এক.
পরীবাগ থেকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছি আর ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। হরতালের কারণে রাস্তায় লোকজন কম। ভয়ে ভয়ে তাকানোর কারণ- আমাকে দেখলেই আশেপাশের কোন মেয়ে বা ভদ্রমহিলা কোন না কোন সাহায্য চেয়ে বসবে। আমার ভেতরে সম্ভবত পিয়ন বা আর্দালি টাইপ একটা ব্যাপার আছে। নিতান্ত অপরিচিত ভদ্রমহিলারাও আমাকে তুই তুমি করে কোন কাজ করে দেয়ার জন্য বলতে তিল পরিমাণ দ্বিধাগ্রস্ত হন না। মনে হচ্ছে আমার ভয় অমূলক, তেমন জরুরী কোন বিষয় না থাকলে হরতালে মহিলারা ঘর থেকে বের হন না।
শাহবাগে রাস্তা আটকে একটা মিছিল বা পথসভা কিছু হচ্ছে। দূর থেকে শুনছি বলে আন্দাজ করতে পারছি না- হরতালের পক্ষশক্তি না বিপক্ষশক্তি। দেশ এখন নানারকম পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির শক্ত ঘাঁটি। কে কখন কোন শক্তি সেটাই বিবেচ্য- সময়ের অবস্থানের ওপরে বক্তব্য বদলে যাবে। একই ব্যক্তি আজকে হরতালের পক্ষে গলা ফাটাবেন, কাল হরতালের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেবেন। আমাকে অবশ্য আরও একটা গুঢ় তত্ব দিয়েছিল টোকাই ফুলমিয়া।
ফুলমিয়ার বয়স তের। ময়লা চটচটে চেহারার কারণে- কোন ধরনের ফুলের সাথে তাকে মেলানো দুরূহ। তবে সবসময়ে ন্যাড়া হয়ে থাকার জন্য চেহারায় খানিকটা পাপড়ি ছেঁটে ফেলা কদমফুলের ভাব আছে। সচরাচর ফার্মগেট এলাকায় থাকে। বাবা নাই, মা আরেকজনকে বিয়ে করেছে। সৎ বাবা তাকে সহ্য করতে পারে না। জীবিকার তাগিদে নানান ধরনের কাজকর্ম করে। হরতালে অনেক শ্রমজীবী মানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও ফুলমিয়ার পোয়া তের। ফুলমিয়ার সাথে এক রাতে ফার্মগেটে পরিচয় হয়েছিল। ঘটনাক্রমে তার একটা ইন্টিমেট এবং এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেবার সুযোগ হয়েছিল।
তার ভাষ্যমতে বেশীরভাগ ছোটখাটো মিটিং-মিছিল পিকেটিং এ ভাড়ায় খাটা লোকজন পাওয়া যায়। একই লোক আজকে এ দলের হয়ে কাজ করল তো কালকে বি দলের। সব কাজের রেট করা আছে আর রেট অনুযায়ী কাজ করার মানুষ। ছোট বলে ফুলমিয়া শুধু পটকা মারার কাজ পায়। বড় হইলে রড চাপাতির কাজ পাবে। তাতে নাকি টাকা বেশী। আর বিরাট সম্মান। এক্ষুণি কেন সে বড় হয়ে উঠে বিরাট সম্মান অর্জন করতে পারছে না এই নিয়ে ফুলমিয়াকে খুবই হতাশ মনে হল।
শাহবাগে হরতালবিরোধী মিছিল শেষে এক নেতা গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে লাঠি চাপাতি হাতে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। সংগে পুলিশের এক দল। আমি তাদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে। মেয়েরা এখন আর ফেলনা নয়। ফুল মিয়ার কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-
- আপনাকে সেদিন হরতালের পক্ষের একটা মিটিং-এ দেখেছিলাম না।
ছেলেটা বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ওজন মাপার চেষ্টা করছে। তার চোখে ঘৃণা। এক্ষুণি বিরাট ক্যাচাল লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। মনে হচ্ছে আমার হিমুলীলা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সাঙ্গ হতে যাচ্ছে। ছেলেটা কিছু বলার আগেই ছবির হাটের দিক থেকে হরতালের পক্ষের একটা জঙ্গি মিছিল এসে হাজির। মুহূর্তে একটা টানটান যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। দলের মধ্যকার বিশেষ বাহিনী পুলিশী প্রহরায় লাঠি চাপাতি হাতে তেড়ে গেল। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আমার সাবজেক্টও মুহূর্তে সামিল হয়ে গেল। উত্তেজিত অবস্থায় ধাক্কাধাক্কিতে একটা মেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। কারো সেদিকে খেয়াল নাই। কয়েকজন তাকে মারিয়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে আড়াল করে দাঁড়ালাম। কয়েকবার আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হল। লাথি, রডের ঘাও খেতে হল কয়েকবার। যুদ্ধংদেহীরা চলে যাবার পর মিছিলের একটা ছেলের সাহায্যে মেয়েটাকে পিজিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হলাম।
এমারজেন্সিতে ডিউটিরত ডাক্তার কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে বললেন,
- এই রোগীকে ভর্তি করা যাবে না। এই মেয়ে পিকেটিং করতে গিয়ে আহত হয়েছে মনে হচ্ছে।
- স্যার উনি হরতালবিরোধী মিছিলে ছিলেন।
- আগে বলবেন তো, ধরুন ধরুন। অনেক ব্লিডিং হয়েছে। রক্ত দিতে হবে। আপনি ওনার কে হন?
- কেউ না স্যার, রাস্তায় পড়েছিল। অনেক কষ্টে তুলে এনেছি।
- ওনার আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া হয়েছে?
- সময় পেলাম কোথায়? তাছাড়া পরিচয়ই তো জানি না।
আমার সঙ্গী ছেলেটা যথেষ্ট দূরদর্শী বোঝা গেল। মেয়েটাকে তুলে আনার সময় ওর হ্যান্ডব্যাগটাকেও তুলে এনেছে। ভেতরে মোবাইল পাওয়া গেল। ছেলেটাই মোবাইলে খবর দিচ্ছে। আমি এতক্ষণে রোগীর দিকে তাকালাম। এখানে সেখানে থেঁতলে গেছে, তারপরও অসম্ভব লাবণ্যময় একটা মুখ। পোশাক আশাকও সেইরকম। এই মেয়েকে এই মিছিলে ঠিক মানাচ্ছে না। সে কি আসলেই মিছিলে ছিল? আধ ঘন্টার মধ্যেই মেয়ের একগাদা আত্মীয়স্বজন এসে হাজির।
- মা কী হয়েছে তোর?
বলতে বলতে যে ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে এলেন তাকে বেশ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মনে হচ্ছে। সঙ্গের বেশ কয়েকজন মানুষজনকে দেখা গেল স্যার স্যার বলে তাকে তোয়াজ করতে। হরতালের মধ্যে এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো মানুষকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসা এনার পক্ষে সম্ভব। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে এক ফাঁকে কেটে পড়লাম।
দুই.
- আরে হিমু না। এই হিমু, দাঁড়া।
মাথায় হিজাব পড়া এক ভদ্রমহিলা। তার চোখেও একটা গাঢ় সানগ্লাস। প্রাইভেট কারের কাঁচ নামিয়ে আমাকে ডাকছেন। তাকে চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু চিনতে পারছি না। তিনি অবশ্য আমার চেনা না চেনার তোয়াক্কা না করে কঠিন কন্ঠ্যে হুমকি দিলেন- এক্ষুণি গাড়িতে উঠে পড়। তোর রাস্তায় হাঁটাহাঁটি বার করে দিচ্ছি।
আমি তাকে চিনে ফেলেছি এমন ভান করে বললাম- অবশ্যই গাড়িতে উঠবো তবে এই মুহূর্তে ভীষণ ইম্পর্টেন্ট একজন মানুষের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তিনি আমাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেছেন। আমি পরে আপনার সাথে দেখা করছি।
তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন- তোর ইম্পর্টেন্ট লোকটা কে? কোন মন্ত্রী? তোর সাথে তো এমপি মিনিস্টারদের লিংক আছে শুনেছি।
- জি না, তিনি মেছকান্দর মিয়া।
- মেছকান্দর মিয়াটা আবার কে? কি করেন?
