মালী যখন তার ডালি ভর্তি ফুল নিয়ে মালা গাঁথতে বসে তখন একটি একটি করে ফুল উঠিয়ে সে তার সুতায় পরিয়ে দেয়। আমিও মালীর মতই কৈশোর স্মৃতির মালা গাঁথতে বসলাম।
আনুমানিক পঁচিশ মাইল দূরের পাবনা জেলা স্কুলে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সমবয়সী ফুপাতো বোন মিলা, পাশের গ্রামের বন্ধু ফরহাদ আর আমি গেছি পাবনা শহরের কাচারীপাড়ায় বোনের বাসায়।
মিলার পরিচ্ছন্ন হাতে ছিল কালো একটা ইলেকট্রনিক্স ঘড়ি। এত সুন্দর মানিয়েছিল যে রাতে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে ভাবলাম, মিলার হাতে এই নব সৌন্দর্য এলো কোথা থেকে?
বয়সে আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড় ফরহাদ এক সময় মিলার পিছনে আমাকে বললো, তুই মিলার চুল নাড়তে পারবি?
চুল নাড়াকে ফরহাদ বৃহৎ কর্মের মত মনে করায় অবাক হয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম, হ্যাঁ, পারবো।
সঙ্গে সঙ্গে মিলার চুল যেইমাত্র নেড়েছি ঠিক তখনই আপা রুমে ঢুকলেন। দেখলাম, আপার দৃষ্টি আমার হাত আর মিলার চুলের দিকে। এরপর আপা মিলাকে ডেকে নিয়ে অন্য রুমে শুতে দিলেন। আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম, একই গ্রামে বাড়ি হলেও মিলারা প্রতি বছর আয়োজন করে কয়েকদিনের জন্য নানীর বাড়ি তথা আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। তখন তো আমরা এক ঘরে শুয়েই বিভিন্ন রকমের গল্প বলি আর শুনি, আপাও তো থেকেছে সেখানে! অন্যদিকে মিলাদের বাড়িতে আমি যাপন কালে আমরা তো এক ঘরেই শুই! কিন্তু আজ আপা মিলাকে অন্য রুমে শুতে দিল কেন?
পরীক্ষা দিয়ে বেড়া থানায় আমাদের বাড়ি আসার পর যে নতুন পৃথিবীটা আমার সামনে উন্মোচিত হতে লাগলো নতুন আনন্দ ও নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায়, তার সব কিছুর মধ্যেই আনন্দ পেতাম। সব কাজ করেই ভালো লাগতো, সব কিছুই সুন্দর লাগতো, এমনকি পুকুরের কিনারের পানিতে একটা দোয়েল পাখি যে পানি ছিটিয়ে গোসল করতো তাও, সমগ্র বিশ্ব জাহানই যেন রূপ-রস-গন্ধ-সৌন্দর্যে ভরা, বিশ্ব যেন সুন্দরেরই লীলাভূমি!
কয়েক মাস পর সবকিছু আরো নতুন মনে হতে লাগলো। বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, আকাশ-বাতাস সব। প্রকৃতির সবকিছু যেন নতুন সাজে সেজেছে, আকাশে বাতাসে যেন নতুন রং লেগেছে। এত রং, এত সাজ, এত সৌন্দর্য তো পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগেও দেখি নি! এসব কোথা থেকে এলো? বছরের প্রথম ও নতুন বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাঠে-ঘাটে নতুন দূর্বা ঘাস গজিয়েছে, গাছে গাছে নতুন পাতা বের হয়েছে; প্রকৃতি যে নতুন বউ-এর মত নতুন সাজে সজ্জিত হতে শুরু করেছে-তাও উপলব্ধি করলাম। কিন্তু তবুও সবকিছুই যে এই বাইরের দৃশ্য-প্রকৃতির পরিবর্তনজনিত তা যেন মনে হলো না; মনে হলো, বাইরে থেকে দেখা এইসব পরিবর্তনের অন্তরালে কোথায় কোনো অভ্যন্তরেও যেন একটা অনির্বচনীয় সুন্দরের সৃষ্টি বা প্রকাশ হচ্ছে বা হতে চলেছে, যার স্পর্শে এই পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। কী সেই সুন্দর, কী তার প্রকৃতি? তাকে চিনতে পারি না সঠিক, তবে তার উপস্থিতি বুঝতে পারি। সে কি সৃষ্টি হচ্ছে আমার মনের গহীনে কোথায়ও? আকাশে যে এত রং, বাতাসে যে এত সুগন্ধ ও সূরলহরী, প্রকৃতিতে যে এত সৌন্দর্য-এ সবের উৎস কি বাইরের দৃশ্য-প্রকৃতি নাকি আমার নিজেরই মন?
