প্রিয় সন্তানেরা,
আমার কিছু কথা আমি তোমাদের বলার জন্য লেখার আশ্রয় নিলাম। জীবনে মানুষের কিছু অসহায় সময় আসে, যখন তাকে স্রোতের বিপরীতে বাঁচার জন্য লড়াই করতে হয়। এই লড়াইয়ের এক সময় কিছু প্রয়োজনীয় কথাও সহজ করে বলার সুযোগ হয় না বা বললেও কারো মাথায় ঢুকে না। তাই তোমাদের সামনা সামনি বসে এই কথা গুলো বলার ইচ্ছা ত্যাগ করেছি। কারণ আমি নিশ্চিত এখন তোমাদের মাথায় আমার দেও বক্তব্য গ্রহণ করার কোন অবস্থা নাই। সেজন্য এই লিখিত অবয়বে আমি এই বিষয়টি সংরক্ষণ করে যাচ্ছি। এই আমার লিখে যাওয়া কথা, একটি ঘটে যাওয়া ইতিহাস; বর্তমানের ইতিহাসের প্লট এবং ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনার সেতু বন্ধন হিসাবে কাজ করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখন তোমাদের মনে বা মগজে এই আমার লেখা কথাগুলো ধারণ না করলেও লিখিত থাকার জন্য, জীবনের কোন এক অবসরে তোমরা এটি পাঠ করে জীবনের কিছু ইতিহাস সমন্ধে নির্মোহ জ্ঞান লাভ করতে পারবে।
প্রিয় সন্তানেরা,
আমি এই লেখা কোথা থেকে শুরু করব ঠিক করতে পারছি না বলে, প্রায় ৩ মাস লিখব লিখব করেও লিখতে শুরু করতে পারিনি। আচ্ছা, আমি কি বর্তমানকে নিয়ে লিখব, যেখানে শুধুই বর্তমানের ইতিহাস, বর্তমানের কথা গুলোই থাকবে? কিন্তু অতীতের স্মৃতিগুলো কি এতই ফেলনা নাকি, যার কোন মূল্য নাই ? অতীতের স্মৃতি যতই বৈরী হোক না কেন, আমার কাছে তারও অসম্ভব মূল্য আছে। আসলে আমরা সময়ের নিয়মের কাছে সকলেই বন্দী। ফলে জীবনের কোন কিছুকেই আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করি না। সেই জন্য আমার এই লেখায় কখনো কখনো কিছু অতীত বেশ দাপটের সাথেই বিচরণ করবে। যদি পড়তে ভালো না লাগে চোখ বুলিও, অবজ্ঞা করিও না।
সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা অন্যকারো ভালবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, হতে পারে না। পৃথিবীতে পিতাহারা সন্তানের এইবোধ আসে, তোমাদের আসেনি। সেজন্য আমি কিছুই মনেও করিনি। কিন্তু আমি তোমাদের বাবা, যা অস্বীকার করতে পারবে না। যা অস্বীকার করা যায় না, তাকে মানিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। যদিও এই মুহূর্তে তোমরা সেই বিষয়টি উপলব্ধই করতে পারছ না। আমি বাবা হিসাবে তোমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি মাত্র, ইহা অলঙ্ঘনীয় কোন পাঠ্য বলেও দাবী করছি না।
কেন এমন হল আমাদের জীবনে?
তোমাদের কাছে আমি স্বাক্ষাত এক ‘শুয়োরের বাচ্চা’, ঠিক না ? একজন শুধু ‘শুয়োর’ হলেও তোমাদের কাছে হয়ত আমার কিছুটা মূল্য থাকত, কিন্তু আমি তো বংশপরম্পনায় ‘শুয়োর’। এমন এক নিকৃষ্ট প্রাণীর সাথে কিভাবে তোমরা থাকবে? তাই আমাকে দূরে রেখে যে সহজ সরলতার পরিচয় দেখিয়েছ, তোমরা দুই ভাইবোন; আমার তা খুব মনে ধরেছে। আমি প্রানের বিনিময়ে তোমাদের এই ইজ্জত রক্ষার জন্য দোয়া করছি। আল্লাহপাক তোমাদের এই পুত পবিত্র জীবন ধারণে সকল সাহায্য দিক, দোয়া করছি !
