আমার এক ফুপাতো ভাই আব্দুর রহিম খান অনেকদিন পর আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। বেড়াতে ঠিক নয়, আমার আব্বার বয়স হয়েছে, মাঝে মাঝেই ইদানিং অসুস্থ থাকেন তাই দেখতে যাওয়া। কিন্তু তিনি আমাদের বাসা খুঁজে পেতে ধন্দে পড়ে গলিটার ভিতর এদিক ওদিক আসা যাওয়া করছিলেন। অবশেষে যে বাড়িটাকে সন্দেহ করে দ্বিধা করছিলেন সেই বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোকের নির্গমন তাকে রক্ষা করলো। জিজ্ঞেস করতে বললেন 'জ্বি, এটাই সেই বাড়ি'।
অধ্যাপক সাহেব তার এই বাড়ি খুঁজে না পাওয়ার খেদ, আক্ষেপ অথবা ব্যর্থতা প্রকাশ করেছিলেন যেমন হাস্যরসে, তেমনি আবার গভীর দু্ঃখবোধ থেকেও। এই দুঃখবোধটা আমারও আছে। কিছুটা রহস্যময় এই মানুষটি আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন দুই যুগ পর। আর এই দুই যুগে আশে-পাশের যে পরিবর্তন তিনি দেখেছেন, তাতে স্মৃতি খুঁজে পেতে তার দুঃখটা বেড়ে যায়। এই বাড়িটা তার মাতুলালয় এবং এই বাড়িতে থেকেই তিনি তার কলেজ জীবনের পাট চুকিয়েছেন। আর তাই হয়তো ভেবেছিলেন অনেকদিন পর এসে পুরনো স্মৃতিগুলোর সংগে দেখা-সাক্ষাত হবে। সে তো হয়ই নি,উল্টো ভিমড়ি খেয়েছেন।
আমার সেই ভাইটি দুই যুগ পর এসে ঐ রকম অবস্থা দেখে কষ্ট পেয়েছেন। দুই যুগে তো কত কিছুই হয়! পাকিস্তান ভেংগে বাংলাদেশ হয়েছে দুই যুগের মধ্যেই। কিন্তু আমি পরিবর্তনটা দেখেছি মাত্র অর্ধ যুগে! প্রতি বছরের ব্যবধানে আমি দেখেছি সব ছাপিয়ে কেবলই নতুনের উদ্ভাস! পুরাতনকে মাটিচাপা দিয়ে নতুনের খুব বেশি বাড়াবাড়ি যেন। বাড়িটার আশ-পাশ, চারদিক, মায় বাড়ির ভিতরটা সব কেমন করে বদলে গেল দ্রুত গতিতে! মাত্র ৫/৬ টি বছর! চারিদিকে ইট-পাথরের জংগল আমাকে খুব বেশি করে হতাশ করে ফেলে। মুক্ত হাওয়া-বাতাস, গাছ-পালা, উন্মুক্ত আকাশ, ঢিলেঢালা আশ-পাশ, পিছনে ফেলে আসা এসবের কথা ভেবে আমি খুব মুষঢ়ে পড়ি। কাউকে কিছু বলতে পারি না, যদি কে্উ আমাকে মনে করে অবাস্তবিক, সস্তা আবেগ আর ছেলেমানুষির ডেরা যেন!
আমাদের বাড়িটা টাংগাইল শহরে থানাপাড়ায়। শহরের কয়েকটি বনেদি পাড়ার একটি। থানার দক্ষিনে অবস্থিত বলে এর নাম হয়েছে থানা পাড়া, সন্দেহ নেই। মেইন রোড থেকে উত্তরে মাদ্রাসার মোড় থেকে বাঁয়ে, তারপর ডানে-- থানার ঠিক দক্ষিনেই পুকুর পাড়টা ঘেঁষে, চন্দ বাড়ি বাঁয়ে রেখে একটু এগিয়ে গেলেই ডানের গলিটাতেই আমাদের বাড়ি। যে সংক্ষিপ্ত বিবরনীটা দিলাম তার অনেক কিছুই এখন আর নেই। পুকুরটা ভরাট হয়ে গেছে গত ৪/৫ বছরে, যেটা আমাদের ছোট্ট বেলা থেকেই দেখে আসছিলাম, যার ওপাড়েই মমিন-লিডারদের বাড়ি। আর দু'এক বছরের মধ্যেই এই ভরাট জায়গাটায় দলান উঠে যাবে বলে দেয়া যায়। চন্দ বাড়িটার সেই জৌলুস এখন আর নেই। মরো মরো অবস্থা। দোতলা দালানটা এখনও আছে, তাদেরও বয়স হয়--জানান দিয়ে দা্ঁড়িয়ে আছে। বিপুল'দা থাকতো কাঠের এক্সটেনশন দোতালায়, কত গিয়েছি, আড্ডা মেরেছি। সেও দেশ ছেড়ে চলে গেছে তিরিশ বছর হলো। দালানটার সামনে দিয়ে মলিন অবস্থায় দু'তিনটি পুরাতন টিনের ঘর উঠেছে। দেখে মনে হয় শত বর্ষের পরিত্যক্ত খুপ্রি। ঘিণ্জি হয়ে গেছে।
