মৃত্যুর গন্ধ তখন ভারী হয়ে ছিল বাতাসে । রডন স্ট্রিটে আলো ক’মে… ক্রমশ আরও ক’মে। চাঅলা, বেশ্যা, মুটে আর ট্রামের দূর থেকে আসা চাপা শব্দে গুরগুর করে উঠছিল পেটের ভেতর। হরহর করে বমি স্রোতের মতো গলা দিয়ে নেমে আসার আগেই কালো বেঁটে মেয়েটাকে আবার দেখে ফেললাম আমি । জিন্স আর কুর্তিতে ধারালো । অরণ্যর পাঁচ-এগারো লাশটাকে চ্যাংদোলা করে পিস হেভেনের লকারে সেঁধানো হচ্ছিল আরও খানিকক্ষণ আগে। যারা ধরেছিল ওর নিস্পন্দ ভারী শরীরটা, তাদের কুশলী যান্ত্রিকতাকে সেলাম ঠুকে একটু তফাতে বিড়ি ধরিয়েছিলাম আমি। তখনই প্রথম দেখা ওকে।
ও বি ভ্যান আর গুটিকয়েক পেজ থ্রি সেলেব্রিটির মধ্যবর্তী শূন্যতায় একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ও ।চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা - মায়োপিক নিঃসন্দেহে। কাঁধে টুকরো টুকরো গেরুয়া আর কমলা কাপড়ের শান্তিনিকেতনি ঝোলা পৈতের মতো আড়াআড়ি করে ঝোলানো। ডান হাতের কব্জিতে মোটা ডায়ালের সাদা ঘড়ি – ছ’টা বাজতে তখনও মিনিট খানেক দেরি । সে অপেক্ষায় না-থেকে পিছলে সরে গেছিলাম আমি । পাটকিলে রংয়ের ঘামে ভেজা কুর্তিটা না পারছিল ওর বুকের ধককে কোণঠাসা করে রাখতে, না ওর লো-রাইজ জিনসের সর্পিল আরম্ভকে সংবৃত করতে। ফুটে ওঠা সাদা ব্রায়ের ঔদ্ধত্যে অরণ্য নয়, কয়েক পল-অনুপল-মুহূর্তের জন্য, ও-ই মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল।
অরণ্যর শোকসন্তপ্ত পরিবার – কুহু ওর বউ, পুশকিন ওর ছেলে – এখন কোথায়? সেন্ট হেলেনস থেকে কলকাতা কতটা দূর আমার জানা নেই …হয়তো বাগডোগরা থেকে এই সবে প্লেনে উঠেছে … হয়তো চক্কর কাটছে দমদমের আকাশে…পুশকিন… পুশকিন… চার বছরের পুশকিন …বাবাকে মিস করবে ও … কিন্তু কুহু? কুহুর কথা জানি না…। বন্ধু মারা গেলে তাকে ঠিক কতটা মিস করা উচিত – সে সম্পর্কে আমারও কি স্বচ্ছ কোনো ধারণা আছে? বিশেষত, সে বন্ধু যদি ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে অধ্যাপক তথা বাংলা ভাষার একজন প্রথিতযশা কবি হয়?
কুহুর কথা অল্প অল্প আবার জানাও আছে আমার। এ মাসের শেষাশেষিই ডিভোর্স পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল ওর…। কিন্তু না, আমার চিন্তাভাবনা সবকিছু এ মুহূর্তে ঘন হয়ে আছে ওই মেয়েটির জামার রঙে । কে ও? অরণ্যর কোনো ছাত্রী? কোনো উঠতি কবি, ডকুমেকার? জানি না। জানতে ঠিক চাইছিও না। কেন না, এই আবার ওর দিকে তাকাতে গিয়েই দেখি নেই ও। কোথায় গেল?
পিস হেভেনের সামনের ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছে। কাঁচাপাকা চুলের পার্টটাইম ফিচারলিখিয়ে থেকে ফুলটাইম সাহিত্যমাফিয়া কিংবা নবীন বাংলা ব্যান্ডের তরুণ লিড সিংগার থেকে বরফসাদা চুলের প্রবীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সবাই নিচু গলায় কথা বলছে:
- এত কম বয়সে…
- একটা চান্স অবধি দিল না…
- বডি তো ঢুকে গেছে…
- আরে, বাথরুমেই তো পড়েছিল আধঘণ্টা…
- কুহুর ফোন নাকি বেজে যাচ্ছে…
তরুণ কবিদের একটা উপদল মালা নিয়ে এসে একটু অপ্রস্তুত। লাশ হাওয়া।
- আচ্ছা, ওর ভাই?...
- একটু কম মদ যদি খেত…
আসার পথে তীব্র এই দাবদাহকে সহনীয় করতে (সন্ধ্যার পরও তীব্র দহনজ্বালা) ওদের মধ্যে কেউ চিলড বিয়ার সহযোগে গলা ভিজিয়ে নেওয়ার বিনীত প্রস্তাব রেখেছিল, তাতেই চিত্তির!
- ওর ভাই কোথায়?...
