রাহেলা আজ আদালতের কাঠগড়ায়। অনেক বড় একটা অপরাধ করেছে সে, যার কারনে আজ তাকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হলো। তার উপর একটি হত্যা মামলার অভিযোগ আনা হয়েছে, সে একজন হত্যা মামলার আসামি, খুন করেছে সে, সে একজন খুনি। সমাজের জঘন্যতম অপরাধের একটি। আদালতে সে নিজেই শিকার করেছে যে সে একজন খুনি। আজ এ মামলার রায় হবে। সবাই বসে আছে রায় শুনার জন্য। বাদি বিবাদী উভয় পক্ষই আদালতে হাজির। সবার অপেক্ষা রায়।
কিন্তু রাহেলা আজ কেন কাঠগড়ায় আসলো? কি এমন কারন ছিল যে কারনে তাকে একটি খুন করতে হলো, কেন তাকে আজ এই আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হলো। তার ও তো ছিল অনেক স্বপ্ন, ছিল অনেক আশা, ছিল এক ছেলে এক মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার।
মাত্র সতের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। পার্শ্ববর্তী গ্রামের ছেলে মোতালেব এর সাথে। মোতালেব কাজ ছিল চাষাবাদ করা। নিজের দুই খণ্ড জমি ছিল, ছিল একটি ছোট্ট কুড়ে ঘর এর মাঝে মধ্যে পরের জমিতে ও বদলি কাজ করত। বিয়ের এক বছর পর তাদের ঘর আলোকিত করে আসে প্রথম একটি কন্যা সন্তান। স্বামী স্ত্রি দুজনেই খুব খুশি ছিল তাতে।
দেখতে হয়েছিল পরীর মতো সুন্দর। তাই আদর করে নাম রাখল পরী। তার দুবছর পড়ে তাদের ঘরে আসলো একটি ছেলে সন্তান। ছেলেটির নাম রাখল বাবুল। দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে রাহেলা ও মোতালেব এর এক রকম সুখের সংসারই ছিল। ছেলে মেয়ে দুটো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, তাদের দুজনের সমস্ত স্বপ্ন তাদের এই সন্তানদের নিয়ে। সন্তানদের লিখা পড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবে। যেহেতু তারা নিজেরা কেহই তেমন লিখা পড়া জানে না, তাই তাদের আজ কতো কষ্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের তাদের মতো বানাবে না। তাদের সন্তানরা লিখা পড়া শিখে অনেক বড় হবে, বাবা মা কে সুখে রাখবে। এর জন্য রাহেলা ও মোতালেব দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে তাদের সন্তানদের সুখের জন্য।
পরীর বয়স এখন এগারো বছর ও পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে, আর ছেলের বয়স নয় বছর ও পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। দুজনেরই লিখা পড়া মোটামটি ভালো। অনেক কষ্ট করে তাদের লিখা পড়া শিখাচ্ছে রাহেলা ও মোতালেব। দুজনেই এক সাথে স্কুলে যায় ও আসে। প্রতিদিনের মতো সেদিন ও তারা স্কুলে গিয়েছিল, কিন্তু ফেরার কোন নাম নাই। প্রতিদিন বিকালেই তারা স্কুল থেকে ফিরে কিন্তু আজ সন্ধ্যা হতে চলছে তবুও ছেলেমেয়ে দুটির ফেরেনি। রাহেলা একটু চিন্তায় পড়ে গেলো।
বাড়ির একটু দুরেই মরিচ খেতে কাজ করছিল মোতালেব, রাহেলা মোতালেবের কাছে গিয়ে বলল ছেলে মেয়ে দুটো এখনো ফিরেনি, একটু খোজ করে দেখার জন্য। মোতালেব আর একটুও দেরি করলো না, স্ত্রীর কথা শুনেই ছেলেমেয়ের খোজে বেরিয়ে গেলো।
মোতালেব বাড়ি থেকে একটু দুরে যেতে না যেতেই সে দেখতে পেলো গ্রামের কিছু লোক তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে তাদের একজনের কোলে একটা ছোট্ট মেয়ে , মোতালেব দৌরে তাদের কাছে গলো। মোতালেব হতবাক এজে তার ই ছোট্ট মেয়েটি পরী।
ছেলেটিও তাদের সাথে সাথে হেটে আসছে আর কান্না করছে। মেয়ের পরনের কাপড়গুলো অনেক যায়গায় ছেড়া, আর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। আর পুরোপুরি অচেতন অবস্থা। ছোট্টো বাড়ীটির সেই ছোট্টো কুঁড়েঘরে নিয়ে আসা হলো।
মেয়ের অবস্থা দেখে রাহেলা অজ্ঞান হোয়ে পোড়লো। খুবই অমানবিক পৈশাচিকতা চালালো ঐ নরপিশাচ গুলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে চেয়ারম্যানের ভাতিজা তাড় দুই সহকারী কে সাথে নিয়ে তাদের পথরোধ করে, তারপর ছেলেটাকে হাতপা আর মুখ বেঁধে গ্রামের নির্জন রাস্তার পাশে ফেলে রেখে মেয়েটিকে পার্শ্ববর্তী ঝোপে নিয়ে তিনজনে তাদের মনের চাহিদা মিটায় এই নরপিশাচ গুলো। এতোটুকু মায়া হলো না এই ছোট্টো মেয়েটির উপর। হিংস্র ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো তারা ঝাঁপিয়ে পোড়লো আর ছোট্টো পরীর দেহটিকে কূড়ে কূড়ে খেল।
ঐ গ্রামেরই দুজন লোক পথ ধরে জাওয়ার সময় দেখতে পায় মোতালেবের ছেলেটিকে হাতপা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে গঙরাচ্ছে, তারা দৌড়ে গিয়ে তাকে বাঁধন মুক্ত করে। তারপর ছেলেটি লোক দুটিকে বলতে থাকে তাড় বোনকে তিনজন লোক পাশের ঐ ঝোপেড় দিকে নিয়ে গেছে। তারা আর কালবিলম্ব না করে ঝোপেড় দিকে এগিয়ে জায়। কিন্তু ততোক্ষণে সব শেষ। নরপিশাচ গুলো তাদের কামনা মিটিয়ে সড়ে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু তারা সড়ে পরার আগেই দুজনে তাদের চিনে ফেলে, এরা আর কেও না, এই গ্রামেরই চেয়ারম্যানের লম্পট ভাতিজা ও তাড় দুই বন্ধু। লোকজন দেখেই তারা সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। পরী অচেতন অবস্থাই পড়েছিলো জমিনের উপর।
সেখান থেকে পরীকে উদ্ধার করে নিয়ে আশা হয় মতালেবের বাড়িতে। পরীর অবস্থা খুবই খারাপ, গ্রাম্য ডাক্তার ডাকা হয়েছিলো সে উপদেশ দিলো উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পরীকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে তার, রাত শেষ হয়ে ভোর হতে চলল এখনো অজ্ঞেন সে।
অবশেষে দুপুর বারটায় পরীর জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরেই সে মা মা বলে ডাকতে লাগল। রাহেলা মেয়ের পাশেই ছিল এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখল সে। মা ও মেয়ে দুজনের চোখেই অস্রু, দুজনে দুজনের চোখে ফেল ফেল করে তাকিয়ে ছিল। পরী অনেক কষ্ট করছে মায়ের সাথে কথা বলার জন্য, অবশেষে কান্না মিস্রিত কণ্ঠে পরী বলতে লাগল, মা, আমারে ওরা এমনে মারল কেন মা, মা আমার পেটে খুব ব্যথা হয় , মা ওরা আমারে খুব মারছে, তুমি ওগরে মারবা না মা? রাহেলা মেয়ের কথা শুনে শুধুই অঝরে কাদছে, মেয়ের এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই রাহেলার কাছে।
এভাবে কেটে যায় তিনদিন ডাক্তাররা সর্বচ্চ চেষ্টা করে, কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি বাঁচাতে পারেনি পরীকে। তিনদিন পর মারা যায় মেয়েটি। নিমিশেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় মোতালেব ও রাহেলার হাজার স্বপ্ন। যাহা তারা বুনেছিল গত ১১ টি বছর ধরে।
থানায় মামলা করা হয়েছিলো, কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রাফতার করেনি। চেয়ারম্যান সাহেব মোতালেবকে মামলা তুলে নিয়ে মিটমাট করার একটা প্রস্তাব ও দিয়েছিল, কিন্তু মোতালেব ও রাহেলা তা মানেনি। এর আগেও এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল ঐ চেয়ারম্যানের ভাতিজা, তখন এটাকে টাকা পয়সা দিয়ে চেয়ারম্যান মিট-মাট করেছিল। কিন্তু এবার আর পারলো না।
পরী মারা গেলো আজ সাত দিন হলো। মেয়েকে হারিয়ে এক রকম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে রাহেলা, কারো সাথে তেমন কোন কথা বলেনা। সারাদিন চুপচাপ হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে পরীর কবরের পাশে বসে থাকে।
