কবিতার নিরীক্ষাকাল
আশি, নব্বই এবং শূন্যদশকে বাংলা কবিতায় ক্রমাগত হারে নিরীক্ষা করেছেন এবং এখনো নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন কবিরা। কবিতার আঙ্গিক নিয়ে, শব্দের ব্যবহার নিয়ে, উপমার নতুনত্ব নিয়ে, ছন্দের কারুকাজ নিয়ে, পূর্বসূরিদের প্রভাব বলয় থেকে বের করে কবিতাকে নতুন পথে নিয়ে আসার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। আশির দশক বাংলাদেশের কবিতার আরেক বাঁক বদলের ইতিহাস। এসময়ে কবিতায় অপ্রত্যাশিত ভাবে ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার চর্চা যার অন্যতম প্রধান কারণ এই সময়ে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবত ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষের পথে হেঁটেছে। কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়ে যায়। তারপরও আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছে আলোড়িত করার মত অসংখ্য সত্যিকার অর্থেই সুন্দর আর নান্দনিক পঙক্তিমালা। সময়ের প্রয়োজনেই আশির দশকের এ কবিতাগুলো চির সুন্দর দ্যোতনায় দ্যূতিময়। এ প্রসঙ্গে কবি ফরিদ কবিরের এই কবিতাটা আনার লোভ সামলানো গেল না।
আমি কোনো মৃত্যু, কোনো জীবন বুঝি না। উৎসবের
পূর্বে এই করতলে কেঁপে ওঠে চিতার আগুন
হাতের চামড়া আর রোমকূপ পুড়ে পুড়ে তৈরি
হয় রণাঙ্গন, আমি অজস্র অশোক পুষ্প ছুড়ে
দিতে থাকি বিপক্ষের কংক্রিট তোরণে, তারপর
কী রকমভাবে যেন পড়ে থাকি নিহত মানুষ
(আত্মযুদ্ধ/ফরিদ কবির)
এসময়ে ব্যাপক লিটল ম্যাগ চর্চার কারণেই হোক আর স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাবার কারণেই হোক কবিতা চর্চার বিকেন্দ্রীকরণ হয় ব্যাপক ভাবে। জাতীয় পর্যায় থেকে কবিদের এই বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকার ভাল এবং খারাপ দিক দুটোই ছিল। প্রথমত কবিতা কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য কবিদের নামের তালিকা করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য এর পেছনে উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কবিতা সাধারণের বোধগম্যতার নাগাল ছেড়ে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। তাই এই সময়ে ব্যাপক কাব্যচর্চা হলেও সাধারণ পাঠকের কবিতা পাঠের হার আশংকাজনকহারে হ্রাস পেতে থাকে। এবং সত্যি বলতে কি এই আকাল নব্বই দশককে প্রবলভাবে স্পর্শ করে থাকে। এ দশকের রেজাউদ্দিন স্টালিন, মারুফ রায়হান, সরকার মাসুদ, ফরিদ কবির, তারিক সুজাত, মাসুদ খান, ওমর কায়সার, চিনু কবির, সোলায়মান আহসান, আল হাফিজ, প্রমুখ কবির নাম করা যায়।
নব্বই দশকেও এমন বিকেন্দ্রীকরণ এবং চর্চার স্বাধীনতা চলতে থাকার কারণে কবিতা হয়ে উঠতে থাকে উচ্চমার্গের বিমূর্ত শিল্প। তবু এর মধ্যে কিছু কবি যেমন টোকন ঠাকুর- লিরিক্যাল কবিতার নতুন এবং নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেন। দুর্বোধ্যতার তোরণ ছুঁয়ে গেলেও কবিতা মোহময় হয়ে ওঠে। টোকন ঠাকুর আমার প্রিয় লিরিকাল কবি। তার একটা কবিতা থেকে কিছু কোট করি।
তবু এই বিন্দু বিন্দু ঘাসের শিশিরে
চুরি যাওয়া পুকুরটা পাওয়া যায় ফিরে
এইসব দেখি আর না দেখি অধিক
অন্তরনগর ট্রেন, চলে ঝিকঝিক
...............অন্তরনগর ট্রেন
এ দশকে মুজিব মেহেদী, ব্রাত্য রাইসুরাও কবিতা নিয়ে নানাবিধ নিরীক্ষা করেছেন, বিশেষ করে ব্রাত্য রাইসু কবিতায় স্বতন্ত্র একটা ধারা প্রতিষ্ঠা করেন। কবিতার আঙ্গিকে নানান নিরীক্ষা চলতে থাকে। অণুগল্প আকারের গদ্য আঙ্গিকের কবিতা চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। গদ্য রচনায়ও কবিতার প্রভাব দেখা যেতে থাকে। শূন্য দশকে এ দুইয়ের সমন্বয়ে মুক্তগদ্য নামে একটু নতুন ধারার সূচনা হয়। মোট কথা কবিতা নিয়ে যত রকম নিরীক্ষা করা যেতে পারে তার সবই এ তিন দশকে ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। একদিকে কবিতাকে উল্টে পাল্টে দেখার এবং নতুন মোহনায় পৌঁছে দেবার সব রকম আয়োজন চলতে থাকে। অন্যদিকে সাধারণের কাছ থেকে ক্রমেই কবিতা দূরে সরে যেতে যেতে- জনবিচ্ছিন্ন শিল্পে পরিণত হতে থাকে। কবিতার রস আস্বাদনের জন্য তার বিশেষ শ্রেণীর পাঠক হওয়াটা আবশ্যকীয় শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
