বিশ্বের ইতিহাসে কবিতার যাত্রাপথ কীভাবে শুরু হয়েছিল, কোন প্রাচীন কবি প্রথম তার মনের কথা কবিতায় প্রকাশ করেছিলেন এটা আমার জন্য বরাবরই তীব্র কৌতূহলের বিষয়। সে নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে গিয়ে এই তথ্যগুলোর মুখোমুখি হলাম। প্রাচীনকালে কেউ কবিতা ভাবতেই পারেন- তবে তার পক্ষে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সেটাকে প্রকাশ করা। লিপি আবিষ্কার হবার পরে বিভিন্ন বৃক্ষপত্রে সৃজনশীল রচনাবলী লিপিবদ্ধ করার সুযোগ হয়ত ছিল কিন্তু তা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল। হয়ত একারণেই প্রাচীন সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া বেশ কষ্টকর। যাদের বা যার সামর্থ্য ছিল তিনি হয়ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারতেন। তবু প্রত্নবিদ, বিজ্ঞানী, সংগ্রাহকেরা কখনোই থেমে থাকেননি। তাদের আবিষ্কার থেকে প্রাচীন সাহিত্যের কিছু কিছু নমুনা উদ্ধার করা হয়েছে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদনের পাশাপাশি- সচেতন এবং জ্ঞাত পাঠকদের কাছ থেকে লেখাটা আরো তথ্যসমৃদ্ধ করার জন্য পরামর্শ প্রার্থী।
কবিতার ইতিহাস- বিশ্ব প্রেক্ষাপট
বিশ্বের ইতিহাসে অস্তিত্ব রক্ষা পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন যে কবিতার সন্ধান পাওয়া যায় সেটা ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের রচনা। বারোটি পাথরের ফলকে কীলক লিপিতে লিখিত মহাকাব্য, ‘এপিক অব গিলগামেশ' লেখা হয়েছিল ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উরুক নগরীর রাজা গিলগামেশের ঐতিহাসিক বীরত্বের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে। উরুক হল মেসোপটেমিয়া বা বর্তমান ইরাক। এই কাহিনী পাওয়া গেছে অ্যাসিরিয়ার সম্রাট অসুরবাণীপালের গ্রন্থাগারে। পুরাতত্ত্ববিদেরা নানা কসরত করে একটু একটু করে জুড়ে জুড়ে উদ্ধার করেছেন এইটুক। কে জানে আরো কত চাঞ্চল্যকর রোমহর্ষক কাহিনী ছিলো আদিতে! সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন ভালবাসার কবিতাও ছিল সুমেরীয় অঞ্চলের ইস্তাম্বুলে। ‘এপিক অব গিলগামেশ’ ছাড়াও প্রাচীন বীরত্বের মহাকাব্য হিসেব স্বীকৃতি পায় গ্রীক কাব্য ইলিয়াড এবং অডিসি, ভারতের সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ এবং মহাভারত। সবচেয়ে বড় মহাকাব্যের স্বীকৃতি পায় মহাভারত এবং তিব্বতীয় রাজা গিজারের বীরত্বগাঁথা। প্রাচীনকালে লিখিত মহাকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য দেব দেবীদের কাহিনী। বিশেষ বৈশিষ্টসমৃদ্ধ মানুষের মধ্যেও দেবতার অনুসন্ধান করা হত। যেমন গিলগামেশকে তিনভাগের দুইভাগ দেবতা এবং একভাগ মানুষ বলে মনে করা হত। কৌতূহলী পাঠকদের জন্য সবচেয়ে প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ অথবা মহাকাব্য 'এপিক অব গিলগামেশ' এর সংক্ষিপ্ত কাহিনী নিচে বর্ণিত হল।
সংক্ষিপ্ত গিলগামেশ মহাকাব্য
গিলগামেশ ছিলেন উরুক নগরীর রাজা, তিনি দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। যেমন সুন্দর তাঁর চেহারা, তেমন তাঁর শক্তি বুদ্ধি সাহস। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাঁকে দর্শনের জন্য আসতো প্রতিদিন। তিনি প্রাসাদের সামনের উঁচু বেদী থেকে নির্দিষ্ট সময়ে দর্শন দিতেন।