- কাল কোন্ শ্মশানে ওকে…
- হ্যাঁ, অর্জিতা পারমিশন দিয়ে দিয়েছে…বাংলা আকাদেমিতেই…
- প্রথম কাব্যগ্রন্থটা যেন কী?...
টকটক অনুভূতিটাকে আরও একবার গিলে ফেললাম আমি। চ্যানেলের চাবুক মেয়েটা চাইছে ইতিউতি – বাইটসের জন্য নতুন মুরগি খুঁজছে নিশ্চিত ।
- না না, বডি ডোনেট করা আছে…
- চোখ?...
- কাল প্রথমে বাংলা আকাদেমি, তারপর…
মেয়েটি আমার পূর্বপরিচিত। যদিও ওর বোতামখোলা ফর্মাল শাদা শার্ট থেকে উঁকি মারছে সপ্রতিভ ক্লিভ্যাজ, ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে মাইক্রোফোন হাতে তাড়াহুড়ো করে এদিকেই এগিয়ে আসতে দেখে আমি সটকে পড়ার তাল করলাম। আর লাগবি তো লাগ ঠিক তক্ষুনি ধাক্কা স্যারের সঙ্গে!
নিখুঁত রিফ্লেক্সে হাতের বিড়ি পায়ের ফ্লোটারের তলায়, কিন্তু ধোঁয়া… আর তার সঙ্গে ব্লেন্ড হয়ে থাকা অ্যালকোহলের গন্ধ? সেই আঘ্রাণকে তো আর লুকোনো যায় না। সুখের কথা, প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে স্যার এতটাই আপসেট যে, অপ্রিয় ছাত্রের বার্মুডা-টিশার্ট পরা সাড়ে পাঁচ ফুটিয়া শরীরটার দিকে দৃকপাতও করলেন না। শাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া তাঁর শান্ত সৌম্য চেহারা শুভ্র অ্যামবাসাডারের ভেতর ঢুকে গেল।
সেই মহাপ্রস্থানপর্ব অবলোকন করতে গিয়েই ক্যালকুলেশনে একটু ভুল করে ফেললাম আমি…নক্ষত্র টিভির মল্লিকা (অফকোর্স শেরাওয়াত নয়) আমাকে পাকড়াও করল:
- আমাদের সঙ্গে আছেন নবীন চিত্রপরিচালক অনঘ মিত্র। কবি অরণ্য সেনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। অনঘদার ছবিতে গান আর চিত্রনাট্য মানেই অরণ্যদা ।আর আজ জাতীয় পুরস্কারবিজয়ী সেই কথাকারকেই চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেললাম আমরা! অনঘদা, কেমন লাগছে ব’লে আপনার ব্যক্তিগত শোকের এই মুহূর্তকে আমরা পাবলিক করে দিতে চাই না…শুধু একটাই প্রশ্ন, এর পর থেকে আপনার পরবর্তী ছবিগুলোতে কে লিখবে গান? কেই বা লিখবে চিত্রনাট্য?
- আমি।
- আপনি!
- হ্যাঁ, আমি। কেন তোমার কোনো সমস্যা আছে তাতে?
- ন্ না…আমার সমস্যা থাকবে কেন? কি…কিন্তু আপনি আপনার বন্ধু রাইটার কাম লিরিসিস্ট অরণ্য সেনকে মিস করবেন না?
- না। করব না । আর যদি করিও, নিশ্চয় তোমাকে কিংবা তোমার ঢপের এই বাজারি চ্যানেলকে জানিয়ে সেটা করব না।
- আমরা বুঝতে পারছি, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু কতটা আপসেট করে দিয়েছে অনঘদাকে। সত্যিই, মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো শেষ বিচারে তো ব্যক্তিগতই। কোনো গণমাধ্যমেরই কি প্রবেশাধিকার আছে সেখানে? আমরা ফিরে যাচ্ছি আমাদের স্টুডিওয়, যেখানে সুমহানকে এ প্রশ্নই রাখতে অনুরোধে করব কবি অজয় ভৌমিক আর অবোধবন্ধু সমাজদারের কাছে । দেখতে থাকুন ন ক্ষ ত্র।
ক্যামেরা আগেই সরে গেছিল আমার ওপর থেকে । ফের আরেকটা বিড়ি ধরিয়েছিলাম। মল্লিকার মুখের পালটে যেতে থাকা মানচিত্রে কোনো আগ্রহই ছিল না আমার। আমার চোখ চিউয়িং গামের মতো যথারীতি চিপকে ছিল ওর বুকের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে । পানিপথ দিয়ে এতদিনে আরও অনেক পানিই যে বয়ে গেছে, সেটা বুঝতে আর যাই হোক পাকা খেলোয়াড় হওয়ার দরকার পড়ে না। অফ দ্য ক্যামেরা, মল্লিকা আবার আমার মুখোমুখি।
- অনঘদা, দিস ওয়জন্ট ফেয়ার! আমার নতুন চাকরি। রিপোর্টটা ভালো যাবে না।
- কেন? ইন্টারভিউটা তো ভালোই নিলি। দেখবি আজ রাতে এই ক্লিপটাই মুখবইয়ে সবচেয়ে বেশি লাইক পাবে।
- লেগপুল করার অভ্যেসটা এবার ছাড়ো, অনঘদা! এতে কারও ভালো হয় না। তোমারও না।
- আরে, শোন না ।তোকে এমনিতেই ফোন করতাম । কাল সকালে আমার ফ্ল্যাটে আসবি একবার?
