এক কাপ চা

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

জোহরা উম্মে হাসান
  • ১৩
এক
আরধ্য এক কাপ চায়ের জন্য কোন কোন দিন অপেক্ষা করতে হয় সকাল দশটা অবধি।এর পর আবার বিকেলের ফিরিস্তি ।
বাড়ীর সবাই চা নাস্তা খায় এবং তা সকাল সকালই । কিন্তু কারো যেন বাড়ীর বয়স্ক মানুষটাকে সময়মত চা দেয়ার কথা একেবারেই মনে থাকে না ।
এ বাড়ীর একমাত্র ছেলের বউ ফারজানা হক ওরফে রিনি , যাকে তিনি আর তাঁর মৃতা স্ত্রী হাবিবা বানু অনেক ধুমধাম করে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলে এনেছিলেন অনেক বছর আগে , সে যেন এখন আর আগের মতো নেই । অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাঁর । শ্বশুর নামে যে একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ থাকে বাড়ীতে তা সে যেন প্রায়শঃ ভুলে যায় । শ্বশুরের দেখাশুনার ভার রইসার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকে সে ।তবে রইসার সেবা যত্নে কোন ত্রুটি নেই । হবেই বা কেন ! রইসাকে নিজের মেয়ের মতো করেই লালন পালন করেছেন শেখ বোরহান উদ্দীন আর তাঁর স্ত্রী ।
কোন কোন দিন কাজের চাপে রইসার চা আনতে দেরী হলে সারা দিনটাই বাজে কাটবে বলে মনে হয় বোরহান উদ্দীনের । তবে এ ব্যাপারে রইসার যে কোন দোষ নেই তা খুব ভালো করেই জানেন তিনি । মেয়েটি তাঁকে বাবার মতোই ভালবাসে । তাঁর যত্ন-আত্নি করতে পারলে এ বাড়ীতে সেইই সবচেয়ে বেশী খুশী হয় । কিন্তু তাতো সব সময় হবার জো নেই । তাকে চলতে হয় ছেলের বউ রিনির হুকুম মতো। পান থেকে চুন খসলে বৌমার মেজাজ যায় চড়ে ।


দুই
ইদানীং ছেলে আর ছেলে বউয়ের ভাবসাব দেখলে বোরহান উদ্দীনের কেন জানি মনে হয় , তাঁরা বড় বেশী আপদ বালাই মনে করছে তাঁকে । যা ভরসা ঐ এক রইসা আর তাঁর স্বামী আক্কাস আলী ।
রইসা বেশ বুদ্ধিমান আর সংবেদনশীল মেয়ে। শেখ বোরহান উদ্দীন আর তাঁর স্ত্রী হাবিবা বানু এই মেয়েটিকে তাদের বড় ছেলে ফারদিন জন্মাবার পর পরই দেশের বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছিলেন ।তখন রইসার বয়স কত ? বড় জোর নয় কিংবা দশ ! সেই ছোটবেলা থেকেই সে নিপুনভাবে এ বাড়ীটাকে আগলিয়ে রাখতে প্রতি পদে পদে হাবিবাকে সাহায্য করেছে। ফারদিনের দুধ খাওয়া থেকে শুরু করে তাকে গোসল করানো , কাপড় পড়ানো , এদিক ওদিক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো
এসব দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছে সে ।
ফারদিনের বয়স যখন সাত কিংবা আট , তখন রইসার বিয়ে ঠিক হয় তাঁদেরই গ্রামের এক সৎ চরিত্রবান যুবক আক্কাস আলীর সাথে । হাবিবা নিজেই এ বিয়ে ঠিক করেছিলেন । সে কতকাল আগের কথা । শেখ বোরহান উদ্দীনের স্পষ্ট মনে আছে সেসব দিনের কথা । রইসার জন্য একসেট সোনার গয়না গড়ানো হয়েছিল । শাড়ী , ব্লাউস আরও অন্যান্য টুকিটাকি কিনে কিনে হাবিবা বানু মস্ত এক ট্রাঙ্ক ভরিয়ে ফেলেছিলেন প্রায় ! ফারদিন রইসার বিয়ের দিন সেই যে সেজেগুঁজে তার পাশে বসেছিল , সেখান থেকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছিল না তাকে । যা হোক রইসার গরীব বাবা মা মেয়ের বিয়েতে খুব খুশী হয়েছিলেন! রইসা নিজেও !
বিয়ের পরপরই শেখ বোরহান উদ্দীন রইসার স্বামী আক্কাস আলীর জন্য একটা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে করণিক এর চাকরি ঠিক করে দিয়েছিলেন । বিয়ের সময় কেবলমাত্র এই একটি শর্তই ছিল আক্কাস আলীর গরীব বাপ মায়ের ।
বিয়ের পর আক্কাস আলী একটা ছোট খাটো ঘর ভাড়া নিয়ে আলাদাভাবে সংসার করতে চেয়েছে অনেকবার । কার না আর সখ হয় ইচ্ছে মতো নিজের ঘর -সংসার করার । কিন্তু রইসার সেই এক কথা । সে গেলে এখানে সবার অসুবিধা হবে আর ভাইয়াকে কেইবা সামলাবে ?
কষ্ট হবে বটে কিন্তু তা সাময়িক আর সব কিছুই একদিন তো ঠিকও হয়ে যাবে- এসব কথা বলে বলে বোরহান উদ্দীন আর হাবিবা রইসাকে বুঝিয়েছেনও হাজার বার । শেষে এও বলেছেন , তাঁর শ্বশুর বাড়ীর লোকজন বিষয়টা হয়তো ভাল চোখে দেখবে না । জামাইও গাল মন্দ করতে পারে । কিন্তু কে শোনে কার কথা । শেষমেশ সবার উপর দিয়ে রইসারই জয় হয়েছে । তাঁর একনিষ্ঠ স্বামী আক্কাস আলী এসব মেনে নিয়েই এ বাড়ীতে আপন লোকের মতো বহু বছর হয় একসাথে বসবাস করছে ।
তবে স্ত্রী হাবিবার পীড়াপীড়িতে রইসা আর তাঁর স্বামীর থাকবার জন্য বাড়ীর নীচ তলার এক কোনে পাঁচ ইঞ্চি গাঁথনি আর উপরে টিন শেড দিয়ে দু রুমের একটা ছোট্ট আবাস বানিয়ে দিয়েছেন বোরহান উদ্দীন ।এর অনেকদিন পর রইসা আর আক্কাস আলীর একটা মেয়েও হয়েছে যাকে বোরহান উদ্দীন আর হাবিবা যথারীতি সুপাত্রে অর্পণও করেছেন । এই হোল রইসা আর আক্কাস আলীর আখ্যান !

