ময়না নামে কেউ মরে নি

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

মোজাম্মেল কবির
  • ১২
  • ১৯

কিশোরগঞ্জের আলেয়া। প্রতি দিন এই ব্যাস্ত শহরের ফুটপাতে দাড়িয়ে থাকে। বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে, দেখে মনে হয় পঞ্চাশ। গত দেড় বছরে চেহারায় এই বাড়তি দশ বছরের বার্ধক্যের ছাপ যোগ হয়েছে। হুড ওয়ালা কালো বোরকা গায়ে। হাতে লেমিনেট করা এফোর সাইজের একটা কাগজ। দূর থেকে দেখে ভিক্ষুক মনে হতে পারে। এতটা কাছে এসে দেখার সময় ব্যাস্ত নগরীর পথচারীদের নেই।
এতো ফর্শা গায়ের রং ভিক্ষুকদের থাকে না। ফর্শা ভিক্ষুকদের গায়ের রং কদিনেই রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায়। আলেয়ার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও গায়ের সম্ভ্রান্ত রং চক চক করছে এখনো।
রোজ সকালে এসে আলেয়া দাড়িয়ে থাকে এখানে, এই একই জায়গায় । কাটা তারের বেড়া ধরে কিছুক্ষন এখানে কিছুক্ষন সেখানে। উৎসুক পথচারী দেখলে দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় পরিপক্কতার অভাব আছে। একটু এগিয়ে গেলেই পথচারী এড়িয়ে পাশ কেটে চলে যায়। আলেয়ার হাতের ল্যামিনেট করা কাগজটি দেখে বুঝে ফেলে, রোজকার আপদ। দ্রুত পায়ে পাশ কাটে।
সবাই নিশ্চিত যে তার হাতে গ্রামের চেয়ারম্যানের জাল সার্টিফকেট।ক্যানসারে আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের সুপারিশ পত্র। কিংবা কন্যার বিবাহের সাহায্য চেয়ে ভুয়া সুপারিশ পত্র। শহরের ফুটপাত মার্কেট আফিস পাড়ায় আজকাল এই সব ভুয়া সুপারিশ পত্র হাতে সাহয্যপ্রার্থীর সংখ্যা এতো বেড়েছে, কেউ কেউ মনে করে এদেরকে ধরে জেলে ঢুকানো উচিৎ।
আলেয়ার মুখ দিয়ে কথা ফুটে না। ব্যাস্ত পথচারীর বাকা চোখ কথা বলার আগেই সতর্ক করে -দূর হ সামনে থেকে। আলেয়া দূরে সরে যায়। গালে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম সুতির আঁচলে মুছে পথ ছেড়ে দাড়িয়ে থাকে।