- কেন?
- আমার এবারের ছবিটায় একটা ইমপর্ট্যান্ট রোলে ভাবছি তোকে । অডিশন কাল।
- স্যরি, অনঘদা। অডিশনটা অন্য কারও নিও। তুমি জান আমি আসব না।
- ও…
- বাই, পরে দেখা হবে।
- বাই।
২
মল্লিকা আমার সাউথ সিটির ফ্ল্যাটে আসেনি কখনও । বছর তিনেক আগে যখন প্রথম এক বিকেলে ও আমার বাড়িতে আসে, তখনও আমি সোনারপুরেই থাকি । সেটা শীত ফুরিয়ে বসন্ত, আমাদের ব্যালকনির জাপানি টবে আমার মতোই বাঁটকুল মাত্র পাঁচ ইঞ্চি লম্বা অ্যাজালিয়ায় তখন সবে ফুল ধরেছে। শাদা শাদা ফুল ঝাঁকড়া চুলের মতো গোছা হয়ে আছে, ঝরে যাবে কয়েকদিন পরেই। যৌবনের বজ্রনির্ঘোষ এভাবেই একদিন ফুৎকারে উড়ে যায়। তবু ওই বেঁচে নেওয়াটা জরুরি। অন্তত আমার কাছে তো বটেই।
আমি খুরপি দিয়ে শক্ত দানা দানা মাটিগুলোকে বাগে আনার চেষ্টা করছিলাম, মা এসে দরজায় দাঁড়ালেন…
– তকাই, একটা মেয়ে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।
- পাঠিয়ে দাও।
- এইখানে?
- হ্যাঁ।
আমার বিধবা মা। কয়েক লক্ষ টাকা দেনা, সেইসঙ্গে একটি নাবালকের দায়ভার এঁরই মাথায় চাপিয়ে উত্তর কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু কোনো বনেদি পরিবারের চিত্রাভিনেতা হতে চাওয়া চালচুলোহীন এক রূপবান যুবক হঠাৎই ছবি হয়ে গেছিল। গায়ের সব গয়না বিক্রি করেও সেই দেনা মা শোধ করতে পারেননি। জ্যাঠামশায়কে নিজের অংশ লিখে দিয়ে তবে কোনোমতে নিষ্কৃতি। তিন বছরের আমাকে নিয়ে অতঃপর লজ্জার মাথা খেয়ে মাথা গোঁজা হরিদেবপুরে পিত্রালয়ে। নেহাৎ একটা স্কুলমাস্টারি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন, নইলে কী হত কে জানে । ছোটোবেলা থেকেই বুঝেছি আমার তিন মামি যে ভাষায় পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করত, তাকে আর যাই হোক শিষ্ট চলিত বলা যায় না।
তখন স্কুলমাস্টারিতে এত মাইনে পাওয়া যেত না। তার ওপর দিদার হাতে স্যালারি ডে-র দিনই তুলে দিতে হত কড়কড়ে অনেকগুলো নোট। আমাকে মা খুব কষ্ট করে পড়িয়েছিলেন দক্ষিণেরই কেতাদুরস্ত এক স্কুলে। তবু এত কিছুর মধ্যেও কীভাবে যেন টাকা জমিয়ে জমিয়ে মা সোনারপুরে দু-কাঠা জমি কিনে ফেললেন। রিটায়ারমেন্টের পর পি এফ আর গ্র্যাচুইটির টাকা দিয়ে সেই জমিতেই একতলা বাড়ি, যা একচিলতে ব্যালকনিসহ কালক্রমে দোতলা হয়েছে।
হ্যাঁ, আমার মা একজন সফল সিঙ্গল ওয়ার্কিং উওম্যান যিনি চিত্রপরিচালক ছেলের সদ্য কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে শিফ্ট করেননি। মাথা উঁচু করে সোনারপুরে নিজের বানানো বাড়িতেই মেতে আছেন বইপড়া আর বাগানচর্চায়।
বাবার রূপের কানাকড়ি না পেলেও তাঁর যাবতীয় বদগুণ কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই আঠের আনা প্রবল আমার মধ্যে! ক্লাস থ্রি থেকেই আমি বিড়ি ফুঁকতে শুরু করে দিয়েছি। সিকসে বেঞ্চের তলায় ব’সে উলটেছি পর্নোগ্রাফির নীল পাতা। ওই ক্লাসে পড়তে পড়তেই প্রোপোজ সেভনের মনিটর বৈশালি মাথুরকে। এইটে স্কুলেরই পিকনিকে সদলবলে মদ্যপান। আর নাইনে … নাইনেই একদিন আচমকা মিলে যাওয়া নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রথম আঘ্রাণ!