তিন
ফারদিনের বিয়ের প্রথম প্রথম রিনি নিজেকে রইসা আর আক্কাস আলীর সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল । বড় চালাক মেয়ে সে । সে বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল শ্বশুর আর শাশুড়ির মনের খবর । এ ছাড়া তাঁর স্বামী ডঃ ফারদিনও ওদেরকে খুব পছন্দ করতো ।
কিন্তু সবদিন তো আর সমান যায় না । তাই অনেক উল্টা -পাল্টা ঘটনার সাক্ষী হয়ে পড়ে রইলেন শেখ বোরহান উদ্দীন ঠিক তার প্রিয়তমা স্ত্রী হাবিবা বানুর ইন্তেকালের পর পরই । দিন কয়েক বাদে একমাত্র ছেলের বউ হয়ে গেল এ সংসারের মধ্যমনি । আর এতেই পালটে গেল , পালটিয়ে গেল অনেক কিছুই । যেন খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকলো এ সংসারের মানুষগুলির আচার আচরণ আর পারস্পরিক সম্পর্কবোধ । ভাললাগা আর ভালবাসা সব , সব কিছু । একটা মানুষ চলে গেলেই কি সব এমনভাবে এলোমেলো হয়ে যায় । ক্লান্ত , শ্রান্ত , অবসন্ন বোরহান উদ্দীন নামের একাকী মানুষটি এসবই দিনমান ভাবেন । আর ভেবে ভেবে কোনই কূল কিনারা পান না !
তবে প্রথম প্রথম রিনির এ পরিবর্তনে ভীষণ অবাক হতেন তিনি । বিশ্বাসও হতে চাইতো না । মনে হতো তাঁর নিজেরই বুঝবার ভুল । কিন্তু বিভিন্ন ধরণের উদ্ভট উদ্ভট কর্মকাণ্ড যখন পালাক্রমে ঘটতেই থাকল , তখন বোরহান উদ্দীন ঠিকই বুঝে ফেললেন যে , এখন থেকে এমনই হবে । এটাই রীতি !নিয়ম !
এই যেমন , আগে দিনের বেলায় না হোক অন্ততঃ রাতের বেলায় এ বাড়ীর সব মানুষগুলো ডাইনিং টেবিলে একটা নিদিষ্ট সময়ে জড়ো হতো । সবার পানাহার আর কল-কাকলিতে ভরে যেত গোটা বাড়ীটা । এখন আর বোরহান উদ্দীনকে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খাবার খেতে বলা হয় না । বেলাবেলি তাঁর রাতের খাবার ঘরে এসে দিয়ে যায় রইসা । এটা নাকি ভাবীর হুকুম । বাবার শরীর ভাল না, তাঁকে আর কষ্ট করে এখানে আসবার দরকার নেই , এই আর কি ! আর তাছাড়া সবার খাবারের সময়েরও নাকি ঠিক-ঠিকানা নেই তাই !
তা হোক । একসঙ্গে পরেই না হয় খাওয়া যাবে বলে , বেশ কয়েকদিন বোরহান উদ্দীন তাঁর পাঠানো খাবার ফেরতও পাঠিয়েছিলেন । শেষমেশ তাঁর নিজের ছেলেই একদিন তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে রিনির কথা মতোই চলতে । আর বয়সী মানুষদের একটু অন্যভাবে চলতেই হয় ! নিয়ম মেনে ! বোরহান উদ্দীন ভেবে পান না এই কয়েক বছরে হঠাৎ করে কি তাঁর বয়স একবারে ষাট থেকে নব্বই হয়ে গেল , যে তাঁর ইচ্ছে মতো চলা বারণ , খাওয়া দাওয়া বারণ , বলা বারণ । আরও কত কি !
মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি , ছেলের এসব কথায় । তার নিজের ছেলে যখন বুঝতে পারলো না তার মনোবেদনার কারণ তখন পরের মেয়েকে আর দোষ দিয়ে কিইবা লাভ ! সেই থেকে নিজের ঘরেই দিন রাতের এমনকি সকাল বেলারও আহার সারেন তিনি । তাই এ বাড়ীর মানুষগুলোর সাথে বোরহান উদ্দীনের দেখা হয় কালেভদ্রে !
চার
শেখ বোরহান উদ্দীনের দুই নাতি । দুজনই নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে লেখা পড়া করে এবং তাঁরা তাদের বাবার মতোই মেধাবী । এতে দারুন গর্ব হয় তাঁর । কিন্তু সেই নাতিদের সাথে তার দেখাই বা হয় কই ? সারাদিন পড়ালেখা আর ল্যাবটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা । ঈদ কিনবা অন্য কোন বড় অনুষ্ঠান ছাড়া তাঁদের দেখা মেলাই ভার ।
আর বোরহান উদ্দীনের নিজের ছেলে ? সেও তো সারাদিন ব্যস্ত থাকে তার ডাক্তারি পেশা নিয়ে । মস্ত বড় চিকিৎসক হিসেবে সুনাম হয়েছে তাঁর দেশে বিদেশে । আফসোস তাঁর মা-ই কেবল এর সবটা দেখে যেতে পারলো না ! এমন ব্যতিব্যস্ত ছেলেকে স্বাভাবিকভাবে অনেক রাতেই কাজ সেরে ঘরে ফিরতে হয় । তাই বাবার খোঁজ খবর নেয়ার সময় সে কোথায় পায় । তাঁকে তেমন দোষ দেন না বোরহান উদ্দীন !