তখন এপ্রিলের প্রথম ভাগ, নতুন বৃষ্টির স্পর্শে নতুন সবুজের সমারোহ যে চারিদিকে হচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ঋতুরাজ বসন্তের শুভাগমন যে হয়েছে তাও বুঝলাম। কিন্তু বসন্ত তো প্রকৃতিতে এর আগে আরো এসেছে আমার জীবনে। কিন্তু তখন তো সবকিছু এত সুন্দর লাগে নি, মনে হয় নি সবকিছুকে এত নতুন নতুন! বাতাসে ছিল না এত সূর, এত গন্ধ! এত সুন্দরের সমারোহ, এত রূপ-রস-গন্ধ কোথা থেকে আসে?
শুনেছি এবং বইপত্রে পড়েছিও যে হরিণের যখন মৃগনাভির সৃষ্টি হয় তখন তা থেকে এত সূগন্ধ ছড়ায় যে হরিণ তাতে মোহিত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে বেড়ায়, কোথা থেকে আসে এত ঘ্রাণ, এত সূগন্ধ! আকাশে বাতাসের সর্বত্র সে এই গন্ধ পায়, কিন্তু তার উৎস যে তার নিজেরই নাভি, তার নাভিতে উৎপন্ন মৃগনাভি বা কস্তূরী গন্ধ পাগল হরিণ তা কিন্তু বুঝতেই পারে না। আমারও সে সময়ের অবস্থা কি হয়েছিল সেই রূপেরই পূর্বাবস্থা? প্রকৃতির সেই সময়ের যে অত রূপ-রস-গন্ধ তারও কি উৎস ছিল আমার সেই তের-চৌদ্দ বছর বয়সী মন? আমার মধ্যেও কি সৃষ্টি হচ্ছিলো কোনো এক অনির্বচনীয় ভাবেরও? কি সেই ভাব? কি তার নাম?
কৈশোরের সেই দিনগুলিতে সময়ে সময়ে কি যেন একটা ভাব শরীর মনে সৃষ্টি হত যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, অথচ অনুভব করা যায়। মন উদাস করা সেই ভাবটি আনন্দের না ঔদাস্যের তা বুঝতাম না, তবে মনের মধ্যে সেই ভাবটি লালন করতে ভালো লাগত। কিন্তু ‘এই আছে এই নাই’ গোছের সেই ভাবটি মনের মধ্যে কখনো স্থায়ী হত না। ক্ষণিকের তরে মনের আকাশে একটা চমক সৃষ্টি করেই আবার তা কোথায় মিলিয়ে যেত। মনের সঙ্গে তার এই লুকোচুরি খেলা সমস্ত নবম শ্রেণী ভরেই ছিল, তবে ক্রমশঃ তা যেন একটু ঘন ঘনই মনের গহনে আবির্ভূত হত এবং ক্রমশঃ তা দীর্ঘতর ক্ষণ ধরেই থাকত। ধীরে ধীরে সেই ভাবটা ক্রমশঃ আরো স্পষ্টতর রূপ পরিগ্রহ করতে থাকলো। চৈত্র-বৈশাখের উদাস করা দখিনা বাতাস যখন হাঁটু পরিমাণ উঁচু পাট খেতের উপর দিয়ে ঢেউ খেলে ছুটে আসতো তখন আমাদের জোড়দহ গ্রামের ঈদগাহ মাঠের কাছের পুকুরের ‘চোখের ঘাটের’ পাশের গাছ তলায় ছায়ায় বসে থাকতে কী যে ভালো লাগতো! কী অপূর্ব সূর যে সে বাতাসে শুনতে পেতাম তা বর্ণনা করা যায় না।
সদ্য হাঁটা শেখা শিশুদের হাত ধরে বা তাদেরকে কোলে করে কিশোরীরা যখন গোসল করতে আসত, উঠতি যুবতী মেয়েরা এলোচুলে তাদের কলকাকলীতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে যখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসত তখন গাছের ছায়ায় বসে সে রূপ দেখতে, বাতাসের সে সূর শুনতে কতই যে ভালো লাগত তা অবর্ণনীয়। তারা যখন পুকুরে নেমে গোসল করতো সে দৃশ্য, ভিজে কাপড়ে তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য, বাতাসে তরঙ্গ তুলে তাদের চলে যাওয়া-সবই এত সুন্দর লাগতো যা বর্ণনা করা যায় না। আবার ভয়ও হত; কেউ কি দেখে ফেলে-কোনো মুরুব্বি এইভাবে ঘাটের পাশে মেয়েদের যাতায়াতের রাস্তার ধারে বসে থাকা? ভয় ও উপভোগের আনন্দ মেশানো মনের সেই যে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি তা সে সময়ে আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ নতুন। অথচ কতই না মধুর!