রাত প্রায় আঁটটা বাজে, মোতালেব নামাজ পড়ে মেয়ের কবরের পাসে দাড়িয়ে ছিল। রাহেলা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে ঘড়ে পাটি বিছিয়ে শুয়ে ছিল। এমন সময় হঠাৎ সে শুনতে পেলো বাড়ির পূব দিক থেকে যেদিকে পরীকে কবর দেয়া হয়েছে সেদিক থেকে মোতালেবের গঙরানো আওয়াজ। ঘরের দরজা খুলে রাহেলা সেদিকে তাকাল , সে দেখতে পেল সেই নরপিশাচ চেয়ারম্যানের ভাতিজা ও তার দুই সহযোগী মোতালেবকে ঘিরে রেখেছে। সহযোগী দুজনে মোতালেবকে দুদিক থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আর ঐ ধর্ষকটা মোতালেবের পেটে লাথি দিচ্ছে আর বলছে যদি না সে দূই দিনের ভেতরে মামলা তুলে না নেয় তাহলে তাদের ছেলেটাকেও মেরে ফেলবে।
রাহেলা আড়াল থেকে এ কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারলোনা । মেয়ে হারানো মা কেমন জানি শোকের আগুনে হিংস্র হয়ে উঠলো। নিজের শাড়ির আচলটি কোমরে খুচে নিয়ে ঢুকলো সে ঘরের ভেতরে। ঘরের বেড়াতে খোচা ছিল মোতালেবের ব্যাবহারের একটি দা যেটা দিয়ে মোতালেব শীতের মৌসুমে খেজুর গাছ কেটে রস বের করতো, রাহেলা এক মুহুর্তে দেরি না করে সেই দা টি নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো।
অবছা অন্ধকার রাতে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সই নরপিশাচটির পিছনে দাড়িয়ই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নরপিশাচটির গলার উপর বসিয়ে দিল একটি কোপ, একটি শব্দও বেরলোনা পিশাচটির মুখ দি়য়ে। কোপ খেয়েই প্রথমে বসেগিয়ে আস্তে করে শুয়ে পরলো মাটিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে সহকারী দুজনে মোতালেবকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলো। কিন্তু রাহেলা থামলো না উপর্যুপরি কোপ বসাতে লাগলো নরপিশাচটির বুকের উপর। অনেকক্ষণ পর মোতালেব তাকে থামালো, কন্তু ততোক্ষণে মৃত্যু নিশ্চিৎ হয়ে গেছে পিশাচটির| নরপিশাচের নিথর দেহটি পরীর কবরের পাশেই পড়ে রইল। রাহেলার সরা গায়ে রক্ত, মেয়ে হারানোর কষ্ট থেকে তার জন্ম নিয়েছিল যে ক্ষোভ, আজ মেয়ের কবরের পাশেই সে ক্ষোভর বহিঃপ্রকাশ ঘটালো রাহেলা। নীরব রাহলা হাত থেকে দা টা ফেলে দিয়ে চিত্কার করে আছড়ে পড়লো মেয়ের কবরের উপর, আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, আমি ওগরে মারছি মা, তুই না আমারে জিগাইছিলি আমি ওগরে মারমুকিনা, তখন আমি তোরে জবাব দিতে পারিনাই, এখন তুই একটু তাকাইয়া দেখ মা, আমি অগোর একটারে কোফাইয়া মাইরা ফালাইছি। পাশে দারিয়ে ছিল মোতালেব, তার নয়ন থেকেও গড়িয়ে পরছিল অশ্রুজল।
খুন করার পর পালয়ে যায়নি রাহেলা। ভোঁর হতে না হতেই চেয়ারম্যান সাহেব সাথে করে পুলিশ নিয়ে আসে, রাহেলাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রাহেলার নামে হত্যা মামলা করেন চেয়ারম্যান নিজে বদী হয়ে।
যেই নরপিশাচ বেঁচে থাকলে যার হাতে হয়তো বা আবারো কামনার খোরাক হতো গ্রামের অন্য কোন পরী, সেই নরপিশাচকে খুন করেই খুনি হয়েছে রাহেলা। তার এই খুনি হওয়ার কারনে হয়তো বা বেঁচে যাবে অন্য কোন পরী। বিগত এক বছর ধরে সেই মামলার বিচার কার্য ও যুক্তি তর্ক চলছিলো, আজ জজ সাহেব এই মামলার রায় দিবেন।
কাঠগরায় দারিয়ে আছে রাহেলা , সামনের সারিতে বসা আছে দু পক্ষের উকিল , উপস্থিত আছে মোতালেব তার ছেলেকে নিয়ে, উপস্থিত আছে চেয়ারম্যান সাহেবও, জজ সাহেব এসে নিজের আসন গ্রহন করে রাহেলার রায় পড়া শুরু করলেন।