এইটা একটা দালান। লক্কড় ঝক্কড় উচু একটা দালান। গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত সুই সুতার কারিগররা এখানে পোশাক বানায়। এরা নিউইয়র্ক লন্ডন চিনেনা, সেই সব বড় বড় শহরে ময়নাদের হাতের তৈরি জামা বিক্রি হয়। এইচ এন্ড এম, জ্যাক এন্ড জন্স, জ্যসিপ্যানী কত্ত বাহারী নামের লেবেল লাগায় ময়নারা।
ময়না জিএসপি বুঝেনা। বুঝে দেড় মাস কাজ করলে এক মাস হয়। বিদেশী ক্রেতার সাদা চামড়ার লোক কারখানা পরিদর্শনে আসলে তিন হাজারের জায়গায় বলতে হবে সারে পাঁচ হাজার। বলতে হবে শিখিয়ে দেয়া বুলি -এইটা জিগাইলে কবি হ আর ঐটা জিগাইলে কবি না। আর ম্যানেজার সুপারভাইজারের মাগী চুতমারানী গালী হজম কইরা থাকতে পারলে চাকরী আছে আর না পারলে নাই।
একটা সুই, দাম বিশ টাকা। অভিযোগ আছে এই মাগী গুলা চুলের খোপার মধ্যে দৈনিক গোটা পাঁচেক সুই লুকায়া নিয়া যায়। খাবারের বাটি আর পায়জামার নীচে এক দুইটা টি-শার্ট নিয়া যায়। এর জন্য কড়া সতর্কতা।
কারখানার গেটে দাড়িয়ে থাকা আধ বুইড়া গোফ ওয়ালা গার্ড একটা একটা কইরা চেক করে। কিভাবে? টান দিয়া চুলের খোপা খুইল্যা চুল পরিক্ষা কইরা দেখে সুই লুকাইয়া রাখছে কি না। তার পর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে শরীরের নানা জায়গায় হাত চালায়। শেষে ভাত রুটির বাটি।
মাঝে মাঝে ময়না কেন্দে ফেলে। ময়নার মরতেও মন চায় মাঝে মাঝে। মরতে চাইলেই মরা যায় না। মরার মধ্যেও নাকি সুখে থাকার গন্ধ পায় মানুষ।
ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা এক ধরনের নেশা। বাঁচার নেশা গাঁজা মদ হেরোইনের চাইতে কম নেশা না। যেই নেশাকে সুন্দর করে মানুষ বলে স্বপ্ন। ভালো দিনের অপেক্ষায় ভালো দিনের আশায় একেকটা দিন যায়। একেকটা রাত কাটে সুদিনের আশায়। ঘর হবে বর হবে সংসার হবে। জামাই বউয়ে ঝগড়া হবে, কোলে বাচ্চা কাচ্চা খেলা করবে... সে এক কঠিন নেশায় ময়নার দিন কাটে।
কারখানার কাছে ডোবার পাশে একটা বারো ফুট বাই পনর ফুট চালা ঘরে ময়নারা দশ জন থাকে। দৈনিক আলু ভর্তা আর ডাল। রাতে মোবাইল ফোনে মমতাজের গান। গোসলের পানির অভাব। দুই তিন দিনে এক বার ভালো মতো গোসল করার সুযোগ মিলে। নাভীর ডানে বায়ে ভীষন চুলকানী। দাউদ হইছে। অসুধ খাইতে পাঁচ ছয়শ টাকা লাগে। তিন মাস ধইরা অসুধের টাকা বাঁচাইতে পারতাছে না ময়না। মায়ের হাতে মাসে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। কম দিলে মায় চলবো কেমনে।


বাণিজ্যিক টেলিভিশনের খবরের বাজার চড়া। লাইভ টেলিকাষ্ট! বিল্ডিং ধ্বস! হাজার হাজার লাশ। দিন রাত হরদম। মন্ত্রী কান্দে নেতা কান্দে। সুশীল সমাজ টকশোতে ঝড় তুফান তুলে। বিবিসি, সি এন এন, আল জাজিরা সবার চোখ কান খাড়া।
লাশের সাথে আপাতত পচিশ হাজার টাকা নগদ, বাকী লাখ লাখ টাকা যেটা দেয়া হবে সেটা বাকী। লাশের সংখ্যা শ হাজার দুই হাজার ছাড়ায়। তার পরে হিসাবে প্যাচ লাগে। যথারীতি সরকারী বেসরকারী হিসাবের চক্কর।লাশের সংখ্যা যতো কম দেখানো যাবে ন্যাংটা শরীরে ততোটাই ইজ্জত রক্ষা হবে। তাছাড়া জানের ক্ষতিপূরণের টাকার হিসাবের একটা ব্যপার তো আছেই।
আমেরিকায় ভোক্তা সংগঠনের ব্যনারে রাস্তায় নামে মানুষ। এরা রক্ত মাখা পোষাক পড়তে চায় না। আমরা গরিব বলে আমেরিকার সরকারের বিশেষ সুবিধায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানীর যে দয়াটা ছিলো তারা আপাতত তুলে নেয়। তাদের কাছে নাকি খবর আছে আমেরিকায় রকফ্যালার, জে পি মর্গান আর এন্ড্রু কার্ণেগীরা যেভাবে শ্রমিকের রক্ত ঘামে ভোগ বিলাশ করতো আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক দর্জির দোকানদাররা এই যুগে তাই করছে। তারা খবর পেয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানীকারকরা পৃথিবীর যে কোন দেশের চাইতে বেশী মুনাফা করে আর শ্রমিকদেরকে সব চাইতে কম মজুরী দেয়। এরা বৈদেশিক মুদ্রা আমদানির ছুতোয় সরকারকে কর না দিয়ে উল্টো ভর্তুকী নেয়।বাড়তী সম্পদ লুকিয়ে রাখতে বিদেশে বাড়ী গাড়ি করে। কাজেই এই গুলা বন্ধ না করলে ওরা বাংলাদেশের পোষাক পড়বে না।সরকার এই ব্যপারে মামা শ্বশুর। কারণ এরাই সরকার সরকারই এরা।