- তিনি একজন মহান পুরুষ। জীবিকার জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করেন। তার একটা ইচ্ছাপূরণ পাথর আছে সেটাকে সঙ্গে নিয়েই ভিক্ষাবৃত্তি করেন। সঙ্গে ইচ্ছাপূরণ পাথর অথচ তিনি ভিক্ষা করছেন- ইন্টারেস্টিং নয়?
তিনি রাস্তায় নেমে এসে স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে বললেন- ফাজলেমি হচ্ছে। তোর ফাজলেমি বার করছি। ইচ্ছাপূরণ পাথর এখন তোর মাথায় ভাঙব। রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে মুহূর্তে তাকে চিনে ফেললাম। মেরিনা খালা। মায়ের চাচাতো বোন। আমার সঙ্গে খুবই ভাব ছিল। বহুদিন যোগাযোগ নাই। একদা স্মার্ট, হার্টথ্রব এই তরুণীর জন্য কয়েকটি ছোটখাটো ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে বললাম, তোমার একি হাল। তালেবান প্রশিক্ষণ নিয়েছ নাকি?
- হুম নিয়েছি। বাসায় চল তোকে কতল করা হবে।
আমি সুবোধ বালকের মত সুড়সুড় করে গাড়িতে উঠে বসলাম।
মুনির খালুর সাথে অনেকদিন পরে দেখা হল। তিনি অন্যান্য খালু সাহেবদের মত না। কিঞ্চিত জলি প্রকৃতির। আমাকে দেখে বললেন, হ্যালো মি. মহাপুরুষ আপনার হাঁটাহাঁটির অগ্রগতি কতদূর। ঢাকা শহরের সবগুলো গলি উপগলি ফিনিশ হয়ে গেছে?
- গলিগুলো মোটামুটি শেষ। ম্যানহোলের ভেতরটা এখনো ট্রাই করা হয়নি। অচিরেই শুরু করে দেব।
- গুড। শেষ হলে জানাবেন। আপনার জন্য একটা ভিক্টরী ল্যাপের আয়োজন করা হবে।
খালা হুট করে ঢুকে বললেন, এক্ষুণি ওর পেছনে লাগলে? খালু হেসে বললেন, ভয় পেওনা। তোমার ভাগ্নে কঠিন চিজ। তার পেছনে লাগলেও সুবিধা করা যাবে না। খালা আমার হাত ধরে ভেতরে নিতে নিতে বললেন, তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে ভিতরে চল। আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে খালার পেছনে বের হয়ে গেলাম।
- শোন, তোকে আর আমি এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেব না। তোর খালুর সাথে কথা বলেছি, তুই উত্তরায় আমাদের নতুন ফ্যাক্টরির ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নিবি।
- অবশ্যই নেব। বেতন টেতন কেমন দেবে?
- তুই যা ভাবতে পারছিস তার চেয়েও অনেক বেশী। তাছাড়া ফ্যাক্টরির নিজস্ব কোয়ার্টার আছে, তুই সেখানে থাকবি। বাইরের লোকের হাতে দায়িত্ব দিয়ে ভরসা করতে পারছি না। দুদিনের মধ্যে চুরি করে ফাঁক করে দেবে।
- নিজেদের লোকেরাই চুরিটা আরাম করে করতে পারে। বাইরের লোকের এত সাহস হয় না।
- করলে করবি। তুইতো ভাল থাকবি। তাছাড়া তোর বিয়েটিয়েও করা দরকার। তোকে আর মহাপুরুষগগিরি করতে দেয়া যাবে না। তোর বাবা ছিল একটা সাইকোপ্যাথ। তুইও ক্রমে তাই হয়ে যাচ্ছিস। আর নয়, এনাফ ইজ এনাফ।
- অনেক দেরী হয়ে গেছে খালা। ইটস টু লেট।
- মোটেই দেরী হয়নি। এখনি সময় তোর পায়ে শিকল পরাবার। বি রেডি।
- ইয়েস বস।
- ফাজলেমি করবি না। ইয়েস বস মানে কী?