বড়োমামা ব্যাবসার কাজে ময়নাগুড়ি গেছিল। মামিই বলেছিল মাকে আমি যদি রাতে ওদের বসার ঘরে শুই, ভেতরের ঘরে পাঁচ বছরের ছোট্ট মামনকে নিয়ে ঘুমোতে মামির আর ভয় করবে না।
আমি কখনও ধরা পড়িনি কেননা চিউয়িং গামের পেপারমিন্টে যেমন ঢেকে যায় বিড়ির তীব্র কটু গন্ধ, খুব কম বয়সেই আমি জানতে পেরে গেছিলাম সব পাপকেই কফিনবন্দি করার জন্য তেমনই খোলা থাকে কোনো না কোনো গোপন সুড়ঙ্গ! এরকমই এক সুড়ঙ্গের খোঁজ ভ্যাপসা গরমের পর একটানা বৃষ্টি আর লোডশেডিংয়ের সে রাতে মামি আমায় দিয়েছিল।
- এবার জন্মদিনে তোর মামার থেকে একটা সাইকেল পেলে কেমন লাগবে, তকাই?
জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। মামির ভারী শরীরটা আশ্চর্য যান্ত্রিকতায় গিলে নিচ্ছিল আমাকে, চেনাচ্ছিল গলি-তস্যগলি, পথ-উপপথ…৫০০ গোপাল জর্দার কুচি জিভের টাকরায় ছুঁইয়ে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল আমার অভ্যন্তর, ধমনীতে পাম্প করে আনছিল পাপরক্ত!
উত্তেজক ওই মাদকতার মধ্যেও আমার কয়েক ক্ষণমুহূর্তের শৈথিল্য মামিকে বুঝিয়ে দিয়েছিল লাল সাইকেলে তখন তকাই উড়ছে!
৩
মা চলে যাওয়ার মিনিট দুই কি তিন পরেই সাদা স্মোকড সলিড টিউবড্রেস পরা যে মেয়েটি ব্যালকনির রেলিঙে হাত রেখে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, চোখের কোনা দিয়ে তাকে দেখামাত্র শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়! ইঞ্চিতিনেক লম্বা স্টিলেটো বাদ দিয়েই অন্তত পাঁচ আট! নিখুঁত আওয়ার গ্লাস – ড্রেসটা টিউবের মতো হওয়ায় সম্ভাবনাময় সাঁতারুর মতো ঈষৎ জেগে আছে ওর উদ্ভাসিত বুক।
নিশ্চয় গাড়িতে এসেছে। ট্রেনেবাসে এভাবে এলে তো আর পৌঁছতে হত না – লুঠ হয়ে যেত!
যেটা স্বীকার করে নিতেই হবে ঈর্ষণীয় সাবলীলতায় ড্রেসটা ক্যারি করছে ও! জিরো ফিগার কি এটাই নাকি?
উঁহু, আমি নিজেকেই নিজে মনেমনে বললাম, সে তো করি-না। আর অনঘ মিত্র - যার ডেবিউ ছবিটাই এখনও পর্যন্ত টলিউডের সবচেয়ে বড়ো ব্লকবাস্টার – আর যাই হোক ‘না’ শুনতে পছন্দ করে না।
- স্যর, আমাকে স্যর পাঠিয়েছেন।
এক মুহূর্তের জন্য চমকে গেছিলাম। ‘স্যর’ মানে আমাদের সবার স্যারের কথা বলছে নাকি? ভুলটা পরক্ষণেই ভেঙে গেছিল:
- অরণ্যস্যর এই চিঠিটা আপনাকে দিয়েছেন।
- ও অরণ্য পাঠিয়েছে আপনাকে?
- আমাকে প্লিজ আপনি বলবেন না। আমি অনেক ছোটো, তার ওপর স্যরের স্টুডেন্ট…
- ওগুলো কোনো ইসু নয়, কয়েক মিনিট পরেই আমি হয়তো তুই করে বলা শুরু করব।
- প্লিজ, এখন থেকেই বলুন না।
- কিন্তু কাল রাতেও তো আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছি। অরণ্য তো তখনই তোমার কথা বলতে পারত। কই দেখি চিঠিটা…
প্রিয় অনঘ
তোকে চিঠি লিখছি দেখে অবাক হচ্ছিস নিশ্চয়। এখন তো কেউ কাউকে আর চিঠি লেখে না। ফোন করে কিংবা মেইল করে নেয়। আসলে মল্লিকা দাঁড়িয়ে সামনে…ওকে রেকমেন্ড করে তোকে লিখছি। মনে হচ্ছে আমিই পৃথিবীর শেষ লেটার রাইটার যাকে ফোন নয়, এসএমএস নয়, ইমেইল নয়, চিঠিই লিখতে হবে আকাশের বিদ্যুৎকে ভাষায় ধরতে হলে।
ভালোবাসা
অরণ্য
- অভিনয় করেছ কখনও?
- হ্যাঁ, স্কুলে একবার হ্যামলেট করেছিলাম…
- হ্যামলেট? স্কুলে! কোন স্কুল তোমার?
- মডার্ন।
- অ। রোলটা কী ছিল তোমার?
- হ্যামলেট।
- অরণ্যর কলেজেই পড়ছ?
- হ্যাঁ।
- ইংলিশ অনার্স?
