হাসান সৌদি আরব থাকে। সৌদি আরব থাকার কারণে তাকে আরবিতেই কথা বলতে হয়। প্রবাসী যারা বাঙ্গালী আছে তাদের সাথে দেখা হলে বাংলা বলে। প্রবাসী বাঙ্গালীরা বিভিন্ন এলাকার হওয়ার কারণে এক এক জন একেক আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। হাসানের বিষয়টা ভাল লাগে না। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এই সাত সাগর তের নদীর পাড়ে নতুন একটা বাংলা ভাষার সৃষ্টি হবে। যেই ভাষায় আরবি এবং আঞ্চলিক এর একটা টান থাকবে। আমাদের যে ভাষার জন্য ছাত্র জনতা প্রাণ দিয়েছিল সে ভাষা থাকবে না। এখনই সৌদি আরব থেকে কোন বাঙ্গালী যখন দেশে আসে তার কথার মানে আরবি একটা টান থাকে।
একটা ঘটনা হাসানের মনে পড়ে যায়। জুবায়ের নামের এক বাঙ্গালী লোক হাসানের সাথে থাকত। তার বাড়ি কুমিল্লাতে ছিল। সে দীর্ঘদিন সৌদি আরব থাকার কারণে বাংলাভাষাটা অনেকটা ভুলেই গেছে। সে সৌদি আরবে আরেকটি বিয়ে করার কারণে দেশের কথা, দেশের বউ, ছেলে-মেয়ের কথা একেবারেই ভুলে গেছে। বউ, ছেলে-মেয়ের জন্য টাকা পাঠিয়েই সে তার দায়িত্ব পালন করে।
একবার খবর এলো জুবায়ের এর বাবা মারা গেছে। জুবায়ের যাবে না যাবে না করেও বাংলাদেশের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। জুবায়েরের বাবা জুবায়েরকে চিঠি দিয়েছে যদি সে তার বাবার লাশ দেখতে না আসে তাহলে সে যেন কোনদিন বাংলাদেশে না আসে। কোন বাবা ছেলের জন্য অভিশাপ দিয়ে না গেলেও তিনি দিয়ে যাবেন। তিনি ছেলের অভিশাপের জন্য দোয়া করে যাবেন। যদি ছেলে দেশে আসে তাহলে তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করা হবে। বিদেশে বিয়ে করার জন্য তিনি সে অভিশাপ দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
জুবায়ের দেশে আসে। দেশের ভাষা শুনে তার মনে হতে থাকে সে এগুলি নতুন শুনেছে। বাংলা ভুলে গেলেও একটু আধটু মনে আছে। বাড়িতে গেলে বউ, ছেলে-মেয়েদের সাথে যখন কথা বলে সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বউ, ছেলে-মেয়ে, গ্রামবাসী জুবায়ের এর কোন কথাই বুঝে না।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই গ্রামবাসী জুবায়ের এর কথা শুনে হাসতে থাকে। প্রতিটা কথাতেই সে আরবির মত টান দিয়ে কথা বলে। বাংলা বলে ঠিক আছে। টান দিয়ে বাংলা শব্দটাকে আরবির মত করে ফেলে। অনেক শব্দ মাঝ খান দিয়ে ছেড়ে দেয়।
এই অবস্থার মধ্যে জুবায়ের এর বউ ছেলে-মেয়ে পড়ল মহাবিপদে। কেউ জুবায়ের এর ভাষা বুঝে না। বুঝতে অনেক সময় লাগে। আরবি একজন বিশেষজ্ঞ আনা হল জুবায়ের এর ভাষা বুঝার জন্য। জুবায়ের আরবি বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বললে আরবি বিশেষজ্ঞও জুবায়ের এর ভাষা বুঝে না। জুবায়ের আরবি বললে আরবি বিশেষজ্ঞ বুঝে। বাংলা বললে কিছুই বুঝে না। জুবায়ের যতদিন দেশে ছিল ততদিন সে আরবি ভাষায় কথা বলেছে। আরবি বিশেষজ্ঞ দুভাষীর কাজ করেছে।
এই ঘটনার পরেই জুবায়ের উদ্যোগ নিয়ে সৌদি আরবে বাংলা ভাষা রক্ষা কমিটি গঠন করে। যারা বাঙ্গালী তাদের বাধ্যতামূলক এই সঙ্গের সদস্য বানিয়ে ফেলে। যে যে এলাকারই হোক না কেন পাঠ্যপুস্তকের ভাষাতেই কথা বলতে হবে। সেই ভাষার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা প্রাণ দিয়েছে সেই ভাষায় কথা বলতে হবে।
কমিটির কার্যক্রম ভালই চলছিল। এর মধ্যেই হাসান অনেক বছর পর দেশে আসে। দেশে এসে বাংলা ভাষার অবস্থা দেখে অবাক হয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন ভাবে কথা বলছে। এফ.এম রেডিওর জকিদের কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়ে। ওরা ইবাংলিশ এ কথা বলে। মানে ইংলিশ, বাংলা মিলে এমন ভাষায় কথা বলে যা অনেক বাঙ্গালীই বুঝে না।