একদিন পতিতভাবে পড়ে থাকা দূর্বা ঘাসে আচ্ছন্ন ফসলবিহীন ক্ষেতে ফুটবল খেলতে গেলে খেলা আরম্ভ হওয়ার পর ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু দুরন্ত বয়স হওয়ায় খেলা থামালো না কেউই।
পিচ্ছিল মাঠে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আমার ডান হাঁটুর উপরে অনেকখানি কেটে গেল। রক্ত বের হতে লাগলো। সেইসাথে ব্যথা আর জ্বালাপোড়া। সবাই খেলা বন্ধ করে আমাকে ঘিরে ধরলো। অবস্থা দেখে আমাকে বাড়িতে চলে যেতে বললো।
ওখান থেকে বাড়ি যেতে মিলাদের বাড়ি আগে পাওয়া যায়। সংক্ষিপ্ত পথে সেই বাড়ির উপর দিয়েই যেতে হয়। ওদের বাড়ির উঠোনের উপর দিয়ে আছার খাওয়ার ভয়ে পা টিপে টিপে যাচ্ছিলাম।
মিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। কাটা স্থানটা ওর চোখে পড়ায় আতঁকে উঠে সে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে?
এরপর বললো, এখানে আয় তো।
আমি বললাম, না, না, তেমন কিছু হয় নি।
মিলা বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে উঠোনে নেমে আমার হাত ধরে আমাকে থামালো। বললো, ইস! কিভাবে কাটলো?
বললাম, ফুটবল খেলার সময় আছার খেয়েছিলাম।
মিলা আমাকে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। ওদের টিনের ঘরের বারান্দায় আমাকে উঠানোর জন্য আমার হাত ধরে জোর করে টান দিলে আমিও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। জোড়াজুড়ি করতে গিয়ে ঘরের খামের সাথে আমার মাথায় গুঁতো লেগে খট করে শব্দ হলো। অবশেষে আমি বারান্দায় উঠলে আমার ভিজা শরীর চুইয়ে পানি ঝরছিল। কিন্তু তাতে মিলার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। ঐ ঘরে যারা ছিল তারাও এলো। মিলা ডেটল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার সময় দেখলাম, ওর চুলে বৃষ্টির পানি লেগেছে। খুব লজ্জা লাগছিল। তাই জড়োসড়ো ভাবভঙ্গিতে ছিলাম। মিলা কেন যেন নিঃশব্দে হাসছিল।
বৃষ্টির পানিতে ব্যান্ডেজ ভিজে যাবে বলে মিলা আমাকে আটকে রাখলো। বৃষ্টি কমে গেলে মিলার দৃষ্টির সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদ্যত হলে মিলা বললো, আর একটু পরে যা, বৃষ্টিটা পুরোপুরি থামুক!
