দুপাশে দুটো বাঁশ আর মাঝে বাঁকারি, তাতেই বেঁধেছে বড় আয়নাটাকে, হাতলওয়ালা চেয়ারখানায় বসেছে মোছাদ্দেক কামলা, প্রথমে সাবান লাগিয়ে ব্রাশ করিয়ে ফেনা তুলে, চকচকে ক্ষুর চালায় খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ির গোড়ায়, রনজিত এ’কাজটা করছে আজ বছর তিনেক হলো, ঠিকঠিক বিশ্বজিত হাজরা মরে যাওয়ার পরপরেই, পৈত্তিক পেশা বলে কথা, বাপটা বেঁচে থাকতে কিছু না দিয়ে যেতে পারলেও, মরে যাওয়া পরপরই কাজ একটা হাজির করিয়ে দিয়েছে বটে,যার দৌলতে আজ চার/পাঁচ জনের সংসার ঠেলেঠুলে গোঁজামিল দিয়ে হলেও চলছে তো !
রনজিত ক্ষুঁর থেকে ব্যবহিত ফেনাটুকু বাম হাতের আঙ্গুলে নিয়ে এ্যালুমিনিয়েমের মগে রেখে জানায়, তা কি করবে আর তুমি, কলের লাঙল চলে এলো, নছিমন ঘরে এসে মানুষ দিয়ে যাচ্ছে গো,ওদিকে দেখো থানা সদরের সড়ক খালগ্রামে ঢুকে পড়ছে !
মোছাদ্দেক চিন্তিত হয়ে পড়ে আরো। দিনে দিন কি হতে যাচ্ছে সব, কি বা বোঝে সে, আর কাকেই বা বলবে, শরীর ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে সে, দাঁড়ি কেটে বিকেল ওয়াক্তে মন্ডলদের পুষ্কুনিতে নেমে নাইতে না পারলে শরীর জুড়োবে না। সকাল-সকাল দাঁড়ি কামাতে পারলে ভালো হতো, রনজিতের কাছে আরো আগে এলে হতো কিন্তু সোহরাব হাজির বাড়ি গিয়েই বেলা হয়ে গেলো, সাত সকালে ডাক পেয়ে হাজির বাড়ি গিয়ে দশ/বারোখানা নারকোল গাছ ঝুঁড়ে দিতেই বেলা কাবার। তবে জ্বালানি ঢের পেয়েছে, নগদানগদি টাকাও হাতে পেয়েছে বলেই তো পনেরো দিনের বাসি মুখটাকে ঝকমকে করতে পারছে, রনজিতের অতো বড় আয়নায় বেশ মানানসই লাগছে বটে, নিজেকে সিনেমার নায়কের চেয়েও তো কম কিছু লাগছে না।
গাঁয়ের লোকে এখন তো দেখছি শহরের লোকদের মতো ঘড়ি ধরে কাম করবে, কি যুগ এলো রে বাবা, খালগ্রাম না জানি কবে আবার আমাদেরই বের করিয়ে ছাড়ে, এদিকে জমিরও দাম বাড়ছে।
-কথা একখান বলেছো বটে, ওদিকে দেখো সেলুন খুলে বসছে কুকুরডাঙার মতিউর।
-কুকুরডাঙা বলছো কি গো, ও তো এলো ওপার থেকে, একেবারে খাস রিফুজি। কি যে হলো ভায়া, দেশের লোকে ভাত পায় না,পুরানো পাগলে ভরছে দেশ।
-আচ্ছা তোমার ক্ষুরে ধারটার দাও না নাকি, বড় লাগছে যে। ধার দেবো না কেনো, তবে তোমার আগে বেশ কয়েকজন কামিয়ে গেলো তো, তাই একটু...
-তা বেশ ইনকাম করছো, দেশ ছেড়ে আবার চলেটলে যেও না কিন্তু, তোমাকে তো বিশ্বাস করা কঠিন।
-কি বলছো যাবো মানে, এদেশ ছেড়ে আবার কোথায়। একসময় দাঁড়ি কামানো হয়ে গেলে মোছাদ্দেক উঠে দাঁড়ায়।
-আমার আবার কি, শ্রমিক মুনিশ আমরা, যেখানে কাজ সেখানে ডাক, শরীর যতোদিন চলবে ততোদিন জীবন,এই তো !
