[মূলত সূর্যের অনুপ্রেরণায় এমন একটা লেখার কাজে হাত দেয়া। তবে যে উদ্দেশ্যে শুরু করেছিলাম লিখতে গিয়ে সে উদ্দেশ্যটিই নতুন পথ ধরেছে। ফলে লেখাটাও নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। এমন অনেক বিষয় চলে এসেছে যাকে আমি কবিতার বর্তমান রূপকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করেছি। কবিতা কে কিভাবে লিখবেন সে বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। তবে কবিতার এই ইতিহাসটুকু অন্তত সংক্ষিপ্তভাবে জানলেও কবিতার সূচনালগ্ন থেকে আজকের কবিতার আঙ্গিক পাঠক বুঝতে পারবেন। বিশেষত নতুন লেখকেরা কবিতা রচনার একটা ধারণা পাবেন। যদি কেউ সমস্ত আঙ্গিক ভেঙে নতুন আঙ্গিকে লিখতে চান তার জন্যও এই পুরনো আঙ্গিকগুলো চিনে রাখা জরুরী কারণ কোন দেয়াল ভাংতে চাইলে দেয়ালটি সম্বন্ধে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। আবার কেউ পুরনো ধারা অনুসরণ করতে চাইলে তিনিও তার পথটি চিনে নিতে পারবেন বলে মনে করি। তবে এখানে পুরো আলোচনাটিই সংক্ষেপে করেছি। যারা উৎসাহী এবং কৌতুহলী তারা নিশ্চয়ই স্বউদ্যোগে পুরো বিষয়টুকু জেনে নেবেন।]
অন্যান্য অনেক শিল্প মাধ্যমের সাথে কবিতা তথা সাহিত্য রচনার কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ এই মাধ্যমটি সৃজনশীল ধারার। প্রত্যেক কবিকেই নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়। একটি গান অনেক শিল্পী একই সুরে গাইতে পারেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা যে কোন শিল্পীই কপি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সেই ছবি কিংবা গানটির কৃতিত্ব নতুন শিল্পীর জন্যও অনেকটাই বর্তায়। কিন্তু কোন বড় কবির কবিতা লিখে কেউ নিজের কৃতিত্ব বলে কিছু দাবী করতে পারেন না। কবিতায় তাই শেখানোর বিষয় খুবই কম। কবিতা রচনা সুরকারের সুর দেয়ার মত, কিংবা অংকন শিল্পীদের নিজস্ব চিন্তা দিয়ে আঁকা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের একটা ছবির মত। তাই কবিদের চিন্তা চেতনার মধ্যে সবসময়ে নতুন কিছু থাকতে হয়। তবে তারপরেও কিছু জানার বিষয় অবশ্যই থাকে। আসলে ’জানতে হবে’ এটা কবিতা লেখার একটা পূর্বশর্তের মত। একজন ন্যাচারাল লিরিকিষ্ট মনের আনন্দে নানান ছন্দে ছড়া বানাতে পারেন। কিন্তু সেই ছড়াগুলো কবিতায় উত্তরণের জন্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করতেই হয়।
সমস্যা হল এই বৈশিষ্ট্যগুলো কি, সে নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বা লিখিত ফরম্যাট বা ধরণগুলোকে আমরা গাইড লাইন বলে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু এইসব ধারার বাইরে গিয়েও কোন কোন নতুন কবি আমাদের চমকে দিয়ে নতুন কিছু নিয়ে আসতেই পারেন। কবিতার মত রহস্যময় একটা বিষয় নিয়ে তাই কোন সুনির্দিষ্ট ধারণায় স্থির না হওয়াই ভাল। অন্ধের হস্তিদর্শনের মত নির্দিষ্ট কোন ধারণায় রুদ্ধ হয়ে গেলে আমরা মিস করে বসতে পারি অনাগত কোন কবির অভূতপূর্ব কোন সৃষ্টিকে। কবিতার যে রূপ এখনো আমাদের দেখা হয়নি, সেই মোহিনী রূপ দেখার জন্য কবিতা পাঠককে মোহমুক্ত একটা মন নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতে হয়।
প্রাচীন যুগ
একটা সময় ছিল বাংলা ভাষায় ছন্দ অন্ত্যমিল ছাড়া কবিতাকে কেউ কবিতা বলেই গণ্য করতেন না। কবিতার সংজ্ঞার সাথে তাই এ দুটো ব্যাপার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। আমরা সবাই জানি বাংলাভাষার সবচাইতে প্রাচীন লিখিত কাব্যরূপ হল চর্যাপদ। বাংলায় মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজের পীড়নে এবং মুসলমান শাসনে ধর্মচ্যুত হবার আশংকায় বাংলার বৌদ্ধগণ তাঁদের ধর্মীয় পুঁথিপত্র নিয়ে শিষ্যদেরকে সঙ্গী করে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে পলায়ন করেছিলেন– এই ধারণার বশবর্তী হয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চারবার নেপাল পরিভ্রমণ করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণকালে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামক একটি