দেখলাম, মিলার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। আমার লজ্জা আরো বেড়ে গেল। আর এক মুহূর্তও দেরী না করে ওদের বাড়ি থেকে চলে এলাম।
তখন ক্রীড়া বা স্পোর্ট হিসাবে হাত তিনেক লম্বা একটা লরী দিয়ে ‘লরী খেলা’ হতো। বিপক্ষের মার ঠেকানোর জন্যে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের হাতেই বেতের ‘ফড়িয়া’ বা ঢাল থাকতো। এক হাতে এই ফড়িয়া ও আর এক হাতে লরী নিয়ে দু-দিক থেকে দু’জন খেলোয়াড় যখন ‘ভাঁজ’ করে আর বাঃ, বাঃ, হুঁসিয়ার, সাবাস প্রভৃতি বলে একে অপরকে উৎসাহ দান বা হুঁসিয়ার-সতর্ক করতো তখন যে কী সুন্দর দেখাতো তা না দেখলে বোঝা যায় না।
খেলা হতো সাধারণতঃ ছোট একটুখানি গোলাকার জায়গায় যার চারপাশ দিয়ে দর্শকেরা বসতো ও দাঁড়াতো। দু-দিক থেকে দু’জন লরী ও ফড়িয়া হাতে ময়দানে আসতো। প্রথমে একজন হয়তো ছন্দবদ্ধ কথায় সুর করে নিজেকে একজন বড় যোদ্ধা বলে পরিচয় দিত এবং পরে তার বিপক্ষজনও অনুরূপভাবে নিজেকে অপর একজন বড় যোদ্ধা-যিনি ইতিহাসে তার বিপক্ষের ছিলেন তার নামে, ধরা যাক-বীর বাহাদুর আলী হায়দার বলে পরিচয় দিত। প্রত্যেকেই তার শেষ কথাটির সঙ্গে রে --- টানটি ধরে তার বক্তব্য শেষ করতো ও সঙ্গে সঙ্গে তার পক্ষের লোকেরা উচ্চস্বরে ও একসাথে খুব জোর দিয়ে ‘হে আলী’ বলে হুংকার দিয়ে উঠতো। এরপর একজন বিভিন্ন কায়দায় ‘ভাঁজ’ অর্থাৎ কুচ-কাওয়াজ করতে করতে বিপক্ষ খেলোয়াড়কে আঘাত করার জন্য এগিয়ে যেত। বিপক্ষ খেলোয়াড় তখন হাঁটু গেরে বসে তার লরী ও ঢাল দিয়ে শত্রুর আঘাত ঠেকানোর প্রস্তুতি নিত। ওদিকে বিপক্ষ যোদ্ধা ভাঁজ করতে করতে এগিয়ে এসে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে শত্রুর দেহে আঘাত করতো এবং দ্রুত গতিতে স্ব-স্থানে ফিরে যেত। এবার দ্বিতীয়জন ও প্রথমজন একইভাবে আক্রমণ করতো এবং আঘাত ঠেকাতে চেষ্টা করতো। যারা বেশী মার খেত তারাই হেরে যেত। এই লরী খেলারই পরবর্তী ধাপ লাঠি খেলা।
লাঠির সবচেয়ে বড় কেরামতী ছিল ‘লাঠি ঘুরানো।’ একজন দক্ষ ‘সরদার’ যখন লাঠি ঘুরাতো তখন সে লাঠি এত জোরে ঘুরাতো যে বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণ লেগে বোঁ-বোঁ শব্দ হতো এবং ঘুরন্ত লাঠিটা চোখেই পড়তো না, পূর্ণগতিতে ঘুরছে এমন একটা বৈদ্যুতিক পাখার মতই লাগতো। সে সময়ে অন্য লাঠিয়ালের লাঠির বাড়ি বা খোঁচা তো দূরের কথা একটা রাইফেলের বুলেটও ঘুরন্ত লাঠিতে বাড়ি খেয়ে ছিটকে যেত। তীব্র বেগে ঘুর্ণায়মান লাঠি হেলিকপ্টারের পিঠের উপরকার ঘুর্ণায়মান পাখার মতই সেই লাঠি ঘুর্ণনকারী সরদারকে নাকি উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। শোনা যায় যে সরদার যদি শত্রু লাঠিয়ালদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায় তাহলে এইভাবে ঘুর্ণায়মান লাঠির সাহায্যেই সে উড়ে উঠে ঘেরাও এর মধ্যে থেকে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারে। ঐ সময়েই আমি লাঠি ঘুরানো শিখেছিলাম।
