গভীর অন্ধকার সময়

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

আশরাফ উদ্ দীন আহমদ
  • ১৮
মাথায় বাঁশ একেই বলে,গরীবের মাথায় বাঁশ, কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বন্ধ হয়ে গেলো ‘আঙ্গরী সিনেমা হল’, কে আর কি প্রতিবাদ করবে, পনেরো দিনের বেতন মাগনা হাতে ধরিয়ে তালাচাবি ঝুলিয়ে দিলো মালিকপক্ষ।
সমস্যা কার কতোটুকু সেটা বড় কথা নয়, সমস্যা এখন সমস্যাই রয়ে গেলো, কতোগুলো লোকের মুখে ঝাঁটা পড়লো সে ফিরিস্তি নাহয় ছাইচাপা পরে থাক, কিন্তু লালচাঁদের কি উপায় হবে, সে তো মাঠে-ঘাটে চাষাবাদ করতেও পারবে না, নছিমন-করিমন চালাতেও পারবে না, আনাজপাতি সওদা করতেও পারবে না, এমন কি পালাদার-ঘরামি বা দিনমজুরের কাজও করতে পারবে না। তবে সে চলবে বা কি ভাবে?
দূরে একটা কাঠফাড়ায়ের মেশিন, সকাল-দুপুর ঘ্যাঁসর-ঘ্যাঁসর শব্দে চলে, লালচাঁদ তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। যেন ওর মাথার মধ্যে অনবরত শব্দ হচ্ছে, কিসের শব্দ কাঠফাড়ায়ের শব্দ, শ্যালো মেশিনের শব্দ, কোনো কিছুই সে অনুমান করতে পারে না। তবে ক্রমশ শব্দটা ঘণায়িত হয়। কয়েকদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি স’মিল গড়ে উঠেছে, ওদিকের কাঁচা সড়কের কাছাকাছি ইটভাটা, রাতদিন মানুষজন খাটছে, কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না। সময় এখন অনেক দামী, কারো কষ্ট বোঝার বা শোনার মতো সময় নেই।
প্রথম মালিকপক্ষ সিনেমা হলটা লোকসান দিয়েও চালিয়েছিলো, শুধু মাত্র কতোগুলো কর্মচারীর মুখের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু বেশিদিন রাখতে পারলো না, ঋণখেলাপি হওয়ার ফলে সিনেমা হলটা বিক্রি করে দিলো, দ্বিতীয় মালিকপক্ষ সিনেমা হল কয়েকমাস চালিয়ে মুনাফা আনতে সক্ষম হলো না, উপরন্ত কোনো-কোনো মাসে লোকসানের টাকাও গুনতে হলো।
হঠাৎ একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিলো, আজ থেকে আঙ্গুরী বন্ধ। এমন কানাঘুষো কয়েকদিন ধরেই চলছিলো, দ্বিতীয় মালিকপক্ষ আঙ্গুরী সিনেমা হল তুলে আলুর কোল্ড ষ্টোরেজ বসাবে। কারণ এলাকায় আলুর চাষ বরাবরই ভালো, কিন্তু সে তুলনায় সংরক্ষণের জায়গা নেই, কোল্ড ষ্টোরেজ অনেক দূরত্বে এবং ধারণ ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। কানকথাটা যে এমন অক্ষরে-অক্ষরে ফলে যাবে তা অবশ্যই ঘূণাক্ষরেও ভাবেনি লালচাঁদ। কারণ সে তো আঙ্গরী সিনেমা হলের পিকেটার ছিলো, সকাল থেকে দুপুর এবং বিকেল অবধি, কাঠের বোডের আটকানো সিনেমার পোষ্টার সাঁটিয়ে হলের নিজস্ব নছিমনের ওপর বসে মাইকের মাইক্রোফোনে মন মাতানো কথা বলে হাজারো দর্শককে হলমুখো করাই হলো লালচাঁদের ডিউটি। সামনে-পেছনের দুটো মাইকই লালচাঁদের রসের কথাকে পৌঁছে দিতো যুবক-বৃদ্ধের কানে।
সাতগাঁয়ের লোকে ওর কন্ঠস্বরের চাতুর্যে মোহিত হতো, আর বিকেল-সন্ধ্যে কাজ শেষে ছুটে আসতো হলে, আঙ্গুরী সিনেমা হলের এক ঝাঁক ডানা কাটা সুন্দরী হুরপরী দেখবার খায়েস নিয়ে, রঙিন রাঙা নায়িকাদের নানান চরিত্রের অভিনয় দেখে মূগ্ধই হতো না, শারীরিক উষ্ণতা নিয়ে বাড়ি ফিরতো, চোখে তখন অন্যরকম স্বপ্ন থাকতো। সারারাত্রের স্বপ্নগুলো দিনের আলোয় কোথায় মিলিয়ে যায়, তখন অন্য এক মানুষ উঠে আসে দিনের সূর্যালোকে, সত্যিই মানুষ এমনই রুপচাদা ইলিশ যেন।