- আগে থেকেই প্রাকটিস করে নিচ্ছি। বস হতে যাচ্ছ যখন। বিয়ে করতে বলছ, মেয়ে টেয়েও দেখেছ নাকি?
- প্রতিদিনই তো দেখছি। একটা মেয়েকে আমার খুব মনে ধরেছে। দেখবি নাকি?
- অবশ্যই। মেয়ে কেমন? একটু ডাউন হলেই ভাল হয়। আমার জন্য কোন আপ মেয়ে রাজী হবে বলে মনে হয় না।
- রাজী হবে না মানে? এসব কী কথা! মেয়ে না শুধু মেয়ের চৌদ্দ গুষ্টি রাজী হবে। তোর আর মেসটেসে থাকার দরকার নাই। আপাতত এখানেই থেকে যা। এক তারিখ থেকে উত্তরা সেটল হয়ে যাবি। কালই মেয়েটাকে দেখাচ্ছি।
- গুড তাহলে চট করে মেস থেকে ঘুরে আসি। জিনিসপত্র নিয়ে পার্মানেন্টলি চলে আসছি।
- মেসে যা আছে থাক। ওসব আর আনতে হবে না।
- তা বললে তো হবে না। মেসের ভাড়া বাকি আছে দিতে হবে। তুমি চট করে হাজার ছয়েক টাকা দেও তো। সব গোছগাছ করে সবার দোয়া নিয়ে আসি। নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি।
- টাকা দিচ্ছি, মেসের ভাড়া শোধ করে সোজা চলে আসবি। কারো দোয়া নিতে হবে না।
তিন.
মেস ম্যানেজার ইসকান্দার মিয়া গোমড়ামুখী টাইপের। সারাদিন বসে বসে ঝিমানো তার একমাত্র কাজ। রামগরুড়ের ছানা, হাসার মত অর্থহীন কাজ করার ব্যাপারে তার বংশে নিষেধ আছে । আমি নিশ্চিত তিনি যদি লটারিতে এক কোটি টাকা জেতার সংবাদ পান তবে খবরদাতার দিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত মুখে তাকাবেন। মেসে ঢুকেই এমন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া শুভলক্ষণ না। ইভনিং শোজ দ্য নাইট। ওনার সাথে ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়ার বেশ একটা মিল আছে। দুজনই রামগরুড় বংশের লোক। নামেও মিল আছে। বাই এনি চান্স উনি মেছকান্দর মিয়ার ভাইটাই নয়ত?
- ইস্কান্দার ভাই কেমন আছেন?
-
তিনি বিরস মুখে তাকালেন। উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
- আপনার ভাই মেছকান্দর মিয়া কেমন আছেন?
- ভাই কী ফাজলেমি করেন। মেছকান্দর মিয়াটা আবার কে?
- তেমন কেউ নারে ভাই? আপনার মত দেখতে, পাথরের উপর বসে বসে ঝিমান।
ইচ্ছাপূরণ পাথর।
-
ইস্কান্দর মিয়ার বিরক্তি চরমে উঠল। এবার একটু -নাটকীয় ভঙ্গীতে বললাম, মেস ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভাই। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন। তাকে আরও একটু ভড়কে দেয়া যাক।
- দোয়া করবেন ভাই বিরাট চাকরি পেয়েছি। অনেক টাকা বেতন। ওরা কোয়ার্টার দেবে, গাড়ি দেবে।
- ভাল।
- এই নেন আপনার বাকি মেস ভাড়া ছয় হাজার টাকা।
তিনি এবার ব্যাপক ভড়কালেন। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন?
- মিথ্যেমিথ্যি যাব কেন ভাই?