- না। কেমিস্ট্রি।
- অরণ্যর স্টুডেন্ট বললে না?
- হ্যাঁ। কম্পালসরি ইংলিশ ক্লাসটা স্যরই নেন।
- হুঁ…মল্লিকা, মল্লিকা। মল্লিকা কী?
- মজুমদার।
- আচ্ছা মল্লিকা, একটা কিছু করে দেখাও তো…একটা কোনো কিছু, এনিথিং।
- স্যর, আমি তো কোনো প্রেপরেশন নিয়ে আসিনি।
- ও।
- ক্যান আই রিসাইট?
- আবৃত্তি করবে? আচ্ছা করো।
- I just don’t know
- দাঁড়াও, দাঁড়াও। কার কবিতা এটা?
- স্যরের।
- অরণ্যের?
- হ্যাঁ।
- ইংরেজিতে আবার কবে থেকে কবিতা লেখা শুরু করল ও?
- কেন স্যর তো পোয়েট। আর ইংরেজির টিচার যখন লিখতেই পারেন।
- না না, সেকথা বলছি না । আসলে একটু অবাক হয়ে গেছিলাম… যেকোনো লেখাই ও তো প্রথমে… ছাড়ো ওসব কথা। বলো। তুমি বলো।
- I just don’t know…
- স্টপ মল্লিকা! তুমি বলছ। খুবই ভালো বলবে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি একটু অন্যরকম চাই। যা তুমি বলছ সেটাকেই অভিনয় করে দেখাতে পারবে?
- অভিনয়?
- হ্যাঁ। অভিনয়ের জন্যই তো তুমি এসেছ এখানে, না?
- কিন্তু আয়্যাম নট শিওর হাউ টু ডু দ্যাট।
- সেটাই চ্যালেঞ্জ। যা তুমি দেখছ একইসঙ্গে তা দেখতে হবে, দেখাতেও হবে।
- ওকে স্যর!
পরের মুহূর্তগুলো ছিল ম্যাজিক। ক্যানভাসের ওপর পড়তে থাকা ব্রাশস্ট্রোকের দার্ঢ্যতায় যেমন মূর্ত হতে থাকে বিমূর্ত, তেমনি বদলে যাচ্ছিল আমার ব্যালকনি। ওর প্রতিটি মুদ্রায় শব্দগুলো পাচ্ছিল অশ্রুত মাত্রা, ভেঙেচুরে যাচ্ছিল স্পেস, মুহূর্তগুলো গ’লে অবলীলায় এঁকে ফেলছিল আরেকটা সময়:
- I just don’t know
How to move
From this eternity to that
I just don’t know
How to be unfaithful
To your dreams seen in dreams…
- ভেরি ওয়েল অ্যাটেম্পটেড! নাচ শেখ নিশ্চয়?
- হ্যাঁ। ওড়িশি। ছোটোবেলা থেকে শিখছি।
- হুঁ… স্টেপস দেখেই বুঝেছি। এলিগ্যান্টলি রিদমিক। জাস্ট লাইক লাইটনিং ম্যাকুইন।
- লাইটনিং ম্যাকুইন? উনি কে?
- একটা গাড়ি।
- গাড়ি!
- কেন কারস ছবির নাম শোনোনি, তুমি?
- কারস? কই না।
- ছোটোদের ছবি। অ্যানিমেশন। আমার খুব ফেভরিট। লাইটনিং ম্যাকুইন ওই ছবিরই হিরো। তোমার স্টেপস দেখে কেন জানি না ওর কথাই মনে পড়ল। লাগবে, মল্লিকা, এই রিদমটা লাগবে।
- লাগবে মানে?
- মানে কথাপুরুষে লাগবে।
- কথাপুরুষ?
- হ্যাঁ, কথাপুরুষ। তবে কিনা আমার কথাপুরুষ। বাবু নরেন মিত্তির যিনি বাংলা রঙ্গালয়ে একের পর এক শেক্সপিয়রের নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছেন।
- সামওয়ান লাইক গি…
- না, গিরিশ ঘোষ নয়…আ কমপ্লিটলি ফিকশনাল ক্রিয়েশন।
- অ্যান্ড হোয়াই কথাপুরুষ?
- নারী নয় কেন? – এটাই কি প্রশ্ন তোমার?
- না, না! আমি তো কিছুই জানি না রিগার্ডিং দিস প্রজেক্ট। প্রশ্ন করব কী করে?
- উত্তর কখনও কখনও প্রশ্নেরও আগে চলে আসে। কথাপুরুষও তেমনি কথানারীর আগে চলে এসেছে মাত্র। আসলে কথাপুরুষ কথানারীরই গল্প। সে যুগের অনেক নাট্যকারের মতো নরেনেরও এক মিউজ ছিল।
- লাইক নটী …
- বিনোদিনী নয়, আলেয়া। আলেয়াকুমারী।
৪
এর তিন সপ্তাহ পরে কোনো এক সন্ধ্যায় অডিশনের পরে আমার আইরিশ ডিওপি কেভিনের পেশিবহুল হাতদুটো ব্যালেনর্তকের ক্ষিপ্রতায় পালকের মতো তুলে নিয়েছিল ওকে। আনন্দে, উত্তেজনায়, কৃতজ্ঞতায় থরথর করে কাঁপছিল মল্লিকা ।
অডিশন খুব ভালো হয়েছিল। আর লুক টেস্টে তো ও সাক্ষাৎ আলেয়া! কেভিন তখনই একটা অস্ট্রিয়ান মিউজিক ভিডিয়োর জন্য ওকে প্রায় সাইন করিয়ে ফেলে আরকী!