-মথুরপুরের নজের আলীর কাঠ ফাড়ায়ের মিলে নাকি লোক লাগবে, দেখো চেষ্টা করে যদি কোনো কাজ পাও।
-নজের নাকি মিলটা বিক্রি করবে তাই তো শুনলাম, তুমি আবার নোতুন করে !
-হ্যাঁ তা তো শুনেছিলাম অনেক আগে,কিন্তু এখন মত পরিবর্তন করে চালু করার চিন্তা করছে।
-ভালো একটা খবর দিলে বটে রনজিত।
পড়ন্ত বিকেলের রেশমী রোদ গায়ে মেখে মোছাদ্দেক চলে যায় বাড়িমুখো, দক্ষিণের খোয়া ফেলা পথটুকু হেঁটে নাবাল জমিতে নেমে আলপথ ধরে যেতে থাকে। বুকের ভেতরে একটা কষ্ট প্রতিনিয়ত বড় জানান দেয়, কষ্টটা শুধু তারই একার, কাউকে বলাও যায় না। কে বা শুনবে তার মতো মানুষের কথা, তবে মাঝেসাঝে নিজের মধ্যে চাগিয়ে ওঠে, দূরের পথটাকে বড় অচেনা লাগলেও আজ কেমন জানি ভালো লাগে, হয়তো ট্যাকে কিছু টাকা আছে বলে, তারপরও বাড়ি যেতে কেমন একটু খটকা রাগে, যেতে হয় বলেই না যাওয়া আর কি !
নজের আলীর কাছে যেতে হবে কাল সকাল-সকাল। যদি একটা বাঁধাই কাজ জুটে যায়, রনজিতের কাছে ভালো খবর পেয়ে মনটা খানিক ভরে যায় ওর। রাত্রে গল্পটা পাড়ে শ্যামলীর কাছে, একটা বিহিত হবে, দিনান্তে ভালো কিছু না হোক শাকভাত তো জুটবে, কি বলো ।
শ্যামলীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি গড়িয়ে পরে আবার ফিকে হয়ে যায়। কি বা বলবে সে খুঁজে পায় না হয়তো। বছর-বছর বাচ্চা বিইয়ে সে একটা রুগ্ন-ভগ্ন শীর্ণকার শরীর নিয়ে কোনোভাবে বাঁশপাতার মতো টিকে আছে, কষ্ট আর ক্লেদ ওর চোখে-মুখে, পেটে কখনো দানাপানি পরে কখনো বা উপাস জীবন কাটে। তখন সে মনে-মনে দুঃখের মধ্যেও সান্ত্বনা দেয় নিজেকে, বছর-বছর বাচ্চা হলেও না বেঁচে ওরা ভারী উপকার করেছে, দু’মুঠো ভাতের অভাবে যেখানে মানুষ হাহাপিত্তস করে, সেখানে বাড়তি মানুষের কষ্ট পীড়া দেয়। শ্যামলী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোছাদ্দেক বলে, কাজটা হলে ভাতের কষ্ট হবে না,প্রতিদিন তো খাওয়া জুটবে...
বাইরের পৃথিবীটা এখন বেশ ঝলমলে, জ্যোৎস্নারাত্রি বলে আলোর রুপালী পাপড়ি চুঁয়ে-চুঁয়ে পড়ছে, তামাম গ্রাম আলোর নাচনে বাধনহারা যেন,মোছাদ্দেকের মনজুড়ে আগামী সকালের স্বপ্ন,চোখজুড়ে অন্য একটা গন্তব্য, তাকে বাঁচতে হবে, যতোই সুন্দর সকাল আসুক, তার জন্য কেনো এমন অন্ধকার থাকবে, সমস্ত অমানিশা দূরে ঠেলে ফেলে তাকে যেতে হবে আলোর সামনাসামনি,দাঁড়াতে হবে পৃথিরীর মুখোমুখি, কেনো তার ঘর অন্ধকার, সকাল হতে আর কতো দেরী সে জানে না, একটা সকালের প্রত্যাশায় সে এখন উন্মুখ।
মথুরপুরের নজের আলীর দলিজে ঢোকে মোছাদ্দেক। পুরানো লোকের দেখা পেয়ে নজের যেন হাতে চাঁদ পায়।
-নারে বিক্রি করার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার চালানোর মনস্থির করলাম, তা ভালোই হলো, খবরটা দিলো কে।
-লোক লাগবে এমন খবর কি কেউ দেয়, চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, আমিও চলে এলাম যদি কাজ জোটে।
-বেশ ভালো, ভালো করেছিস বেশ...