আমীন !
এখন ধরো সামাজিক কিছু বিষয়কে নিয়ে কথা বলি। তোমাদের সনদের বয়সে কিছুটা ঘাপলা আছে। এটি এই দেশের নিয়মের বরখেলাপ নয়। সেই হিসাবে তোমরা যথেষ্ট পরিপক্ক। মনেরেখ, এই প্রায় তোমাদের কাছাকাছি বয়সেই আমরা আমাদের জীবন অনেক সংগ্রাম পেড়িয়ে শুরু করেছিলাম। তোমাদের জম্মদানের প্রক্রিয়ায় আমার বয়স তোমাদের সমান ছিল। যে বয়সে তোমার বাবা বিবাহ করেছিল সেই বয়সে তোমাদের তো নাবালক বলা যায় না, ঠিক না। আজ তোমাদের অনেক বুদ্ধি, অনেক প্রিয়জন। তোমাদের দুই জনকে এই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা করেছি। একটু ভুল করে বলেছি... আমি কিছুই করিনি। তোমরা করেছ ! হয়ত তোমাদের ইচ্ছায় বললে আমি শুধু কিছু ফেরতযোগ্য অর্থ ব্যয় করেছি, যা তোমরা আমাকে আর কিছুদিন পর ফেরত দিতে চাও। কি সুন্দর তোমাদের হিসাব ! যে বা যিনি কোনদিন একটি দাওয়াতে ভালো খাবার একা খায় নাই, তোমাদের জন্য নির্লজ্জের মত অনেকের বাকা চোখ উপেক্ষা করে বহন করে এনে খাইয়েছে, সেই জম্মদাতার তোমাদের জন্য ব্যয়িত অর্থ ফেরত দেবার মন মানসিকতা তোমরা অন্তরে লালন করেছ, জেনে প্রীত হতে পারিনি। এটি আমার চরিত্রের বিপরীত ভাবনা। তোমারা এই বিষয়টি কিভাবে অন্তরে পোষণ করলে? কে তোমাদের এই বুদ্ধি দাতা? কি জানি, আমার পেশাগত বিষয়ে জীনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। জীনতত্ত্ব আমাকে পড়তে হয়, পড়াতে হয়। সেই সামান্য লব্ধিত জ্ঞানে আমি জানি সন্তানের জীবনচক্রের বহমান চরিত্রের ঠিক ৫০% বাবার চরিত্র, বাকি ৫০% মায়ের কাছ থেকেই আসে। তাহলে অংকের নিয়মে ইহা সহজ সরলভাবেই প্রতিয়মান হয় যে, এই অর্থ ফেরত দেবার ভাবনা তোমরা কোথা থেকে পেয়েছ ! যাক, তবুও খুব ভালো লাগছে যে তোমরা না চাইলেও আমাদের কিছু না না কিছু সম্পদ বয়ে বেড়াচ্ছ ! আজীবন বেড়াবে; বেড়াতেই হবে ! ইহাই সৃষ্টিকর্তার খেলা !
প্রিয় সন্তানেরা,
তোমরা আমার একটি দিব্য জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছ। তা হল ভালোবাসা কখনো নিঃস্বার্থ হয় না। এটি অফেরতযোগ্য বলে এতদিন যা ভেবেছি, তা আমার ভুল ছিল। এই ভুলের মাসুলের কারনে, আমি জীবনে তোমাদের অনেক ইচ্ছাই হয়ত পুরন করতে পারিনি। কখনো কখনো আমার ইচ্ছে ছিল, সামর্থ ছিল না। আবার কখনো কখনো সামর্থ ছিল, ইচ্ছে ছিল না। এই যে জীবনের নিয়ামক শক্তির হেরফেরে তোমাদের অনেক ইচ্ছে জলাঞ্জ্বলি দিতে হয়েছে, সে জন্য আমি তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী নই। কারণ আমি আদর্শকে বিক্রি করার মন্ত্র জীবনে রপ্ত করতে শিখিনি। এটি অবশ্যই আমার দুর্বলতা। কিছু কিছু দুর্বলতা মানুষ আমৃত্যু বয়ে বেরিয়ে আনন্দ পায়, আমার কাছে এটি একটি সুখকর বিষয় ! এই নীতিবোধ মেনে চলতে গিয়ে আমি তোমাদের কাছে শুধু নই, রাষ্ট্রের কাছেও অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। আমার পদন্নোতি হয়নি। আমার সামাজিক উন্নতি হয়ত তেমন কিছুই হয় নি। আমার ঢাকা শহরে মাত্র একটি বাড়ি হয়েছিল, তাও অংশিদারিত্বের মাধ্যমে; নিরংকুশ মালিকানায় নয়। হয়ত তোমাদের জন্য এই নিরঙ্কুশ মালিকানা বেশি উপভোগ্য ছিল, এ আমার নিদারুন ব্যর্থতা ! কিন্তু তোমাদের অজানা থাকলেও তোমাদের বাবার একটি খুব সাধারন অর্জন আজ জেনে যাও। গোটা দেশের অনেক মানুষ জানে তোমার বাবা একজন সৎ, আদর্শবান মানুষ। দুর্নীতিকে সে হাসতে হাসতে অবজ্ঞা করত পারে। হালাল জীবিকার একটি আদর্শ সে অনেক কষ্টে নিজেকে মানিয়ে ফেলেছে। সেই কারনেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক তোমার বাবাকে একটি ঋণমুক্ত অতি সাধারন জীবন দান করেছেন। যেখানে প্রাচুর্য নাই, কিন্তু অভাব নাই; নাই কোন ঋণের বোঝাও। আমি হলফ করে বলে যেতে পারি এই মুহূর্তে আল্লাহর ডাকে যদি পরপারে চলে যাই, কেউ তোমাদের কাছে এসে কোন কিছুই দাবী করতে পারবে না। তোমাদের বাবার কৃতকর্মের জন্য দায়ভার বহন করে যেতে হবে না। আমি তোমাদের এই উচ্চ আসনে আসীন করে চলেছি, হয়ত বুঝোনি।
যাক গে, এসব সম্মানের বিষয় মুখ্য নয় ! অসম্মান নিয়েও সম্পদশালীদের দৌরাত্ব চলছে সমাজে, সেখানে তোমার বাবার এই নির্লোভ জীবন তোমাদের ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু সামান্য চোখ কান খোলা রেখে তাকালে দেখতে পারতে যে, সৎ জীবন হালাল রুজির জীবনচারিতে আল্লাহপাক তোমার বাবাকে যে বরকতময়ী জীবন দিয়েছেন, সেখানে তার যা অর্জন; তা তোমার বাবার অনেক বন্ধুও এখনও সেই লেভেলে পৌছাতে পারেনি। আরও একটি বিষয় জেনে রেখো যে, তোমার বাবার এই অর্জনে নিজের চেষ্টা এবং শ্রম জড়িত। অন্য কারো কোন অবদান নাই, এমন কি তোমার মায়েরও।
এই অপ্রিয় বিষয় যখন উঠেই এলো, তো আরও একটি প্রাসংগিক বিষয় এখানে বলে ফেলি!
কি বলো সন্তানেরা !