বউমাও সারাদিন ব্যস্ত থাকে বন্ধু বান্ধব আর আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে । কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে আলাপ করতে করতে একেবারে কাহিল হয়ে পড়ে সে । কানাডায় তাঁর ছোট বোন থাকে । ওদের সাথে স্কাইপ এ আলাপ করতে বসলে কোন কোন সময় পুরোটা দিনটাই প্রায় চলে যায় ! আবার মাঝে মধ্যে সে তাঁর স্বামীর ঢাউস গাড়ীটায় চড়ে শপিং এ যায় । গুলশান , বনানী মায় উত্তরা পর্যন্ত । স্বামী আর ছেলে পুলের কেনা-কাটার সব কিছুর দায়িত্ব তাঁর মাথার উপর । অনেক সময় সে কাঁচা বাজারও করে - এই যেমন অগোরা , মীনা কিংবা নন্দন থেকে, ওসব স্টোরে মনমতো হরেক রকম সবজী , ফল মূল ইত্যাদি পাওয়া যায় । ফারদিন ইদানীং সবজীর দিকে ঝুঁকেছে । বয়স বাড়লে তাইই নাকি নিয়ম । কিন্তু বোরহান উদ্দীনের সব সময় এতসব সবজী খেতে ভাল লাগে না । এটা নিয়েও মন খারাপও করেন তিনি । তবে রইসা এসব সামলিয়ে নেয় । নিশ্চয়ই সব কথা সে তার ভাবীজানকে খুলে বলে না ! বললে কি হতো তা ভেবে পান না বোরহান উদ্দীন । তাঁর খাবারই কি বন্ধ হয়ে যেত ? নাহ , তিনি মিছেমিছি এতদূর ভাবছেন । তাই , তাই কি হতে পারে কোনদিন ?
এ বাড়ীর বাড়তি টুকটাক কেনা কাটার ভার আক্কাস আলীর । আর রইসার দায়িত্ব পুরো সংসারের রান্নাবান্না সামলানোর । এদের কল্যাণে বোরহান উদ্দীনের কপালে পছন্দসই এটা ওটা খাবার তবু জোটে । নিজে তো আর এই বয়সে বাজারে যেতে পারেন না ।
সপ্তাহে চারদিন মর্নিং ওয়াক করেন বোরহান উদ্দীন । ডাক্তারের নির্দেশ । হাই প্রেসার আর সুগারের রুগী তিনি । তাঁকে এটা নিয়ম করে মানতেই হয় । হাঁটার সময় প্রতিদিন আক্কাস আলী তার সংগে সংগে যায় । তখন বোরহান উদ্দীন তার সংগে মন খুলে দুনিয়ার যত কথা বলতে থাকেন । আক্কাস আলী বুঝুক আর না বুঝুক রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজনীতি এসব কিছুই বাদ যায় না । মনটা তখন তাঁর খুব হালকা হয় ! আক্কাস আলীকে সে সময়ে একেবারে নিজের কাছের মানুষ বলে মনে হয় বোরহান উদ্দীনের!
ইদানীং রইসার হাঁটুর ব্যথাটা বেড়ে যাওয়ায় সে একাকী সব কাজ আর আগের মত করতে পারে না । তাঁকে টুকটাক কাজে সাহায্য করার জন্য রিনি কয়েক মাস হয় তাঁর বাপের বাড়ী থেকে আবেদা নামে একটা উঠতি বয়সের মেয়ে নিয়ে এসেছে । তবে আবেদা রইসার মতো নয় । সুযোগ পেলেই সে তাঁর মায়ের বয়সী রইসার সাথে ঝগড়া-ঝাটি জুড়ে দেয় । আর নিজেই গিয়ে রইসার বিরুদ্ধে নালিস করে রিনির কাছে । যেহেতু আবেদা রিনির দেশের মেয়ে , তাই এ মেয়েটির উপর তাঁর পক্ষপাতিত্ব অনেকটাই বেশী । বোরহান উদ্দীনের বড় ভয় , এই মেয়েটি তো আবার তাঁর নামে এটা ওটা কথা রিনিকে গিয়ে বলেনা ?
পাঁচ
যা হোক , এ বাড়ীতে রইসাই কেবল শেখ বোরহান উদ্দীনের মনের মতো করে চা তৈরি করতে পারে । বাড়ীর সবাই ইদানীং হাল্কা লিকারে দুধ ছাড়া চা খায় । কোন কোন সময় টি ব্যাগে গ্রীন টি । তুলসী টি । আরও কত কি ! ব্লাক কফি । ক্যাপিচিনো এসবও তাদের প্রিয়! এসব নাকি স্বাস্থ্যসন্মত ! শরীরে কোন বাড়তি মেদ জন্মাতে দেয় না ! আর মনও নাকি থাকে ফুরফুরে ।
আগে ফারদিনেরও তাঁর বাবার মতো দুধ চা খুব প্রিয় ছিল । কড়া লিকার আর দুধে ভরা সেই চা । প্রত্যেক সকালে বাবা আর ছেলের জন্য একই পদ্ধতিতে দুধ চা তৈরী করতো রইসা । বিকেলে কেবল বোরহান উদ্দীনের জন্য !