- নো, কেভিন! শি ইজ মাইন টিল দ্য রিলিজ অব কথাপুরুষ!
কেভিন নিবৃত্ত হয়েছিল। ফাঙ্কফূর্টগামী ৮টার ফ্লাইটটা ধরতে হলে ওকে এখনই ট্যাক্সি ধরতে হবে। মল্লিকাও যেতে চাইল। কৈখালিতে ওর বাড়ি। লিফট দেওয়ার ব্যাপারে কেভিন আমার চেয়ে অনেক উদার। গেমটা ঘুরে যাচ্ছে দেখে স্ক্রিপটে একটা মাইনর কারেকশন করতে করতে আমি রিভার্স স্যুইং ট্রাই করলাম:
- যাবি যা। হরষিৎ তো কনট্র্যাক্টটা আজকেই সাইন করিয়ে নেবে বলছিল। ঠিক আছে, বেটার নেক্সট উইক।
- না অনঘদা, তাহলে থেকেই যাই।
কনট্র্যাক্টের হাজারো ফ্যাচাং। হরষিতের কাছে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স বুঝতে বুঝতেই ন-টা বেজে গেল। তার ওপর দেখা গেল মল্লিকার প্যানকার্ড নেই। চেক ইসু করতে সমস্যা।আমি অরণ্যর ফোনের অপেক্ষায় আছি। টাইটেল সং-এর লিরিকটা ওর আজই শোনানোর কথা। আমি অ্যাপ্রুভ করলে জিতুর কাছে সুর হতে যাবে। তারপর আমরা তিনজন বসব। মানে, আমি অরণ্য আর জিতু। অরণ্য আর আমার দুজনেরই পছন্দ হলে জিতু ফাইন্যালি কম্পোজিং-এ বসবে।
আরও আধঘণ্টা পর ঠিক সাড়ে ন-টায় অরণ্যর ফোন ঠিক এসেছিল। আমি ওর সাথে কথা বলতে বলতেই ইশারায় ছুটি দিয়ে দিলাম আমার দুই অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টরকে। ইনকমপ্লিট কনট্র্যাক্ট পেপার নিয়ে হরষিৎ আমার নির্দেশের অপেক্ষায়। আরদালি কাম দারোয়ান রতনও কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। এখনই বেরোলে শেষ মেট্রোটা পেয়ে যাবে দুজনেই। আমি ইশারায় ওদেরও ছুটি করে দিই ।তালা দিয়ে আমিই চাবি নিয়ে যাব আর কাল এগারোটায় আমিই এসে অফিস খুলব(যেরকমটা হয় কোনো কোনো দিন), বুঝতে পেরে রতন হাঁফ ছেড়ে দৌড় দিল। হরষিৎ আগেই হাঁটা লাগিয়েছে। আমি পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বার করে মল্লিকাকে দেখিয়ে আশ্বস্ত করতে চাই। দেখি ওর খেয়ালই নেই…দেয়ালজোড়া আয়নার সামনে একমনে কোনো একটা নাচের মুদ্রা অভ্যাস করছে। ওদিকে মোবাইলে অরণ্য লিরিকটা সবে বলতে শুরু করেছে।
- সিং, অরণ্য! সিং!
- মানে?
- জিতুকে যেভাবে গানটা গেয়ে বোঝাস,সেভাবে একটু গা। অডিশন চলছে।
তিন মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর অরণ্যর গলা ভেসে আসে। সুরকার হিসেবে জিতুর নাম থাকলেও আমার ছবিতে সুরটাকে প্রথম কনসিভ করে অরণ্যই।
আমি ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে মল্লিকাকে ইশারা করলাম। রাগ আশাবরীতে বাঁধা সেই গান প্লাবিত করে দিল আমার অফিস ফ্লোর। কোমল নি আর ধা-টা একদম ঠিকঠাক লাগিয়েছে অরণ্য। মল্লিকা তার সঙ্গে মিলিয়েছে নিজের উদ্ভাবিত মুদ্রা। আমি হ্যান্ডিক্যামে ধরে রাখতে উদ্যত হই এই যুগলবন্দি। মোবাইলবাহিত স্যরের কণ্ঠ যেন মল্লিকাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি বিভঙ্গে! আমার ক্যাম মল্লিকার সঙ্গে কমিয়ে নেয় নিজের দূরত্ব। ওর গা থেকে ভেসে আসছিল পাহাড়ি ঝরনায় ভেসে যাওয়া বুনো ফুলের গন্ধ… বাঁধভাঙা, উচ্ছ্বল, নিরুদ্দেশ… যে জানে না ভাবী গতিপথের প্রতিটি আগামি বাঁকে কোন্ কোন্ জটাসুর ওঁত পেতে ব’সে আছে!