এই যে তোমার বাবার বাড়ির দুইটি ফ্লাট দেখছ, যা তোমাদের সামনেই তৈরি হয়েছে। সেই বাড়ির জমি তোমার বাবাকে তার এক বন্ধু কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই জমি কিনতে অযাচিতভাবে তোমার বাবাকে প্রেসার দিয়ে তোমার মায়ের নাম দেয়ানো হয়েছে। সংসারের স্বার্থে তোমার বাবা তা মেনে নিয়েছে। সেই জায়গায় মালিকানা নিতে গেলে তোমার মায়ের দেবার কথা ছিল প্রায় ৩ লাখ টাকা। যেহেতু তার মনে জমির মালিক হওয়ার সাধ ছিল, তো তার কি উচিত ছিল না সেই টাকা শোধ করে দেয়া? কিন্তু মাত্র ১,৪৮,০০০ টাকা দিয়ে ৩ লাখ টাকার সম্পত্তি ভোগ করার এই ইচ্ছে তোমার মায়ের ছিল, বাবার নয়। এখানেই শেষ নয়... সেই অংশে তোমার বাবা ধার দেনা করে ফ্লাট তৈরি করল। যার বাস্তব মাপ ১১৪৫ বর্গ ফুট। এই অংশ করতে তোমার মায়ের দেয় অবদান বিভিন্ন সুত্র যোগ করলে ১,০৫,০০০ টাকা মাত্র। একজন বধ্য পাগলও বুঝে যে, ঢাকা শহরে এই টাকায় কোন বাড়ি করা যায় না। কিন্তু তোমার মায়ে সেই বাড়ি দখলের জন্য বারংবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেশ তোমরাও সেই বাড়ির অধিকার মাকে বুঝে দেবার জন্য বাবার সাথে কর্কশ স্বরে তর্ক করেছ। তোমার বাবা আগেই বলেছি ভালবাসা ফেরতযোগ্য কোন সম্মদ মনে করে না বলেই, যখন বুঝতে পেরেছে যে সন্তানেরাও বাবার সাথে অনৈতিক আচরণ শুরু করেছে, সে দূরে চলে এসেছে ! যেখানে নৈতিকতা বিক্রি হয়ে যায়, যেখানে ভালবাসার বিনিময়ে সম্পদ নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হয়, সেখানে তোমার বাবার থাকা সম্ভব নয়। তোমার বাবা অচল মুদ্রা হিসাবেই বেঁচে আনন্দ পায়। কারণ তোমার বাবার কাছে সম্পদ কবরে নেয়া যায় না বলেই মায়াও লাগে না। তোমার মায়ের প্রকারান্তরে তোমাদের দরকার ছিল বলেই দিয়ে এসেছি। আমি দূরে এসেছি... এখন আর ওই সম্মদ আমাকে টানে না। ভালোবাসা যেখানে মূল্যায়িত বিষয় হয়, সেখানে তোমার বাবা বাঁচতে পারেনা। বুকের পাজরের ক্ষত বয়ে বেরাতে হোক, আর বুক ভোরে শ্বাস নিতেই হোক, তোমার বাবা আজ তোমাদের ছেড়ে অনেক দূরে ! যেই দুরুত্ব গজ ফিতায় মাপা যায় না !