তবে সেই চা তৈরি যে সে কাজ ছিল না ! প্রথমে সের দুই দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে তা ক্ষীরের মতো ঘন করতে হতো । তারপর চুলোয় দুই কাপ চায়ের জন্য দশ কাপ পানি বসিয়ে তা ফুটিয়ে ফুটিয়ে কম করে ফেলতে ফেলতে যখন তা হয়ে দাঁড়াতো প্রায় পাঁচ কাপ পরিমান , তখন তাতে চায়ের খুচরো লিকার ঢালতে হতো । তবে যে সে লিকার নয় । একবারে খাঁটি ইন্সপাহানী লেবেল টি । এরপর ফুটে ফুটে সেই চা যখন আড়াই কাপ পরিমান গিয়ে দাঁড়াত, তখন তাতে সেই ঘন দুধ থেকে পাক্কা এক কাপ দুধ ঢালা আরম্ভ হতো । আর এ সময়টা খুব সাঙ্ঘাতিক । চায়ের কেতলির কাছে দাঁড়িয়ে বিশাল এক চামচ নিয়ে ঘন ঘন নাড়া না দিলে সব চা কেতলি গড়িয়ে উথলে পড়বে নির্ঘাত নীচে, চুলোর গায়ে ।
কদিন আগেও বাবা আর ছেলের জন্য সকালের চা চড়িয়ে অন্য কোন কাজে যাওয়া চলতো না রইসার । কিন্তু এখন দিন পালটিয়েছে । হাই কোলস্টরোল এর ভয়ে দুধ চা খাওয়া বেশ কিছুদিন আগে ছেড়ে দিয়েছে ফারদিন । সুগারও । চিনি নাকি গুপ্ত ঘাতক ! মাঝে মধ্যে নন ফ্যাট দুধে সে চা খায় বটে । কিন্তু খুব হাল্কা ! স্ত্রী আর দু ছেলের চাপে সেই হাল্কা দুধ চা ছেড়ে সেও ইদানীং শুধু লিকার চা ধরেছে !
তো ওরা খায় খাক । শেখ বোরহান উদ্দীন তার পুরনো অভ্যাস কিছুতেই পালটাবেন না বলেই যেন প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন । আসলে এই বিশেষ ধরণের চা বানানোর সাথে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর অনেক স্মৃতি যেন জড়িয়ে আছে । এমন মন ভোলানো এক কাপ চা পেয়ে কতদিন যে তিনি তার স্ত্রীর সুন্দর গালদুটো ভালবাসার আলতো ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন , তা আর গুনে শেষ করা যাবে না ।
হাবিবা বানু যতদিন বেঁচে ছিলেন , তিনি নিজেই স্বামী আর ছেলের জন্য দু বেলা চা বানিয়েছেন । বন্দের দিনগুলোতে কাপের সংখ্যা যেত পত পত করে বেড়ে। শেখ বোরহান উদ্দীন তাঁর বন্ধুদের এই বিশেষ চা পান করার জন্য প্রায়শঃ দাওয়াত দিতেন । আর তাঁরা স্বভাবতই এই চা খেয়ে হাবিবা বানুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেত । সেই মুখচোরা ছেলেটাও মাঝে মধ্যে তাঁর বন্ধুদের নিয়ে এসে মার হাতের তৈরী সেই মহাস্বাদের চা খাওয়াতো ! কিন্ত এ সব কথা এখন বোধহয় একবারেই ভুলে গেছে সে । আর তা ভাবতে গিয়ে অজান্তে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে আসে বোরহান উদ্দীনের বুক বেয়ে !
এখন সব হিসেবই অন্যরকম , জানেন বোরহান উদ্দীন ! তার বউমা যা বলবে সেই হিসেবেই চলছে আর চলবে এই সংসার ! তাই যখন শুনতে পেলেন , এ বাড়ীতে এখন থেকে দুধ চা বন্দ , তখন ভয়ানক দুঃখ পেলেন তিনি । বউমার এহেন বিবেচনাহীন আচরণের কথা ভেবে খুব অবাকও হলেন ।গতকাল রইসা এসে চুপি চুপি তাঁকে জানিয়ে গেছে সেই অকল্পনীয় কথাটা।
বউমার কাছে বিষয়টা হয়তো সামান্য হতে পারে । একেবারেই গুরুত্বহীন । কিন্তু তার কাছে ? একবারই কি সে এ বিষয়টা নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করতে পারলো না ?কিন্তু কি নিদারুন দুঃখই না পেলেন বোরহান উদ্দীন আচমকা এ কথাটা শুনে । কি মনে করেছে তাঁকে বাড়ীর সবাই ? তার কি কোন ইচ্ছে , অনিচ্ছে থাকতে নেই ! একে একে সব ইচ্ছে আর ভাল-মন্দের হিসেব বাদ দিয়ে তিনি তো চলছেনই এদের মত করে । এদের ইচ্ছে অনিচ্ছেকেই মুল্য দিয়ে । কিন্তু তার সেই স্পেশাল চা বন্দ , তা যেন ভাবতেই পারেন না তিনি ! সামান্য এক কাপ চা !
বন্ধ ! কেননা বউমার হুকুম । বাবা মানে বোরহান উদ্দীনের উচ্চ রক্তচাপ, সুগার । তাই এসব চলবে না । ডাক্তারের বারণ । কিন্তু কোন ডাক্তারের , তাও ঠিক মতো জানেও না কেউই । সুগার সুগার করে চিনি মিষ্টি এসব সাধের খানাপিনা অনেক দিন আগেই তো বর্জন করেছেন বোরহান উদ্দীন । সেই সাথে রেড মিটও ! কিন্তু একটু ঘন দুধ দিয়ে চা বানিয়ে খেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে , তা যেন এক্ষণে বুঝেও বুঝে উঠলেন না তিনি ।

ছয়
অনেক আগের বনেদী সেই রাগটা যেন মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো বোরহান উদ্দীনের । ইচ্ছে হোল সব লন্ড ভণ্ড করে দিতে এক নিমিষেই । কিন্তু পারলেন না। আগেও যেমন পারেন নি ! দেয়ালে টাঙ্গানো হাবিবা বানুর সেই কতকাল আগের ছবিটা , আর তাঁর সাথে লেপটানো ফারদিন এর সরল কচি মুখটা তাঁকে যত রাগ , ক্রোধ আর অভিমান থেকে দূরে রাখার জন্য বোধহয় চিরদিনের জন্য ফন্দি এঁটে রেখেছে । আগের মতো এবারের পারলেন না তিনি । এবারেও হার হোল তার !
কিন্তু একথা কেনই বা বলল বৌমা ! তাঁর তো না জানার কথা নয় , এখন তাঁর জন্য যে দুধ চা বানানো হয় , তা আগের নিয়মে নয় । পাতিলে প্রথমে চায়ের লিকার ছেড়ে দিয়ে তা কিছুটা ঘন হয়ে এলে তাতে কৌটার গুলানো দুধ ঢেলে দেয় রইসা কোনমতে । এই তো । কিন্তু এ চা খেলে কি এমন মহা দুর্ঘটনা ঘটবে তাঁর শরীরের তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না বোরহান উদ্দীন ! তবে ঠিক ঠিকই যেন বুঝতে পেরেছেন এটা বৌমার অর্ডার আর তা এক বিন্দুও নড়চড় করা কার সাধ্য !
