জেরি’র কথা মনে আছে? ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের জেরি?
রাউলিংএর লেখা গল্পটা উচ্চমাধ্যমিকে সুনীল স্যার পড়াতেন। আমরা তখনও ‘সৃজনশীল’ হই নি। একটা ছোট্ট বাচ্চা, বাচ্চাই তো, অনাথাশ্রমে থাকে, লেখিকাকে কাঠ কেটে দেয়, গল্প করে ভাবতেই মনটা কেমন করে উঠত। ও মায়ের গল্প বলত। মাকে খুব ভালোবাসত ছেলেটা। মাকে কত উপহার দিবে সেই ফিরিস্তি দিতে দিতে কেটে যেত একেকটা রাত।
‘সৃজনশীল’ যুগের সুমিকে আমি গল্পটা বারবার বলতাম। মেয়েটা হা করে গিলত।
‘জানো, জেরি’র কিন্তু আসলে মা’ই ছিল না’।
আঁতকে উঠত সুমি।
‘তুমি কি জেরিকে মিথ্যাবাদী ভাববে, সুমি? সুনীল স্যার কিন্তু আমাদের অন্য কিছু ভাবতে শিখিয়েছিলেন’।
এই গল্পটাও সুমি জানে। তবু প্রতিবার চোখ কপালে তুলে মেয়েটা। কাজল কাজল চোখ দিয়ে ভাষা ঠুকরে বেরোয়।
‘একটা ছেলে কখনো মায়ের আদর পায়নি। তাকে কী বলব? আদরের কাঙাল? কাঙাল আমরা কে নই, সুমি’?
সুমি মুচকি হাসে। আমার হাতটা ধরে রাখে।
‘তো, স্যার কি বলতেন জানো? এটা নাকি জেরি’র কল্পনাশক্তি। কিংবা স্বপ্নলোক। বাস্তব আর স্বপ্নের সূক্ষ্ম ফারাকটা ফালাফালা করে একশ একটা গল্পের ফোয়ারা ছোটাত ছেলেটা মুহূর্তে মুহূর্তে। এত সুন্দর করে কল্পনা, হোকনা যতই অলীক, কয়জন করতে পারে, সুমি’?
সুমি খানিক চিন্তা চিন্তা মুখে তাকায়। ও কি কোনো স্বপ্নলোকে চলে যেতে চায়?
‘তোমরা তোমাদের অদ্ভুত অদ্ভুত কল্পনাগুলো এখন আমাকে বলবে। কিন্তু কোনো মিথ্যে বলবে না। মিথ্যে আর কল্পনার পার্থক্য সুনীল স্যার আমাদের শিখিয়েছিলেন’।
‘বাহ, মজাতো!’ সুমি লাফিয়ে উঠে। একবার নয়, প্রতিবার।
‘সাজু নাকি স্কুল শেষে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়, ওর বাবা অফিস থেকে আসার সময় লিটল ম্যাগ, সাহিত্য পত্রিকা, রহস্য উপন্যাস এসব নিয়ে আসে। মফস্বলের কলেজে পড়তাম । এতো সৌখিন তো আমরা ছিলাম না। ও আসলেই তাড়াতাড়ি করে ছুট দিত। কিন্তু আমি জানি, ওকে ছুটতে হত টিউশন নিতে। টাকা আসবে কোত্থেকে, বল’?
‘ওর, বাবা ছিল না, না’?
‘ছিল। আর একটা সৎ মা’ও ছিল। বাংলা ছবির রাণী সরকার টাইপের সৎ মা’।
সুমি মন খারাপ করে ফেলে।
‘রাকিব প্রায়ই খ্যাপ এ ফুটবল খেলতে যেত জেলায় জেলায়। হ্যাট্রিক করার গল্পটা বলতে ওর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত’।
‘ওয়াও, তাই’?
‘কিসের ওয়াও! দৌড় দিতে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে, আমাদের মাঠের খেলায় ও সাইড বেঞ্চে বসে থাকে, আবার খ্যাপ’?
সাজুর দুঃখ ভুলে সুমি খিলখিল করে হেসে উঠে।
‘রবিন নাকি মামার বিয়েতে টিনাকে হাত ধরে “ভালোবাসি” বলেছে। টিনা ওর নানি বাড়ির ভাড়াটিয়া। অথচ গাধাটা মেয়ে দেখলে কাঁপতে থাকে, ভয়ে আর লজ্জায়’।
‘উজ্জ্বল কে নাকি ওর চাচাতো বোনেরা বলে নায়ক উজ্জ্বল। আর আমরা কি বলি জানো? দিলদার। দিলদাররা কখনো নায়ক হতে পারে, সুমি? ওদের কি কোনো নায়িকা থাকতে নেই’?