আমাদের গলিটার দু'পাশেই এখন ইটের দেয়াল উঠেছে। ৫/৭ বছর আগেও ছিল না। গলিতে ঢুকতেই ডান হাতে ঈসা মামাদের বাড়ি, যার মাকে আমরা ডাকতাম নানী বলে। কিভাবে নানী হলো জানিনা। ঐ বাড়িটা ছিল কোমর সমান মোটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আর বাঁ দিকে ছিল মামুনদের বাড়ি, তারও আগে থাকতেন আখতার ভাইরা। ঐ বাড়ির সামনেটা অনেকদিন ফাঁকা ছিল। পরে মামুনরা পাটশোলার অস্থায়ী বেড়া দিয়েছিল। তারপর আসলামদের বাড়ি, কোমর সমান ইটের দেয়াল ঘেরা ছিল। আগের দিনে কোমর সমান দেয়াল অথবা বেড়া থাকলেই যথেষ্ট ছিল মনে হয়।যদিও বাড়ীর প্রবেশ দ্বার বা মূল ফটকের দিকটা উঁচু দেয়াল বা বাঁশের বেড়ায় ঘেরা থাকতো। এই বাড়িটার মুখোমুখি ছিল আমাদের বাড়ি। আসলামদের বাড়িটা দুই অংশে ভাগ করে এক অংশ ভাড়া দিয়ে রেখেছিল। ঐ ভাড়া বাড়িটাতে এক সময় এক কলেজ পড়ুয়া মাধবিলতা তার মামা-মামীর সংগে বসবাস করতে এসেছিল এবং ঘটনাচক্রে একদিন সে আমার সহধর্মিণী হয়ে আমাদের বাড়ির বউ হয়ে চলে আসে। আমাদের বাড়ি ছিল অনেকদিন বাঁশের তালাইর ঘেরা। পশ্চিমেই ছিল একটা খোলা মাঠ, একেবারে বড় না হলেও ছোটখাটো ফুটবল ম্যাচ হওয়ার জন্য মানানসই। মাঠটার চারিদিকেই বাড়ি-ঘর, অনেকদিন জানতামও না এটা কার জায়গা। একেবারে ছোট্ট বেলা থেকেই দেখছি, কেউ আসেও নি কখনো বাড়ি বানাতে। আমরা নাম দিয়েছিলাম 'সবুজ সেনা'র মাঠ। একজন সভ্য, নম্র-ভদ্র, সুশীল মানুষ আখতার ভাই পাড়ার ছেলেদের নিয়ে একটা ক্লাব করেছিলেন যার নাম দিয়েছিলেন 'সবুজ সেনা'। অনেকের সংগে আমিও ছিলাম তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। রক্তছাপ দিয়ে এর সদস্য হতে হতো এবং 'ভাল কাজ ব্যতিত কোন মন্দ কার করিব না' ধরনের শপথ নিতে হতো। এই মাঠটা ছিল আমাদের প্রাণ সঞ্চালক। ধুমিয়ে খেলেছি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, এমনকি খুব ছোট বেলায় রাজা-বাদশা'র যুদ্ধ যু্দ্ধ। বিকেলে খেলার আগে প্রায় প্রতিদিন আখতার ভাইর উপদেশমূলক ক্লাস হতো। মাঝে দু'একবার অচেনা লোকজনদের দেখেছি মাঠের মাপজোক করতে। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে তারা আর কোন চেষ্টা করে নি। আমরা ভাবতাম মাঠটা যেন আমাদের নিজেদেরই, শ্রেফ খেলাধুলার জন্যই।
আমাদের বাড়িটায় ছিল দক্ষিনে মুখ করা ইংরেজি ‘এল্’ প্যাটার্নের একচালা দালান ঘর। নিতান্তই মধ্যবিত্তের ঘর যেমন হয়। দক্ষিন-পশ্চিম কোনে ছিল টিনের বাংলা ঘর। গোসলখানা এবং ইঁদারা বা কুয়োতলা ছিল পূর্ব দিকে মাঝামাঝি জায়গায়। হয়তো ইঁদারার কারনে রান্না ঘরটা ছিল মূল দালানের একটু কাছাকাছিই। যে কারনে রান্না ঘরটার পিছনে বাড়ির ফটকের দিকে বেশ কিছু খালি জায়গা রয়ে গিয়েছিল, যেখানে লাগানো হয়েছিল একটা পেয়ারা গাছ, সুমিষ্ট লাল পেয়ারা। আরো ছিল একটা আম গাছ, গলির দিকের সীমানা ঘেঁষে ছিল কয়েকটি সুপারি গাছের সারি। উল্লেখ্য যে, আমার আব্বা-আম্মা দু'জনেই চুটিয়ে পান খেতেন। একেবারে উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল লম্বা এক হরিতলী গাছ। প্রত্যেক মৌসুমে অসংখ্য হরিতলী এসে বসতো। হল্দে-সবুজ রঙের পাখিগুলো। দু'একবার আব্বাকে দেখেছি বন্দুক দিয়ে শিকার করতে। এক ফায়ারে ৪/৫ টা পড়ে যেতো। সালন রান্নায় সুস্বাদু ছিল খেতে। পরে অবশ্য আব্বা আর শিকার করেন নি। একসময় গাছটা কেটেও ফেলা হয়। এই গাছটার খুব কাছেই ছিল একটা সজনে গাছ। সজনেগুলো হতো যেমন সুডৌল, তেমনি ছিল স্বাদ। এমন সজনে বাজারেও পাওয়া যেতো না। পশ্চিম দিকের সীমানা ঘেঁষে ছিল বেশ কয়েকটি আম আর কাঠালের গাছ। একটা গাছের কাঠালের রোয়ার রঙ ছিল প্রায় কমলার মতো, অথবা পিচ্ রঙের। মূল দালানের পিছনে ছিল আবারো সুপারি আর কয়েকটি নারিকেল গাছ। এইসব গাছপালা সবই ছিল আমার আম্মার হাতে লাগানো। আশ্চর্য লাগে আমার আম্মা এইটুকুন জায়গার মধ্যে কেমন গুছিয়ে গুছিয়ে এতসব গাছগাছরা লাগিয়ে বাড়িটাকে ছায়া-সুনিবিড় করে রেখেছিলেন, তার সন্তানদের সুমিষ্ট ফলের স্বাদে মাতিয়ে রেখেছিলেন! এগারো শতাংশ জায়গায় এর চেয়ে বেশি কি আর করা যায়!
আমাদের গোসল সারা হতো কুয়োতলার লাগোয়া বাথরুমে। বাথরুম বলছি এই কারনে যে এটা ছিল পাকা দালান, ভিতরে ছিল ছোট্ট এক জলাধার, যাতে মাঝারি মানের আট বাল্তি পানি ধরতো। বাইরে কুয়ো থেকে পানি ঢেলে বাথরুমের জালাধারে পানি ফেলার ব্যবস্থা ছিল। পৌরসভার ট্যাপের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার পুর্ব পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল। তারপর এক সময় শহরে ট্যাপের পানি সরবরাহ শুরু হলে কুয়োর ব্যবহার কমে যায়। এইসব আধুনিক সুবিধাদি আমরা শহরবাসী খুব বেশী দিন হলো পাই নি। ট্যাপের পানি পেয়েছি যদ্দুর মনে পড়ে স্বাধীনতার পরপর, স্যানিটারী সিস্টেম এসেছে তারও অর্ধযুগ পর, সম্ভবতঃ সত্তুর দশকের শেষ দিকে।
মুল দালানে ছিল শুধুমাত্র দু'টি ঘর। পশ্চিম দিকটায় থাকতেন আব্বা-আম্মা। যেটা 'এল'-এর অনুভূমিক। পূর্ব দিকেরটা একটু বড়, থাকতাম আমরা ভাই-বোনেরা। আমাদের ঘরটায় দু'টো খাট পাতা ছিল। সামনে ছিল লম্বা বারান্দা। আব্বা ছু'টির দিনে বাজার সেরে এখানে বসে আয়েশ করে পান চিবুতেন আর দিনের খবরের কাগজ পড়তেন। তখন জেলা শহরে খবরের কাগজ দুপুরের আগে পাওয়া যেতো না। আব্বার ঘরে ছিল একটা সিলিং ফ্যান, আমাদের ঘরে ছিল না। এটা ষাটের দশকের মাঝামাঝির কথা। তখন ঘরে দু'একটা ফ্যান থাকলে বিত্তবানদের কাছাকাছি বলে ধরে নেওয়া হতো। আসলে সেই রকম কিছু নয়। আমরা নিরেট মধ্যবিত্তই ছিলাম। একটা বড় রেডিও ট্রান্জিস্টার ছিল, সর্ট ওয়েভ্। আব্বার ঘরে দেয়ালে ছোট্ট একটা তাক্-এ রাখা থাকতো। তাক্টা তৈরীই করা হয়েছিল এই রেডিওটা রাখার জন্য। তখন অবসর সময় কাটতো রেডিওর গান আর নাটক শুনে। ঢাকা কেন্দ্রের অনুরোধের আসর শোনার জন্য তক্কে তক্কে থাকতাম, অবশ্য একটু বড় হওয়ার পর। শর্ট ওয়েভে শোনা হতো বিবিধ ভারতী এবং বিবিসি। স্বাধীনতার পর সৈনিকদের অনুষ্ঠান 'দুর্বার' শুনতাম রাত পৌনে আটটায় সবাই মিলে।
বাংলা ঘরটাতে থাকতেন, প্রথম দিকে, সেই ফুপাতো ভাই আব্দুর রহিম খান আর আমার ছোট চাচা আবুল বাশার। দু'জনেই আমাদের বাড়িতে থেকে কলেজের পাট চুকিয়েছেন । বয়সের দিক থেকে দু'জনেই ছিলেন খুব সমসাময়িক। রহিম খানের ছিল নন্-স্টপ পড়াশোনা আর চাচার ছিল বেশ ক'টা স্টপেজ। রহিম খান একবারে পাশ করে বেরিয়ে গেছেন, আর ছোট চাচা ইন্টারে দু'বার এবং ডিগ্রীতে তিনবার ফেল্। কিন্তু তার ধৈর্য্য ছিল অসীম এবং ঈর্ষনীয়। প্রগাঢ় মানসিক শক্তি না থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হতে পারতেন না। সবশেষ ছোট চাচা বেরিয়ে যাবার পর আমাদের বড় ভাই বাংলাঘরটায় আশ্রয় নেন। তিনি ঢাকায় চলে যাবার পর মেজো ভাই জায়গা পেয়ে যায়। ওদিকে একজন নিষ্ক্রান্ত হয় আর এদিকে দালানঘর থেকে একজন করে কমে। সংসার মনে হয় এভাবেই বড় হতে হতে ছোট হতে থাকে। ঐ বাংলাঘরটায় শেষ থেকেছিলাম আমি এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। আমার এক দশকের অনেক স্মৃতি ঐ ঘরটায় জড়িয়ে আছে।
এই বাংলাঘরটায় একসময় এক মধ্য বয়সী মওলানা জায়গীর ছিলেন, মনে পড়ে। আমাদের পড়ানোর চেয়ে তার মাথার পাকা চুল ওঠানোই জরুরী ছিল বেশি। বাংলাঘরের বাইরের দিকে ছিল লম্বা বারান্দা। অবসরে আমাকে দিয়ে পাকা চুল ওঠাতে দিয়ে তিনি অঘোরে ঘুমাতেন, আর এক ফাঁকে আমি পালাতাম।
ছেলেবেলায় আমাদের বাঁধাধরা এক বৃদ্ধ প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন, সরোজ বাবু। চুল দাড়ি সব সাদা। তিনি এলে আমরা ঐ বাইরের বারান্দাতেই পড়তে বসতাম মাদুর বিছিয়ে। মুখ লাল করে সবসবময় পান খেতেন, আমাদের পড়াতেন আর ঝিমুতেন।
বড় মায়া-মমতায় ঘেরা ছিল আমাদের বাড়িটা। ছয় ভাই-বোনের কোলাহলে মুখর থাকতো সব সময়। আমোদ-আহ্লাদের পাশাপাশি ঝগড়া-ঝাটিও থাকতো। শীতের বিকেলের উঠানটার কথা খুব মনে পড়ে...দুপুরের খাবার শেষে আম্মা নিজ হাতে উঠোন ঝাট দিতেন, যখন কাজের লোক ছিল না। মাটির উঠোনে বাঁশের ঝাড়ুর দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যেতো, যেন এক ধরনের শিল্পীত মোজাইক । তারপর বারান্দায় বসে আম্মা একটা পান খেতেন খুব আয়েশ করে। পান খেলে আম্মাকে অসম্ভব সুন্দর লাগতো। কি কারনে জানি না, পান মুখে থাকা অবস্থায় তিনি কখনো রাগ করতেন না। যে কারনে আমাদের সংগে কখনো রাগ করলে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম পান খাওয়ানোর জন্য।আমাদের বিকেলটা ছিল স্বাধীনতার মত। অপেক্ষায় থাকতাম কখন বিকেল হবে আর শুরু হবে বন্ধুদের নিয়ে খেলায় মাতামাতি। অবশ্য প্রতিদিনের হাতের লেখা আর অংকের পাঠ শেষ করে। নইলে ছোট চাচার হাতে চিরদিনের জিম্মি। আমি ছুটির দিনে দিনের বেলায় বোনদের সংগে পুতুল খেলাও খেলতাম। পুতুল খেলা হতো উঠানের এক কোনে, আম-কাঁঠালের তলায়। আমার পুতুলগুলো ছিল বনেদি পরিবারের। জুতার বাক্স দিয়ে আমি বানাতাম দোতলা বাড়ি আর বোনদের বানিয়ে দিতাম একতলা। আব্বার আদরটা একটু বেশি ছিল বলে আমার পকেটে দু'চার পয়সা থাকতো। ঐ দিয়ে কেনা টিনের গাড়ীতে চড়ে আমার পুতুল-পরিবার বোনদের পুতুলদের বাড়ী বেড়াতে যেতো।