নাটক, সিনেমাতে দেখে আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য বেশি। আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন নাটক সিনেমা বানিয়ে দেশের মানুষদের এমন একটা ভাষা উপহার দিচ্ছে তা মূল ভাষার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যুবকরাও বাংলা ভাষার বদলে হিন্দি, ইবাংলিশ এবং ইংরেজিতে কথা বলছে। অনেক শিক্ষিত লোকগুলিও মূল বাংলাভাষায় কথা বলতে পারছে না।
হাসান ভাবতে থাকে সে ভেবেছিল বাংলাভাষাকে প্রবাসীরাই কলুষিত করছে। এখন দেশে এসে দেখা যাচ্ছে বাংলা ভাষাকে দেশের মানুষরাই কলুষিত করছে। শহীদ, জব্বার, বরকত, সালামের রক্ত কি তাহলে বৃথা গেল। ওরা বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য লড়াই করেছিল। এখন যদি দেশে ইবাংলিশ চালু হয় তাহলে উর্দু গ্রহণ করতে সমস্যা কি ছিল।
হাসানের রিনা নামের ছোট একটা মেয়ে আছে। সে বেশির ভাগ সময় হিন্দি চ্যানেলগুলি দেখে। বাংলা চ্যানেলে কোন সময় চাপ পড়ে গেলে সে বড় ধরণের অপরাধ মনে করে। হিন্দি চ্যানেল দেখতে দেখতে হিন্দি এত সুন্দর করে বলতে পারে যা হিন্দিভাষীরাও বলতে পারবে না। রিনার মত আজকাল অনেক ছেলে-মেয়েরাই হিন্দি ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। উর্দু এবং হিন্দি কাছাকাছি ভাষা। হিন্দির প্রচলনটা যে হারে শুরু হয়েছে আমাদের রক্ত রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারির মর্মকথা ভুলন্ঠিত হচ্ছে।
হাসান কিছু বলতে পারে না। তার কথা কে শুনবে। সে মূর্খ মানুষ। দেশে থাকে না। বিদেশে বছরের পর বছর পরে থাকতে হয়। বাহিরে বের হলেই বাংলা ভাষার অপমানগুলি দেখে। চোখ দিয়ে পানি ফেলে। বরকত, রফিক, জাব্বারের কথা স্মরণ করে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। এমনকি নিজের পরিবারকেও বলতে পারে না।
নিজের পরিবারকে বললে বলে আধুনিক হতে। গ্রামে বললে বলে যার প্রচলন সেটাকেই মানতে হয়। শহরে বললে বলে আপনি এরকম ব্যাকডেট চিন্তা করেন কেন। বাংলা চাষা বোঝাদের ভাষা। ইংরেজি হচ্ছে ভিআইপিদের ভাষা। হিন্দি হচ্ছে সমগ্র জনতার ভাষা। এই যদি হয় তাহলে দেখেন আমাদের ভাষার মর্যাদা আজকে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। জল ফালানো ছাড়া অন্য কোন কিছু এখন আর করার নেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বশির আহমেদ
এ অবস্থার দায় কিন্তু কেবল প্রবাসী, গ্রামের অশিক্ষিত কিংবা আঞ্চলিক ভাষাবাসির নয় এদায় আমাদের সকলের । বাস্তবতার নিরিখে গল্পটি লেখার জন্য লেখক কে ধন্যবাদ ।
অামরা যতদিন ধরে রাখতে পারব ততদিন পরিবর্তনের কথা চিন্তা করব কেন। অামাদের পরিবর্তনের কথা চিন্তা করা উচিত না। এটাই একটা নেতিবাচক ধারণা। অামাদের ধারণা রাখতে হবে শহীদদের প্রতি শদ্ধা জানিয়ে ভাষাকে যেন পরিবর্তন করা না হয়। যদি হয় তাহলে তখন দেখা যাবে। অামাদের শহীদদের মর্যাটাকে অনতত রাখতে দেন। পরিবর্তন হয় মানুষের জন্য। মানুষ যদি পরিবর্তন না করে তাহলে সে নিজে নিজে পরিবর্তন হতে পারে না। অামরা নিজেরা চেষ্টা করব যেন নিজেরা পরিবর্তন না হই।এখন ও পৃথিবীতে এমন কতগুলি ভাষা অাসে যেগুলি পরিবর্তন হয়নি। অামরা সেই ভাষামত হতে পারি না কেন।
মারুফ মুস্তাফা আযাদ
লেখাটা ভালো লাগল। বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।কিন্তু ভাই এই অপভ্রংশ রোধ করার কোন উপায় নাই। একটু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখ, সংস্কৃতের অপভ্রংশ প্রাকৃত, যা থেকে বাংলার সৃষ্টি। প্রথম যুগের বাংলা আমরা বুঝতে চাইলে অনেক যুঝতে হবে। সে ভাষার সাথে যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন ও বিচিত্র ভাষা (যেমন আরবী, ফারসী, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, মারাঠী, গুজরাটী ইত্যাদী) মিশে যে বাংলা তৈরী হয়েছে সেটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষা গুলোর একটি। যার জন্য এত মানুষ প্রান বিসর্জন করেছে। এই পরিবর্তন