সুমি চুপ করে থাকে। এক দুইদিন হয়তো আমার কাঁধে মাথা রাখে।
‘সবুজের কথা হয়ত তোমাকে বলতাম না। শুনবে? বলি তাহলে। বৃষ্টি হলে ওকে আর পায় কে। মাঠে ফুটবল নিয়ে কাঁদায় মাখামাখি করে ফেলে। এরপর সাঁতার। নদী সাঁতরে জল ঘোলা করে ফেলে ছেলেটা। জীবনে একটা প্যারাসিটামল পর্যন্ত খায়নি, এমন সুস্থতা দিয়েছে ওকে সৃষ্টিকর্তা’।
‘তবে সমস্যা কোথায়? ও কোন কল্পনার কথা বলেছিল? কি স্বপ্ন বুনেছিল সবুজ’?
‘থ্যলাসেমিয়া রোগটার নাম জানো, সুমি? শরীরের রক্ত ভেঙে পড়ে এই অসুখে। চোখ, হাত সাদা হয়ে আসে। বুকটা ধুকধুক করে। হৃৎপিণ্ড দুর্বল হতে থাকে। পেটে চাকা জমে। খুব তীব্র মাত্রার ছিল না বলে সবুজ এখনো ক্লাস করতে পারে। দুই তিন মাস পরপর রক্ত নিয়ে নিয়ে ছেলেটা জেলা হাসপাতালের ধুলোকণাও মুখস্ত করে ফেলেছে। আর কয়টা বর্ষা দেখবে এ জীবনে কে জানে’।
আমার হাতে এক ফোঁটা উষ্ণ জল এসে পড়ে।
‘কাঁদছ সুমি। পৃথিবীটা অনেক কঠিন, ছোটবেলায় মা বলেছিল, বুঝিনি। এই কঠিন পৃথিবীতে অশান্তি লেগে থাকে। বেকার বড় ভাই থাকার অশান্তি। বাবার পেনশনটা নিয়ে টানাটানির জ্বালা। মায়ের ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার দৌড়ঝাঁপ। বোনের শ্বশুরবাড়ির জ্বালার উত্তাপ। ক্লাস শেষে খেয়ে না খেয়ে টিউশন নিতে যাওয়ার চাপ। ঠিকমত টাকা পাই না সবসময়। পেটে দানা পড়েনা মাঝে মাঝে বেলায় বেলায়। খালি পকেট নিয়ে তোমাকে উপহার দিতে পারি না। একটা ফুলও না। শুধু চুমু দিতে পারি, নিবে’?
লাল লাল চোখ নিয়ে সুমি তাকায়। ‘আর তুমি? তুমি কোন স্বপ্নলোক যাপন কর? সেদিন ক্লাসে কী বলেছিলে স্যারকে’?
‘আমি কিছুই বলিনি’।
এরপর আমি চলে আসি। একটিবারও পেছনে তাকাই না। আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে এক সুন্দরী নদীর পাশে বসে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে, আমাকে অনুভব করতে চাচ্ছে, এতটা সুখ আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে থাকি। দৃশ্যটা বাস্তব না স্বপ্ন নাকি অন্য কোনো মহাজাগতিক, এটা ভাবতে বয়েই গেছে আমার।
একটা সময় আমি আমার ঘরে চলে আসি। মাঝরাত। কোনো আলো নেই। ভাইকে বকুনি দিয়ে বাবা চুপ করে গেছে এতক্ষণে। অন্ধকার ঘরে কাঁদছে কিনা কে জানে। বাবাদের কান্না দেখতে হয়না ছেলেদের। মায়ের ইনসুলিনটা শেষ হয়ে গেছে। আজ আবার বটি’র খোঁচা লেগে আঙ্গুলটা কেটে গেছে। ঘা শুকাবেতো?
একেকটা রাত আকাশ ভেঙে দুঃখ নামে, আমি বলি জোছনা। আমার ঘুম আসে না। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। নিজেকে খালি খালি লাগে। এই নির্মম বাস্তবতা অসহ্য লাগে। ধীরে ধীরে আমি প্রবেশ করি স্বপ্নলোকে। জানালার ওপাশে অবাক চোখে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কাঁচের তৈরি শরীরটাতে চাঁদের আলো ঢুকে প্রতিসরিত না হয়ে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন হয়ে একটা মরীচিকার সৃষ্টি হয়। মেয়েটার চোখে জল। আমি মেয়েটাকে ছুঁতে চাই। জড়িয়ে ধরতে চাই। যদিও বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানের দেয়ালটা আমি পেরোতে পারি না। কে কবে পেরেছে, সুমি?
কিন্তু সমস্যা করে নগ্ন জানালাগুলো। জেরি’র ঘরেও নাকি একটা জানালা ছিল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
হতাশাগ্রস্থ, অসহায় একটি ছেলে যখন নির্মম বাস্তবতার তীব্র আঘাতে পরাজিত হতে থাকে প্রতিদিন, তখন সে আশ্রয় নেয় স্বপ্নলোকের। সে এই স্বপ্নের মাঝেই কিছুটা সময় বসবাস করে কষ্ট ভুলে থাকতে চায়।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