তখনকার দিনে বিশেষ করে আশ্বিন মাসে যখন কৃষকের কোনো কাজ থাকতো না তখন গ্রামে গ্রামে হাডু-ডু খেলার ধুম লেগে যেত। আর লাগতো ‘শাস্তর বলা’র ধুম। লাঠি খেলার ঢোলের বাজনা, হাডু-ডু খেলার ‘ডাকের’ শব্দ আর শাস্তুরে গানের টানে রাতের আকাশ বাতাস আনন্দমুখর হয়ে থাকতো।
বিভিন্ন দলে দলবদ্ধ হয়ে হাডু-ডু খেলা হতো। এতে দু-পক্ষ সামনাসামনি দাঁড়াতো। বিবাহিত-অবিবাহিত, ছাত্র-অছাত্র, হাইল্যা-গিরস্ত, এ পাড়া-ও পাড়া এমনকি যে সব গোষ্ঠী বড় তাদের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে খেলা হতো। এ খেলায় বাড়িওয়ালাকে সাধারণতঃ পান, তামাক ও এক ধামা মুড়ি, এক হালি নারিকেল ও কিছু গুড় দিতে হতো খেলোয়াড়কে। নিছক আনন্দ পাওয়া ও দেওয়াই ছিল এ খেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কাজেই এতে হার-জিৎ নিয়ে কখনো কোনো সংঘাত বা কোন্দল সৃষ্টি হতো না। এখন খেলা নিয়ে গ্রামে যে দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি হয় তাতে অনেকেই আহত তো হয়ই-আরো লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের কারণে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তিও ধ্বংস হয়, এ ছাড়া কালাকাল ধরে চলে আসা সদ্ভাব-সম্প্রীতি ও মন মানসিকতার যে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় তা আর কোনদিনই ভরাট হওয়ার নয়।
কেচ্ছার জন্য বাড়ির উঠোনে একটা আসর বসতো। চারদিকে স্রোতারা সব বসতো, মাঝখানে শাস্তর বলনেওয়ালা ও তার ‘পাছ দোহারেরা’ বসতো। কথক বিভিন্ন ধরণের গল্প সম্পর্কিত রস ও অঙ্গভঙ্গী সহযোগে কেচ্ছাটা বর্ণনা করে যেতেন। আনন্দ ও বিষাদের স্থানগুলোতে দু-এক অন্তরার গান থাকতো। কথক এই গানটা ধরায়ে দিতেন আর পাছ দোহারেরা পরম উৎসাহে হুংকার দিয়ে সে গান গাইতো। বেহুলা লক্ষীন্দর ও রূপবানের মত কেচ্ছাগুলোয় পর পর দু-রাত লাগতো। কেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে চলতো হুক্কা আর তামাক। বেহুলা লক্ষীন্দর, রূপবান, জামাল বাদশা, বানর বাদশা প্রভৃতি কেচ্ছাগুলো শুনতে শুনতে নিজেকে এইসব কেচ্ছার নায়কের সঙ্গে একেবারে একাত্ম করে ফেলতাম এবং ক্রমশঃ ঢুলতে ঢুলতে এক সময়ে টুপ করে ঘুমিয়ে যেতাম। কখনো কখনো কেচ্ছার মধুর দৃশ্যগুলি স্বপ্নেও দেখতাম। ‘বেহুলা লক্ষীন্দর’ কেচ্ছার ‘‘বেউলার নাচনে হে তুষ্টু ভোলা মহেশ্বর’’ গানটির সুর এখনো কানে বাজে।