এনকিদু থাকতো বনে, সে ছিলো সরলসোজা মুক্ত মানুষ, তার গায়েও খুব শক্তি, তবে কিনা গা ভর্তি লম্বা লম্বা পশম। সে বনে বনে শিকার করে বেড়াতো, পশুচর্ম পরতো, ঝর্ণার জল খেতো, মানুষের নগরসভ্যতা বিষয়ে তার কোনরকম ধারণা ছিলো না।
উরুক নগরীর দেবী ইস্তারের মন্দিরে সুন্দরী নারীরা পূজারিণী হয়ে থাকতো। এদেরই মধ্য থেকে ক'জন মোহিনী বনে গিয়ে এনকিদুকে বশ করে নগরে নিয়ে এলো। উরুকে এসে প্রথমেই এনকিদুর রাজা গিলগামেশের সঙ্গে দেখা। পরিচয় শুরু হলো মল্লযুদ্ধ দিয়ে। অনেক সময় ধরে যুদ্ধ চলল। গিলগামেশ বহু কসরত করে শেষমেশ জিতলেন। কিন্তু যুদ্ধের পরেই দু'জনের গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। গিলগামেশ আর এনকিদু একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারতো না। দু'জনে মিলে অনেক বীরত্বের কাজ করে বেড়ালো এনকিদু ও গিলগামেশ। খুম্বাবা দৈত্য বধ করলো, বন কেটে নগরী সম্প্রসারিত করলো।
এদিকে দেবী ইস্তার একদিন গিলগামেশকে আহবান করলেন তার স্বামী হবার জন্য। গিলগামেশ একেবারেই নারাজ, বলেন, "দেবী, ক্ষমা করুন। আপনার কীর্তিকাহিনী তো আর কারুর জানতে বাকী নেই। কত পুরুষের মুন্ডুই তো চিবিয়েছেন অতীতে! দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।"
দেবী রেগে চটে ক্ষেপে একেবারে আগুন। ছুটে গেলেন পিতা আণুর কাছে, ইনিয়ে বিনিয়ে নালিশ করলেন গিলগামেশের নামে, সে নাকি মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে তার নামে। আবদার করলেন স্বর্গের ভীষণ বৃষকে উরুক নগরীতে লেলিয়ে দিতে। আদি দেবতা জ্ঞানী আণু প্রথমে রাজি হন না, বলেন " কন্যা, তাহলে সাত বছর খরা চলবে।" কিন্তু ইস্তার কান্নাকটি করে অনর্থ করতে থাকেন। এনলিল, নিনুর্তা, শামাশ, ঈয়া-সব দেবতারা মিলে থামাতে পারে না তাকে, অবশেষে আণু রাজি হন স্বর্গবৃষকে লেলিয়ে দিতে।
এই বৃষ এসে উরুক নগরী উলৎখন্ড করতে শুরু করলো, বহু লোক মারা গেল। খবর পেয়ে গিলগামেশ আর এনকিদু ছুটে এলো, এনকিদু লাফিয়ে গিয়ে ষাঁড়ের শিং ধরলো চেপে আর গিলগামেশ তার তলোয়ার নিপুণ লক্ষ্যে ষাঁড়ের গলার মধ্য দিয়ে চালিয়ে দিল। বিপুলদেহ ষাঁড় মরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। ষণ্ডের হৃৎপিণ্ড কেটে সূর্যদেবতা শামাশকে আহুতি দিলো গিলগামেশ আর এনকিদু।
এইভাবে সাধের ষাঁড় মরে গেলো বলে দেবী ইস্তার আরো রেগে গেলেন। দেবতাদের দরবারে বিচার চাইলেন। গিলগামেশ আর এনকিদুর মধ্যে একজনকে মরতে হবে। দেবতারা দরবারে বসে ঠিক করলেন এনকিদুর জীবন নেওয়া হবে। শামাশ প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু তিনি সংখ্যালঘু, বাকী সব দেবতারা রাজী।
এনকিদু অসুস্থ হয়ে পড়লো, গিলগামেশ দিনরাত সেবা করল বন্ধুর, কিন্তু বৃথা। অসুখ তার সারলো না। একদিন দিন শেষ হয়ে এলো তার। এনকিদুর শেষকৃত্য সেরে গিলগামেশ আক্রান্ত হলেন তীব্র বৈরাগ্যে। এই তাহলে মানুষজীবন? এত ক্ষণিকের? এই আছে এই নেই? এই জেনে ও মানুষ সন্তুষ্ট থাকে খানাপিনা নাচাগানায়? এমন কি কেউ নেই যে তাকে সন্ধান দিতে পারে অমরত্বের?