-বড্ড কষ্ট, একটা কাজ পেলে-
-কাজ কোনো ব্যাপারই নয় রে, শুধু তোর ইচ্ছে বলে কথা, আমি তো কাজ নিয়েই বসে আছি রে হারামজাদা।
মোছাদ্দেকের ঠোঁটের হাসিটুকু মিইয়ে যায় আচমকা। যতোই নরোমস্বরে কথা বলুক না কেনো, মূল ধান্ধা তার কাছে অজানা নয়। নজের আলীর ব্যবসাপাতি কি,তা কে না জানে, দু’চার’দশ অঞ্চলের লোকের নখদর্পণে, নয়নখালি-কুকুরডাঙা-সবুরপুর-পাঁঠামোড়ের যতো ব্যবসা সবখানেই তার একটা শেয়ার আছে, নতুন ব্যবসা তো করবে বলেছিলো অনেক আগে। ব্যবসার কথাটা শুনে পিছিয়ে এসেছিলো সে’বার। মোছাদ্দেক বুঝে যায় আবার সে কথায় বলতে চায়, নতুন ব্যবসা ! এ সে কোন প্রাণীর কাছে এলো, এখনো শরীরে তার সে রকম আঁশটে গন্ধ, টাকার গন্ধের কাছে কখনো কি পরাজিত হয়, মোছাদ্দেক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, পারেনি সে বার,তারপরও আজ তাকে মাথানীচু রেখে দাঁড়াতে হয়, যেন সে কতো অপরাধ করে বসে আছে।
জীবন বাঁচানোর জন্য একটা কাজ তার বড় প্রয়োজন, সাত অঞ্চলে মানুষের কোনো কাজ নেই, জমি জিরাত সব পানিহীন, মরুভূমি যেন এদেশে নেমে এসেছে, কি ভাবে বাঁচবে এক মোছাদ্দেক ! তার বাঁচা-মরা নিয়ে কি কারো মাথা ব্যথা আছে ? পৃথিবী যে যেমন পারে বাঁচে, কেউ যেন কারো জন্য নয়। কারো সময় নেই কাউকে এতোটুকু দেওয়ার, নজের আলী তো অন্য এক মানুষ, সে দেবে ভাবা যায় !
সাত অঞ্চলের মেয়েমানুষ সংগ্রহ করা একটা কাজ বলে কি মনে হয়, কেমন চাকুরী সে বোঝে না, তারপরও সে বোঝে, চাকুরী দেওয়ার নাম করে মেয়েমানুষ সংগ্রহ করতে হবে। এটাই কাজ তার বেঁচে থাকার জন্য, মোছাদ্দেক কামলা ছোটলোক হতে পারে তাই বলে এমন কাজও করবে। নজের আলী তারপর সে মেয়েদের কোথায় নিয়ে যাবে, তাও জেনেছে, এমন একটা চাকুরী সে কি ভাবে নেবে, ভাবতে পারে না, সে’বার চলে গিয়েছিলো,অন্য কাজ থাকলে করবো বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু এখনো লোকটা সে রকমই আছে, এতোটুকু পরিবর্তন হয়নি। ভেবেছিলো এতোদিনে হয়তো কিছুটা ভালো হয়ে অন্যকোনো ধান্দা বাতলে দেবে, কিন্তু সে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো এখানে এসে। গাঁয়ের মেয়ে মানুষদের কাজের নাম করে বেশ্যা বানাবার জন্য শহরে নিয়ে যাবে। নিজের প্রতি একসময় বিতশ্রদ্ধা এসে যায়।