৫
বার্মাটিকের এগজিকিউটিভ টেবিলটার ওপরে শুইয়ে নিয়েছিলাম ওকে। ধুপ ধুপ করে আলাদা আলাদা শব্দে একের পর এক পড়ে যাচ্ছিল পেপারওয়েট, ফাইলস, পিনকুশন, গ্লোব, ল্যান্ডলাইন, মোবাইল চার্জার, এমনকী শেষমেশ চিত্রনাট্যও। কালো হারেম প্যান্টটা ঠিকঠাক ছাড়ানোও হয়নি…আসলে স্টার্টার কিংবা অ্যাপেটাইজার দিয়ে যেমন একটা ফুলকোর্স ডিনারের শুরু, প্লে-র আগে, খেলোয়াড়মাত্রই জানে, তেমনই ভাইটাল হল ফোরপ্লে।
অরণ্যর গান জাগিয়ে তুলেছিল মল্লিকাকে। ধাপে ধাপে হয়তো বা। মনোবিদরা এর সঙ্গে জুড়বে আরও দুটো ফ্যাক্টর: অসম্পূর্ণ চুক্তিপত্রজনিত কারণে মল্লিকার অবচেতনে লুকিয়ে থাকা ইনসিকিওরিটি আর সেইসঙ্গে আমার পরবর্তী ট্রেডমার্ক ভণ্ডামি:
- কে তুমি?
বাসে রাখা আমার নাটকীয় প্রশ্ন শুনে সচকিতে মল্লিকা চিবুক তুলে তাকায়।
- আলেয়া না মল্লিকা? হু আর য়্যু?
মল্লিকার চোখে এখনও লেগে অসমাপ্ত সংগীতের রেশ। নাকি ঘোর বলব একে? পলক না ফেলে ও এখনও তাকিয়ে আমার দিকে। মুহূর্তের জন্য হলেও কোথা থেকে একটা যাত্রাপালামার্কা বিবেক আমাকে দংশন করতে উদ্যত হয়।
- শি কুড হ্যাভ বিন ইয়র ডটার!
পেশাদারি উৎকর্ষে সেটাকে ঝেড়ে ফেলে আমি এগিয়ে যাই।
- নো শি ইজন্ট। অ্যান্ড আয়্যাম নট অলসো ফোর্সিং হার ইনটু ইট!
ওকে অর্ধ প্রদক্ষিণ করে দাঁড়াই ওর পেছনে। হাত রাখি ওর কাঁধে। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলি:
- আমার আলেয়াকে দেখতে চাই আমি!
ক্লাইম্যাক্টিক কর্ষণের আগে ড্রয়ার হাতড়ে আমি কেবল রাবারটা সংগ্রহ করে নিতে পেরেছিলামমাত্র…।
৬
গলির পর গলি পেরিয়ে যাচ্ছি।
Lanes, by-lanes, alleys –
চাইছি বেঁটে কালো মেয়েটার মুখোমুখি হতে।
Crisscrossing each other
ট্রামের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে…কলকাতার ভেতর আর একটা কলকাতার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছি আমি।
Every new turn opening up the lid
of a new civilization
আলো আরও নিবু নিবু… ট্রাইডেন্টগুলো নজরে পড়ছে না। হাতপাখার বাঁট দিয়ে বিহারি রিকশাঅলা ঘামাচি মারছে, তার পায়ের পাশেই নেড়ি কুত্তাটা কুন্ডলী পাকিয়ে তোফা ঘুম দিচ্ছে, ফুটপাথে হাঁটু গেড়ে জনাতিনেক ছোকরা গোল হয়ে ব’সে কী করছে যেন…
Children playing hide and seek,
ধোঁয়া, ডেনড্রাইটের পোড়া গন্ধ, আমি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। Smoke coming out
হলদে-সবুজ বাইলেনে টিমটিম করে আলো জ্বলছে একটা দোকানে।
from the makeshift tea stalls
তার সামনের বেঞ্চে উলটো করে ব’সে মাটির খুরিতে চা খাচ্ছে ওই যে মেয়েটি - বাঁ হাতে জ্বলন্ত সিগারেট – IB wK †m ?
And a smoggy brown light
আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়াই আর তখনই উপক্রমণিকার মতো শুরু হয় বৃষ্টি।
And a staircase down there
বছরের প্রথম ধারাপাত – তার বড়ো বড়ো ফোঁটা, নেশা কাটতে শুরু করেছে…
Accelerating footsteps….Let’s stop here
যদিও তলানির মতো পড়ে থাকা তার শেষ হ্যাংওভারে আমার ঠোঁট অসহায়ভাবে বিড়বিড় করে যায় আমার ব্যালকনিতে সময়কে দুমড়েমুচড়ে মল্লিকার উচ্চারিত শেষ পংক্তিমালা:
Even eternity must know where to stop
মেয়েটির চা বহুক্ষণ হল শেষ, সিগারেট আরো আগে নিভে গ্যাছে । আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে – কান্না কি? না সম্ভবত। বমিবমি ভাবটাও বহুক্ষণ উধাও। তাহলে?
- স্যরের বন্ধু না আপনি?