এভাবেই পরের বোঝা বয়েই জীবন কাটছিলো লালচাঁদের। অথচ আজ যেন পগারে পড়লো অকস্মাৎ সে, কোথায যাবে, চারদিকে শুধুই চাপচাপ অন্ধকার, কোথায় বা যাওয়া যায় সে তো কিছুই জানে না, এভাবে কি একটা জীবন চলতে পারে, মাথার ভেতর তাবৎ ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে জট পাকিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে।
আশ্বিনের রোদ মাঠজুড়ে, নতুন ফসল এখন কৃষকের দেহলিতে নবান্ন উৎসব ঘরে-ঘরে, আকাশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে, কখন যে কেঁদেকেটে ভিজিয়ে দেয় বলা যায় না, লালচাঁদ আপন মনে হাঁটছে সদ্য মাটি ফেলা সড়ক ধরে, কোথায় যে যাচ্ছে সে জানে না। কতোকালের স্বপ্নগুলো আজো বাস্তবে রুপ পেলো না, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে গেলো, গরীবের স্বপ্ন কি এভাবে মরে যাবে, কোনোদিনই কি সফল হবে না তাহলে, নিজের সাথে নিজেই কথা বলে, নিজেই নিজেকে অনেক-অনেক প্রশ্ন করতে থাকে, তার প্রশ্ন যেন শেষ হয় না। খোঁড়া মানুষের মতো ঘঁষটে-ঘঁষটে জীবন পার করে, কেউ-কেউ হয়তো করুণায় করে যায় তাকে, সত্যসত্যিই এভাবে কি একটা জীবন কাটে, ধনেখালির মেঁঠো পথ ছেড়ে নাককাটি মন্দিরের বিরান জমির আল ধরে হাঁটছে থাকে। খেঁজুর গাছের সারি চলে গেছে নাক বরাবর, শীতকালে জায়গাটা খেঁজুর রসের ঘ্রাণে মৌ-মৌ করে, তখন কতো পাখ-পাখিলি আনাগোনা দেখা যায়, নাককাটি মন্দির পরিত্যক্ত এখন, কেউই ফুল-পাতা দেয় না বিশেষ আর, আশেপাশে হিন্দু স¤প্রদায়ের কোনো মানুষ নেই, কে বা কারা যেন এখন জমিটুকু জবরদখল করে বসে আছে রাতারাতি।
লালচাঁদ ধপাস করে বসে পড়ে ছায়া-ছায়া জায়গাটায়। এখানে এলে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়, ওপাশে একটা শীর্ণ নদী বয়ে গেছে দেহাতি ঢঙে। বড় বেশি এলোমেলো ছন্নছাড়া নদী, লালচাঁদ তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। একটা চাকুরী ছিলো তার এতোদিন, আজ থেকে সে যে একেবারে বেকার, অথচ ঘরে মা-পঙ্গু বাবা, ছোট ভাইটি বিয়ে করে নিজের সংসারের ঘানি টানতেই জেরবার। বোন দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে, বাপের যেটুকু জমিজিরাত ছিলো বোনদের পার করতেই শূন্য হাতের থলি। তারপরও এখনো খাই মেটে না বোন জামাইদের, দাও-দাও শুধু ওই একটাই শব্দ দাও... কি দাও জানি না তারপরও দাও, জীবন অতিষ্ট করে ফেলে এমনই সব ক্যাচাঁলের মধ্যে পড়ে কারই বা ভালো লাগে এই জীবনকে, চোখের সামনে অন্ধকার এসে বুঁদ-বুঁদ করে যেন, লালচাঁদ এখন কোথায় যাবে, কোথায় যাওয়া যায় জানে না। লালচাঁদ এখন তাহলে যাবে কোথায়, জীবন তো ওই মাত্র একটাই তারপরও এই জীবন নিয়ে কোথায় যাবে আর, পালিয়ে যাওয়া মানে কি শামুকের খোলসে নিজেকে লুকিয়ে রাখা, বুকের ভেতর অনেক-অনেক কালের কষ্ট, কোথায় আর যাওয়া তার, লোকে বলছে দেশের সমস্ত সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ হিন্দী সিনেমা এবং আকাশ সংস্কৃতির আগ্রসনে সিনেমা হলগুলো দর্শক হারিয়েছে,সিনেমা হল বন্ধ মানে তো আরো-আরো বেকার, বেকারত্ব যে কি তা হাড়ে-হাড়ে বোঝে লালচাঁদ। বেকারত্ব মানেই হলো স্বপ্নের সমাধি, কিন্তু এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। বাস্তব যে এতোখানি কঠোর এবং কঠিন তা কখনো ভাবতে পারেনি।