আমাদের বাড়ির কোনে ছোট্ট একটা মুরগির খোয়ার (ঘর) ছিল। ছোট বেলায় টিনের চালায় কাঠের এই ছোট্ট ঘরটা হা করে অবাক তাকিয়ে দেখতাম। মধ্যবিত্তের সংসারে তখন প্রতি বাড়িতেই মুরগি পালা হতো। মুরগিগুলো সারাদিন উঠানে চড়িয়ে বেরাতো, বাচ্চাগুলো কিচিরমিচির করে মা-মুরগির সংগে লেগে থাকতো। সন্ধ্যাবেলায় আম্মা সযতনে ওদের খোয়ারে পুরে তবে নামাজে যেতেন। যন্ত্রনা ছিল অনেক। মাঝে মাঝে রাতের বেলা শিয়াল এসে মুরগি দু'একটা নিয়ে যেতো। একদিন সকালে উঠে দেখি পুরো খোয়ারটাই গায়েব। মুরগিচোরের কাজ।অনেক খোঁজাখুঁজির পর সেটা পাওয়া গেল পাড়ার পিছনের মাঠের কোনায়। মুরগি একটাও নেই, আশেপাশেও না। বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল। আম্মার মন প্রচন্ড রকম খারাপ, খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
রান্না ঘরটা ছিল বাঁশের তালাইয়ে ঘেরা উপরে টালির ছাদ। মেঝে ছিল মাটির কিন্তু চারদিক ইট বাঁধানো। ইটরঙের টালির ছাদের রান্না ঘরটা ছিল আমাদের বাড়ির বৈশিষ্ট এবং সৌন্দর্য্যবর্ধক। এই ঘরে আসলে রান্না এবং খাওয়া দু'টোই হতো। এক কোনে ছিল দু'টো মাটির উনুন, তখন কাঠ বা গাছের লাকরিতে বাড়ির রান্না হতো। লাক্ড়ির দাম বেড়ে যাওয়ার পর কাঠের ভুসি বা গুঁড়ি দিয়ে রান্না হতো। আরেক কোনে ছিল মিটসেফ আর থালাবাসন রাখার র্যাক। বেতের পাটি ছিল, পিঁড়ি ছিল। আম্মা বেড়ে দিতেন, আমরা যে যার মতো বসে খেতাম। শুধু আব্বার খাবারটা চলে যেতো দালান ঘরে। তিনি সেখানে বসেই খেতেন বরাবর। এই রান্না ঘরটা পরে শুধু খাবার ঘর হিসেবেই থেকে যায়, রান্না করার জন্য ঘরটার পাশেই খালি জায়গাটায় আর একটা ছোট ঘর করে নেয়া হয়, সম্ভবতঃ রান্নার ঝামেলা বেশি থাকার কারনে। পিছনের দিকে একটি বাঁশের মাচাও তৈরি করে নেয়া হয় যাতে লাকরি-পাটশোলা ইত্যাদি রাখা হতো। তিতাস গ্যাস না আসা পর্যন্ত এখানেই রান্না হতো।
এই বাড়িতে থেকেই আমাদের শৈশব-কৈশোর-তারুন্য পার হয়ে যায়। সময়ের সংগে সংগে ছোট হতে থাকে সংসারটা। কোলাহল কমতে থাকে। একদিন আমরা একে একে বেরিয়ে পড়ি মফস্বল শহর থেকে ঢাকায়, জীবনের তাগিদে। বোনদেরও বিয়ে হয়ে যায় এক এক করে। আব্বা-আম্মা একলা হয়ে পড়েন। এইসব ঘর-সংসারগুলোর ছোট হয়ে যাওয়াটা খুব চোখে পড়ে। ছোট হওয়ার সংগে সংগে শুন্যতা বাড়তে থাকে। জীবনের প্রতিটি স্তর মানুষের জন্য জরুরী বলেই সবাই এইসব পরিবর্তনগুলো খুব সহজেই মেনে নেয়।
আমি কিছুদিন ঢাকায় থেকে চাকরিসূত্রে একেবারে আফ্রিকায় চলে যাই দারা-পরিবার নিয়ে। দু'বছর পরপর আসি। ঢাকায় ভাই-বোন-ভায়রাদের বাসায় থেকে দু'চার দিনের জন্য টাংগাইলের বাড়ি যাই। আমি চলে যাওয়ার এক বছর না ঘুরতেই আম্মা আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান। বাড়িটা এখন খা খা করে। এই আসা যাওয়ার মাঝেই একদিন আব্বা আমাদের তিন ভাইকে ডেকে বাড়ির অংশ ভাগ করে দিলেন। বললেন, বাবারা, তোমাদের আম্মা চলে গেছেন, আমিও কবে চলে যাই ঠিক নেই। কখন কি হয়। বাড়িটা তোমাদের ভাগ করে দিয়ে যাই। কি ভাবে কি করা যায়, বল তো !