মোছাদ্দেক কামলা একসময় অনেক রাতজাগা কাজ করেছে, সীমান্তলাগোয়া গ্রাম বলে এমন কাজ করতে তেমন সমস্যা হয়নি, মাদকদ্রব্য থেকে চিনি-চাল-ডাল সবই আমদানী-রপ্তানি করেছে, পাচার কথাটা বলতে ইচ্ছে হয় না, অথচ মেয়েমানুষ পাচার করার চিন্তা কখনো হয়নি। নরসুন্দর রনজিতের কাছে কামের কথা শুনে ভেবেছিলো হয়তো নজের আলী আগের থেকে মানুষ হয়েছে, কিন্তু সব মানুষ কি আর ইচ্ছে করলেই মানুষ হয়, না কি মানুষ হতে পারে ? তাহলে অমানুষ থাকবে কে, একটা কিসের সংষয় তাকে বড় বেশি কুঁড়ে-কুঁড়ে খায়, তবে সে কি করবে, খরায় দেশটা মরুভূমি হতে বসেছে কিন্তু কেউই দেখার নেই, মানুষ এখন কে কোথায় যাবে, তাও বা কে বলে দেবে। বুকের মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা খাঁ-খাঁ করছে।
-কাঠফাড়ায়ের কাজটা তোকে দিয়ে করাতে মন চায় না, সে আর কতো পয়সা, আমার বুদ্ধিমতো চললে খাওয়া পড়ার অভাব নাই, দেশ-গাঁ নিয়ে তোর কি কাজ বল্ তো, তোর চায় টাকা কি বলিস বাপ !
মনে আবার খটকা লাগে, ভালোই ফাঁদ পেতে রেখেছে, কাঠফাড়ায়ের কাজটা দেবে না।
-চেনা লোক মানে তো বিশ্বাসী লোক। কথাটি আবার জানায় নজের।
-কিন্তু আমি তো ওই কাজই চাইছিলাম, একটা কাজ মানে একটু ভালোভাবে।
-আরে বোকা মানুষ, কাজ তো সবই কাজ, ভালো আর মন্দ বলে কোনো কথা আছে, যেমন টাকার গায়ে কি লেখা থাকে কোনটা কালো কোনটা বা শাদা টাকা, টাকা তো সবই টাকা, কথা হচ্ছে যার কাছে টাকা থাকে সেই হলো টাকার মালিক, কি বোঝানো গেলো।
নজের আলীর কথা আর ভালো লাগে না। লোকটা আর ভালো হবে না বোঝে সে। কোনো উপায় না বুঝে আস্তে-আস্তে সরে পরে, যাওয়ার সময় একটা সালাম ঠুঁকে বলে, একটু চিন্তা করে দেখি, তারপর বলবোনি।
-বেশি চিন্তার কি আছে, কাজে লেগে যাও রে বাবা, অতো ভাবলে দিন দুনিয়া চলে, বলো।
দবির হাজির চালের আড়তের কাছে এসেই মনটা কেমন চনমনে হয়ে ওঠে। অনেকদিন দেখা নেই, দেখা করবে আজ, এমনও হতে পারে চালের আড়তের একটা কাজ জুটে গেলোও হয়তো জুটে যেতে পারে। মানুষটা বরাবরই তাকে এটা সেটা কাজে নিতো, নজের আলীর ব্যাপারটা খুলে বললে একটা ধান্ধা কি জুটে যাবে না।
দবির হাজি কথাপ্রসঙ্গে জানালো, দিনকাল সব কেমন পালটে যাচ্ছে, কেউ আর কাউকে দেখেও না দেখার ভান করছে, কি আর বলবো।
-কিন্তু আমার যে এখন...
-হ্যাঁ সে কি আমি বুঝি না, আসলে কে আর কি করবে। গোবরডাঙার মানু তো সেদিন পায়ে ধরে সে কি কান্নাকাটি, একটা কাজ জুটিয়ে দাও, আমি কি করি, ওদিকে ওই হাতিবাগানের ছেলে-ছোকরাগুলো তো পিছে লেগেই আছে যে কোনো প্রকারের কাজ দিতে...
-দবির চাচা আপনি আমাকে ওদের কথা বলছেন, ওরা তো সবাই ওপার থেকে আসা লোকজন, আমি আপনার পুরানো কর্মচারী, আমার সাথে তুলনা করলে...
-ওপার-এপার বলে তো কথা নেই রে, সবাই আসছে নিজের নিজের ধান্ধায়, সবারই তো হক আছে কি বলিস ?
মোছাদ্দেক কামলা এবার সত্যিসত্যিই নিজের ভেতর সেধিঁয়ে যায়, কোনো ব্যবস্থা সে করতে পারছে না। একটা কাজের বড় প্রয়োজন, অথচ কোথায় কাজ ! রাতজাগা কাজটাই কি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, শেষপর্যন্ত আবার সেই পুরানো পেশা। ভাবতেও কেমন যেন শরীর সিউড়ে ওঠে। শ্যামলীর নিষেধের কারণে ছেড়েছিলো ওই পেশা, এখন সে কি করবে, কোথাও তো কাজ নেই, রিক্স থাকলেও দুটো টাকা তো ঘরে আসতো নগদানগদি, কম কিসের।
মন্ডল বাড়ির পুস্কুনিতে সেবার সেজো বউয়ের গলার হার পরে গিয়েছিলো, আর তখনই মোছাদ্দেকের ডাক পরে, মোছাদ্দেক সারা বেলা পানিতে তন্নছন্ন করে এলোপাথারী বিলি কেটে কেটে শেষ বেলায় হারটা পায়, পায়ের ডগায় উঠে আসে, পানি থেকে তুলতেই সে কি শোরগোল উঠে গেলো, যেন মস্ত একটা কাজ করে ফেলেছে, সত্যিই কাজ বটে একখান সে করেছিলো কিন্তু মন্ডল বাড়ির কেউই জিনিসটা পেয়ে আর তাকে পাত্তা দিলো না, মাঝখান থেকে শুধুমাত্র কয়েকটা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলো, এই নাকি অনেক ।
কাঁচুমাচু করে মোছাদ্দেক বলে, এটা কি ইনসাফ হলো, সারাবেলার রোজটা দিলেও নাহয় একটা কথার কথা ছিলো।
কথাটা শুনে সেজো মন্ডল হেঁকে বলেছিলো, আসলে ছোটলোকদের স্বভাবই ওই একই, একটু কাজ করলি বলে এখন কড়াই-গন্ডায় বুঝে নিতে চাস, তোদের আর কান্ডজ্ঞান হবে না।
তারপরও কিছু না দিয়েই সেই টাকা নিয়ে ফিরে আসতে হয় বাড়ি। সে রাত্রে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে প্রবলভাবে, সে জ্বর থাকে দীর্ঘ বারোদিন, কেউই ফিরেও তাকায়নি। এই কয়েকদিন কিভাবে যে সংসারটা চালায় শ্যামলী, সে বুঝে না কিছুই। হাটের ওপাশে মন্ডলদের কাপড়ের দোকান, ইচ্ছে হয় একবার ঢুঁ মেরে দেখে কোনো কাজফাজ পাওয়া যায় কি না। পরক্ষণে মনটা কেমন মুষড়ে যায়, যেতে ইচ্ছে করে না, মন থেকে সাঁই না দিলে কোথাও কি যাওয়া যায়, নাকি যেতে ভালো লাগে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে লজ্জা-সরমের মাথা খেয়ে একসময় ঢুকে পরে মন্ডলদের কাপড়ের দোকানে। প্রথমে একটু সংকোচ লাগলেও ধীরে-ধীরে সহজ হয়ে যায়।
মেজো মন্ডল একঝলক দেখেই বলে ওঠে, আরে মোছাদ্দেক মিয়া যে, কি মনে করে এই ভর দুপুরে।
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটুকু ঝুলে থাকে ওর। কি বলবে বলতেও চোখে-মুখে সরম। অনেক কষ্টে একসময় বলে,“আমার একটা কাজ ভারী দরকার !”