লালচাঁদ কটকটে রোদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। বাড়িতে অনাহারি কয়েকটা মুখ তার পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, গনগনে আগুনের মতো সময়গুলো কেটে যায়, বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে, মোচর দেয় কঠিনভাবে। একটা অবলম্বন একটা আকাশ ধরতে চায়, একটা নদী ঘিরে ধরে আছে তাকে, কিন্তু সে তো পারে না বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে, কোথায় যাবে, আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে সময়, মোক্ষম সে সময় রাত্রের প্রহরীর মতো দন্ডায়মান। দূরে একটা কি নামের পাখি ডেকে যায়, সময় নিয়ে-নিয়ে ডেকে ডেকে ওঠে, ডাকটা বড় বেশি উদাসি করে যেন, বিরহির বাঁশীর সুরের মতো। একটা সময় চোখে অনেক-অনেক স্বপ্ন ছিলো, স্বপ্নগুলো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, কখনো হয়তো পদ্মদীঘির শাপলা-শালুকের মতো ভেসে ওঠে মনের কোণে, তখন বুকের ভেতর একটা হাহাকার কেমন যেন মোচড় দেয়, নদীর মতো সেই মেয়েটি কেমন করে যেন তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো, কি তার অপরাধ আজো বুঝে পায় না। ওমন একটা শান্ত মেয়ে পায়রা কি বা চেয়েছিলো তার কাছে তাও জানা হলো না। পায়রার মতো উড়ে-উড়ে ঘুরে বেড়াতো সে, কতো দূরে চলে যেতো একা-একা, লালচাঁদ কখনো দেখতো আবার কখনো বা কোনো পাত্তাই দিতো না। একদিন পায়রা সত্যিসত্যিই হারিয়ে গেলো, আউশতলী মাদ্রাসায় আমছিপাড়া পড়তে যেতো, প্রতিদিন যেতো না, মাঝে-সাঝে যেতো, বড় হুজুর-ছোট হুজুর সবাই ওকে ভালোবাসতো, একদিন ছোট হুজুর তার শোবার ঘরে নিয়ে যায় কি একটা জিনিস দেখাবে বলে, তারপর কি একটু খাওয়ায়, পায়রা জ্ঞান হারায়, তখন ছোট হুজুর দরজার ঝাঁপটা বন্ধ করে দেয়, এবং তার সঙ্গে....
লালচাঁদ আর কিছু ভাবতে পারে না। দু’দিন পর পায়রার মৃতদেহ পাওয়া যায় কুম্পু নদীর পাড়ে, অতোটুকু শরীর ওর ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেয়ে লম্পট লাপাত্তা হয়, ছোট হুজুরকে আর যেমন পাওয়া যায়নি তেমনি পায়রাও হারিয়ে গেলো সুনীল আকাশে, কেউ দেখে অথবা কেউই দেখে না। কিন্তু লালচাঁদ আজো খুঁজে ফেরে আকাশের দিকে তাকিয়ে, সত্যিই মানুষ কতোখানি পায়ন্ড হলে এমন হতে পারে।
ছোপ-ছোপ অন্ধকার বেদনার ভাষা মৃত্যুর মতো পৃথিবীর তাবৎ অন্ধকার অধীর হাওয়ায় ভেসে-ভেসে আসে লালচাঁদের ঘরে। কোথাও পালানোর জায়গা নেই, কোথায় যাবে সে, নিজেই জানে না, অমাবশ্যার রাত্রি আজ। ঘরের ভেতর অন্ধকার, বাইরে ঝিঁ-ঝিঁ গুলো ডেকে মরে, জোনাকির আলো যেন ফুরিয়ে গেছে, নিস্তব্ধ কৃষ্ণের মতো লালচাঁদ ঘরের মধ্যে নিজের সঙ্গে অন্ধকারের সঙ্গে, নিভে যাওয়া শুকতারাটির সঙ্গে নক্ষত্রপতনের গল্প করে, স্বপ্নের আঙিনায় দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে গোধুলী ধূসর পৃথিবীর অন্ধকারে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ হৃদয় ছোঁয়া গল্প। ছোট ছোট বাক্যে দারুণভাবে গল্প বলেছেন। শুরুটাও ছিল দুর্দান্ত। শেষে এসে লালচাঁদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একান্ত কষ্ট টের পাওয়া হলো। ছোট হুজুরের কু-কীর্তি প্রকাশ করলেন, সবই দারুণ লাগল। শুবকামনা লেখকের জন্য।
এশরার লতিফ গভীর বোধের চমত্কার গল্প.
সাদিয়া সুলতানা ভাল ১টা গল্পে পাঠক কম দেখে মনটা খারাপ হল। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখলেই এমন লেখা যায়। লিখতে থাকুন পড়তে থাকুন। পাঠক অাপনাকে ঠিক খুঁজে নিবে। শুভকামনা ভাই।
বিবাগী বিদ্যুৎ হৃদয় ছুয়ে গেলো আপনার লেখাটা, একটা জমাট কষ্টের অস্তিত্বও জেনো টের পাচ্ছি বুকের খাচায়!

১৭ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী