তিনি রাজাকার নন

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

জাহাঙ্গীর অরুণ
  • ১৭
  • ৮২
- জামাল মিয়া অবস্থা কি বুঝ?
- অবস্থা আবার কি?

চট করে জামাল বুঝতে পারে কিসের অবস্থা। সে চা দোকানদার, সে বুঝলেও যা না বুঝলেও তা। তাকে মানুষজন প্রশ্ন করে উত্তর পাবার আশায় না। প্রশ্ন করে সাথে সাথে নিজে নিজেই বলবে এই আশায়। রশিদ মোল­া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন -
‘ঘটনা কিছু না, বুঝলা। পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে। পাখা গজাইছে’

কথা অবশ্য একদিক দিয়ে ভালই বলেছে রশিদ মোল­া। পাখা ঠিকই গজিয়েছে। জামালেরও পাখা গজিয়েছে। কিন্তু এই পাখা দিয়ে সে কোন দিকে লাফ দিবে তা এখনো ঠিক করেনি।

রশিদ মোল­া হচ্ছে ব্রাহ্মণপাড়া থানার ইমাম সমিতির সভাপতি। শোনা যাচ্ছে শাšি— কমিটি নামের একটা ব্যাপার আছে। রশিদ মোল­া এই কমিটির ও সভাপতি যে হবেন তা প্রায় নিশ্চিত। এপ্রিল মাস ১৯৭১। রাত ৮টার দিকে রশিদ মোল­া বসে আছে জামালের চা দোকানে। রশিদ মোল­ার উদ্দেশ্য খুব সরল। জামাল সহজ সরল ছেলে। তার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে আসে হরেক রকমের মানুষ। আড্ডার বড় একটা অংশ যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। রশিদ মোল­ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এদের গতিবিধি সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়া। আর এই কাজে সবচেয়ে বড় তথ্যটা আসবে জামালের কাছ থেকে। জামাল পঙ্গু মানুষ। একটা হাত নাই। চা বেচা ছাড়া তার কোন গতিও নাই। সব সময় এখানে পাওয়া যাবে। সামান্য কিছু টাকা পয়সা দিলে সে এমনিতেই সব তথ্য দিয়ে দিবে।

- তো জামাল মিয়া, মায়ের শরীর কেমন তোমার?
- বেশী একটা ভালা না হুজুর। বয়স হইছে..
- বয়সের অজুহাত দিয়ে ফেলায়ে রাখবা না। নবী করিম কি বলছে? মায়ের পায়ের নীচে জান্নাত। জান্নাত যেই পায়ের নীচে তার কোন বয়স নাই।
- হ ঠিকই কইছেন।
- মায়ের সেবা করবা। টাকা পইসা লাগলে আমার কাছ থেকে নিবা। দয়া দেখায়ে দিব তা না। ধার দিবো। আমাদের নবী কর্জে হাছানা দিতে বলছেন। কর্জে হাসানা বুঝ?
- না হুজুর
- পরে বুঝায়ে বলবো একদিন। তো দেশে যে অরাজকতা শুর“ হইছে তার কোন খুঁজ রাখ?
- আমি খুঁজ রাইখ্যা করবো কি?
রশিদ মোল­া কিছুটা হতাশ। মনে হচ্ছে না দিন দুনিয়ার খবর এই ছেলে রাখে। কিন্তু খবরটা নিতে হবে। সবচেয়ে বড় আখড় হলো এই চায়ের দোকান। সে আবার ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞাসা করে –
- তো কার কার কথা জানি বল­া?
- কি কথা হুজুর?
- ঐ যে বল­া না, মুক্তিতে জয়েন করছে?

জামাল কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ করে না। সহজ ভাবেই বলে
- হুজুর আমি তো জানি না।
- জানতা না এখন জানবা। সবাই তো আব্দুল কাদের জিলানী না যে মায়ের পেট থেকে পবিত্র কুরান মুখস্থ করে আসবে। সারা জীবন তো চা ই বেইচা গেলা। এখন একটু চোখ কান খোলা রাখো। দেশদ্রোহীতে তো দেশ ভইরা যাইতাছে। যেই দেশের খাও এই দেশের বির“দ্ধে যাওয়াতো হকের কথা না? কি কও হকের কথা?
- না হকের কথা অইবো কেমনে?
- এই দেখ তুমি চা বেচো তুমি বুঝ। অনেকেই তা বুঝতেছেনা। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। আর দেশের নামও কত সুন্দর দেখ! পাকি¯—ান! মানে কি দাড়াইলো? পাকপবিত্র স্থান। বুঝ মিয়া?
- কথা তো ঠিক।
- ভারত মানে কি? ভরত থেকে ভারত।
রশিদ মোল­া মুখটা বিক্রিত করে বলতে থাকলেন ভরর...ররততত। ‘বুঝলা মিয়া ভরত। ভরতের লগে হাত মিলাইছে। ভরতের ফল হইবে ফুর..রত।’

কথা মনে হয় প্রায় শেষ রশিদ মোল­ার। উঠতে উঠতে বলে­া - খেয়াল রাইখো। তোমারে পছন্দ করি। তুমি ভাল ছেলে। ভাল ছেলে হয়েই যদি দেশের পাশে না দাড়াও তো কারা দাড়াবে? খবর টবর দিয়া দেশের ¶তি যেন না হয় এই কাজে সাহায্য করবা।

রশিদ মোল­া যাবার সময একশোটা টাকা দিয়ে বলে­া - আরো পাইবা, যাই ময়নামতি বলে ক্যাম্প হইছে আমাগো আর্মির। ইনারা পাকি¯—ান ফৌজ হইলেও এখন আমাদের মেহমান। নবী এ করিম মেহমানের সেবা করতে নির্দেশ দিছে।

দেশে যুদ্ধ শুর“ হয়েছে। রা¯—া ঘাটে তেমন মানুষ নাই। শহর থেকে মানুষজন গ্রামের দিকে ছুটছে। তাদের চোখে মুখে ভয়। জামাল সব দেখে। তার করার মত কিছুই নাই। ঘরে অসুস্থ মা। সে মাকে নিয়ে যাবে কোথায়? জামাল অনেক দিন ধরেই ভাবছে যুদ্ধে যাবে। সে মরলে কাঁদার কেউ নাই। মা আছে, মা তো আর কয় দিন পর এমনিতেই থাকবে না। বেঁচে যে আছে তা ই মরনের চেয়ে বেশী কষ্ঠ নিয়ে। এত রোগ নিয়ে এত কষ্ট করে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। সে গরীব মানুষ চিকিৎসা বলতে সহিদ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি। এক দিন খেয়াল করে দেখেছে তার পেট ব্যাথায় যে ঔষধ দিচ্ছে সেই একই ঔষধ দিলো তার মায়ের জন্য। অথচ মায়ের হচ্ছে শ্বস কষ্টের রোগ। বেজায় শ্বাস কষ্ঠ। যখন শ্বস কষ্ঠ ওঠে তখন মায়ের বুক কামারের দোকানের হাফরের মত ওঠানামা করে। ঔষধের এই ঘটনায় জামাল কিছু বলে নাই। কি বলবে? সে চায়ের দোকানের লোক। লেখাপড়া তো বেশী করতে পারলো না। বাবা ছাড়া কি মাথার উপরে বটগাছ থাকে? বাবার মৃত্যুর পর সে যে নিজের ও মায়ের মুখে খাবার দিতে পারছে তা ই অনেক। সে কথা বলার মত বড় কেউ না।

মাস পাঁচেক আগে সাগরের পাড়ের লাখ দশেক মানুষ মারা গেল। সরকার কি কিছু করছে? সরকার তো কিছুই করে নাই। জামালের মত এমন জামাল মরে গেলে কারো কিছু আসবে যাবে না। অš—ত নিজের ভাষার নিজেদের একজন সরকার দরকার। তাহলে যদি দেশের কিছু হয়। এর চেয়ে বেশী জামাল কিছু বুঝে না।

জলিল মাষ্টারের সাথে ইতিমধ্যেই জামাল গিয়ে কথা বলে এসেছে। মাষ্টার সাহেব এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের লিডার। মাষ্টার সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে
- তুমি যুদ্ধে গিয়ে কি করবা?
- স্যার আমার একটা হাত নাই বলে যুদ্ধে নিবেন না?
মাষ্টার সাহেব খুব লজ্জায় পড়লেন। এমন করে তিনি আঘাত দিতে চাননি। মাষ্টার সাহেব পকেট থেকে তার ফাউন্টেন পেন টা বের করে কাগজে একটা দাগ দিলেন। এর পর বলে­ন
- জামাল এই দেখ। এই যে কলমটা দিয়ে দাগ কাটলাম। কালি বের হবার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কার?
- স্যার কলমের মাথাটার
- কিন্তু উপরে যে একটা টিউব আছে যার মধ্যে কালিটা থাকে তার কি প্রয়োজন কম?
- না স্যার।
- প্রয়োজন মত সবাই নিজের দায়িত্বটুকু পালন করলেই সামগ্রিক ভাবে একটা কাজ হয়।
- জ্বি স্যার।

মাষ্টার সাহেব কিছু¶ন চুপ থেকে বলে­ন
- রাজাকার হতে পারবে?

জামাল অবাক হয়ে চুপ করে রইলো। মাষ্টার সাহেব আবারো বলে­ন –
- তাজা মাছ পুকুর থেকে তুলতে গেলে পঁচা মাছের টোপ ফেলতে হয়। আমার একজন পঁচা লোক দরকার।

জামাল কি বুঝলো কে জানে। কিন্তু সে জানে মাষ্টার সাহেব যা বলেছেন তার গভীরতা অনেক। সূর্য ঘুরে না, পৃথিবীকে ঘুরতে হয় সূর্যের মুখ দেখার জন্য। ¯^াধীনতার সূর্য আমাদের প্রতি বিমুখ। এই সূর্যকে দেখতে হলে আমাদের নিজেদেরই ঘুরতে হবে। আর জরিল মাষ্টারের মত লোকজনই পারবে দেশটাকে ঘুরিয়ে ঐদিকে নিতে। জামাল তেমন কিছুই বুঝলো না। শুধু বলে­া - স্যার আমি পারবো।

জামাল পেরেছে। দেশে যুদ্ধ চলেছে। জামাল রাজাকার হয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে রশিদ মোল­াদেরক সাহায্য করেছে। পঁচা মাছ হয়ে সে অনেক অনেক রশিদ মোল­ার পেটের ভিতর ঢুকেছে। আর পঁচা মাছে গাঁথা বর্শীতে টান মেরে জলিল মাষ্টারের মুক্তিবাহিনী এই রশিদদেরকে শিকার করেছে।

সব ভাল যার শেষ ভাল। শেষ ভাল হয়নি জামালের। মাযের কোন খুঁজ রাখতে সে পারেনি। অসীম দেশপ্রেম নিয়ে মানুষটা প্রেমহীন হায়নাদের সাথে মিশেছে মাতৃভূমিটাকে একটু ধাক্কা দিয়ে ঘুরাবার জন্য। সে জানতো একটু ঘুরলেই ¯^াধীনতার সূর্য দেখা যাবে। এই সূর্য নিজে ঘুরে আসবে না। তাকে ঘুরাতে হবে। সে ঘুরিয়েছে তার সামর্থমত। একজন স্পাই হবার মত এত সাহসিকতা দেখানোর মানুষটার শেষ ভাল হয়নি। ¯^াধীনতার মাত্র দুই দিন আগে ১৪ তারিখ রাতে একটা অপারেশনে সে পাকি¯—ান আর্মির সাথে যায়। সেখানেই তাকেও মুক্তিবাহিনী গুলি করে মারে। সেদিন খুব প্রচার হয়, রাজাকার ডেঙ্গা জামালেরও মৃত্যু হয়েছে।

যুদ্ধে জলিল মাষ্টার শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধের প্রায় চলি­শ বছর পর ঢাকা থেকে একদল মানুষ এসেছে মুক্তিযুদ্ধা জলিল মাষ্টারের বাড়ীতে। হইচই ফেলার মত সংবাদও হয়েছে। জলিল মাষ্টারের বাড়ীতে বিল্ডিং এর কাজ করার সময় মাটির নীচে একটা সুটকেস পাওয়া গেছে। বেশ নথিপত্র এতে আছে। পুরনো লেখা, তেমন কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। ধারনা করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে কার উপর কি দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন এমন লেখা আছে এতে। কিছু কিছু লাইন এমনই কথা বলছে।

লেখার কোথাও কি পাওয়া যাবে সামান্য সেই চায়ের দোকানদার জামালের কথা? যেখানে বলা আছে তাকে পঁচা মাছ বানানো হয়েছে গভীর জলের বড় বড় মাছ শীকারের জন্য। নিষ্ঠার সাথে যে মানুষটা নষ্ঠ খেতাব নিয়ে নষ্ট হয়ে চলছেন চলি­শটা বছর জুড়ে, কোথাও কি কোন প্রমান পাওয়া যাবে না তার প্রেমের? প্রেম কি এমনই প্রমানহীন হয়! প্রেম কি এমনই বিফল হয়?

¶তি কি না হয় ধারনাই করলাম যে জলিল মাষ্টারের সুটকেসের লেখা উদ্ধার হয়েছে। দেশের সব পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে লিড নিউজ হয়েছে “তিনি রাজাকার নন / তিনি দেশ প্রেমিক জামাল”। তার চায়ের দোকানের জায়গায় জামালের আব¶ মূর্তি হবে। লেখা থাকবে “তিনি রাজাকার নন”।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক শক্তিশালী একটি কাহিনী ...খুব ভালো লাগলো ...ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা
তাপসকিরণ রায় এটি সাধারন মানুষের দেনও মুক্তি যুদ্ধে অনেক--তাঁর পরিচয় অবশেষে পাওয়া গেল এটা আসার কথা.গল্পটি ভালো লাগলো.
সালেহ মাহমুদ বেশ ভালো গল্প। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা অলিখিত অংশের একটু ব্যতিক্রমী বর্ণনাই বটে। ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।
রোদের ছায়া সুন্দর গল্প আর কাহিনীটাও বেশ লাগলো, এরকম ঘটনাতো শুনেছি অনেক ঘটেছে , তবে শেষ পর্যন্ত জামালের মৃত্যু বাস্তবতাই তুলে ধরল ......মোলা =মোল্লা , খুঁজ =খোঁজ , চলি­শটা=চল্লিশটা ,সব শেষে এরকম জামালদের জন্য শ্রদ্ধা জানাই ।
সিয়াম সোহানূর দারুণ একটা থিম ! অন্যরকম ভাল লাগ্ল।
আহমেদ সাবের অনেক দেরী হয়ে গেছে অরুন। নায়ক আর খল-নায়ক একাকার হয়ে চালের মধ্যে কাঁকর হয়ে মিশে গেছে। তাদের পার্থক্য করা খুব কষ্টকর। দুঃখ, জামাল মিয়ারা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। চমৎকার নান্দনিক লেখা। বেশ ভালো লাগলো।
এশরার লতিফ একজন মুকিযোদ্ধা স্পাইকে নিয়ে খুব মানবিক একটা গল্প, ভালো লাগলো, শুভেচ্ছা.
সুমন দারুন একটা গল্প awesome
Lutful Bari Panna যথারীতি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চমৎকার লেখা। ঘটনার বাঁকে বাঁকে কত গল্প লুকিয়ে থাকে। এরকম কিছু জামালদের নিঃস্বার্থ অবদান না থাকলে সত্যি কি দেশ স্বাধীন হত। সুবিধাবাদী কত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় আর জামালরা নায়ক হয়েও ইতিহাসে বেঈমান আখ্যায়িত হয়ে যায়। জামালদের আমরা না চিনি তাদের গল্পগুলো অবশ্যই জানা দরকার। আগের লেখা পড়েই বুঝেছি- দারুণ একটা হাত আপনার। বিমুখ করেননি এবারও।

০২ সেপ্টেম্বর - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