এদিকে শ্রমিক সংগঠনের নামে ব্যাঙের ছাতা কিছু গজাইছে। কিছু নেতা গজাইছে। এদের উপর কারখানার মালিকরা যেমন খ্যাপা সরকারও অসন্তুষ্ট। শালার পুতাইন সারা জীবন ভেন গড়ীতে টেম্টুতে লট্কি দিয়া চলছস, আর এহন বিমানে চইড়া দেশ বিদেশ ঘুইরা কারখানার মালিকদের দুন্নাম করস? মালিকরা তগরে ঠগায়! এই গুলা মইরাও ঝামেলা পাকায় বাইচ্চা থাকলেও জালায়। জানের ক্ষতিপূরণ চাস, রাখ দিতাছি...


আলেয়া তার মেয়ে ময়নার লাশ পায় নি। সে জানতে পেরেছে মৃতের তালিকায় ময়নার নাম নাই। গত দেড় বছর এর তার কাছে ঘুরে লাভ হয় নি। এখন সে প্রতি দিন সাভারের ফুট ওভার ব্রীজের কাছে যেখানে বিল্ডিংটা ছিলো তার কাছে দাড়িয়ে থাকে। এখানে এখন পুকুরের মতো গর্ত। বর্ষার পানি জমে আছে। মায়ের ধারণা পাশে যে ইটের স্তুপ সেখানে খুঁজলে ময়নার হাড় কিংবা মাথার খুলি না পাওয়া গেলেও লেমিনেট করা আইডি কার্ডটা পাওয়া যাবে। বার বার সে কাটা তারের বেড়া পার হয়ে ঢুকে যেতে চায় ইটের স্তুপের কাছে। পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। সেখানে অস্থায়ী ভাবে পুলিশ তাবু টানিয়ে প্রহরা বসিয়েছে।

মিডিয়ার ক্যামেরা এখন অন্য কোন খবরের খোঁজে। গরম খবর।সামনে ঈদ, কার বউ দামী থ্রীপিস আবদার করে না পেয়ে অভিমানে স্বামীকে তালাক দিয়েছে এমন গরম খবর! ইটের স্তুপের নীচে ময়নার মাথার খুলীতে ধুরা সাপ কয়টা ডিম পেড়েছে তা এখন বাসী খবর। কেউ কেউ সন্ধিহান ময়না নামে কেউ ছিলো না। ময়না নামে আসলে কেউ মরে নি। এমন দুর্ঘটনার সুযোগে আলেয়ার মতো অনেকেই পথে নামে আবেগের বাণিজ্য নিয়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু মূল্যবান একটি লেখা। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
অনেক ধন্যবাদ ওয়াহিদ ভাই আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকুন।
তাপস চট্টোপাধ্যায় ভালো লাগলো . আরো গল্প চাই .
আরো গল্প আসবে দাদা। ভালো থাকুন।
biplobi biplob অসাধারন হয়েছে, বাক্যে যোগ্যতা এবং আসক্তির প্রভাব পরিপুষ্ট
অনেক ধন্যবাদ দাদা। ভালো থাকুন।
সাদিয়া সুলতানা অসাধারণ লাগল। পুরো লেখার বাক্য বিন্যাসে গুণী লেখকের মুনসিয়ানা বেশ বোঝা যায়। ময়নাদের অসহায়ত্ব আমরা যেন ইচ্ছে করে ভুলে থাকতে চাই। ভুলে থাকলে চোখের সাথে সাথে মনের আরাম হয় যে। শুভকামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ আপা। আপনার ভালো লাগা আমার লেখাকে সফল করেছে। আমি ধন্য হলাম। সাহিত্যে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র যদি ফুটে নাই উঠে তাহলে তার স্বার্থকতা কোথায়। আমাদের ভুলে যাওয়া সত্যি মনে করিয়ে দিতে পেরেছি এই আমার সফলতা। ভালো থাকুন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী অসাধারণ একটা থিমকে গল্পে তুলে এনেছেন। লেখনী, লেখার পরিবেশ চমৎকার। মাঝের দুই পরিচ্ছেদে {(২) এবং (৩?)} লেখার আঞ্চলিকতা ভালো লেগেছে। কিন্তু এই ভাবটা পুরো গল্পে রাখেননি আবার যে পরিচ্ছেদে রেখেছেন সেখানেও নিরবিচ্ছিন্ন নয়- ইচ্ছে করেই কিনা বুঝলাম না। ধন্যবাদ জানাই ময়নাকে নিয়ে আসার জন্য... আবারো একটু মনে করিয়ে দেয়ার জন্য...
আঞ্চলিক ভাষা আমি ইচ্ছে করেই জুড়ে দিয়েছি আপা। যেখানে যাদের কথা বলেছি চেষ্টা করেছি তাদের ভাষাতেই তুলে ধরতে। আরার যখন লেখক তার গল্প বলায় ফিরে এসেছে তখন যথারীতি সাধারণ ভাষার ব্যবহার। সে জন্যই একই পরিচ্ছেদে দুই ধরণের ভাষা দেখা গেছে। অনেক ধন্যবাদ।
Salma Siddika এত ভালো লিখেছেন! চোখে পানি এসে গেলো।
অনেক ধন্যবাদ আপু। আপনার মন্তব্য আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে... ভালো থাকুন।
আখতারুজ্জামান সোহাগ বোঝা গেল খুব সম্প্রতি গল্পটা লেখা। যদিও বিল্ডিংটার নাম উল্লেখ করা হয়নি তবুও বুঝতে বাকি নেই কোনটির কথা বলা হয়েছে। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে এই সেক্টরের কিছু কানাগলি আমার চেনা আছে। তার কিছুটা এখানে পেলাম। গল্পটা ভালো লেগেছে। বক্তব্যটাও। শুভকামনা লেখকের জন্য।
আপনার প্রফেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট লেখা বলে হয়তো আপনি আরো ভালো বলতে পারতেন। আমাকে তথ্য সংগ্রহ করে, সাথে কল্পনায় সাজাতে হয়েছে গল্পটি। অনেক ধন্যবাদ সোহাগ ভাই। ভালো থাকুন।
জোহরা উম্মে হাসান তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি , গভীর পর্যবেক্ষন , সচেতন সমাজ দর্শন , অনুভূতির অনুপম বিশ্লেষণ ! বড় ভাল লাগলো !
আপা আপনার এতোটা উচু মাপের মন্তব্য আমাকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছে... আমার গল্পের ফলাফল যাই হোক আমার লেখা সফল, আমি ধন্য। ভালো থাকুন।
শামীম খান ব্যাথিত মানুষের ভাষা বুঝতে পারে না ব্যস্ত নাগরিক সমাজ । যাদের ঘামে গড়ে উঠছে দেশটা তারা টাকার অভাবে মাসের পর মাস রোগ পুষে রাখে , এটাই বুঝি নিয়ম এ সমাজে ! সত্যি আজ মানুষগুলো বেঁচে আছে এক নেশায় । একটানে পড়ে ফেললাম । খুব ভাল লাগলো । শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ লেখার মর্মার্থ উপলব্দি করে বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকুন।
আরমান হায়দার সমসাময়িক সমাজচিত্র । ভালো লাগল।
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন।

২৫ মে - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