মেজো মন্ডল কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে বলে, কাজ কোথায় পাবো বাবা, দোকান চালানোই এখন বড় মুশকিল, ওই যে দুটো ছোকরা দেখছো, ওদের টানতে গিয়েই জেরবার অবস্থা এখন।
-না বলছিলাম কি, যে কোনো একটা কাজ, আপনার তো অনেক ব্যবসা।
- ওই তো ভুল বললে, ব্যবসা কি আছে আর আগের মতো, প্রতিযোগিতার মার্কেট, চারদিকে দোকান, কে কতো সস্তা দামে গ্রাহককে ভালো জিনিসটা দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা বলতে পারো।
মোছাদ্দেক আর কি বলবে ভেবে পায় না। দূরে একটা কাক কর্কষস্বরে ডেকে মরছে, শুনতে কার বা ভালো লাগে, এভাবে কেনো যে ডাকে, নিজের কাছে অনেক বড় অপরাধি মনে হয় তাকে, কিন্তু কি কারণে সে অপরাধি, সেই হিসাবটা মিলাতে পারে না। মনে-মনে বলে, বড়লোকের যতো থাকে ততই নেই-নেই করে গগণ ফাটায়, হয়তো তামাম দুনিয়াটা খেয়ে ফেললেও মনের ক্ষুধা কোনোদিন মিটবে না। মুখে আগুন পেটে আগুন, আগুন দিয়ে সর্বঙ্গ গড়া শরীর, মোছাদ্দেক বাড়িমুখো হাঁটা দেয় তারপর।
রাত্রের বিছানায় শুয়ে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে, চাঁদ কেনো এতো রুপুসী, কে বা ওর শরীরে এতো রুপ এঁটে দিলো, শ্যামলী ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে, আজো তেমন খাওয়া হয়নি তাদের, ঘরে দুটো চিপসানো মুড়ি ছিলো সেগুলো দুজনে খেয়েছে, আর টিউবওয়েলের পানি,তাতে কি পেটের ক্ষুধা মেটে। মোছাদ্দেক ভেবে পায় না মানুষ কিভাবে ধনী হয়, একশ্রেণীর মানুষ তো না খেয়ে মরে। ওদিকে টাকার পাহাড়, ব্যাংক ভত্তি টাকা, টাকা-টাকা শুধু টাকা, তারপরও টাকার জন্য হাহাকার। আরো চায় আরো চায়, টাকা-টাকা- টাকা।
বাল্যবন্ধু কয়েষের বাপের মৃত্যুর পর ওদের বাড়ি মিলাদ দেওয়া হয়, কুকুরডাঙা গ্রামের মোতিয়াহাটি মসজিদের মুয়াজিন এসে মিলাদ পড়ায়, সে মিলাদে মোছাদ্দেক গিয়েছিলো, বাড়ির পাশের মানুষ বলে কথা, মুয়াজিন সাহেব বয়ান করছে মধুর সুর তার। মানুষ দিনদুনিয়া ভুলে কান খাড়া করে তামাম বয়ান শুনছে, মোছাদ্দেকও শুনছে। মুয়াজিন বলেন,“দুনিয়া ভি কিছু লয় রে ভাই, আখিরাতের কাজ করো, মানুষ তো তুলোর মতো একদিন যেমন উড়ে এসেছে, তেমনি করে একদিন উড়ে যাবে, কিছুই সে নিয়ে যাবে না”।
দিনদুখি মানুষগুলো হু-হু করে কেঁদে বুক ভাসায়, যেন তারা কতো ভুল করে ফেলেছে, কি যে ভুল হয়তো তাও জানে না। দুনিয়াতে এসে কি বা পেলো কি বা সে নিয়ে যাবে, সে চিন্তা কারো মাথায় একবারও এলো না। কয়েষের বাপ অনাহারে মারা গেছে, চিকিৎসা কাকে বলে ওটা আরেক ফ্যাসাদ ছাড়া কিছু না। কয়েষ তো হাটখোলা বাজারের দিকে ইঁদুর মারা বিষ,উঁকুন মারার বিষ,দাঁতের মাজন,লিঙ্গ লম্বা এবং মোটা হওয়ার জন্য মালিশ করার মোলম, মাজায় ব্যথার মলম,বীর্য ঘন করার হালুয়া থেকে দাঁতে পোকা লাগার ঔষধ বিক্রি করে, সারাদিনে কতো টাকা আয় করতে পারে বা, ওর বাপের পেশা এটা, বাপ ট্রেনে-বাসে হাটে-বাজারে ফেরী করে বিক্রি করতো, ছেলে তখন ছোট ছিলো, কিন্তু বাপ একদিন চলন্ত ট্রেন থেকে পা ফসকে পরে সেই যে মাজা এবং পায়ের গোড়ালির ব্যথা নিয়ে বিছানায় পড়লো আর উঠতে পারলো না।
ডাক্তার বলেছিলো, পায়ের গোড়ালির এবং মাজার হাড় ভেঙে ফ্যাক্চার হয়েছে, সারানোর কোনো উপায় নেই।
এই ভাবে মানুষটা বিছানায় পরে থাকলো দিনের পর দিন, বছর পাঁচেক তো হবেই, তারও বেশি হতে পারে হয়তো। হিসাব কেউই রাখেনি। কে বা রাখবে ওমন একটা লোকের !