গিলগামেশ শুনেছিলেন তার এক বহু পূর্বপুরুষ উৎনাপিশতিম্ নাকি বেঁচে আছেন, কেউ কোনোদিন পার হয় নি এমন এক মহাসমুদ্র পার হয়ে তবে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। গিলগামেশ ছেড়ে দেবার বান্দা নন, সাধারণ তো নন তিনি। তিনি রওনা দিলেন দীর্ঘ যাত্রায়। চলতে চলতে পার হন কত মাঠ, বন, নদনদী। তারপরে এক জোড়া পাহাড়ের কাছে এসে দেখেন এক বিরাট ফটক, বন্ধ। ফটকে পাহারা দেয় একজোড়া অদ্ভুত প্রহরী, তারা অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ড্রাগন। সাধারণ মানুষ হলে তাদের দৃষ্টিতেই ভস্ম হয়ে যেতেন গিলগামেশ, কিন্তু তিনি তো দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা, তাই তাঁর কিচ্ছু হলো না।
তারা আরো খানিক কষাকষির পরে খুলে দেয় ফটক, গিলগামেশ ঢোকে। কালির মত কালো অন্ধকার তার চোখমুখ ঢেকে ফেলে, সে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে এগোতে থাকে। দীর্ঘ সে অন্ধকার-যাত্রা, সে চলে আর চলে। অবশেষে পথের প্রান্ত মেলে, সুড়ঙ্গের শেষে একটুকরো আলো। গিলগামেশ আলোতে বেরিয়ে আসে।
সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র, জীবনে কেউ এ সমুদ্র পেরোয় নি কোনোদিন। শুধু সূর্যদেব শামাশ তার আলোর রথে চড়ে আকাশপথে পেরিয়ে যান এই জলরাশি। এরই পরপারে উৎনাপিশতিম থাকেন। কিভাবে সেখানে যাবে গিলগামেশ?
জলের ধারে বসে থাকে গিলগামেশ, বসে বসে ভাবে আর ভাবে। কোনো পথ পায় না। এমন সময় দেবী সিদুরী সাবিতু এসে সামনে দাঁড়ান তার। বলেন, " গিলগামেশ, ফিরে যাও। জন্মালে মরতেই হয়, এ পরম সত্য, কিন্তু জীবন বড় সুন্দর গিলগামেশ। এভাবে জীবন নষ্ট কোরো না, ফিরে যাও। খাওদাও আনন্দফূর্তি করো, রাজত্ব করো প্রাণভরে। কেন এই ভরা যৌবনের দিনে সব ছেড়ে ছিন্নবসনে খালিপায়ে উসকোখুসকো চুলে পথে পথে ঘুরছো তুমি? আমার কথা শোনো, ফিরে যাও।"
গিলগামেশ কেঁদে লুটিয়ে পড়ে দেবীর পায়ে, " দেবী, আমায় সমুদ্র পেরুবার পথ বলে দিন। উৎনাপিশতিমের কাছে আমার যে যেতেই হবে। আমার এ জীবনের কোনো অর্থ নেই, যদি সেখানে না যেতে পারি।"
দেবী একেবারে গলে জল, ধরে তোলেন গিলগামেশকে। বলেন, "ঠিক আছে, ঠিক আছে। এত ভেঙে পড়তে হবে না বাছা। চোখ মোছো। খেয়ামাঝিকে বলে দিচ্ছি তোমায় নিয়ে যাবে উৎনাপিশতিমের কাছে।"
খেয়ামাঝি গিলগামেশকে পৌঁছে দেয় উৎনাপিশতিমের কাছে। সেই বহু-পুরাতন পূর্বপুরুষ ও তার স্ত্রী, দুজনে গিলগামেশকে স্বাগত জানিয়ে ঘরে নিয়ে যান। গিলগামেশ তো অবাক! একেবারে তারই মতন মানুষ-মানুষ দেখতে এঁরা, সুপার-হিউম্যান কিছু তো না!
বুড়ো উৎনাপিশতিম গিলগামেশকে সামনে বসান, ধীরে ধীরে বলেন, "বাছা, তোমার মন দুঃখে পরিপূর্ণ। কি হয়েছে তোমার? কেনই বা এ দুর্গম পথ অতিক্রম করে এসেছ এখানে? "
গিলগামেশ মলিনমুখে আস্তে আস্তে বলে, " আমার প্রিয়-বন্ধু মারা গেছে। তার মৃত্যুর পরে আমার কাছে জীবন এক অর্থশূন্য দু:স্বপ্নের মত লাগছে। "
উৎনাপিশতিম বলেন, "মানুষকে তো মরতেই হয়, এ তো সবাই জানে।"
গিলগামেশ বলে, "তাহলে আপনারা কী করে পেলেন দেবতাদের মত অনন্ত জীবন?"
উৎনাপিশতিম হাসেন, বলেন, "সে এক বিরাট লম্বা গল্প। শুনতে চাও?"
গিলগামেশ উৎসুক হয়ে ঝুঁকে পড়ে, বলে, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে চাই।"
উৎনাপিশতিম বলেন, " সে বহুকাল আগের কথা। তখন আমার যৌবনের দিন। সদ্য বিবাহ করেছি, সামনে আশায় ভরা দিন ছড়িয়ে আছে। সুরিপ্পাক নগরে ছিলো আমাদের বাড়ী। সেখানে কত সব দেবমন্দির, পূজার্চনা, আনন্দ-উৎসবে সারা বছর ভরে থাকতো সে নগর। কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহ লাগলো একসময়, সেই মারাত্মক গণ্ডগোলে দেবতাদের পূজা বিঘ্নিত হতে লাগলো। তখন দেবতারা বৈঠকে বসলেন। দেবতা এনলিল রেগে গেছিলেন খুব, তিনি বললেন জলোচ্ছ্বাসে তিনি ডুবিয়ে দেবেন দুনিয়া। মানুষের মতন এমন ঝামেলাবাজদের বাঁচিয়ে রেখে কোন লাভ নেই। এরা একেবারে আগাপাশতলা খারাপ। বাকী দেবতারাও বললেন "হ্যাঁ, তাই।" শুধু মানবহিতৈষী দেবতা ঈয়া একবার একটু বললেন," কিছু কিছু ভালো মানুষও তো আছে। তাদেরও এভাবে মেরে ফেলা হবে? " কিন্তু সংখ্যাগুরুর চিৎকারে তার স্বর চাপা পড়ে গেল।"
তারপরে সেই রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আমি দেখলাম দেবতা ঈয়াকে, তিনি ফিসফিস করে বললেন," সুরিপ্পাকের মানুষ, সুরিপ্পাকের মানুষ, শুনছো? তুমি বিরাট এক নৌকা বানাও, সবদিক ঢাকা ছাদওয়ালা নৌকা। সেই নৌকায় সবরকমের গাছের বীজ নাও। সবরকম প্রাণীর একজোড়া করে নাও। বিরাট মহাবন্যা আসবে, সব ডুবে যাবে, বাঁচতে চাও তো এখনই নৌকা বানাতে লাগো। এখনই, এখনই।" ঘুম ভেঙে গেল, কথাগুলো তখনও কানে লেগে রইলো। একটুও সময় না নষ্ট করে কাজে লেগে গেলাম আমরা। তারপরে সব কিছু নিয়ে সেই নৌকায় উঠে বসলাম আমি আর বৌ ।