শূন্য দশকের কবিতা
শূন্য দশকের মাঝামাঝি এসে অন্তর্জালে সাহিত্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশ্ব সাহিত্যের সংগে পরিচিতি হয়ে ওঠে যে কোন সময়ের চাইতে সহজ। এ ছাড়াও দুই বাংলার কবিতা এক ছেদবিন্দুতে দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে অন্য যে বিষয়টা এসেছে সেটা হল কোন গ্রন্থ প্রকাশ না হওয়ায় বা প্রকাশ হলেও প্রচারে এগোতে না পারায় যে দুই বাংলার যে কাব্য প্রতিভাগুলো আড়ালে থেকে যেত সে প্রতিভাগুলোও আমাদের সামনে এসেছে। বাংলা কবিতা বরাবরই পাশাপাশি প্রবহমান দুটো ধারায় চলছিল। একটি পূর্ববঙ্গ অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যতটা পরিচিত অন্যরা ততটা নয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামীদের মত কবিরা বরাবর আমাদের আওতার বাইরে ছিলেন তাদের চমকপ্রদ সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে। অন্যদের কথা তো বলার সুযোগই নেই। এমনকি এই শেষ তিন দশকে যে কবি সাধারণ পাঠকের সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসতে পেরেছেন সেই শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত আমাদের কাছে এতদিন অপরিচিতই ছিলেন। অন্তর্জাল শ্রীজাতর সৃষ্টিসম্ভারের কিছু অংশ অন্তত আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে। মোট কথা শূন্য দশকের শেষাংশে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে এসে আমরা দুই বাংলার কবিদের এক প্লাটফর্মে পাবার সুযোগ যতটা পেয়েছি ততটা এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। দুই বাংলায় কবিতার বিকাশ এক সমান্তরালে হয়নি। আশির দশক থেকে আমাদের দেশে ছন্দ অন্ত্যমিলের চর্চা বেশীরভাগই পূর্বতন কবিদের হাতে হয়েছে। নতুন সময়ের কবিরা ছন্দ অন্ত্যমিলচর্চাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বর্জনই করেননি অনেক ক্ষেত্রে তারা সরাসরি বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং সেটা মোটামুটি শক্তভাবে। কিন্তু একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ছন্দ অন্ত্যমিলের চর্চা ছিল উল্লেখযোগ্য হারে বেশী।
কবিতার প্রথমযুগে যেমন ছন্দ অন্ত্যমিলের পক্ষে কিছু গোঁড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই প্রজন্মে এসে তার বিপক্ষেও একদল গোঁড়া কবিদের আবির্ভাব ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থান এই দুই মতবাদের মাঝামাঝি। যে যুক্তিতে অন্ত্যমিলকে বর্জন করতে চান এখনকার কবিরা সে যুক্তিতে অন্ত্যমিলকে ধরে রেখেই নতুন ধারার অন্ত্যমিল চর্চার পক্ষে আমার দৃঢ় অবস্থান। এবং এ প্রসঙ্গে শুদ্ধ ছন্দের ও অন্ত্যমিলের চর্চাকেও আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় না। মূলত শুদ্ধ ছন্দের চর্চা থেকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছন্দ চর্চাকারী কবিরা অনেক আগে থেকেই ফিরে এসেছেন। অন্ত্যমিলের বৈচিত্র্যও আমাদেরকে শিখতে হবে আর তা শিখতে হবে অন্ত্যমিলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই। যে কোন সৃজনশীল চর্চা বৈচিত্র্য ছাড়া টিকিয়ে রাখা মুশকিল।
এসময়কার ছন্দ চর্চার উদাহরণ হিসেবে আমরা এই সময়ে যিনি কবিতা বা লিরিক লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ভালভাবেই উতরে গেছেন, 'উড়ন্ত সব জোকার' কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি শ্রীজাতর কয়েকটি লেখা দেখতে পারি।
মিঃ ইন্ডিয়া যা বলেছিল
শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কে বিপন্ন, অকর্মণ্য, ইহজন্মে জগন্নাথ
ঠুঁটো হস্তে করো নমস্তে , কাটো অল্প টাকার চেক
অটো চড়ছ ? কী আশ্চর্য ! বাসে বড্ড ধকল, না ?