কয়েষ হাটের দোকানটাই বেচাবিক্রি করে, কি লাভ বা হবে আর, মানুষজন আজকাল এসবে তেমন গুরুত্ব দেয় না, নেহাৎ যারা আসে তারাও ওর মতো আরেক হতভাগা। তবে কয়েষ কারো সাথেপাঁচে থাকে না। দু’ তিনটে ছেলে-মেয়ে নিয়েই জেরবার অবস্থা, সংসারের এই টানাটানিও যাবে না।
মুয়াজিন সাহেব বলে,“সবই আল¬ার খেলা ভাই, সে কাকে মারবে আর কাকে রাখবে সেই জানে। ধনী-গরীব সব সেই নিয়ন্ত্রণ করে, করো ক্ষমতা নেই নিজে-নিজে কিছু করা। আল¬া যাকে দেয় সেই ধনী হয়, যাকে দেয় না, সে না খেয়ে মরে, যাকে ভালোবাসে সেই বেহেস্তে যাবে, এখানে কারো কিছু করার নেই...”
আচমকা মুয়াজিনের কথা মনে হতেই মোছাদ্দেক ভাবে, যদি তাই হয় তাহলে আল¬া তাকে ভালোবাসে না। এইটাই সত্য, আর সব কিছুই্ মিথ্যে বৈ তো কি। ভালো যখন বাসেই না তাহলে সেই বা কি করতে পারে। অনেক রাত হয়ে যায়, ঘুমের সমুদ্রে হারিয়ে যায় একসময়।
সাত সকালে ঘুম ভাঙে মজেদ মলি¬কের হাঁকডাকে, ঘরের ঝাঁপ খুলে মোছাদ্দেক জানতে পায়, মলি¬কবাড়ি যেতে হবে তাকে এখনই।
-কি কারণ, জানতে চাইলে।
মজেদ মলি¬ক বলে, পঁচিশখানা নারকোল গাছ ঝুঁড়তে হবে।
মোছাদ্দেক হাতে চাঁদ পায় যেন,পঁচিশখানা নারকোল গাছের কথা শুনেই মন প্রাণ ভরে ওঠে। মনে-মনে হিসাব কষে ফেলে, পনেরো টাকা করে হলে পঁচিশখানা নারকোল গাছ ঝুড়তে সে কতো পাবে, সে চিন্তা করতে থাকে। আনন্দিত চিত্তে বলে ওঠে, হিসাব মতো পনেরো টাকা করে গাছপ্রতি দিলে যেতে পারি।
মজেদ মলি¬ক জানায়, টাকার কথা আগে বলছো কেনো রে বাপু, আগেও তো মলি¬ক বাড়ির গাছ ঝুড়েছো, নাকি ?
