প্রাক আধুনিক যুগ
১৮০০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কাল বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের প্রাক আধুনিক যুগ বলে পরিচিত। এই যুগটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল এ সময়েই। বাংলা সাহিত্যকে এক ধাক্কায় যোজন পথ অতিক্রমণের প্রায় একক কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এছাড়া বাংলা কবিতাকে আধুনিকীকরণের কৃতিত্বধারী, বিরল মেধার অধিকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও এই সময়ের কবি। ১৯২০ সাল পর্যন্ত বাংলা কবিতা ছিল মূলত ছন্দ আর অন্ত্যমিল সমৃদ্ধ কবিতা। ধারণাটা এ সময়েই প্রসার লাভ করে যে কবিতা মানেই ছন্দ আর অন্ত্যমিল। প্রকৃতপক্ষে একটা সময় পর্যন্ত যে কোন সাহিত্য এমনকি গল্পও ছিল ছন্দ অন্ত্যমিল প্রধান। বিশাল বিশাল কাহিনী রচিত হত এরকম কবিতায়।
ছন্দ বিষয়ক সংক্ষিপ্ত আলোচনা
কোন একটা ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তার নানান রকম বৈচিত্র্য চলে আসে। ছন্দেরও এমন অনেক প্রতিষ্ঠিত বিন্যাস আছে। পয়ার, সনেট, লিমেরিক ইত্যাদি। তবে এগুলো নিয়ে আসলে আলোচনা করব না। মূল ছন্দের ভিত্তিটা ধরতে পারলে এরকম অনেক কাঠামো বা বিন্যাস নিজেও আবিষ্কার করে নেয়া যায়। তাই ছন্দ প্রসঙ্গে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে এই অংশটুকু শেষ করব।
ছন্দের ভিত্তি হল মাত্রা। বাংলা ভাষায় ছন্দের মাত্রা তিন প্রকার। সবচেয়ে সহজটি হল স্বরবৃত্ত। তারপর অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত। স্বরবৃত্তে প্রতিটি সিলেবলকে এক মাত্রা ধরা হয়। অক্ষরবৃত্তে মূলত প্রতিটি অক্ষরকে এক মাত্রা ধরা হয়। তবে যুক্তাক্ষরও এক মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়। মাত্রাবৃত্তে প্রকৃতপক্ষে যুক্তাক্ষর ভেঙে ভেঙে দুই মাত্রা বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে মাত্রাবৃত্তই হল প্রকৃতপক্ষে অক্ষরবৃত্ত। অক্ষরবৃত্তের হিসেবটা মূলত সহজ। তবে যুক্তাক্ষর গঠন বিষয়ক জটিলতার জন্য অনেক সময়ে ঝামেলার মনে হয়। যেমন ’আলটপকা’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে চার মাত্রা। কারণ এর উচ্চারণ হল আল্টপকা। এটি স্বরবৃত্তে তিন মাত্রা। আল+টপ+কা। আবার মাত্রাবৃত্তে এটি খুব সহজ পাঁচ মাত্রা- আ+ল+ট+প+কা। আর একটি শব্দের উদাহরণ- বন্ধন। স্বরবৃত্তে এটি ২ মাত্রা- বন+ধন। অক্ষরবৃত্তে তিন মাত্রা- ব+ন্ধ+ন। মাত্রাবৃত্তে চার মাত্রা ব+ন+ধ+ন। আশা করছি খুব সহজ করেই তিনটি মাত্রাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর বৃত্তের ব্যাপারটি হল যে বৃত্তেই হিসেব করা হোক প্রতিটি লাইনে মাত্রার সংখ্যা সমান হতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ স্বরবৃত্তে কাজী নজরুল ইসলামের লিচুচোর-
বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে
সেকি বাস করল তাড়া/ বলি থাম একটু দাড়া
বা+বু+দের+তাল+পু+কু+রে/ হা+বু+দের+ডাল+কু+কু+রে= ৭মাত্রা/৭মাত্রা
সে+কি+বাস+কর+ল+তা+ড়া/ ব+লি+থাম+এক+টু+দা+ড়া= ৭মাত্রা/৭ মাত্রা
এটাই মাত্রাবৃত্তে-
বা+বু+দে+র+তা+ল+পু+কু+রে/ হা+বু+দে+র+ডা+ল+কু+কু+রে= ৯মাত্রা/ ৯মাত্রা
সে+কি+বা+স+ক+র+ল+তা+ড়া/ ব+লি+থা+ম+এ+ক+টু+দা+ড়া=৯মাত্রা/ ৯মাত্রা
এটা অক্ষরবৃত্তে
বা+বু+দে+র+তা+ল্পু+কু+রে/ হা+বু+দে+র+ডা+ল্কু+কু+রে= ৮মাত্রা/ ৮মাত্রা
সে+কি+বা+স+ক+র্ল+তা+ড়া/ ব+লি+থা+ম+এ+ক্টু+দা+ড়া=৮মাত্রা/ ৮মাত্রা
মূলত স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ব্যাপারটা খুবই সহজ। অক্ষরবৃত্তের হিসেবটা একটু খেয়াল করতে হয়।
(ক্রমশঃ)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।