পাড়াপড়শি ত্রিকালদর্শী । যেতে আসতে তাকাচ্ছে ।
হতভাগ্য, এ বৈরাগ্য ইহজন্মে অবশ থাক
চুলে তৈল অনেক হইল। এবে শ্যাম্পু (ফ্রিডম কেশ)
কে বাপান্ত, অল্পে ক্লান্ত, চিঁড়েচ্যাপ্টা অবস্থা
পরমান্ন খুব সামান্য খেলে বুঝবে কী জম্পেশ
কে অপাত্র, গরিব ছাত্র, পরজন্মে জমিন্দার
কে অপেক্ষা, ট্রিপল টেক্কা, তবু ময়না তাকায় না
চাপাকান্না রাজেশ খান্না, কাঁপাহাস্য গোবিন্দা
কে ক্ষুধার্থ, প্রথম পার্থ, বেলা পড়লে চা খায় না
কে নমস্য, দুগ্ধপোষ্য, কে চালাচ্ছে অযোধ্যা
কে উলঙ্গ, অঙ্গভঙ্গ, কে ডিভোর্সি, ঘুমন্ত
কে বসন্তে নন্টেফন্টে, কে গো বৃষ্টি অঝোরধার
আটপৌরে ইঁদুরদৌড়ে আশাভরসা ছুমন্তর
একরত্তি গরম সত্যি গেলে দিচ্ছে তাদের চোখ
কাটা ছন্দ, তুমিও অন্ধ । খুঁজে ফিরছ সবার দোষ
নীচেউচ্চে শকুন ঘুরছে... তবে সামনে যা দেখছ,
তা নিমিত্ত । মধ্যবিত্ত । খেপে উঠলে অবাধ্য
হে মোগাম্বো, এবার থামব । কাঁচাকাব্যে বুনোট কম
বাকি গল্প অল্পস্বল্প ব্যবিলন বা হরপ্পার
সবই পন্ড, তবু অখন্ড খিদে-তেষ্টা-ভ্রূণোদ্গম...
ও শতাংশ, পাঁঠার মাংস খাওয়া হয়নি ক'রোববার ?
----------কাব্যগ্রন্থ ------------------- উড়ন্ত সব জোকার
প্রতীকী
শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
মোমবাতিদের বিক্রি বাড়ে। মৌনমিছিল । সমাবেশ ।
প্রতিবাদের পলকা শিখা বাতাস এসে কমাবে ।
কোথায় ক'জন খুন হয়েছে দুর্ঘটনার মলাটে
কোথায় কারা শাস্তি পেল সত্যি কথা বলাতে...
এসব কিছুর বিরূদ্ধে আজ মোমবাতিরাই দাঁড়াল
প্রকাশ পেল একটুখানি, রইল কিছু আড়ালও
মাঝেমধ্যে অবাক লাগে। কী হয়েছি কী হতে
দেখতে-দেখতে ডনের থেকে তফাত গেল কিহোতে
ভুল মনে হয়। ভুল মনে হয়। ভুল মনে হয় যা ভাবি
জীবন, তোমার দাঁড়িপাল্লা ধাক্কা খেয়েও স্বাভাবিক।
একদিকে তার খিস্তি রাখা, অন্যদিকে শাবাশি
স্পর্শ করেও কী স্বাদ পাবো, ভালই যদি না বাসি ?
বেঁচে থেকেও লাভ নেই খুব । মরলেই বা ক্ষতি কী ?
বাস্তবে আর কী যায় আসে, সবই যখন প্রতীকী ?
-------------কাব্যগ্রন্থ ------------------- ছাই রঙের গ্রাম
(ক্রমশঃ)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।