আমরা বললাম, আপনার যেমন খুশি, আমাদের কিছুই বলার নেই।
তিনি মুল দালানটা মেজো ভাইকে দিতে চাইলেন এবং আমরা বাকি দুই ভাই বিনা বাক্যে সম্মতি দিলাম। বলে নেয়া ভাল, আমি আগে থেকেই কথায় কথায় বলতাম, বাড়িটা যদি ভাগ করা হয় কখনো, তা'হলে কারো আপত্তি না থাকলে যেন বাংলাঘরের দিকটা আমাকে দেওয়া হয়। কারন ঐ ঘরটাতে আমি থেকেছি সবচেয়ে বেশি দিন, স্মৃতিও জড়িয়ে আছে অনেক। মেজো ভাইরটা হয়ে যওয়ার পর থেকে যায় পশ্চিমের ঐ বাংলাঘর আর পূর্বের রান্না ঘরের দিকটা। বড় ভাই ব্যপারটা জানতো বলে সহজেই সম্মতি দিয়ে সে রান্না ঘরের দিকটা নিল। এই ব্যাপারে আমরা সবাই উদার ছিলাম। কোন প্রশ্ন ছিল না কোন। কোন আবেগও কাজ করে নি। অনেকেই বাড়ি ভাগ করা নিয়ে আবাগাপ্লুত হয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাপের ভিটা কেন ভাগ হবে? পরে ভাগ ঠিকই হয় কিন্তু সুখের হয় না। আমরা বাস্তব দিকটাই দেখেছি। বাড়ি ভাগ হলেই সব শেষ হয়ে যায় না। বোনদের পাওনা অংশও বুঝিয়ে দেয়া হয়।
এর পর আমি দেশে এসেছি কয়েকবার। বাড়ি গিয়েছি সবাই মিলে। যখন গিয়েছি, ভাইয়েরা দু'জনেই সংগে যেতো। বোনেরা কেউ পাড়লে যেতো, স্বামীর সংসারে বাঁধা যেহেতু। দু'চার দিন যা থাকতাম, হৈ হুল্লোর করে কাটাতাম। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে বাড়ির এদিক সেদিকটা হেঁটে হেঁটে কি যেন খুঁজতাম। বারান্দায় বসে বাংলাঘরটার দিকে উদাস তাকিয়ে থাকতাম। বড় নস্টাল্জিক আমি। পাশের মাঠে যেয়ে ছোটদের খেলা দেখতাম আর আমাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ চেষ্টা করতাম। আমি জানতাম, কিছুই থাকবে না একদিন, সব বদলে যাবে। তাই হয়তো আমি বর্তমানটার সংগে খুব বেশি করে লেপ্টে থাকতে চাইতাম। জীবনের ফেলে আসা অংশটুকুকে খুব বেশি করে অনুভব করতে চাইতাম।
একদিন বিদেশে থেকেই সংবাদ পেলাম বড় ভাই বাড়িতে ওর জায়গায় দালান করবে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। দালান করবে এই জন্য নয়, বাড়িটার সবকিছু বদলে যাবে, চাপা পরে যাবে আমাদের শৈশব-কৈশোরের সেই ছাপগুলো, সেই ভয়ে। বদলে তো একদিন যাবেই, কবে বদলাবে সেই ভয়ে ছিলাম। সংবাদটা পাওয়ার এক বছর বাদে দেশে এলাম, বাড়ি গিয়ে দেখলাম ইট-সুরকি-বালুর ছড়াছড়ি। বড় ভাইর জায়গাটায় ইতিমধ্যে মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে গেছে, কয়েকটি কংক্রিটের কলাম দাঁড়িয়ে আছে, যেন উড়াচ্ছে নিশান আরো উপরে ওঠার । এদিকের সব গাছপালা শেষ, ইঁদারা বা কুয়োতলা বলতে কিছু নেই, কংক্রিটের মেঝের নিচে চাপা পড়ে গেছে। বাথরুমটা কোন রকমে বেঁচে আছে। রান্না ঘর একযুগ আগেই গ্যাস আসার পর সরে গিয়ে মূল ভবনের এক্সটেনশানের সংগে লেগে গেছে। অবশিষ্ট যা পড়ে ছিল তা এখন মাটিচাপায় চলে গেছে। আমি দেখতে পেলাম আমাদের বাড়িটার শরিরের এক দিকে একটা অবধারিত টিউমার বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। একদিন ধীরে ধীরে বড় হবে, বাড়িটার অবয়ব বিকৃত হবে। খুঁজে পাবো না এদিক সেদিক তাকিয়ে আমাদের হিরন্ময় দিনগুলোর কোন চিহ্ন। মনটা হাহাকার করে উঠলো।