এলো ভীষণ বর্ষা, প্রবল বন্যা। ছয়দিন ছয়রাত্রি একনাগাড়ে চললো বৃষ্টি, দুনিয়া ডুবে গেল। বন্ধ নৌকা আমাদের নিয়ে ভাসতে লাগলো। সব রকমের বীজ আর সবরকমের প্রাণীর একজোড়া করে নিয়ে আমরা দুটি মানুষ ভাসছি অগাধ জলে, প্রলয়ের অন্তে ফের দুনিয়াকে প্রাণময়ী করবো বলে।
সপ্তম দিনে বৃষ্টি থামলো, নিশাত পর্বতের চূড়ায় নৌকা এসে ঠেকলো। জানালা খুলে দেখি জল শুধু জল চারিদিকে, আমরা দুজন মানুষ প্রাণভরে কাঁদতে লাগলাম। তিনখানা পাখি উড়িয়ে দিলাম, পায়রা, সোয়ালো আর দাঁড়কাক। দিনের শেষে প্রথম দুটো পাখি ফিরে এলো, খুব ক্লান্ত ওরা। কিন্তু দাঁড়কাক ফিরলো না, তবে কি সে কোনো ডাঙা পেয়েছে? নাকি ভাসতে থাকা মৃতদেহের উপরে বসেছে?
পাহাড়ের চূড়ায় ডাঙা জেগে উঠলো, জল নেমেছে। নৌকার দুয়ার খুলে নেমে এসে আমরা দেবতাদের পূজার্চনার ব্যবস্থা করলাম। এনলিল টের পেয়ে রেগে আগুন, কী ই ই ই? এরা পালিয়ে বেঁচেছে আমার মহাপ্রলয় থেকে? কেউ এদের সাবধান করে দিয়েছিল! কে সে? কেন দিয়েছিলো?
দেবতারা সবাই মিলে এনলিলকে শান্ত করলেন, বললেন," দ্যাখো এরা কত শুদ্ধসত্ত্ব ভালো মানুষ! এরা কি মরবার যোগ্য? কত যত্নে দ্যাখো সব বীজ রক্ষা করেছে, কত যত্নে সব প্রাণী এনেছে জোড়া জোড়া! এরা বাঁচলে এদের সন্তানসন্ততি এদের মত ভালো হবে, দুনিয়া খুব ভালো জায়গা হবে তখন। তাছাড়া, মানবজাতি না থাকলে কারা আমাদের উপাসনা করবে? কারা পূজা করবে, প্রসাদ দেবে, নানা উপচারে দেববন্দনা করবে? মিষ্ট সুরে স্তব করবে? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা তো কথাই বলতে পারে না! "
এনলিল গলে জল, এগিয়ে এসে আমার আর আমার বৌয়ের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড় করালেন, কপাল ছুঁয়ে আশীর্বাদ করলেন, বললেন, "আজ থেকে তুমি উৎনাপিশতিম (আত্মনপশ্যতম্?),এতদিন তোমরা দুজন মানুষ ছিলে, আজ থেকে তোমরা পেলে দেবতাদের মতন অনন্ত জীবন।"
গিলগামেশ এতখানি বড় বড় চোখে শুনছিল সব, এইবার কোথা থেকে তার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। সে শুনলো যেন উৎনাপিশতিম বহুদূর থেকে কইছেন, "গিলগামেশ, গিলগামেশ, কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা পেয়েছি অমরত্ব, তুমি কি দিতে পারবে সেইরকম কঠিন পরীক্ষা? এই দ্যাখো, পরীক্ষা দেবে কি, এ ছেলে তো ঘুমিয়েই পড়ছে।"