-কথা ঠিকই,তবে সময় যে পাল্টে গেছে, মানুষজন সবাই কোথায় যাচ্ছে বুঝতে তো পারছেন, এখন টাকার হিসাবটাই বড় কথা।
-বেশ তো কথা শিখেছো, এতো টাকা নেবে মানে বুঝতে পারছি না।
-বুঝে লাভ নেই, রাজি হলে বলেন যাচ্ছি এখনই।
-অংকটা কিছু কমানো যায় না,মানে আট/দশ টাকার মধ্যে হলে ভালো হতো।
-অন্য রাস্তা দেখুন, আমি গাছ ঝুড়িয়ে খাবো না,এ’কাজে কেউ টাকা দেয় না, কামলাদের টাকা দিতে মানুষের কষ্ট হয়। একটা কাজ করতে চায় স্থায়ী কাজ যাকে বলে।
-কাজ করে কতো আর পয়সা দেবে,কামলাদের দিনমজুরীতে বেশ লাভ।
-আপনার যুক্তি আপনার মতো, আমার চিন্তা আমার মতো। তারচেয়ে বড় কথা আমি হিসেবমতো টাকা না পেলে যাচ্ছি না,বলে দিলাম।
মজেদ মলি¬ক উপায় না বুঝে বলে ওঠে,সত্যিই তোমরা বড় সুযোগ খোঁজো দেখছি। যাক অতো কথা বলে লাভ নেই, নেবে যখন চলো,আমার আবার অনেক কাজ আছে।
মোছাদ্দেকের আনন্দ যেন ধরে না। কাস্তে-কাঁচি দড়া-দড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে-যেতে ভাবে পনেরো টাকা হলে পঁচিশটা গাছ ঝুঁড়তে কতো হতে পারে। হাতে-হাতে হিসাব কষে, পনেরো টাকা করে হলে দশটা গাছ ঝুঁড়তে একশত পঞ্চাশ টাকা হয়,কুড়িখানা হয় তিনশত টাকা, আর পাঁচখানায় হয় পঁচাত্তর টাকা, সর্বমোট যোগ করলে অংক হিসাব দাঁড়ায়, তিনশত পঁচাত্তর টাকা, অনেক টাকার একটা শব্দ কানের কাছে বড় মিষ্টি হয়ে বাজে। মন-প্রাণ ভরে ওঠে, আজ সে অনেক টাকা রোজগার করবে, সত্যিই কে যেন বলেছিলো, কেউ কাউকে দেয় না, ছিনিয়ে নিতে হয়। শক্তি না থাকলে তার জন্য পৃথিবী নয়, এখন পৃথিবী তার, যে পারে নিজের ভাগ কেড়ে নিয়ে আসতে। মোছাদ্দেক আর কিছু ভাবতে পারে না, ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, এখন তার সামনে শুধু অন্যরকম আলো, সেই আলোর পথ ধরে যেতে হবে তাকে অনেক দূর-সুদূর।
টাকাগুলো হাতে পেলে অনেকদিন পর বাড়ির জন্য ভালো-মন্দ খাবার কিনে নিয়ে যাবে, কতো কিছু খেতে চায় বউটা, মুহূর্তে নিজেই হেসে ওঠে, ভালো খাবার তো দূরের কথা দুটো ভাতই নিয়মিত পায় না, তার আবার ভালো-মন্দ !
অনেক বেলা হয়ে যায় গাছগুলো ঝুঁড়তে-ঝাঁড়তে আর তারপর তামাম রোয়াক-উঠোন সাফ সুতোরো করতে, বেলা তখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে চলে গেছে সূর্য, শরীর বেশ ক্লান্ত,চোখ দুটো বুঁজে আসে তার, পা যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তারপরও তিন শত পঁচাত্তর টাকার অংক কষে মনটা ভালো হয়ে যায়।
মজেদ মলি¬কের ছোট ভাই একসময় বাইরে এসে জানায়, আজ বাদে কাল আড়তে গিয়ে টাকা নিতে হবে।
বুকের ভেতর সঞ্চিত তাবৎ স্বপ্নগুলো নিমেষে উড়ে গেলো, ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যায় মুহূর্তে, কি করবে ভেবে পায় না, মুখ বুঁজে থাকে। সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে মুখ থুবড়ে পরে যেন, নিজের ভেতর খাবি খেতে-খেতে বাড়ি ফেরে। আবার সেই মরা মুখ, আর ভালো লাগে না, নিজেই ক্ষেপে ওঠে, কিন্তু একজন মোছাদ্দেক কামলা কি বা করতে পারে ?
বুক ভারি হয়ে ওঠে, শ্যামলী চিৎ হয়ে মেঝের বিছানায়, মোছাদ্দেক কামলা তাকিয়ে থাকে নির্বাক চোখে। ওই চোখে অনেক-অনেক কথা অনেক জিজ্ঞাসা আর একটুখানি গ¬ানি, তারপর আর কিছুই পড়তে পারেনি সে। তবে কাল প্রত্যুষের সূর্য উঠবে, সে সূর্যের আলোতে আবার হাঁটবে, আড়তের পথ তো বেশি দূরে নয়, স্বপ্ন যখন আছে নিশ্চয় বাঁচবে সে আগামীকাল।