তোমার বাবা নিজ চেষ্টায় মানুষ অমানুষ যাই বল, আজকের অবস্থানে এসেছে। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে যাওয়ার এই কষ্ট শ্রমকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টায় অনেকেই যুক্ত। কিন্তু দুঃখজনক হল সেই অভিযাত্রায় তোমার বাবার পাজরের অংশীদারও অংশ নিয়েছে। শুধু তোমাদের জীবনের উন্নতিকে লক্ষ্য করে অনেক আগে এই বিষয় জেনেও আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু কোন এক কবি বলেছিল ... সাগরের জলে শিশিরসিক্ত জলকণা দিয়ে তাকে হিসাবে নিতে বলেছিল ! আমার জীবনের সমস্ত অর্জনকে শিশির সিক্ত বারীধারায় মেপে ফেলেছিল। একজন বীর কখনো এই অন্যায় মেনে নেয় না, নেয়া উচিত নয় ! তোমার বাবাতো বীর নয়, সাধারন সরল মানুষ। তাই সন্তানের জীবন গড়তে গিয়ে চুপচাপ হজম করেছে এই অসম্মান গুলো। কিন্তু সব কিছুর একটি শেষ আছে। লেবু কচলাইলে তেতো হয়, ব্যবাহারের অনুপযোগী হয়। আবার রশিকে বেশি টানলে বা বেশি পেচাইলে ছিঁড়ে যায়। এই ছিঁড়ে যাওয়া অলঙ্ঘনীয়, একে অবজ্ঞা করা যায় না। কিন্তু যে পেচায় সে বোঝেনা, কক্ষনো বোঝে না। কিন্তু তোমারা তো বুঝতে পারতে ! একজন মানুষ সারাজীবন শুধুই দিয়ে যাচ্ছিল... তার ত্যাগ তোমরা অস্বীকার করলে কিভাবে? কিভাবে তাকে অসম্মানের যাতাকলে পিষ্ট করতে তোমরা সেখানে ঘি ঢাললে ! তোমাদের বয়স শিক্ষা কি বিবেকবান করেনি? যেই শিক্ষা মানুষের বিবেক কে সত্যের পথে চালিত করেনা, সেই শিক্ষার কিবা দাম ! মাকে ভালবাসায় কোন সমস্যা দেখিনি, তাই নিজেকে গর্বিত ভেবেছি ! কিন্তু আমি এতো বোকা যে, মায়ের ভালবাসার শতভাগে সন্তান যে বাবাকে শুন্য ভালোবাসা দিতে পারে আমার ভাবনায় ছিল না ! তাই আমি যখন তোমাদের আচরণ দেখেছি হয়েছি কিংকর্তব্যবিমুঢ় ! আমার মুখে ভাষা আসেনি, রুচিতেও বেঁধেছে ! তাই তো তোমাদের জন্য আমার এই লেখা ‘ বাবার চিঠি’। একজন অসহায় বাবার জীবনের কিছু প্রলাপ মাত্র !
২৪ বৎসরের একজন তরুণ দীর্ঘ ৩ মাস বাবার সাথে কথা বলতে পারেনা ! আরেক জন ২২ বৎসরের তরুণী যখন নিশ্চিত হয়ে যায় তার বাকি জীবনের লেখাপড়ার খরচ বাবা ব্যবস্থা করেছে; আর ফোন দেবার প্রয়োজন মনে করে না ! কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না! হায় আমার সন্তানেরা ! আমি সারা জীবন আবেগ আর বাস্তবের সমন্বয় করে জীবন চালয়েছি। কিন্তু তোমাদের ভিতর সেই বিষয়টি এক্কেবারে অনুপস্থিত কেন, বুঝতে পারিনা। আমি তোমাদের বাবা ! আগেও বলেছি আমার এই জীবন নিজের শ্রম ও সৎ চিন্তার নিগুঢ় ভালোবাসা দিয়ে তৈরি। তোমাদের কাছে মূল্যহীন, কিন্তু এই সম্পদ আমার কাছে অমুল্য! আমি জানি শিক্ষা জীবনে কষ্ট করে লেখাপড়া করার কি জ্বালা। তাই লোভীকে যেমন আমার শ্রমে গড়া সম্পদ দিয়ে এসেছি, তেমন বাকিটুকুও তোমাদের কল্যাণে ব্যয়িত হবে, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমার নিজের যে সম্পদ সেখান থেকে যে যে আয় হবে তা দিয়ে তোমারা অনেক সাচ্ছন্দে তোমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবে। শুধু যে সম্পদ থেকে তোমরা তোমাদের এই খরচ মিটাতে পারবে, তার দেখাশোনা ভালভাবে করো। অন্য কারো বুদ্ধিতে সেই সম্পদের কোন ক্ষতি করিও না। মনেরেখো, দুধালো গাভির লাথিকে হজম করতে হয় ! আর বুঝে নিও বাবার ভালবাসার চেয়ে অন্য যাদের ভালোবাসা দেখে বিমোহিত হচ্ছ, তা কক্ষনোই বেশি নয়।
অনেক কথাই হয়ত বলা যায়, যেতো ! কিন্তু তোমাদের আগত জীবনের সম্মানকে মূল্য দিতে গিয়ে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন দেখিনা। বাবা হিসাবে একটি অনুরোধ রেখে গেলাম। জীবনে বাঁচতে হলে বীরের মত বাঁচিও। মূর্খদের কেউ সম্মান করে না। কারো জীবনের চরিত্রহরন করিও না। কেউ করলে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করো। যারা অন্যের চরিত্র হনন করে নিজেদের লাভবান মনে করে, তারা একদিন প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় তোমাদেরও চরিত্র হনন করবে! আমি তাই চুপ করে দেখে যাই... বোকাদের মত। আমার মনের গভীরে লালিত বিশ্বাস বোকাদের স্বর্গ গড়তে সহজ হয় ! স্বর্গ গড়তে যারা সহজ করে ফেলতে পারে, এই জীবনে স্বর্গ লাভে তাদের সমস্যা হবার কথা নয়। স্বর্গ লাভে সম্পদ কোন বিষয় নয় !