ক্ষেতে ফসলের বা’ন-বুনানী ও নিড়ান-কুড়ান হয়ে যাওয়ার পর আসতো বর্ষা। নদী থেকে জোলা বা নালার মত জায়গা দিয়ে নতুন পানি ঢুকতো বিলে। আমরা ডোড়া জাল দিয়ে মাছ মেরেছি-শুধু বোয়াল মাছ-অনেক বড়-পেট ভরা ডিম! সারারাত ধরে মাছ মারতাম, জোলার এ পার থেকে নেমে দুইটা বাঁশের লাঠির সাথে বাঁধা জাল টেনে দু’জন ওপারে গিয়ে ওঠা, আর তাতেই স্রোতের টানে নদী থেকে বিলের মধ্যে প্রবেশরত মাছ জালে উঠতো; কাপড়ে কাছা মেরে লাফিয়ে উঠে ‘আনন্দের ধ্বনি’ দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে নামা ও তীব্র স্রোতের মধ্যে আড়াআড়ীভাবে জাল টেনে ওপারে ওঠা, মাছ ধরা, মাছ গাঁথা-সেই অন্ধকারে বা পরিষ্কার বা আবছা জ্যোৎস্নায়! ওহ! সে যে কী থ্রিলীং, কী যে আনন্দ ও উদ্দীপনার, তা এই আষাঢ়ে মাছ যে মারে নি সে বুঝবে না। কোনো কোনো রাতে মুষলধারে নামতো আষাঢ়ে বৃষ্টি-আকাশ ভেঙ্গে; চারদিক সূচীভেদ্য অন্ধকার! তারই মধ্যে বৃষ্টি মাথায় করে মাছ মারা! এ রকমের বৃষ্টির মধ্যেই মাছ হতো খুব বেশী, মাছ দিশেহারা হয়ে জোলা দিয়ে ঢুকতো ভিতরে আর মারা পড়তো দলে দলে। বেশির ভাগ মাছই লোকজনকে ‘দিয়ে থুয়ে’ খাওয়া হতো, অনেক মাছই পঁচে নষ্ট হতো। সেই মাছেরই অভিশাপ বোধহয় লাগছে এখন। এখন বোয়াল মাছ দুষ্প্রাপ্য, আড়াই হাত/তিন হাত বোয়াল মাছ তো কল্পনারও অতীত।
সূঁচালো ফলাওয়ালা ‘কুঁজ’ এবং ‘জুতী’ দিয়েও আষাঢ়ে বোয়াল মাছ মারতো সৌখিন লোকেরা। বিলে পানি পড়লে বিলের চারধারে যে ‘চতরা’ বা সমতল-সাধারণতঃ পতিত জমি থাকতো তার উপর যখন অল্প পানি হতো তখন বোয়াল মাছেরা সেই সমতল পতিত জমির উপর উঠে খেলা করতো একা একা বা জোড়ায় জোড়ায়। এইভাবে খেলতে খেলতে এক সময়ে একে অপরকে অথবা নিজেই নিজের লেজ কামড়ে ধরে সাদা পেট জাগিয়ে ভেসে উঠতো স্থির হয়ে। ‘জিয়ানী’ আগে থেকেই বাঁশের পলো বা মাচানের উপর জুতী হাতে ওৎ পেতে বসে থাকতো। যেইমাত্র মাছ সাদা হয়ে উঠতো অর্থাৎ ‘পীড়াতো’ অমনি জিয়ানী তার জুতী ছুঁড়ে দিয়ে বা কোপ মেরে মাছ গেঁথে তুলতো।
এ মাছ মারা খুব কষ্টকর ও বিপজ্জনক। সারা রাত একটা পলোর উপর বসে থাকা। এমন অনেক সময় হয়েছে যে পাশাপাশি পলোর উপর বসে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন দু’জন জিয়ানীর একজন হঠাৎ করে পলোর উপর থেকে পানিতে পড়ে গেলে সেই শব্দ শুনে পার্শ্ববর্তী জিয়ানী হঠাৎ ঘুমাচ্ছন্ন চোখে ভুলবশতঃ তাকেই মাছ মনে করে তাকে কোপ দিয়ে গেঁথে ফেলেছে!
আমি একদিন রোঙ্গাই নামের একটা বিলে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে সারারাত বসে ছিলাম, একটি মাছের সাড়াশব্দও পাই নি। অনেক রাত্রে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কোথা থেকে বিরাট এক উড়োজাহাজ তার সমস্ত আলো জ্বেলে একেবারে আমাদের মাথার উপর দিয়ে প্রায় আমাদের হাত দিয়ে নাগাল পাওয়ার সমান উঁচু দিয়ে উড়ে গেল; আমরা তো ভয়ে সব জিয়ানী চিৎকার করে উঠেছিলাম, উড়োজাহাজটা বুঝি বা আমাদের মাথার উপরই পড়ে যায়! কিন্তু না, ডাইভ দিয়েই সেটা আবার উপরে উঠে চলে গেল দক্ষিণে। সকালে বাড়ি এলাম একেবারে খালি হাতে। আর একদিন কাজল কুড়া বিলে মাছ মারতে গিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম। বেশ সুন্দর পরিষ্কার জ্যোৎস্না রাত, ঝিরঝিরে বাতাস। যেই একটু তন্দ্রার মত এসেছি অমনি পিঠের উপর কিসের যেন মৃদু খোঁচায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলেই দেখি অন্য গ্রামের তাহেজ মুন্সী সাহেব দাঁড়িয়ে-তখন আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক; থাকতেন আমাদের বাড়িতেই। প্রায় সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ অথচ কী শক্ত, সমর্থ ও দৃঢ় স্বাস্থ্যের অধিকারী। এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল যাবৎ তিনি শিক্ষকতা করে আসছেন, যার ফলে এলাকায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় সকলেই তার ছাত্র। আমি সরাসরিভাবে তার ছাত্র নই কিন্তু তবুও তাকে ওস্তাদ মানি এবং দাদা বলে ডাকি।
মুন্সী দাদা বললেন, কি রে, এত কষ্ট করে মাছ মারার তোর কি ঠেকা? তুই তো এখন ফুলের ডালির মত বসে বসে খাবি। চল, বাড়ি চল।
সে কথার মধ্যে ধমক, ভয় দেখানো নাকি আদর ছিল তা বুঝলাম না কিন্তু শখের মাছ মারা আর হলো না। অস্ত্রপাতি অর্থাৎ জুতী, পলো, হারিকেন, ছাতি সব গুছিয়ে নিয়ে মুন্সী দাদার আগে আগে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম নিঃশব্দে। বাড়ি পর্যন্ত সমগ্র এক মাইলেরও বেশী পথে একটি কথাও তিনি আর বললেন না, নিঃশব্দে আমরা হেঁটে বাড়ি চলে এলাম। বাবা বারান্দাতে বসে বিড়ি খাচ্ছিলেন; মুন্সী সাহেবকে দেখে তিনি তাড়াতাড়ি বিড়ি ফেলে দিলেন। মুন্সী সাহেব তার হাতের লাঠি দিয়ে ঘরের মধ্যে নির্দেশ করে আমাকে বললেন, যা, শুয়ে থাকগে।
সেইদিনই প্রথম একটা কথা বুঝতে পারলাম, আমার যেন অনেক মূল্য আছে এবং সে মূল্যও এত যে আমাকে যেন অত্যন্ত হেফাজতে থাকতে হবে, মাছ মারার জন্য ওভাবে বিলের ধারে গিয়ে শুয়ে থাকা তো চলবেই না, এমন কিছুও করা চলবে না যাতে আমার স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য ও মন-মানসিকতার ক্ষতি হয়। আমাকে নিয়ে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ও মুন্সী দাদার অনেক আশা-আকাংখা। সেদিনের পর আর কখনো জুতী দিয়ে মাছ মারতে যাই নি; সময়ও হয় নি, সে সুযোগও আর হয় নি কখনো।
বড়শী দিয়ে মাছ মেরেছি বিলে ও হালটে-মাটিয়ালে এবং বর্ষার সময়ে বাড়ির ঘাটে ও মাঠের মধ্যে ক্ষেতে। বিলে কাছী বা রশি টেনে পলো দিয়ে মাছ মারার কাজে সাহায্য করেছি। আমরা ছোট দুইজন ছেলে অনেক বড় ও মোটা কাছীর দুই প্রান্ত কোমড়ের সাথে বেঁধে টান করে উরু সমান পানিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতাম আর বড়রা কাছীর পিছনে পলো নিয়ে এগিয়ে যেত আর মাছ মারতো।
তখন বিল-বাওরে পানি থাকতো, তাই বছরে নতুন মাছ জন্মিত, কারণ মাছ ডিম পাড়ার ও বংশ বিস্তার করার ক্ষেত্র পেতো। এখন চারদিকেই সব বাঁধ হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, বিল-বাওর সব সেঁচে ইরি-বোরো ধানের আবাদ করা হচ্ছে, মাছ বংশ বিস্তারের ক্ষেত্র ও সুযোগ পায় না, পুরনো মাছ বেঁচেও থাকে না। তখন “মাছে ভাতে বাঙ্গালী” বলে একটা কথা চালু ছিল কিন্তু এমন দিন হয়তো দূরে নয় যখন এ কথাটি বাস্তব ক্ষেত্রে তার অর্থ হারিয়ে ফেলবে। সত্যিই মাছ এমন একটা জিনিস যা দেখলেই লোকে বলে, “মার।’’ মাছ ছোট হোক বড় হোক, একটা হোক আর বহু হোক, খাওয়া যাক আর না যাক ছেলে-বুড়ো প্রতিটি মানুষই মাছ দেখলেই তাকে মারতে যায় ও মারে। কেউ কখনো মাছ বাঁচিয়ে রেখে মাছ বাড়ার চিন্তা ও চেষ্টা করে না। এই একটা জিনিস যা মানুষ শুধু মেরেই শেষ করছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে; মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাছ এবং শিয়াল; দেখলেই মানুষের বুলিই হচ্ছে “মার” এবং “ধর।’’ মাছ কি বলে জানি না তবে শিয়াল নাকি বলে, “মানুষের কী ক্ষতিই যে করেছি, তারা আমাদের দেখলেই বলে ধর ধর, আর দুনিয়ার যত কুকুর আছে সব আমাদেরকে ধরতে আসে যার জন্য হাঁসটা-মুরগীটা যে ধরে একটু আরামে খাব সে উপায় নেই। মানুষ বড়ই অমানুষ, অন্যের একটু ভালো দেখতে পারে না।’’
স্কুলের পাশে বাজারে যাওয়ার রাস্তায় ওষুধ বিক্রির মজমায় বা পথচারীর গোলাকার জমায়েতে মজা উপভোগের মধ্য দিয়ে দোতারা বা হারমোনিয়ামের বাজনার সাথে গান শুনে বিলম্বে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকের বকা খেয়েছি। সিনেমার পোস্টার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ম্যাটিনি শো-তে হলে সিনেমা দেখে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে বাবার মার খেয়েছি। প্রখর রৌদ্রে মাঠের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানো, মার্বেল খেলা, বেয়ারিং-এর তিন চাকার গাড়ি চালানো, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ভিজে আম কুড়ানো এ রকম কত কিছুই যে করেছি!
দুপুরে আমার তেমন ঘুম ধরতো না। একবার গরমের দিন দুপুরে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে এ পাশ ও পাশ করার পর মিলাদের বাড়ির পাশের হালটে গিয়ে দেখি ওরা বদনদারী খেলছে।
হঠাৎ চোখে পড়লো, উঁচু বাড়ির আবর্জনাময় ও আগাছাপূর্ণ ঢাল বা গড়ান বেয়ে নীচে হালটের দিকে একটা বেশ বড় সাপ মিলার সোজাসুজি নেমে আসছে। চমকে উঠলাম। সাপের উল্টোদিকে বা নিরাপদ জায়গার দিকে হাত ইশারা করে আকাশ, বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বললাম, মিলা, সাপ আসছে, সরে যা, সরে যা।
দেখলাম, যেদিকে সরে যেতে বলছি মিলা সেদিকে শুধু তাকাচ্ছে পূর্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে। আমি প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললাম, ধেত্তোরি, বোকা কোথাকার!
খুব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে ওকে সরিয়ে নিয়ে বেশ কয়েক পা যাওয়ার পর টাল সামলাতে না পেরে পাশে ধানের খড়ের গাদার উপরে দু’জন গিয়ে আছড়ে পড়লাম। অন্যেরা হাতের কাছে লাঠি সোটা যা পেলো তাই দিয়েই সাপের উপর বাড়ি শুরু করলো। আমরা উঠে শরীর থেকে খড় ঝাড়তে ঝাড়তে দেখলাম যে তিন হাতের মত লম্বা বিষধর এক গোখরা সাপ।
মিলার সাথে কথা না বলে ওর প্রতি শুধু অগ্নি দৃষ্টি বর্ষণ করতে থাকলাম। মিলা লজ্জিতভাবে হাসতে লাগলো।