দুধ চা আর চলবে না , এই কথাটা রইসার মুখ থেকে শোনার পর বোরহান উদ্দীনের ঘুম গেছে যেন হারাম হয়ে । যতই নিজেকে বোঝান, দোহাই দেন স্ত্রী আর ছেলের সেই ছবির , কিন্তু কিছুতেই মন প্রবোধ মানে না ! রাগ , ক্রোধ , অভিমান এসব যেন সব ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলতে থাকে তাঁকে । এত সামান্য কথা হয়তো কাউকে বলা যায় না । কারো সাথে ভাগাভাগি করাও যায় না । কিন্তু বোরহান উদ্দীনের মনে হচ্ছে ভয়ানক , অতি ভয়ানক কোন কথা শুনতে পেরেছেন তিনি । যা তাঁর অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে মহা সংকটে ফেলে দিচ্ছে !
অনেকক্ষণ ধরে ভাবছেন তিনি। এই তুচ্ছ অথচ তাঁর জীবনের যেন মহা গুরুত্বপূর্ণ কথাটা ছেলেকে জানাবেন কি না । কিন্তু তেমন কিছু করতে পারবে কি সে? বাবার মনোবেদনার কারণ বুঝে উঠবে পারবে কি সে ? বরঞ্চ যদি বলেই উঠে- ভালই তো , খুব ভাল পেসক্রিশসন দিয়েছে রিনি , এবার থেকে তোমার শরীর আরও ভালো থাকবে । আচ্ছা এক কাপ দুধ চার শক্তি কি এতই প্রবল ? নিজেকে বারে বারে এ প্রশ্নটা কোরে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকেন বোরহান উদ্দীন!

বউমার দুধ চা বন্ধ করার কথা শুনে অনেক অনেকদিন আগে পত্রিকায় পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়লো বোরহান উদ্দীনের । সেটা অবশ্য এক কাপ কফির গল্পো । গপ্পের লেখক স্পেন না ইতালীতে বেড়াতে গেছেন । একটা কফি শপে কফি পান করতে গিয়ে দেখেন , অনেক কাস্টমার কফির অর্ডার করছেন এভাবে, ‘ ওয়ান কাপ ফর মি অ্যান্ড ওয়ান কাপ ফর দ্য ওয়াল ।’ সুন্দরী আর সুশ্রী ওয়েট্রেস এসে যিনি অর্ডার করছেন তাঁকে এক কাপ কফি দিয়ে সামনের দেয়ালে বাকি এক কাপ কফির স্লিপ এঁটে রাখছে । লেখক তো অবাক ! কি ভৌতিক কাণ্ড রে বাবা ! এদের দেয়ালও কফি খায় নাকি ? নাকি দেয়ালের নীচে বসে থাকা মানুষের আত্না । যা হোক , ব্যাপারটা জানার জন্য উতলা হয়ে সেদেশে দীর্ঘদিন বসবাসকারী এক বন্ধুর শরণাপন্ন হলেন তিনি। সেই বন্ধুই তাঁকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললো । আর সেটা হোল , সেদেশে যারা গরীব মানুষ, ভবঘুরে, যাদের এক কাপ কফি খাওয়ার মতো হাতে পয়সা নেই তাদের জন্যই এই সন্মানজনক সাহায্য । তাঁরা কফি শপে এসে কফির অর্ডার দেয় এভাবে, ‘ওয়ান কাপ কফি ফরম দ্য ওয়াল’ ! আহা , কি সুন্দর সে সব দেশ । মানুষের জন্য মানুষের কতো সন্মানবোধ আর সহানুভূতি ! হায়রে নিয়তি ! তাকেও কি দেয়ালের চা খেতে হবে শেষমেশ ?

সাত
বোরহান উদ্দীন এক্ষণে ভাবলেন , এবার থেকে বাহিরে গিয়ে দুধ চা খাবেন তিনি । তাঁর তল্লাবাগের বাড়ীর আশপাশটায় অনেক মাঝারি আর ছোট আকারের চায়ের দোকান আছে । সেখানে দারুন ঘন লিকার আর দুধঘন দিয়ে যে খুব ভালো চা বানানো হয় , তা জানেন তিনি । দেখেছেন ও ! শুধু কি চা ? চায়ের সাথে গরম গরম লুচি, পুরি আর সিঙ্গারা অহরহ ভাজা হোচ্ছে সেখানে । পাশের য়ুনোভার্সিটির জোড়া জোড়া সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা এসে সেখানে হরদম এটা ওটা খাচ্ছে ।
কিন্তু বোরহান উদ্দীনের বাহিরে তেমন কিছু খাওয়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে । বড়সর দোকানগুলো তবু একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তাতে কিছুটা যদিও চলে । কিন্তু এসব দোকান ? এ সব অল্প বয়সীদের ছেলে মেয়েদের জন্য । যাদের লোহাও হজম হয়ে যায় অতি সহজেই । তাই তাদের সবই চলে । কিন্তু তিনি ? তাছাড়া এ পাড়ায় তার একটা আলাদা কদর আছে । এ পাড়ার আদি বাসিন্দা তিনি । আর মোটামুটি বড়সর চাকরির করার আগের সুবাদে পাড়ার সবাই তাকে বেশ সমীহই করে । আর সবাই জানে , বোরহান উদ্দীন ভুলেও বাহিরের খাবার খান না !
বোরহান উদ্দীন অনেক কাল আগে তল্লাবাগে সাড়ে সাত কাঠার এ জায়গাটা কিনেছিলেন একেবারে জলের দামেই । তখনও এ এলাকাটা এমন তরতর করে বেড়ে উঠেনি । বাড়ীর সামনের রাস্তায় সারা বর্ষাকাল জুড়ে হাঁটুর উপর পানি জমে থাকতো। কলার ভেলা করে পার হয়ে তারপর সদর রাস্তায় উঠতে হত। তারপরও এ জায়গাটায় বাড়ী করতে পেরে খুশী হয়েছিলেন বোরহান উদ্দীন আর তার স্ত্রী ! সেই বাড়ীটা ধীরে ধীরে বেড়ে একতলা থেকে দোতালা হয়েছে । সাজ পোশাকেও পরিবর্তন হয়েছে তার ম্যালা , অন্তত উপরের তলায় !
দোতালায় থাকেন তাঁরা । নীচে দু ঘর ভাড়াটে । এত বড় বাড়ী সহজে ভাড়া হয় না দেখে , অনেক দিন আগেই এক ইউনিট বাড়িটাকে ভেঙ্গেভুঙ্গে ছেটেকেটে দু ভাগ করা হয়েছে । হাবিবা বানু বেঁচে থাকতেই দোতালা করা হয়েছিল । আসলে দোতালা একটা বাড়ীর বড় শখ ছিল তার ! যার সামনে থাকবে খোলা বারান্দা আর তাতে দোল খাওয়ানো বাহারী লতা পাতা আর ফুলের গাছ । সামনা সামনি দুটো বেতের চেয়ার , আর তাঁর মাঝখানে ছোট্ট একটা গোল টেবিল । যেখানে সকাল বিকেল শোভা পাবে বোরহান উদ্দীনের স্পেশাল চা ! কিন্তু বড় অসময়েই চলে গেলেন হাবিবা বানু । এক মাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে নাতিপুতিকেও ভালো কোরে নাড়াচাড়ার সৌভাগ্যই যেন তাঁর হোল না আর ।
এখন দোতালার খোলা বারান্দাটা আরও সুন্দর হয়েছে । সেখানে নকশা আটা গ্রিল এর দিকটায় নানা রকম দেশী বিদেশী মানি প্ল্যান্ট শোভা পাচ্ছে । নতুন নতুন বাহারী বেতের চেয়ার আর টেবিল এসেছে । টেবিলের বুক জুড়ে তাজা টসটসে লাল গোলাপ । কখন রঙ বেরঙের ডালিয়া আর চন্দ্র মল্লিকা । বৌমা খুব ফুল ভালবাসে । তবে এখন ঐ রারান্দাটার পুরো মালিক সেইই ।
স্ত্রী মারা যাবার পর তাদের সেই স্মৃতিভরা বিশাল ঘরটাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে পুত্র আর পুত্র বধূর জন্য । বোরহান উদ্দীন অনেক কষ্টে তাই মেনে নিয়েছেন । এরপর নাতিরা যখন একটু একটু করে বড় হতে থাকল , তখন পাশের বেডরুম থেকে তাঁর ঠিকানা হল , সেই চিলতে গেস্ট রুমে। মন্দের ভাল আছেন তিনি এখানে । একবারে এক কোনে । কারও বেজার মুখ দেখতে হয় না । অযাচিত ভাবে কানেও আসে না কারও গোপন কথার মিছরির ছুড়ি ! তবে সমস্যা যে একবারেই হয় না , তাই বা বলেন কি করে । মাঝে মধ্যেই যখন বৌমার বাপের বাড়ীর আত্মীয়স্বজন এ বাড়ীতে বেড়াতে আসে , তখনই তাঁর সুন্দর মুখটা তমশাময় হয়ে যায় । যেন শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরা আকাশের পূর্বাবস্থা । নিজেকে তখন দারুন অসহায় লাগে বোরহান উদ্দীনের । কেবলি ভয় হয় তাঁকে যদি এ ঘর থেকে অন্যত্র যেতে বলে বৌমা ! কোথায় ? সেই চিলে কোঠার বস্তা-বন্দী ঘরটায় । যেখানে কেবল আরশোলা , টিকটিকি আর নানান জাতের পোকামাকড়ের আস্তানা !
নীচের তলার ভাড়াটিয়াদের তুলে দেবার জন্য অনেক তোড় জোর চলছে , চলে ! চলবেও । কিন্তু এই একটা ব্যাপারে ভয়ানক একগুয়ে মনোভাব পুষে রেখেছেন বোরহান উদ্দীন । নীচের তলার ভাড়া দিয়ে তিনি তাঁর নিজের হাত খরচ চালান । আর প্রতিমাসে দেশের বাড়ীর এতিম খানায় একটা বড় অঙ্কের টাকা পাঠান । এর অন্যথা হোক , তা তিনি ভাবতেও পারেন না । ছেলে তাঁর বাবার এই সেন্টিমেন্টকে মোটামুটি মেনেই চলে । কিন্তু ওপক্ষ থেকে ছেলের বউ যখন স্বামীর কাছে ভাড়াটেদের বিপক্ষে প্রায়শঃ নানা যুক্তি খাড়া করে , তখন ছেলেও তাঁর বাবার উপর মনে মনে দারুন উস্মা প্রকাশ না করে পারে না ।
একবার ছেলে বলেই বসেছিল তাঁকে ধানমন্ডিতে পাশাপাশি বিশাল যে দু-দুটো এপার্টমেন্ট সে কিনেছে , সেখানেই চলে যাবে তারা । কিন্তু পরে স্ত্রির সাথে আলাপ কোরে সেখানে হয়তো বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সমস্যার কথা ভেবেছে । বাবা সাথে গেলে আবার সেই কক্ষ সংকট দেখা দিতে পারে । আবার তাঁকে এখানে ফেলে রেখে গেলে লোকে কি বোলবে ?