প্রিয় সন্তানেরা,
তোমাদের এতক্ষণ এই লেখায় আটকিয়ে রাখার চেষ্টা ঠিক হচ্ছে না। কোন এক বাবার আবেগ দিয়ে তোমাদের জীবন চলবে না, উন্নত হবে না। আমি তোমাদের এই সময়টুকু কেড়ে নেবার জন্য দুঃখিত ! বাংলাদেশের রাস্তায় তোমরা অবশ্য এরচেয়ে বেশি সময় জ্যামে ব্যয় করবে। কিন্তু সেখানে তোমাদের চিন্তা থাকবে কাজে ব্যস্ত, এখানে এই বাবার চিঠিতে যে সময় ব্যয়িত হলো, তা অকাজের ! কিন্তু বাবা হিসাবে আমার এই সামান্য সময় না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। আমি অসহায় হয়েই তোমাদের মুল্যবান জীবনের একটি ঘণ্টা সময় জোর করে কেড়ে রেখে দিলাম। এর শাস্তি তোমারা যা দিবার দিও ! তোমরা কি লক্ষ্য করেছ আমি আজ তোমাদের প্রতি কোন অধিকার খাটাতে পারলাম না ! বাবার এই অসাহয়ত্ব বুঝতে তোমাদের আমার স্তরে আসতে হবে যে ! হয়ত ততদিন আমি বাঁচব না ! অথবা আমার কোন খোঁজ নেবার তোমাদের কোন সময় হবে না। তোমাদের নতুন নতুন বাবা হবে। তাদের নিয়ে তোমাদের সুন্দর সময় কাটবে। আমি সেই সুন্দর সময় তোমাদের জীবনে আসুক, যেখানেই থাকি যত দূরেই থাকি তোমাদের জন্য এই দোয়া রইল! যেদিন তোমরা আমার অবস্থানে আসবে, সেদিন জানবে বাবারা সন্তানের অপেক্ষায় থাকে, সারাক্ষন ! বাবাদের দরোজা সন্তানের জন্য কখনোই বন্ধ হয় না, কক্ষনোই না !
সবশেষে বলে যাইঃ
শুন্যতারও একটি অবস্থান আছে। অনেকেই তা মানতে চায় না। কেউ অবশ্য জানেনা শুন্যতায় অভ্যাস্থ হলে ভীষন সুখি হওয়া যায়। শুন্যতার আনন্দ চরম আনন্দ। চেস্টা করলেও সবাই এই সুখ অনুভব করতে পারেনা, কেউ কেউ পারে!
"Paradoxical happiness is the real pleassure in life."
আমার সন্তানেরা ভালো থেকো । মানুষের মত, মানুষের জীবন নিয়ে বেঁচে থেকো। মানুষরূপী কোন এক ‘শুয়োরের বাচ্চা’ হিসাবে নয় !
ইতি,
তোমাদের অধম বাবা।