গদ্যকবিতা ও গদ্যছন্দ
প্রতিষ্ঠিত ধারাকে ভাঙার জন্য সবসময়েই কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন। কবিতার মতো পঙক্তি সাজানো বাংলা গদ্যকবিতা লিখে এ ধারাটি প্রথম ভাঙেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। বাংলা গদ্যকবিতার সূচনা হয় বিশের দশক থেকে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে তা চূড়ায় পৌঁছে যায়। রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা রচনার কাল তিরিশের দশক, তাঁর চারটি গদ্যকবিতাগ্রন্থ রয়েছে- পুনশ্চ(১৯৩২), শেষ সপ্তক(১৯৩৫), পত্রপুট(১৯৩৬) এবং শ্যামলী(১৯৩৬)। সুধীন্দ্রনাথ বাদে তিরিশের সব প্রধান কবিই অল্পবিস্তর গদ্যছন্দের চর্চা করেছেন। সবচে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন সমর সেন। কাজী নজরুল ইসলামও একটি গদ্যকবিতা লিখেছিলেন, তবে তা মূলত গদ্যকবিতাকে আক্রমন করে।
যাকে আমরা গদ্যছন্দ, গদ্যকবিতা বা মিশ্রছন্দ, মুক্তছন্দ বলি তা মূলত Verse libre বা Free Verse বলে বিশ্বসাহিত্যে পরিচিত। এটার নানান রকম ফের আছে। হুইটম্যান যে Free Verse –এর কথা বলেছেন সেটাকে বলা যায় গদ্যছন্দ আর পাউন্ড যে Free Verse এর কথা বলেছেন সেটা হল মিশ্রছন্দ। গদ্যছন্দ একেবারেই নিয়মিত ছন্দের বাইরের জিনিস অর্থাৎ তা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ছন্দে রচিত। এর প্রাণ ছন্দস্পন্দ, যে-ছন্দস্পন্দ আবার প্রত্যেক কবির ব্যক্তিগত ও নিজস্ব।
খুব সঙ্গত প্রশ্ন, এই প্রাকৃতিক ছন্দ ব্যাপারটা আসলে কি? কিভাবে একে আয়ত্ত করা যায়? উত্তরটা বুঝতেই পারছেন, প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত। গোটা বিশ্বপ্রকৃতিই একটা ছন্দে আবর্তিত। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একটা নির্দিষ্ট সময়কাল অথবা ছন্দে আবর্তন করে। একইভাবে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে, সূর্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে এবং এ প্রক্রিয়ায় গোটা ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুসম্ভার ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রাভিমুখে আবর্তন করে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা না চাইলেও বা ঘরে শুয়ে বসে নিরুপদ্রব নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করতে চাইলেও বাধ্য হয়েই আমাদেরকে এই ছন্দের সাথে একাত্ম হতে হয়। মানুষের কথা বলার মধ্যে, স্বাভাবিক আচরণের মধ্যেও এক ধরণের ছন্দ আছে। যদি কেউ তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে তবে খুব দ্রুতই তিনি অসামাজিক হয়ে পড়বেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও এই প্রাকৃতিক ছন্দ ধরে ফেলাটা খুব জরুরী। বেশীরভাগ নবীন কবিই এই ছন্দ ধরতে না পেরে নানানভাবে কবিতা রচনা করতে চান। কেউ কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে কবিতা ভারাক্রান্ত করে ফেলেন তবু ছন্দটা ধরতে পারেন না। কবিতার দরজায় পৌঁছানোও হয়ে ওঠে না।
যাই হোক, গদ্য কবিতার ছন্দ আসলে খুব সহজ। সেটা হল আমাদের মুখের স্বাভাবিক ভাষাই হল গদ্যকবিতার ছন্দ। আরোপিত কিছু, বাহুল্য কিছু এই ছন্দটাকে নষ্ট করে দেয়। যে প্রশ্নটা উঠে আসতে পারে সেটা হল- তাহলে কি কঠিন ভাষা বর্জন করতে হবে?
এ প্রশ্নের উত্তরে একটু মনোযোগ দাবী করছি। সেটা এরকম, কারো পড়াশোনার লেভেল যদি ওপরের দিকে থাকে, জানার পরিধি যদি বিস্তৃত হয় তবে তার কথা এবং লেখার ভেতরে সে ছাপ থাকাটাই স্বাভাবিক। তিনি যা বলছেন, কবিতায় যে উপমাগুলো ব্যবহার করছেন তার সাথে তার এই জ্ঞানের পরিধি সম্পৃক্ত। তখন তার বক্তব্য লেখনীর বিষয়বস্তু সবার পক্ষে সুবোধ্য নাও হতে পারে। কিন্তু তার লেখার মধ্যে সহজাত দক্ষতায়, তার নিজস্ব স্বাভাবিক ছন্দেই তা এসে যাবে। অর্থাৎ দুর্বোধ্যতা কখনোই ছন্দপতনের কারণ নয় যদি তা আরোপিত না হয়। যে কোন লেখার মান বাড়াতে তাই পড়াশোনার বিকল্প নেই।
কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও এটা সমভাবে প্রযোজ্য। একটা উদাহরণ দেই। একজন লিখলেন ‘ভরত রাজার প্রাচীন দেউলের মত দুটি চোখ’। এই উপমাটিতে সৃজনশীলতা আছে। লেখকের ইতিহাস ও প্রত্নতাত্বিক জ্ঞানের ছাপ আছে তবে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য নয়। কিন্তু লেখকের উপমা ব্যবহারের মধ্যে যে সহজাত ছন্দের প্রকাশ ছিল সে কারণে এটি সার্থক। উপরন্তু লেখকের জানার পরিধি লেখার মান বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। তাই কবিতা লিখতে হলে আপনাকে শুধু কবিতা নয় নানাবিধ জ্ঞানে পরিপূর্ণ থাকার চেষ্টা করতে হবে।
(ক্রমশঃ)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।