ইসকান্দার মিয়া আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
- হিমু ভাই টাকা দিয়া আমাকে অপরাধী করবেন না। আপনি যেখানে খুশী যান। টাকা দিতে হবে না। আমার এই অনুরোধটা রাখেন।
পরিস্থিতি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। ইস্কান্দার মিয়ার মত মানুষ আচমকা এমন আচানক কান্ড করে বসবেন আন্দাজ করতে পারিনি। মানুষ চেনা বড়ই দুস্কর। আমি রাস্তায় নেমে আসলাম। খালার বাসা থেকে আনা চটের ব্যাগে ছয় হাজার টাকা রেখে কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছি। পাঞ্জাবীর পকেট নেই, কী আর করা। সামনে অনেকদিন হাঁটা হবে না, হাত পায়ে জং ধরে যাবার সম্ভাবনা। শেষবারের মত হেঁটে নেই। পথে নেমে পথকে বললাম, আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো।
দোয়েল চত্বরের কাছে বিকট শব্দে একটা বাসে আগুন ধরে গেল। লোকজন ছুটোছুটি করছে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল কাল হরতাল তাই বাসে আগুন ধরানো হয়েছে। ইদানীং হরতালের আগের দিন থেকেই প্রি অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীরা জনগণের মঙ্গল চিন্তায় ব্যাপক খাটাখাটনি করছেন। ক'জন মারা গেছেন দেখার জন্য আমি বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছনে টোকা টের পেয়ে না তাকিয়েই বললাম, চলুন বিস্ফোরণের ফলাফল একটু সরেজমিনে তদন্ত করে যাই।
- অবশ্যই, নিজের হাতের কাজ টেস্ট করবেন না সেটা হয় নাকি? চলুন আমিও যাই।
নেমপ্লেটে লেখা আছে সারওয়ার। মেট্রোপলিসের ইউনিফর্ম। মনে হচ্ছে আজ রাতে আর মেরিনা খালার কাছে ফিরে যাওয়া হবে না। সরি খালা তোমার চাকরী আর বউ আপাতত ওয়েটিং লিস্টে থাকুক। সারওয়ার সাহেবের ঠাণ্ডা ভাবভংগী ভাল ঠেকছে না। ভোগাতে পারে। কবে ছাড়া পাব বলতে পারছি না।
- আপনার ব্যাগে কী?
- ছ হাজার টাকা। নেবেন নাকি?
- কী বললেন? ঘুষ সাধার অপরাধে আপনাকে প্রেফতার করা হল। আপনার নাম কী?
- হিমু।
- শুধু হিমু?
- হিমালয় থেকে হিমু। আপনি চাইলে টাইগার হিমু নামে ডাকতে পারেন।
অফিসারের চেহারায় 'পেয়েছি বাছাধন' টাইপের হাসি দেখা গেল। গোঁফে তা দিয়ে বললেন, খালি পা কেন?
- আমার লাইনে জুতা পরার নিয়ম নেই।
- ব্যাগে টাকা কেন? পেমেন্ট আগেই পেয়ে গেছেন?
- কিসের পেমেন্ট?
- বুঝতে পারছেন না?
- জি না।
- থানায় চলুন, প্রপার ডলা পড়লেই মাথা ডিস্টিলড ওয়াটারের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
- জি আচ্ছা।
সারোয়ার সাহেব রমনা থানার নতুন ওসি। তিনি নিজের চেয়ারে বসে গোঁফে হাত বুলাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আর একটা ঝড় আসার পূর্বলগ্ন।
- বোমাটা কে ফাটাতে বলেছে?
- প্রশ্ন বুঝতে পারছি না।
- ঠিক আছে মাথা পরিষ্কার করার ওষুধ দিচ্ছি।
তিনি উঠে আসার ভঙ্গী করলেন। মনে হচ্ছে ওষুধের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠছি- কারণ ওনার ভাবভংগী ঠাণ্ডা। অ্যাকশনের সময় এ ধরনের মানুষগুলো ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। ঠিক এই সময় চশমা পড়া ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। ওসি সাহেব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
- আসুন স্যার। আপনি এখানে? ফোন করলেই তো হত।
- কনফিডেন্সিয়াল ব্যাপার সারওয়ার। ফোনে বলা ঠিক হত না। আলাদা কথা বলা দরকার। ও কে?
ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। আমারও তাকে চেনা চেনা লাগছে। মনে করতে পারছি না। তিনিই আগে মুখ খুললেন।
- আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি?
- মনে হয় হসপিটালে?
- রাইট, আপনি সেই লোক আমার মেয়েকে হসপিটালে নিয়ে এসেছিলেন। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন বলেন তো?
মনে হচ্ছে ছাড়া পেয়ে যাব। ভাগ্য এত তাড়াতাড়ি প্রসন্ন হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। তিনি ওসি সারওয়ার সাহেবকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। ফিরে এলেন ওসি সাহেব একা। আমি ছাড়া পাবার প্রত্যাশায় উঠে দাঁড়ালাম। ওসি সাহেব আমার কলার ধরে তুলে ধাক্কা মেরে হাজতে ঢুকিয়ে লক করে দিলেন।
হাজতে দুদিন কেটে গেল। সারওয়ার সাহেবের দেখা নাই। ডলা দিতেও আসছে না কেউ। কাউকে খবরও দিতে পারছি না। তৃতীয় দিন সারওয়ার সাহেব থানায় এলেন। নিজেই হাজত খুলে আমাকে বের করলেন।
- সরি হিমু সাহেব জরুরী একটা অপারেশনে বেরিয়েছিলাম। আপনার ব্যাপারে ডিসিশন নিতে পারিনি। আমি খোঁজ নিয়েছি, আপনার নামে কোন এলিগেশন নেই। আপনি যেতে পারেন। দুদিন হাজতে থাকতে হয়েছে। আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।
- সরি হবার জন্য থ্যাংকস। না হলেও ক্ষতি নেই। ক্ষমতাবান মানুষদের সব কিছুই সুন্দর। আপনার হাতে কি হয়েছে?
- অপারেশনে সামান্য স্ট্যাব হয়েছে। তেমন কিছু না। বাই দ্য ওয়ে একজন কনস্টেবল বলছিল আপনার নাকি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে?
- জি না। আমি সামান্য মানুষ। আমার কোন ক্ষমতা নেই।
- ওকে আপনার সাথে একটু রুড হয়েছিলাম। সরি ফর দ্যাট। আপনি আসতে পারেন।
- থ্যাংক ইউ স্যার। বাই দ্য ওয়ে পুরান ঢাকায় ট্যারা সুলেমানের আস্তানা চেনেন তো?
- হোয়াট?
- এখন গেলে, মাত্র একজন লোক আছে পাহারায়। বাচ্চাটা সুস্থ আছে।
- হোয়াট?
- ওকে গুডবাই।
আমি ওসি সাহেবকে স্তম্ভিত করেদিয়ে সুট করে বেরিয়ে আসলাম। বেশীক্ষণ থাকলে আবারো আমাকে আটকে রাখার কুবুদ্ধি গজাতে পারে ওনার মাথায়।
চার.
একটা মোবাইলের দোকানে গিয়ে খালার নম্বরে ফোন দিলাম। খালার বিরক্ত গলা শোনা গেল।
- হ্যালো।
- খালা পুলিশে ধরা খেয়েছিলাম। আজই ছাড়া পেয়েছি। তোমার চাকরীটা এখনো আছে?
- তুই যে চাকরী করবি না সে আমি আগেই জানতাম। যা তোকে আর আমি আটকে রাখব না। তুই রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বিখ্যাত মহাপুরুষ হয়ে যা। রাস্তা তো অনেক হোল এবার ম্যানহোলের ভেতরে সেঁধিয়ে দেখে আসতে পারিস। জায়গাটা তোর খারাপ লাগার কথা না। তুই হচ্ছিস গন্ধ গোকুল। গর্ত ছাড়া তোর ভাল লাগবে কেন?
- রাগ কোরো না খালা। সত্যি বলছি, আমি এখনি আসছি।
আমি ফোন রেখে খালার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি বলে রাস্তায় কয়েকজনের সাথে দেখা করার পরিকল্পনা নিলাম। একজন ফুলমিয়া। ফুলমিয়াকে পাওয়া গেল না। হরতালের সিজন, ফুলমিয়া তার ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্টে ব্যস্ত আছে। ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়ারেও পাওয়া গেল না। সে তার ভিক্ষার পাথর সমেত উধাও হয়ে গেছে। কি জানি হয়ত ইচ্ছাপূরণ পাথরের কেরামতি এখন তার আয়ত্তে। খালার বাসায় পৌছুতে বেশ দেরী হয়ে গেল।
ভেবেছিলাম খালা রেগে ব্যোম হয়ে থাকবে। তার বদলে এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম যা কল্পনারও বাইরে। আমাকে দেখেই কলকলিয়ে বললেন, সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে গেছে রে। তোকে যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম ওর ভাইপোকে দুদিন আগে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। আজ নাকি এক ফকির টাইপের মানুষের কথায় পুরনো ঢাকা থেকে ছেলেটাকে উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের পাশের ফ্লাটেই থাকেন। মেয়েটার বাবা ডিএস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আছেন। ওরা কাউকেই বলেনি। কিডন্যাপাররা নাকি কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিল। আজ পাওয়ার পরে আমাকে বলল। একটু দাড়া ডেকে আনছি মেয়েটাকে।
- এই সিনথি, সিনথি।
খালার পেছন পেছন আমিও ফ্লাট থেকে বের হলাম। পাশের ফ্লাটে নক করছেন খালা। ফ্ল্যাট থেকে মেয়ের বদলে গোঁফওয়ালা এক পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই তার মুখে হাজার পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠল।
- আরে হিমু সাহেব, আপনি এখানে?
- বিশ্বাস করুন আমি কোন বোম ব্লাস্টিং বা চুরি ডাকাতির প্লান করছিনা। জাস্ট খালার বাসায় এসেছি।
- কি যে বলছেন, লজ্জা দেবেন না ভাই। সময় করে থানায় চলে আসবেন গল্প করা যাবে। সরি ভাই মাথার ঠিক নাই। আপনি যাবেন কী, ঠিকানা বলুন আমিই আপনাকে নিয়ে যাব। এই সিনথি ইনিই হিমু ভাই।
- ইটস ওকে সারওয়ার ভাই। আমিই যাব।
ওসি সাহেব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। সেদিনের হরতালে আহত মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছি, অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
- আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি? আরে আপনিই তো শাহবাগে..
- জি না। আমি নই তিনি অন্য একজন।
- কনফিউজ করার চেষ্টা করবেন না। আপনার পাঞ্জাবীর রং আর মুখটা সেদিন স্পষ্ট মনে আছে। আপনি সেদিন কোথায় হারিয়ে গেলেন বলেন তো। বাবা খুব খোঁজাখুঁজি করেছেন।
খালা হঠাৎ বেরিয়ে এসে বললেন, কি ব্যাপার পূর্ব পরিচয় আছে নাকি তোদের? ভালই হল, কি বল সিনথি? সিনথি নামের মেয়েটা লজ্জায় ঘন ঘন মুখের রং বদলিয়ে অপরূপ হয়ে উঠেছে। খালা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছি তুই আবার গুবলেট করে দিস না। আমি ওদেরকে বলেছি তুই উত্তরার ফ্যাক্টরী দেখাশুনা করিস। ফিফটি পারসেন্ট শেয়ার। বললাম, খালা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না। শেয়ার বলার দরকার কী ছিল? উনি মাইন্ড খাইতে পারেন- প্রায় শিরকি গুণাহর মত। যেখানে ওনার সাথে লাইফ শেয়ার করার কথা সেখানে..
- ফাজলেমি রাখ। সেটা তোকে ভাবতে হবে না। শেয়ার আমি লিখে দেব।
- খালুকে না বলে সেটা কী ঠিক হবে?
- সে আমি বুঝব। ওটা আমার নামে। আর তোর খালু যে তোকে কী পরিমাণ পছন্দ করে তুই জানিস না।
*************
আজকের জ্যোৎস্না কী যে মায়াবী লাগছে। আমি খালা খালু আর সিনথি ফ্লাটের খোলা বারান্দায় বসে জ্যোৎস্না দেখছি। কাল হরতাল তাই রাত বারোটার আগেই শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। শহুরে জ্যোৎস্না তার ঝাঁপি খুলে অচেনা রূপ মেলে ধরেছে নিশ্চিন্তে। হরতালের দুএকটা ভাল দিকের এটা বোধ হয় একটা। আমি জানি কাল আবার পথের হিমু পথেই ফিরে যাবে। হিমুরা কখনো কোন মেয়ের হাত ধরবে না। সেটা ভেবে আজকের সময়টা নাইবা নষ্ট করলাম।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।