বাড়িটার জন্য অনেক আগে আরও একবার মনটা হাহাকার করে উঠেছিল, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমরা সবাই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দেশের বাড়িতে চলে যাই আরো অনেক শহুরে বাঙালীর মত, পাকিস্তানী হানাদারদের হাত থেকে প্রান রক্ষার জন্য। আব্বা ছিলেন সরকারী চাকুরে, সুতরাং পাকি সরকারের আদেশ জারি হলো সব কর্মচারীদের অনতিবিলম্বে কাজে যোগ দিতে। সপ্তাহ তিনেক পর, সম্ভবতঃ এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আব্বা আমকে আর মেজো ভাইকে নিয়ে টাংগাইল ফিরলেন। সেই দিন দেখেছি জরাজীর্ন বাড়িটাকে। মাত্র তিনটি সপ্তাহের অযত্নে বাড়িটা যেন বৈধব্য নিয়েছে।মুরগির বাচ্চা ধরার বাঁশের টুপড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে উঠানে। শুন্য খোয়ার পড়ে আছে এক কোনে। শৈবাল জমে গেছে চারিদিকে। বারান্দা-চৌকাঠে বালির আস্তর জমে আছে। যেন ভাঙা হাট। বাসবাস না থাকলে বড়িতে কেমন মরন ধরে যায় সে দেখেছি সেদিন।
আরো দু'বছর পর যখন এলাম, দেখলাম বিশাল এক বাক্সের মত দালান দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মূলভবনটার সামনে বাঁ দিকে একেবারে গা ঘেঁষে। আমার খুব কষ্ট হলো দালানটার নক্সা দেখে। আমাদের সেই উঠোনের দিকে একটু জায়গা ছেড়ে দিলে কি এমন হতো ! সামনে ছোট্ট একটা বাগানের ব্যবস্থা রাখতে পারতো। আমার ইচ্ছে ছিল তিনটে বাড়ির সন্মুখ ভাগটা যেন মুখোমুখি থাকে। বাড়ি থেকে বেরুলেই যেন একে-অন্যের দেখা হয়। জায়গা ছেড়ে রাখলে আকাশটাও একটু দেখা যাবে। বড় ভাই যদি দালানটা বানানোর আগে আমার সাথে একটু কথা বলতেন, তা'হলে নিশ্চয়ই আমি এই কথাগুলো বিনীতভাবে তাকে বলতাম। আসলে এ সবই আবেগের কথা । আজকের এই কঠিন অর্থনীতির যুগে কে শুনে এইসব কথা ! এই দেশে এখন বেঁচে থাকার জন্যই মানুষ সমধিক উৎকন্ঠিত।
এখন আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসলে বাঁ চোখে কিছু দেখি না। বাড়িটার বাঁ দিকটা কালের আঁধারে হারিয়ে গেছে। সবকিছু ছাড়িয়ে একটা কংক্রিটের টিউমার দাঁড়িয়ে আছে। সেই রান্না ঘর, পেয়ারা গাছ, কুয়োতলা আর নেই...ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। ডান দিকে আছে সেই বাংলা ঘরটা, দাঁড়িয়ে আছে কোন রকমে। বয়স হয়েছে বেশ, মাঝে কিছু জোড়া-তালি দেওয়া হয়েছিল। ঘরের সামনে আছে একটা মেহ্দি গাছ, আছে নীম গাছ, কিছু ঘাস, লতা-পাতা। প্রজাপতি-ঘাসফড়িং ওড়াউড়ি করে মাঝে মাঝে। উঠানের অর্ধেকটা বেঁচে আছে এখনো। এই ঘর আর উঠানটুকুও থাকবে না একদিন। আমার ইচ্ছে আছে ঐ দিকটাতে আমি একটা ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি করবো, মুল ভবনের সামনের দিকে এক চিল্তে জায়গা ছেড়ে দেবো, দু'চারটা গাছগাছালি বুনবো। চাই মেহ্দি কিংবা নীম। দরজা খুলে যেন দেখতে পাই আমাদের স্মৃতিঘেরা দালানটা। মেজো ভাই যদি এটার উপর বুলডোজার না চালায় তাহলে আশা করি এই রকমই থাকবে।