আট
এ বাড়ীর নতুন সংস্কার বা স্থাপনা নিয়ে গতরাতে রিনি যে প্রস্তাবটা দিয়েছে স্বামীকে , তা তখন তখনি মেনে নিতে ফারদিনের একটু কষ্টই হল বৈকি । রিনি এ বাড়ীটাকে ডেভেলপার এর কাছে চটজলদি দিয়ে দেয়ার জন্য একেবারে সমন জারী কোরে বসেছে। স্বামীকে সে বুঝিয়েছে , এতে কোরে তুচ্ছ ভাড়াটিয়াদের নিয়ে তাদের বর্তমান অসুবিধাগুলোও যেমন দূর হবে , তেমনি বিষয়টি লাভজনকও কম হবে না । ইচ্ছে করলে বাবাকেও কিছু টাকা দেয়া যেতে পারে। তবে তাঁর টাকা পয়সার কি এমন দরকার । যা দেয়া যাবে তাইই তো দেবেন তিনি বিলিয়ে । আর রইসা তাদের সঙ্গেই যাবে । প্রয়োজনে বাবাকে কিছুদিনের জন্য দেশের বাড়ীতে পাঠানো যেতে পারে। ওখানে তিনি মন্দ থাকবেন না । আর বাবাকে দেখা শুনার জন্য রইসার স্বামীকে পাঠানো তো হোচ্ছেই ।
রিনি তো এক নাগাড়ে তার প্ল্যানটা স্বামীকে বলে টলে অনেক রাত্রিরে ঘুমোতে গিয়েছিল । ফারদিনের কেন জানি মনে হোল , মা বাবার স্মৃতিময় বাড়ীটা ভেঙ্গে ফেলার কথা বলতে রিনি বিন্দুমাত্র কষ্ট পেল না । রোজকার মতো সে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাতে শুতে যাবার আগে প্রাত্যহিক সৌন্দযচর্চা শেষ কোরে ফিনফিনে সেই গোলাবি ফুল ফুল নাইট গাউনটা গায়ে দিয়ে নরম গদি আটা ধবধবে বিছানাটায় নিজেকে নির্ভার এলিয়ে দিলো । রিনির সেই গোলাবি ফুল ফুল নাইট গাউনটা ফারদিনের বিশেষ পছন্দের , রিনি তা ভালো করেই জানে । কিন্তু আজ কেন জানি সেই পছন্দের রাত্রিবাস পরা রিনি তাঁকে তেমন করে টানতে পারলো না । রিনির কি মন খারাপ হোল তাতে? কি জানি ! তবু রিনি যখন চেয়েছে তার সমাধান না করে কিছুতেই যে সে ক্ষান্ত হবে না তা বেশ ভালো করেই জানে ফারদিন !
তবে রাত কেটে গেলে দিনের আলোতে ফারদিনের মনে হোল , রিনির প্রস্তাবটা একবারে উড়িয়ে দেবার মত নয় । কিন্তু বাবাকে বলবে কে ? তবে বলতেই হবে তাঁকে, যা মনে করেন করুন তিনি । আজ বন্দের দিন । বাবাকে এ বাড়ীটা ডেভেলপারকে নিয়ে দেবার কথা আজই তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলতে হবে ।
নয়
সকাল বেলায় প্রাতঃভ্রমনে যাবেন বলেই মনস্থির করেছেন বোরহান উদ্দীন । মনটা কয়েক দিন থেকে তাঁর একেবারেই ভালো নেই । সেই চায়ের রেশ ।তবে মনে মনে তিনি পণ কোরে বসেছেন , এ জীবনে আর চা ছুঁয়ে দেখবেন না তিনি । থাকুক সবাই শান্তিতে থাকুক । তিনি কেন সকলের কলহের কারণ হোতে যাবেন ।
আজ যেন সবার উপর অভিমান কোরেই আক্কাস আলীকে সঙ্গে নিয়ে আসেননি তিনি । থাক সবাই । একাই এ পৃথিবীতে এসেছেন , একাই চলবেন তিনি ।হাঁটছেন বোরহান উদ্দীন । চলছেন তো চলছেনই । যেন এ চলার শেষ নেই !
এবার অনেক অনেকক্ষণ পর একাকী চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের পাশে নেতিয়ে পড়া গাছদের ছায়ায় বসে একটু প্রাণমন জুড়োতে চাইলেন তিনি । চশমার কাঁচ পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে মুছে নিয়ে তা আবার দু চোখে এঁটে নিয়ে লেকের কিনারে ভেসে থাকা মাছদের দোলাচল দেখতে ভালই লাগলো তাঁর । হাতে ঘড়ি নেই, তবুও রোদের আঁচ দেখে নিশ্চিত বুঝে নিলেন , বেলা অনেক হোয়েছে । অন্ততঃ ঘণ্টা কয়েক আগেই শেষ হোয়ে গেছে সকাল হাঁটার সময় ।
বাড়ীর সবাই কি তাঁকে নিয়ে কি কিছু ভাবছে ? দুশ্চিন্তা ? না , তা আশা করার নয়। ওদের ম্যালা কাজ । তাঁকে নিয়ে ভাববার সময় কই ছেলে আর ছেলে বউ বা নাতিদের!আর রইসা বা আক্কাস আলী ? ওরাও কি তাঁকে নিয়ে আর ভাবছে না? মিলেমিশে গেছে ওদের দলে ?
কিন্তু ওকে ? আক্কাস আলী না ? হ্যাঁ তাইতো । দূর থেকে দেখা গেল হন্তদন্ত হোয়ে তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সে । এদিক , ওদিক ,সেদিক । লেকের এপাশ ও পাশ । খুঁজে খুঁজে না পেয়ে খুবই যেন নিরাশ হোয়ে পড়েছে বেচারী। উসকো খুসকো চুল আর দাড়ির ভারে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না তাঁর পুরোটা মুখ । কিন্তু সে যে ভয়ানক শঙ্কিত আর ব্যথিত তা এতদূর থেকেও তাঁর আচরণে পুরোপুরি প্রকাশ পাচ্ছে !
আক্কাস আলীর হাতে ওটা কি ? কালো সাদা ফুল আঁটা ফ্লাক্সটা না ? তাই তো । কিন্তু কেন ? নি শ্চ য় চা ! দুধ চা বানিয়ে তাঁর জন্য কে পাঠিয়েছে এই নিভৃত বাগানে । নিশ্চ্য়ই রইসা । বোরহান উদ্দীনের আজ কেন জানি সত্যি সত্যি মনে হল, রইসা ঠিক ঠিক তাঁদের মেয়ে । এই স্নেহভরা ম্লানমুখ মেয়েটির সাথে তাঁর রক্তের সম্পর্ক নেই বটে কিন্তু আছে যেন আত্নার সম্পর্ক ।
অনেক অনেক দিন পরে বোরহান উদ্দীন হাসলেন প্রাণভরে । গভীর তৃপ্তিতে । তাঁকে নিয়ে ভাববার অন্ততঃ দুজন মানুষ এখনও জীবিত আছে এ পৃথিবীতে । রইসা আর তাঁর স্বামী আক্কাস আলী ! এ বিষয়ে আজ যেন তিনি নিশ্চিত !