পুঁথি নেপাল রাজদরবারের অভিলিপিশালায় আবিষ্কার করেন। কেউ অবশ্য বলেন এর নাম চর্য্যাশ্চর্য্যাবিনিশ্চয়। পরবর্তীকালে একে চর্যাপদ নামকরণ করা হয়। চর্যাপদ-এর সবগুলো কবিতা ছন্দে রচিত, পঙক্তির শেষে অন্ত্যমিল। মোট সারে ছেচল্লিশটি পদ বা কবিতা সংকলিত চর্যাপদের কবিতাগুলো আসলে ছিল গান। তাই কবিরা প্রতিটি কবিতার শুরুতে কোন সুরে কবিতাটি গাওয়া হবে, তার উল্লেখ করেছেন। এমন কয়েকটি সুর বা রাগের নাম: রাগ পটমঞ্জরী, রাগ অরু, রাগ ভৈরবী। মূলত বাংলা কবিতায় ১৮০০ সালের আগে যা কিছু রচিত হয়েছে, সবই রচিত হয়েছে গাওয়ার উদ্দেশ্যে। আর গানের সাথে তাল-লয়, ছন্দ-মাত্রার যোগাযোগ থাকতেই হয়।
চর্যাপদের কবিতাগুলোর ভাষার দাবীদার আরো অনেকে ছিল। তবে গবেষকগণ এতে বাংলার ছাঁচ পেয়েছেন। তবে অন্যেরাও বঞ্চিত নয়। মূলত বাংলাসহ বেশ কিছু ভাষার আদি ভাষাই চর্যাপদের ভাষা।
এখানে চর্যাপদের দুটা কবিতাংশ অর্থসহ উদাহরণ হিসেবে দেয়া হল।
চর্যাপদের কবিতা :০১
নগর বাহিরেঁ রে ডোম্বী তোহারি কুড়িআ
ছোট ছোট জোহ সো বাক্ষ্মণ নাড়িআ ।।
কবিতার অর্থ :
নগরের বাইরে ডোম্বী তোমার ঘর ।
ব্রাক্ষ্মণরা খুব যত্নে সে ঘর তোমার এড়িয়ে চলে।
চর্যাপদের কবিতা :০২
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই শবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ শবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত শবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাড়া তোহৌরি।
ণিঅ ঘরণী সহজ সুন্দরী ।।
কবিতার অর্থ :
উঁচু উঁচু পর্বতমালায় বাস করে এক শবরী-বালিকা ;
ময়ূরপুচ্ছপরিহিতা সেই শবরী ,গলায় ওর গুঞ্জার মালা।
উন্মত্ত শবর, পাগল শবর, গোল করিও না----
তোমার ঘরের, তোমার নিজ গৃহিণী সহজ সুন্দরী ।
মধ্যযুগ
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বিবেচনা করা হয় ১২০০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে। বিতর্কিত হলেও কেউ কেউ অবশ্য ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করেন। কারণ এ সময়ের কোন সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া যায় নি। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি সেন বংশের শাসক লক্ষণ সেনের রাজধানী বিনা বাধায় জয় করে দেশে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত করেন। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের সিংহাসন দখল করে দিল্লীর শাসনভুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর পুত্র সেকান্দর শাহের আমলে বড়ু চণ্ডীদাসের আবির্ভাব হয়। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন। এছাড়া মধ্যযুগের অন্যান্য সাহিত্যিক নিদর্শন সমূহ হচ্ছে কীচকবধ, বৈষ্ণব পদাবলী, রামচরিত, শূন্যপূরাণ প্রভৃতি। মধ্যযুগের সাহিত্যধারা দুইভাগে বিভক্ত- মৌলিক সাহিত্যের ধারা ও অনুবাদ সাহিত্যের ধারা। মৌলিক সাহিত্যধারার মাঝে ছয় ধরনের সাহিত্যকর্ম অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ পদাবলী সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, নাথ সাহিত্য, দোভাষী, পুঁথি সাহিত্য, সত্য নারায়ণের পাঁচালী এবং অনুবাদ সাহিত্য ধারায় উল্লেখযোগ্য কাব্য হলঃ রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণবিজয়, রসূল বিজয় ইত্যাদি।
বড়ু চন্ডিদাসের সময়ে বাংলা ভাষা আর বানান রূপ ভিন্ন ছিল। তবে তার মোহন ছন্দের দু একটা উদাহরণ দিতেই হয়।
"আকুল করিতেঁ কিবা কহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন।।
পাখী নহোঁ তাঁর ঠাই উড়ী পাড়ি জাঁও।
মেদনী বিদায় কেউ পসিআঁ লুকাওঁ।।
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।"
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী।।
(কে না বাঁশী বাএ বাড়ায়ি/ বড়– চণ্ডীদাস)
ষোড়শ শতকে জ্ঞানদাসের পদগুলো পড়লে মনে হয় এই সময়ের মধ্যে বাংলা কবিতার ভাষা এবং ছন্দ অনেক ফাইনেস্ট হয়ে এসেছে।
"রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।"
(ক্রমশ)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।