ঠেকানো সম্ভব না ভাই। পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র ভাষা যে ভাষায় এতরকম শব্দ আছে। পরিবর্তন ও হবে, অপভ্রংশও হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাষার জন্য প্রান দিয়েছেন, তাই বলে এই না যে তাঁরা পরিবর্তন বিরোধী ছিলেন। তাঁরা বেঁচে থাকলে এই পরিবর্তন মেনে নিতেন বলেই আমার বিশ্বাস। আর ভালো জিনিসের সাথে খারাপ জিনিস তো আসবেই। এক্ষেত্রে সেটার নাম হলো "বাংলিশ"। সাথে খারাপ না থাকইলে ভালোর মর্ম বোঝা যায় না। আমাদের যেটা করনীয়, সেটা হল এই বিশ্বগ্রাসী পরিবর্তনের স্রোতে নিজেদের স্বত্তা যেন বিলীন হয়ে না যায়। তাহলেই আমাদের পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগ সফল হবে।
অাপনার মন্তব্যর সাথে এক হতে পারলাম না।কারণ অাপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা অান্দোলনের সাথে অাপনি একমত না।সালাম, বরকত, জব্বার বুকের তাজা রক্ত কেন ঢেলে দিয়েছিল তা অামরা সবাই জানি। এখন কথা হচ্ছে অাসরা যদি অামাদের ভাষাটাকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে উদু হতে কি দুষ ছিল। ভাষা পরিবর্তন হয়। কিন্তু অামাদের ভাষা পরিবর্তন হওয়া শহীদের সাথে বেইমানি হওয়ার সামিল। অাপনি কি জানেন, পৃথিবীতে অনেক অান্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে। অাজ পর্যন্ত ভাষার জন্য বাংলাদেশ ব্যতিত কোথায়ও অান্দোলন হয়নি। অামরা এই দিক থেকে পৃথিবীর মধ্য সবচেয়ে ব্যতিক্রম। এই জন্যই এটার নাম অান্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। অাপনার সাথে একটা বিষয়ে একমত যে, বাংলাভাষার অাদি যে রুপ তা নেই। অাদি রুপ থেকে এখন যেই ভাষাটা এসে দঁাড়িয়েছে এটা অামাদের নিজস্ব ভাষাই। কিন্তু অামি বলছি কি, অাজকাল হিন্দি সিনেমা বলা. দেখা থেকে যা শুরু হয়ে গেছে কোনদিন না বাংলা ভাষাটা হিন্দি হয়ে যায়। নিজের ছেলে খারাপ হলে ও যে দরদ দেখাবেন অন্য ছেলে ভাল হলে ও সে দরদ দেখাবেন না। অামাদের ভাষা থেকে ভাষাটা পরিবর্তন হলে ও অামরা পরিবর্তন টাকে মেনে নিতে কষ্ট হবে না। কিন্তু হিন্দি যদি হয়ে যায় তাহলে কি অামরা মেনে নিতে পারব। এমনিতেই অামাদের ভাষার মধ্য ফারিস, ইংরেজি, অারবি, ফরাসি ইত্যাদি ঢুকে গেছে। এখন নতুন করে ঢুকছে হিন্দি। মনে কিছু নিবেন না। নিজের মনে যা এসেছে লিখে দিয়েছি। চিন্তা করে লিখি নি। ভাল থাকবেন। পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভাই যখন আমি তোমাকে কমেন্ট করি, আমার এটাই ভয় ছিল যে তুমি হয়ত একটু ভুল বুঝবে। হলও তাই। কারন ব্যাপারটা আসলেই একটু জটিল। তুমি, আমি বা আমরা সবাই যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত সেটা হচ্ছে নেতিবাচক পরিবর্তন। মানুষের মুখে মুখে ভাষার যে পরিবর্তন হয় সেটা মানতে কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু সংস্কৃতির উপর সরসরি আগ্রাসনটা আসলে মানা যায় না। আর '৫২র ভাষা আন্দোলনের সাথে আমি শুধু একমতই নই, বরং মাঝে মাঝে আফসোশ হয় যে, জন্মটা আরো আগে কেন হলো না। কারন এই আন্দোলনের জন্যই এই ভাষা এতটা অনন্যতা পেয়েছে। যাই হোক, আক্ষেপটা এখানেই, যে ভাষার জন্য এত দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেল, এই প্রজম্নের কাছে তার মূল্য অত্যন্ত সংকীর্ণ। সত্যিই যদি প্রেতাত্মা বলে কিছু থাকত তাহলে ভাষা শহীদদের আত্মা এদের মাথাগুলা মুরগীর মাথার মাথার মত টেনে ছিড়ে ফেলত।
তাপসকিরণ রায়
দেশে বাংলা ভাষার কি স্থান তা আপনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ভাই ! আসল সত্যি জেনেই ভয় হয়--অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবলে তো আঁতকে উঠতে হয় ! আপনার গল্প চিত্রটি সুন্দর ফুটে উঠেছে।ধন্যবাদ আপনাকে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।