বিকেলে বাবার চিলতে ঘরটার এককোণে বোসে , ফারদিন যখন অনেকটা নির্ভয়ে বাবাকে জানালো বাড়ী নিয়ে রিনির গতরাতের সেই প্রস্তাবটার কথা, তখন বোরহান উদ্দীন হঠাৎ কোরেই যেন তাঁর বর্তমান খোলস ছেড়ে ফিরে গেলেন যৌবনে । অতীতে । ভয় নেই , নেই কোন দুর্বলতা , অসহায়ত্ব কিংবা অন্ধ ভালবাসার ঝলকানি । এ জমি , ঘর- বাড়ী তাঁর নিজের । তিনি নিজে যা সিদ্ধান্ত নেবেন তা মানতেই হবে সবাইকে ! অনেক অনেক দিন তিনি চুপ কোরে ছিলেন । কিন্তু আজ আর নয় ! অন্যায় করা আর তা সওয়া তো একই ! তিনি আর কোন অন্যায়ই সইবেন না !
বোরহান উদ্দীন কোনদিক না তাকিয়ে নির্ভয়ে আর নির্ভার কণ্ঠে ছেলেকে জানিয়ে দিলেন তাঁর শেষ সিদ্ধান্তের কথা । আর তা হোল, ডেভেলপার আসুক , আসতেই পারে । কিন্তু তার আগে রইসা আর তাঁর স্বামী আক্কাস আলীকে তিনি লিখে দিতে চান তার সম্পত্তির অর্ধেকটা !
কথাগুলো গরগর কোরে বোলেই বোরহান উদ্দীন মনে মনে এই ভেবে পরম শান্তনা অনুভব করলেন যে, এখন থেকে তাঁকে মনের মত অন্ততঃ এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবার জন্য রইসাকে আর কারো দয়ার উপর নির্ভর কোরতে হবে না !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Salma Siddika অসহায়ত্ব জয়ের গল্প ভালো লেগেছে।
ভাল লেগেছে জেনে খুব খুশী হলেম সালমা , ভাল থেক !
আখতারুজ্জামান সোহাগ গল্পটা একটু বড়। তবুও পড়তে ক্লান্তি আসেনি। স্ত্রী হাবিবার বিয়োগের পর থেকে বৃদ্ধ বোরহান সাহেবকে ঘিরে সংসারের অন্য মানুষগুলোর আচরণগত পরিবর্তন দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অভিনন্দন। ঘটনা এবং ঘটনা বর্ণনাও ভালো লেগেছে। গল্পের শেষে এসে বোরহান সাহেবকে যৌবনের রূপে দেখে আশার আলো দেখলাম। শুভকামনা লেখকের জন্য।
সুচিন্তিত মন্তব্যে অনেক খুশী হলেম । অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ধন্যবাদ ! ভাল থাকবেন !
মোজাম্মেল কবির দুঃখবোধ কেটে গেলো শেষ দুটি লাইন পড়ে... এতক্ষণ শুধু কষ্ট ক্রমেই ভারী হচ্ছিলো...
অনেক অনেক ধন্যবাদ , ভাল থাকবেন !
এশরার লতিফ বৃদ্ধ বয়সের অসহায়ত্ব চমৎকার ফুটেছে। প্রতিবাদটি আরও ভালো লাগলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এশরার লতিফ আপনার ভাল লাগার জন্য !
প্রজ্ঞা মৌসুমী ডাক্তার বাড়িতে থাকার কিংবা আত্নীয়স্বজন ডাক্তার হওয়ার এই এক সমস্যা। অনেক সময় খাবার নিয়ে ভয়েই থাকতে হয়। লেখার বুনট সুন্দর। শেষের দিকে বোরহান উদ্দীনকে ভালো লেগেছে। বনস্পতিকে মাথা উচু করে বনস্পতির মত দাঁড়িয়ে থাকলেই মানায়। আক্তার ভাইয়ের মত ওয়ান কাপ ফর মি অ্যান্ড ওয়ান কাপ ফর দ্য ওয়াল- উদ্ধৃতিটা দারুণ লেগেছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রজ্ঞা খুঁটিয়ে পড়ে মন্তব্য করার জন্য !
সকাল রয় অনেক ভালো লাগলো। ঠিক যেন চিরচেনা ছবি। আপনার লেখনি সবসময় ভালো হয়।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ এই সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আপনার লেখাও সবসময় ভালো হয় !
সহিদুল হক khub sundor likhechen, onek onek shuvechcha
অনেক, অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা !
মোঃ আক্তারুজ্জামান বোরহান সাহেবের রংচটা বয়সের বর্ণনা কোন না কোন ভাবে অনেকেরই শেষ বয়সের জীবন চিত্র। অনেক অনেক ভাল লাগল। ‘ওয়ান কাপ ফর মি অ্যান্ড ওয়ান কাপ ফর দ্য ওয়াল ।’- উদ্ধৃতিটা খুব চমৎকৃত করেছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ এই সুন্দর মন্তব্যের জন্য আর ভাল্লাগার জন্য !
মালেক জোমাদ্দার আপু চমৎকার লিখেছেন !!! । আমার কবিতা ও গল্প পড়ার অনুরোধ থাকলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ , অবশ্যই পড়ব !
সাদিয়া সুলতানা বাস্তব জীবনের গল্প। হয়তো আমার আশেপাশের। পরিসর বড় তবু ক্লান্তিকর নয়। শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ সাদিয়া আপনাকে পড়ে মন্তব্য করার জন্য !

১০ ফেব্রুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