- হ্যাঁ ।
- অনঘ মিত্র? ডিরেক্টর?
- হ্যাঁ।
- এখানে?
- এমনি।
- এমনিই?
- হ্যাঁ, এমনি এমনি।
- বাঃ! চমৎকার! সত্যি কথা তো আপনি তো বেশ সুন্দর বলতে পারেন!
- তুমি?
- আমি?
- তুমি কে?
- আমি আমি।
- না, মানে কী তোমার নাম, কোথায় থাক?
- ও, সেগুলো জানা এই রাত্তিরে আপনার খুব দরকার হয়ে পড়েছে, না!
- না।
- তবে?
- মানুষকে ডাকতে একটা নাম তো লাগেই। আর অ্যাড্রেস জানা থাকলে …আমার গাড়িটা কাছেই পার্ক করা আছে। চাইলে তোমায়…
- লিফ্ট, তাই তো?
- হুঁ।
- জানেন, স্যর প্রায়ই আপনার কথা বলতেন।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ, এই তো লাস্ট উইকে ফিলোলজির ক্লাস নিতে নিতেও বলছিলেন…
- কী বলছিল অরণ্য?
- বলছিলেন ইনফ্লুয়েন্স অব শেক্সপিয়র অন ইংলিশ ল্যাংগোয়েজটা আপনি নাকি স্যরের খাতা থেকে বেমালুম টুকে দিয়েছিলেন!
- হ্যাঁ, আমি তো পড়াশুনো করতাম না। ক্লাস বাংক করে সিনেমা দেখতাম। না টুকে উপায় কী বলো?
- এখনও তো টুকেই যাচ্ছেন।
- মানে?
- মানেটা আপনি ভালোই বুঝতে পারছেন, অনঘদা। আপনার ছবি আমি দেখেছি। এ নিয়ে কথা বাড়ানোর মানে হয় না। কিন্তু হঠাৎ আমায় ফলো করছেন কেন?
- ফলো? তোমায়? কই …না তো! আমি কেন তোমাকে ফলো… আসলে আমি খুঁজছিলাম।
- খুঁজছিলেন? কাকে?
- কাউকে।
- কাউকে মানে?
- দ্যাখো, অরণ্য ওয়জ আ গুড বয়। জীবনে কোনোদিন ক্লাস বাংক করেনি, রেজাল্ট খারাপ করেনি, মিথ্যে কথা বলেনি, দল বদলায়নি, অন্যের বউয়ের সঙ্গে শোয়নি। তবু ওর সেপারেশন হয়ে গেল, কলেজে ছাত্ররা নম্বর না-বাড়ানোর জন্য মুখে থুথু ছেটাল…ফ্রাস্টেশনে কবিতা ওকে ছেড়ে গেল, ও গান, চিত্রনাট্য আর মদ ধরল একসঙ্গে । আমার সঙ্গে প্রথম ছবিতেই রাইটার কাম লিরিসিস্ট হিসেবে আকাশছোঁয়া সাফল্য। কিন্তু কুহু ফিরে এল না। আমাদের সেকেন্ড ছবিটাও গেল আটকে ।ইট ওয়জ আওয়ার ড্রিম প্রজেক্ট টু টুগেদার! কথাপুরুষ। আই ওয়ন্টেড টু কাস্ট আ গার্ল অ্যান্ড হি ওয়াকড অ্যাওয়ে! আমি অন্য একটা ছবি শুরু করলাম, কিন্তু ও সরেই রইল। কেউ জানল না কিন্তু আমাদের জুটি ভেঙে গেল। ও আরও মদের মধ্যে ডুবে গেল। আর এখন মরেও শান্তি নেই…কে জানে কত কাটা-ছেঁড়া হবে কালকের পর থেকে!
- এর সঙ্গে কাউকে খোঁজার সম্পর্কে কী?
- আসলে অরণ্যই খুঁজছিল কাউকে, যে শুধরে দিত ওর ভুল…
- আর আপনি?
- আমি সেই কাউকে এনে হাজির করতাম ওর সামনে।
- ঘটকালি?
- সর্ট অব।
- হুঁ…বুঝলাম। এবার কি লিফটটা পাওয়া যেতে পারে? দশটা বাজলে মেসে আবার ঢুকতে দেবে না।
- ও শিওর!
বৃষ্টি অবিশ্রান্তভাবে পড়েই চলেছে। পিস হেভেনের পাশেই পার্ক করা ছিল লাল শেভ্রলে অ্যাভিয়ো। অন্ধকার চিরে ওর সার্চলাইট লোডশেডিং-এ মোড়া শহরটার খানাখন্দে মোড়া পথকে আলোকিত করতে করতে চলে।
- আমি সোনারপুর, তুমি?
- নিউ গড়িয়া।
- তাহলে বাইপাস ধরে নিই?
- হ্যাঁ।
- সিটবেল্টটা লাগিয়ে নাও,প্লিজ!
- শ্যিওর।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই আমরা উঠে এলাম বাইপাসের পিচ্ছিল মসৃণতায়। এইখানে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। শিশিরের কনা - ছু৺য়ে থাকা সবুজও এখন ঘোর কালো।