আমাদের বাড়িটার বদলে যাওয়ার পাশাপাশি বদলে যেতে থাকে আশপাশটাও। যেন বদলে যাওয়ার উৎসব শুরু হয়েছে। একদিন আমাদের পাশের মাঠটাও বিক্রি হয়ে গেল ৬/৭ টুকরোয়। বছর তিনেকের মধ্যে ৪/৫ টা বাড়ি উঠে গেল। আমাদের গা ঘেঁষে দু'টো, এক ইঞ্চি জায়গা ছাড় নেই। দক্ষিন-পশ্চিমের কোনে একটা দোতলা হলো। ওখানটা দিয়ে আড়াআড়ি একটা রাস্তা ছিল, সোজা মেইন রোডে ওঠা যেতো। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। আরো বাড়ি উঠবে; ইট-সুরকির স্তুপ করা আছে। বসতি গড়ার উৎসব শুরু হয়েছে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে ঘরবদ্ধ হওয়ার নিদারুন পরিকল্পনা। আসলামদের বাড়ির পশ্চিমের অংশটুকু বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখনে এক বছর আগেও ছিল একতলা দালান, এবার দেখলাম হু হু করে পাঁচ তলা উঠে গেছে। পূর্ব দিকের নানীদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে, উঠেছে তিন তলা দালান, চালু করেছে 'মাতৃসদন ক্লিনিক'।
আমরা পিষে যাচ্ছি। চারিদিক থেকে আমাদের বাড়িটা নিষ্পিষ্ট হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি বছরে কি ভায়ানক অবস্থা! ধেয়ে আসছে যেন কংক্রিটের জঞ্জাল। মাটিচাপা পড়ে যাচ্ছে সব। চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই সব শৈশব-কৈশর। আর কোন নতুন শৈশব তৈরি হবে না, এখনকার নতুনেরা জানবে না কৈশোরের হুটোপুটি ছুটোছুটি। চিনবে না আকাশের রঙ, শরতের বিকেল--ঘুড়ি ওড়াউড়ি। এক ফালি উঠোনের কথা কল্পনাও করেতে পারবে না। এরা এখন পচা নর্দমার পাশে কংক্রিটের দেয়ালে কাঠ-কয়লায় 'অমুক+তমুক' লিখে, নয়তো ভুল বানানে কিছু অশ্লীল কথা লিখে সময় কাটাবে। বন্ধুর হাত ধরে পাড়ার কোন এক সূর্যালোকহীন অন্ধকার কোনে 'ড্রাগ' নামক অতিথিকে আলিংগন করে বুদ্ হবে, আরও অন্ধকারে তলাবে বলে।
আমার সেই ক্ষুদে বন্ধুরা বেঁচে গেছে ,যাদের সঙ্গে আমার বেকার জীবনের দিনগুলো চুটিয়ে ক্রিকেট -ফুটবল খেলে কাটিয়েছি। এই 'সবুজ সেনা' মাঠের সেই তুখোর বোলার আনিস-রন্জু, ফেরদৌস, ব্যাটস্ম্যান রুমি, শামিম, লিডার, চন্দন, মানিক, রাঙ্গা, হারুন, নাসাদ, আরও কত নামের ক্ষুদে বন্ধুরা তোমরা কত সৌভাগ্যবান ছিলে। তোমরা খোলা আকাশের নীচে সবুজ মাঠে রৌদ্রের আদরে শৈশব কাটিয়েছ, কৈশোরে নেচেছো। অঝোর বৃষ্টিতে ফুটবল খেলায় হুটোপুটি করে কাটিয়েছো কত বিকেল। বৃষ্টি ভেজায় সব একাকার। এতটুকুন ছেলে শামীমের গোল কিপিং কি ভোলা যায় ! কোথায় আছ তোমরা এখন! কাঁদতে চাও যদি তবে একবার এসে দেখে যেও সেই জায়গাটা। এই মাঠেই বাতি জ্বালিয়ে চুটিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেছি কত আমি, আমার বন্ধু বুলবুল, রফিক, ঝিলু--ধরাশায়ী করেছি কত অন্য পাড়া থেকে খেলতে আসতো যারা। সব শেষ হয়ে গেছে, কংক্রিটে চাপা পড়ে গেছে সব। পড়ে আছে শুধু একটা ছোট্ট চাপা গলি, নর্দমাকে সংগী করে। শেষ হয়ে গেছে আমার আব্বার গুটি গুটি পায়ে মাঠের কোনাটায় এসে দাঁড়িয়ে একটু খোলা হাওয়া চোখে-মুখে লাগাবার দিনগুলো। আমরা অসহায় হয়ে পড়ছি প্রতিদিন সময়ের কাছে, নিত্য-নৈমিত্তের কাছে। হেরে যাচ্ছি যেন ঠেলা-ঠেলি, ঠোকা-ঠুকির মাঝে, প্রতিদিনের অনাসৃষ্টির কাছে।
আমি বাংলাঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকি। বলি,তুমি আর দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবে! সব শেষ হয়ে গেছে। আমার স্বপ্নগুলো এখন প্রতিদিন আমার সঙ্গে কেবলই কৌতুক করে। এবার তুমি নতজানু হও, পারতো শুয়ে পড়ো। আমি তোমাকে মৃত্যুর গান শোনাবো। তোমাকে ইতিহাসের অংশ করতে একদিন তোমার বুকের উপর কংক্রিটের মনোরম দালান তুলবো। কবর দেবো তোমাকে, আমাকে, আমার শালীন জীবনটাকে।