গিলগামেশ জেগে উঠলো সাত দিন সাত রাত পার করে, উৎনাপিশতিম বললেন, "গিলগামেশ, তুমি খুব দুর্বল মনুষ্য, তুমি অমরত্বের উপযোগী ঠিক নও। দ্যাখো তো কত ঘুমালে, সাতদিন সাতরাত হুঁশ নেই, রা নেই। যাও বাড়ী যাও এবারে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। "
গিলগামেশ কেঁদে ফেলে, " হায়, ঘুম দস্যুর মতন চুরি করে নিল আমার সবকিছু। এখন কোথায় ফিরবো আমি? কার কাছে? আমার উরুক নগরে? না:, এ ব্যর্থ অবস্থায় সেখানে ফেরা অসম্ভব। আমার মরণই ভালো, বন্ধুকে সেখানে ফিরে পাবো, সেই ধূলার প্রাসাদে, ইরকালার ধূলার প্রাসাদে। আমি কিসের দুরাশায় এতদিন ঘুরলাম, আমি কী জানতাম না আমার গতি সেই ধূলার প্রাসাদেই হবে শেষ অবধি?"
উৎনাপিশতিমের বৌ গিলগামেশের করুণ এ বিলাপে একেবারে গলে গিয়ে স্বামীকে বলে, " তুমি যেন একটা কীরকম হয়ে গেছ ! আগে তো তুমি এমন ছিলে না! মানুষ হয়ে তুমি মানুষের দুর্বলতা ভুলে গেলে? বাছা এত কষ্ট করে এলো, কিছু দিলে না তুমি ওকে? দ্যাখো তো কি রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা, হাড়গুলো গোণা যায়। তুমি বিশ্রাম করতে না দিয়ে গপ্পো করেছ, এখন আবার ঘুমের দোহাই দিয়ে বকছো! "
উৎনাপিশতিম এবারে নরম হলেন, কইলেন, "ঠিক আছে, আচ্ছা দেখি কি করা যায়। গিলাগামেশ, কেঁদো না বাছা আর। তোমাকে আমি সন্ধান দেবো এক আশ্চর্য জিনিসের।"
আগে গিলগামেশকে ভালো করে স্নানের ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি, বহুকালের ধুলোময়লা ধুয়ে ধৌতবস্ত্র পরে গিলগামেশ তাজা হয়ে উঠলো। সঞ্জীবনী জল ছিটিয়ে তাকে আরও তাজা করে তারপরে উৎনাপিশতিম তাকে এক আশ্চর্য ওষধির সন্ধান দিলেন, সেই ওষধি খেলে বুড়া মানুষ ফের যৌবন পায়।
গিলগামেশ সেই ওষধি নিয়ে বুড়া আর বুড়ীর পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে চললেন খেয়ামাঝির নৌকায়। সমুদ্র পেরোলেন, প্রাণে তার আশা তার উরুক নগরীর বৃদ্ধ জ্ঞানীরা আর কেউ মরবে না, সকলে পুনর্যৌবন পাবে।
কিন্তু তীরে এসে তরী ডোবার মতন অবস্থা হলো শেষে। পুনর্নবা-ওষধি পাড়ে রেখে এক হ্রদে জল খেতে নেমেছিলেন গিলগামেশ, সেই সুযোগে এক মহানাগ চুরি করে নিয়ে গেল সে ওষধি। জলপান করে ফিরে এসে গিলগামেশ আর পেলেন না তা।
সেই থেকে মানুষ মরণশীলই রয়ে গেল, যৌবন শেষে তার জরা আসে, তারপরে মৃত্যু। সাপেরা কিন্তু প্রতি শীতের শেষে খোলস পালটে নতুন যৌবন পায়।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।