,যাহোক প্রথমে ভেবেছিলাম অনাবিল-ই নায়ক,কিন্তু পরবর্তি ঘটনা গুলো আনোয়ার সাহেবকে নিয়ে,তার লেখক জীবনে ট্রাজেডী সত্যি বেদনাদায়ক।এমন অনেক প্রতিভাবান লেখক এখনো বাংলাদেশে জীবিত আছে। শুভকামনা রইল।

২৯ অক্টোবর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী