চেনা- অচেনা

ঈর্ষা (জানুয়ারী ২০১৩)

পন্ডিত মাহী
  • ২৩
রাত তিনটার দিকে জয়ীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাথে সাথেই শুরু হল চাপা উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার কারণ সহসাই সে উপলব্ধি করতে পারলো না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে।

মনে পড়ে গেলো, গত মাসের মিড টার্মের সময় একটা পরীক্ষায় এমন হয়েছিলো। প্রশ্ন হাতে পেয়েই লিখতে বসেছে। একটানে লিখে ফেলল প্রথম প্রশ্নের উত্তর। সব উত্তরই জানা। দ্বিতীয় উত্তরটা লেখা শুরু করতে যাবে এমন সময় মনে পড়ে, মনে পড়ে না এমন দোলচাল শুরু হল। তারপর আস্তে আস্তে সব ফাঁকা। খোলা আকাশের মত ফাঁকা। জয়ী কত চেষ্টা করলো, মনে পড়লো না। নিজের নামটাও না। ভাগ্যিস, ম্যামটা খুব বেশী ভালো ছিল। অসুস্থতার জন্য পরীক্ষাটা আবার দিতে দিয়েছে।

বাথরুমে বেসিনের কলটা খুব একটা জলনিরোধক নয়। টপটপ করে পানি পরছে। জয়ীর কপাল কুঁচকে গেলো। বিরক্তিকর শব্দ। এ কারণেই কি ঘুম ভেঙ্গেছে?

জয়ী উঠে দাঁড়ালো। বিছানা ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে থাই গ্লাসে হেলনা দিয়ে দাঁড়ালো। গ্লাসগুলো খুব ঠাণ্ডা। কুয়াশা জমে একাকার। গ্লাসের গায়ে আঙ্গুল দিয়ে নিজের নাম লিখল জয়ী, সাথে একটা প্রশ্নবোধক! জয়ী নিজেই জানেনা তার মনে কি খেলা চলছে। হাত দিয়ে কাঁচ পরিষ্কার করে নিলো, ঠিক ততটুকু, যতটুকুতে বাইরে দেখা যায়।

বাড়ির পেছনটা এদিকে। এ এলাকাটা বড্ড শহুরে হয়ে উঠেছে। শহর ছেড়ে বেড়িয়ে আরেক শহরে এসে পরতে হবে জানা ছিল না। রাস্তার দু’পাশে ছ’তালা বাড়ির সাড়ি। অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা পার্ক আছে। আর এই পেছন দিকটা একটা খেলার মাঠ আর আরেকটু জংলা। এই খোলা জায়গাটুকুর কারণে এইদিকে বেশ আলো আসে, বাতাসও। আর এই রাতে কনকনে ঠাণ্ডা।

মুছে নেওয়া কাঁচের গায়ে আবারও কুয়াশা জমে গেছে। জয়ী এবার সরে এলো। বিছানায় এসে বসলো। পাশেই সুঠাম দেহী একটি শরীর যার পৌরুষ ঠিকরে বেরুচ্ছে এখনো।

সমীর। ইউনিভার্সিটিতে যে প্রথম দেখাতেই জয়ীর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। সেই পাগলামি এখনো একই রকম আছে। সন্ধ্যের সেই সুখানুভূতিটা তাড়া করলো ও কে। সমীরের মধ্যে, অনেক গভীরে চলে যাওয়া, কখনো সমীর জয়ীর মাঝে। একের পর এক ঝড়, একের পর এক সুখের ঢেউ আছড়ে পরে। জয়ী ঠোঁট কামড়ে ধরতেই ব্যথা পেলো।
- ঈশ, বুনোটা ঠোঁটটা ফুলিয়ে ফেলেছে...
আনমনে বলে উঠলো জয়ী।
ঘুম আসছে না। অচেনা জায়গা। সমীরই নিয়ে এসেছে। ওর নিজের ফ্লাট, যদিও ওর বাবার কেনা।

সমীর নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। জয়ী হেলান দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। মাথার ফাঁকা ভাবটা কমেছে। তবু কোথায় যেন সব থেমে আছে। একটা ভাবনা জমতে না জমতেই ধোঁয়ার মত মিলিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে এখনো গাঢ় অন্ধকার। নিস্তব্ধ, আর নিঃসঙ্গ।

মাত্রই ঢুলনি বাড়ছিলো। গায়ের নীচে চাপা পড়া ফোনটা কেঁপে উঠলো। ফোন এসেছে। ফারিয়ার ফোন! ফারিয়া ওর কলেজের সহপাঠী, প্রাণের বন্ধু। কিন্তু এর রাতে? আর এতদিন পর!
- হ্যালো
- যাক তোকে পাওয়া গেলো
কোনরকম সৌজন্য ছাড়াই ফারিয়া বলে উঠলো
- হু...ঘুমিয়ে ছিলাম
জয়ী জবাব দেয়
- বুঝতেই পেরেছি। দু’বার ফোন দিয়ে পাইনি। ভেবেছিলাম আর দেবোনা। সকালে দেবো। কিন্তু কথাটা জরুরী। না বলে শান্তিও পাচ্ছি না। তোর শোনাটাও জরুরী
- কি জরুরী কথা। তোর আরেকটা জুটেছে নাকি এই রাতে...
- ধুর, ফাজলামি রাখ
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, এই মুখে কুলুপ আটকালাম। বল, শুনছি
- জানিস আজ হঠাৎ করেই আমার ভাইয়ের কাছ থেকে খবর পেলাম। অনিক ফিরে এসেছে। সেন্ট্রাল হসপিটালে আছে
- অনিক? কোন অনিক বলতো?
- জয়ী এটা ফাজলামির সময় না
- আমি কি তাই করছি নাকি, আজব!
- মানে?
- কোন অনিকের কথা বলছিস আমি কি করে জানবো। আমি অনিক বলে কাউকে চিনি বলে মনে হয় না
- সত্যি?
- কি সত্যি?
- তোর মনে পড়ছে না?
- নাহ
- অনিক, যাকে তুই প্রপোজ করতে গিয়েছিলি। যাকে অন্ধের মত ভালোবাসতি। ওকে না পেলে মরে যাবি বলেছিলি।
- না না... মনে পড়ছে না...
- অনিক যে তোর বান্ধবীকে ভালোবাসতো, তোকে নয়। যে তোর কারণে অপমানিত হয়ে নিরুদ্দেশ হয়। তোর মনে পড়ছে না জয়ী? একটুও
- না... কিচ্ছু মনে পড়ছে না...
- ওকে... এটা নিয়ে আমরা সকালে আবার কথা বলবো। রাখলাম...

জয়ী মাথা নাড়ল এমনিতেই। নামটা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কি একটা স্মৃতির কাঠামো যেন পাজলের মত হয়ে গেছে। মিলছে না। এক চিন্তাশূন্য, ভোঁতা কল্পনার জগত, মনের জগত।
জয়ী নীরব। ভাবছে। ছবি মেলাচ্ছে। অনিক নামটা তার অতি চেনা! একটা ছবি ভেসে উঠছে প্রকট ভাবে।


দুই
সমীর ডাইনিং টেবিলে। রাতের বাসি চাইনিজটা গরম করে খেতে বসেছে।
জয়ী প্লেটে খাবার নিয়ে নাড়ছে। দেখছে। চিন্তিত নিমগ্ন ভঙ্গি। রাতের কথাগুলো ঘুরে ফিরে মনে পরছে। সমীর আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-খাচ্ছ না যে
জয়ী মুখ তুলল না। খাবার নাড়তে নাড়তেই বলল, এই তো খাচ্ছি
-কোথায়? কি ভাবছ?
-নাহ। কিছু না
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জয়ী।
-কি, মা মা ভাব লাগছে নাকি? অত চিন্তা করো না। আমি সাবধানেই ছিলাম

চট করে জয়ীর মাথায় কাল সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে গেলো। এক চিলতে হাসি লাগলো ঠোঁটে।
-ধুর তুমি নাকি! আমি কি তাই ভাবছি!
-তো...?

জয়ী স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে রাখবার চেষ্টা করলো। আড় চোখে তাকাল সমীরের দিকে। কথাটা বলবে কিনা! বলে হালকা হতে ইচ্ছে করছে।
-তোমার অনিকের কথা মনে আছে?
-অনিক? কেন বলতো
-আগে বলো মনে আছে?
-নাহ। এই নামে তোমার আমার পরিচিত কে আছে?
-নেই!
জয়ী চমকাল। তবে যে কালরাতে ফারিয়া ফোন করলো!
সমীর বিড় বিড় করে বললো,
-কি হয়েছে জয়ী?
- না মানে... কাল অনেক রাতে ফারিয়া ফোন করেছিলো। বলল, অনিক ফিরে এসেছে। আমি ঠিক নামটা মনে করতে পারছিলাম না। তুমি তো জানো আমি ভুলে যাওয়া স্বভাবের। ভাবলাম তুমি হয়তো চিনবে...
-ধুর! কি আবোল-তাবোল ভাবছ। ফারিয়া তোমাকে ফোন করবে কোন দুঃখে! মনে নেই লাস্ট ইয়ারে ও পার্টিতে কি সিনক্রিয়েট করলো। অকারণেই তোমার সাথে ঝগড়া করলো। ও করবে তোমায় ফোন! অবিশ্বাস্য!

জয়ী মাথা ঝাঁকাল। সামান্য মাথা ঘুরছে। খাবারে গা গুলাচ্ছে ওর।
ফারিয়ার সকালে ফোন করার কথা বলেছে। জয়ী দাঁড়ালো।
-উঠছ যে, খাবে না?
-না, শরীরটা ভালো ঠেকছে না। তুমি কি আমাকে বাসায় ড্রপ করে যেতে পারবে?
-সে কি, তুমি না বললে বাসায় কেউ নেই। তিনদিন আমার কাছে থাকবে। আমি কত প্লান করলাম। আর আজ রাতে তো পার্টিও দিয়েছি।
- না, সমীর। আজ আর ভালো লাগছে না। অন্যদিন। প্লীজ...
-ওকে ওকে... ড্রপ করে যাবো। কিন্তু হঠাৎ এমন চুপসে গেলে কেন?
-কিছু না। আমি ঠিক আছি। শুধু বাসায় যাবো

জয়ী আর কথা বাড়াল না। ঘরে এসে বিছানায় এসে বসলো। মনটাকে বড্ড ছন্নছাড়া লাগছে।

মনের মাঝে মন বড্ড ঝুলন্ত, দোল খাচ্ছে এদিক সেদিক। অনেক মানুষের চিৎকার ভেসে আসছে ভেতরে ভেতর। চেনা-অচেনা। সব কিরকম স্পষ্ট! অনিক! গায়ে চেক শার্ট। পরনে জিনস। বড্ড সাধারণ। তবু ওর চোখে কি যেন নেশা। জয়ী তল পায় না। ডুবে যায়।

হইহুল্লো চারিদিকে। সমানে বিয়ার আর হুইস্কির বোতল খোলা হচ্ছে। উদ্দাম সুরে জোরালো গান। অনিক বড্ড বেমানান খালি হাতে। অনিকের হাত ধরে চেঁচামেচি পেরিয়ে নিয়ে এসেছিলো নিজের রুমে। দরজা বন্ধ করতেই হইহুল্লো কিছুটা কমে যায়। ভেতরে ভেতরে উসখুস করছিলো অনিক। স্বভাব লাজুক চেহারা। চাপা উদ্বেগ। কি ভাবছে জয়ী? জয়ী প্রথমে আবদার, পরে অনুনয় করে চাইল। অনিকের মন গলল না বা গলে যাবার মত অবশিষ্ট ক্ষমতা ছিল না। মানুষ কতবার গলতে পারে একসাথে!
জয়ী হাল ছাড়ল না। নিজেকে উজাড় করে দিতে চাইলো, সবটুকু। সর্বস্ব উজাড় করে। খোলা সমুদ্রের মত নিজেকে মেলে ধরল অনেকের কাছে। অনিক কি ডুব দেবে না!
কয়েক মুহূর্তের জন্য অনিকের স্নায়ু অসাড় হয়ে গেল। ছুটে বেড়িয়ে গেলো দরজা খুলে। ওপাশে একটু দূরেই একটা চেনা মুখ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেলো দুজনেই। হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ বয়ে গেছে শিরদাঁড়ায়।

জয়ী বর্তমানে ফেরে। হাত দিয়ে মুখ চেপে আছে। লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। যেমনটা ঠিক একইভাবে করেছিলো বছর খানেক আগে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল সে। লজ্জা! এখন আর লজ্জা করে না। লজ্জায় পোষায় না। এক সময় কষ্ট হতো, কিন্তু বিশ্বাস ভেঙ্গে যেতে কতটা সময়ই লেগেছিল? এক মুহূর্ত?

জয়ী সেলফোনটা হাতে নিয়ে ফারিয়াকে খুঁজল। কললিস্টে ফারিয়া নামের কেউ নেই।


তিন
বাড়ি ফিরে সরাসরি নিজের ঘরে ঢুকল জয়ী। জামা-কাপড় ছেড়ে ঢোলা গাউন পরে নিলো। গোছান ঘর। কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। ঘরের ভেতর নকশা করা খাট, আলমারি, টিভি, শোকেস সবই চকচক করছে। আভিজাত্য ঠিকরে বেরচ্ছে। রাস্তা ঘেঁষা পশ্চিমের জানলা দিয়ে আলো আসছে। হিম হিম ভাব। জানলার সামনে চোখ বুজে নিজের ঘরের চেনা গন্ধটা খুঁজে নেয় জয়ী।
রোদে পোড়া দুপুর মিয়িয়ে আসার গল্প শোনে কান পেতে। বিকেলের আসি আসি ভাব, শীতের হিম বাতাসের খেলা। কখন যে এভাবেই সন্ধ্যে পেড়িয়ে গেলো!

সন্ধ্যেটা বড় নিঃসঙ্গ হয়ে আসে। তারপরের সময়টা আরো বেশী। জয়ীর বাবার কথা মনে পড়ে। বাবাটা কাজ কাজ করে কেমন যেন দূরে দূরেই থেকে গেলো। কাছে আসা বলতে হঠাৎ রাত করে ফোন দেওয়া। দেশে ফিরলে হঠাৎ কোন সকালে নাস্তার টেবিলে কথার আদর। ব্যাস এইটুকু। কোন শাসন নেই, কোন বারণ নেই, নেই জিজ্ঞাসা। কোন চাওয়াও নেই। গুছিয়ে নিয়েছে নিজের আলাদা সংসার।
মা’টাও বড় ঝাপসা দেয়ালে। ছবিটা মোছা হয়নি বহুকাল।
জয়ী চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,
-বড্ড একা কি আমি?
মনে মনে নিজেকে একটা প্রশ্ন ধরিয়ে দিলো।
নাহ। সমীর আছে। যে পাগলের মত ভালোবাসে। যার কাছে সব পাওয়া যায় যখন-তখন। বুনো স্বাদ, বেসামাল রোমান্স-পাগলামি, আনন্দের বন্যা।
ভালোই তো ছিল। অনিক! অনিকটা কেন যে মাথার মধ্যে ফিরল?
জয়ী তেতে ওঠে। ফোন করবে নাকি একবার ফারিয়াকে? ও নিশ্চয়ই জানে। ওর তো জানার কথাই।

জয়ী দেরী করলো না। ডিরেক্টরি থেকে ল্যান্ড ফোনের নম্বরটা খুঁজে পেলো। জয়ী অস্থিরতায় ভুগছে। ও কথা বলবে তো!
ওপাশে রিং বাজছে। ফারিয়াকে পেতে একটু সময় লাগলো। কেউ ডেকে দেবে বলে অপেক্ষায় রাখল।
-হ্যালো, স্লামালাইকুম
-হ্যালো, ফারিয়া
-জী, কে বলছেন
-আমি জয়ী
ওপাশ থেকে সব চুপচাপ। জয়ী কোন শব্দ শুনতে পায় না।
-তুই কেন ফোন করেছিস
-একটু দরকার ছিল তোর কাছে
-আমার তা মনে হয়না। তোর আর আমার মাঝে দরকার বলে কোন শব্দ নেই
-ফারিয়া শান্ত হও। আমার শুধু একটা ইনফরমেশন চাই। আর কিছু না...
ফারিয়া চুপ। ভাবছে। মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। এখন আরো খারাপ হয়ে গেলো ওর।
-বল কি জানতে চাস
-তুই কি গতরাতে আমায় ফোন করেছিস?
জয়ী বলতে গিয়েও এই কথাটা বলতে পারলো না।
-অনিক কোথায় আছে জানিস?
কোনমতে গলা দিয়ে কথাটা বের করতে পারলো জয়ী।
ফারিয়া আবার চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ।
-জয়ী, তোর আমার ব্যবধানটা আমি ভালো করে জানি। স্পষ্টত আমি বড্ড তলার মানুষ। হাতড়ে ধরার খড়-কুটোও নেই। তুই কেড়ে নিয়েছিস। তো আবার তোর কি সাধ জাগল... কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা না দিলে চলছে না?
-ফারিয়া, প্লীজ...
ফোন রাখার শব্দ পেলো জয়ী। জয়ীর নিজেকে খুব ছোট লাগছে। খুব এঁটো লাগছে নিজেকে। বাইরে রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ, মানুষের হল্লা দেয়াল টপকে ঘরে আসছে। একঘেয়ে সময়ে একঘেয়ে শব্দের সুরে বড্ড নিঃসঙ্গ লাগছে।

সে কি অলক্ষ্মী। প্রাণের বন্ধুটির মনের ঘর সে কেন নষ্ট করলো? ঈর্ষায়? অন্ধ মোহে? সে কি জানতো না ওদের গভীরতার কথা! তবু কেন ডেকে এনেছিল সেই রাত? কিসের জন্য জয়ী?

নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো জয়ী। রাতের আকাশে কুয়াশা ভাঙ্গছে। বিছানার উপর সেলফোনটি তখন বার্তা পাবার সংকেত দিলো। ফারিয়ার মেসেজ।

-অনিক ফিরেছে। আজ আমার বিয়ে। আর তুই বেহেয়ার মত না আসলেই খুশি হবো।


চার
রাত অনেক গভীর হয়ে ঢেকে নিয়েছে সব। বাইরের কোন কিছুই এখন আর দৃশ্যমান নয়। ঘন কুয়াশা জড়িয়ে রেখেছে। শহরের কোলাহল ঝিমুচ্ছে। শুধু হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটো রিকশা টুনটুন শব্দ করে চলে যায়। জোনাকির মত এক বিন্দু আলো সাথে নিয়ে।

একটা কামিনী গাছ একতলা এ বাড়ির অন্দর পাহাড়ায়। ফারিয়া জানলা ধরে সেদিকেই তাকিয়ে। ঘড়িতে দশটা বাজে। ঘড়ি অনুযায়ী এ বাড়িতে এখন খাবার সময়। পাশের ঘরে খাবার টেবিলে একটু পর পর কিছু রাখার শব্দ। সেই শব্দ ক্রমশ বিলীয়মান হয়েও এ ঘরে কিছুটা রেশ রেখে যায়।

ফারিয়ার মোটেও খেতে ইচ্ছে করছে না। এই হিম হিম বাতাসকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। কতবার শীতের মাঝে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে বেরানো। খুব কাঁপন ধরলেই হাতের মাঝে থাকা আরেক হাতকে শক্ত করে জরিয়ে ধরতো। গভীরে নিজেকে চেপে ধরতো। মাসুদ অবশ্য ফোড়ন কাটতো,
-এ্যাই, আস্তে। তোমার বুকের পাহাড় দুটো আমাকে ধাক্কা মারছে।
আচ্ছা ফাজিল একটা ছেলে। আর সব সময় হাসি যেন মুখে লেগেই থাকে।
কত শীতের দিন এভাবেই কত দ্রুত কেটে গেছে। রাস্তার ধারে ভাপা পিঠা খাওয়ায়, সর্ষে বাটায় চিতই, কিংবা গরম গরম জিলেপী। কখনো আইসক্রিম খাবার দুঃসাহস।

-কিরে এই রাত করে জানলা খুলে বসে আছিস কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো...
ফারিয়া মা’র গলা পেয়ে সরে বসে। আড়মোড়া ভাঙ্গে।
-উঠছি মা। এমন করো কেন! এইতো বসলাম। ভালোই তো লাগছিলো...
-থাক। অত রঙ করে ঠাণ্ডা লাগানোর দরকার নেই। দু’দিন পরে যার বিয়ে, ধাড়ি মেয়ে, তবু বুদ্ধি হল না! খেতে আয়। ভাত বারা হয়েছে।
মা’টা চিরকালই এমন। গলা উঁচু করে এত কথা না বলে শান্তি পায় না। ভাবল ফারিয়া। দু’দিন পরে বিয়ে? সত্যি! খুব করে সাজবে এবার। ফারিয়া ভাবতে ভাবতে উঠে পরে।


খেতে বসেছে সবাই। শুধু ফারিয়ার ছোট ভাই, রাজীব সবার আগে খেয়ে উঠে গেছে। ওর ঘর থেকে একটা ইংরেজি গানের বাদ্য-বাজনা ভেসে আসছে। কথাগুলো ঠিক কি বলছে ফারিয়া তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। ফারিয়া খাওয়ায় মন দেয়। মার হাতের ফুলকপি ভাজিটা অসাধারণ লাগে। দু’চামচ উঠিয়ে নেয় প্লেটে।

হঠাৎ করেই গানের আওয়াজটা বেড়ে যায়। ফারিয়া ঘার ঘুরিয়ে দেখে দরজায় রাজীব। গলা উঁচিয়ে রাজীব বলে,
-আপা তোর ফোন...
ফারিয়া মুখে খাবার নিয়েই জিজ্ঞেস করে,
-কে করেছে?
-জানি না। আননোন। তুই এসে দেখ। বলছে তো জরুরী...
-এত রাত করে কার এত জরুরী বায়না... হ্যাঁ...
ওপাশে মা খেঁকিয়ে ওঠে...
ফারিয়া পাত্তা না দিয়ে জবাব দেয়,
-আমি দেখছি তুই যা... আর সাউন্ড কমিয়ে ছাইপাঁশ শোন...

খাবার রেখেই ফারিয়া ফোন তুলে নেয়। ওপাশে ঘ্যারঘ্যারে বিশ্রী শব্দ।
-হ্যালো!
-ফারিয়া! আমি অনিক।


পাঁচ
বিয়ে বাড়ি সন্ধ্যের দিকে ঝিমিয়ে পড়েছিলো। ফারিয়া তখন সাজ-গোজ চলছে। সাতটার দিকে আবার জমে গেলো। বড় বড় সাউন্ড বক্সে প্রচণ্ড শব্দে হিন্দি ছবির গান বাজছে। ছেলে-ছুড়িরা নাচছে, চিৎকার করছে, গাইছে। বাড়ির মহিলারাও নিজেদের শেষ মুহূর্তে মেকআপে ঝালিয়ে নিচ্ছে। বুড়োদের দল তাদের গিন্নীদের ফাঁকি দিয়ে মিষ্টি চেখে দেখছে টপাটপ।

ফারিয়া আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো। সাজলে তাকে অসম্ভব রূপসী দেখায়। তখন আর অতিরিক্ত লম্বা চিবুকটা অত নজরে পরে না। এত উচ্ছ্বাসের মাঝেও গতরাতের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। মা কিছু টের পায়নি। তবে মনের মাঝে কেমন খঁচ খঁচ করে বিঁধছে। আজ আবার কোন অনর্থক হবে না তো!

রঙ্গিন দিনগুলোর কথা মনে মনে রটে যায় গোপনে। স্মৃতিগুলো উঁকি দিচ্ছিল বারবার। অনিক ফিরে এসেছে!
সেই সকাল করে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ যাওয়া। বাড়ির সামনে থেকে শিউলি কুড়িয়ে অনিকের বইয়ের মাঝে গুঁজে দেওয়া। অনিক প্রশ্ন নিয়ে তাকাত। ফারিয়া মাথা ঝুলিয়ে বলতো,
-রাতে আমার কথা মনে পড়বে তো... তখন এগুলোয় কাছে পাবে...

মাঝে মাঝে এ-ওর বাসায় আড্ডা। কখনো ক্লাস শেষে কোথাও ওড়া-উড়ি। অনিকের কথা শুনতে ভালো লাগতো। জীবনের কথা, ভাবনার কথা, লক্ষ্যের কথা। ও সাধারণ থাকতে চেয়েছিল। ফারিয়া নিজেও নিজেকে খুব সাধারণ একজনের সাধারণ বৌ হিসেবে কল্পনা করে নিতো। সুখের সংসার। নেদু-নেদু বাচ্চা কোলের মাঝে। অফিস ফেরত অনিক, হাতে বাজার। বুক-পকেটে ঠাসা চকলেট। ফারিয়া চকলেট খুব পছন্দ করে।
অথচ, সব কেমন হয়ে গেলো নিমেষেই।
ওই নোংরা মানুষিকতার মেয়েটির জন্য। ও নাকি প্রাণের বন্ধু ছিল! ছিঃ...
ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো ফারিয়ার। বুকের মাঝে তীব্র জ্বালা।

আয়নায় এখনো তাকিয়ে ও। ঢালা জড়িপাড়ওয়ালা জামদানি পরেছে আজ। গলায় সোনার হার, মাথায় টিকলি আর দুল, নথ এসব তো আছেই। হাত ভর্তি বর্ণালী চুড়ি। কপালে টিপ, চোখে আই-লাইনার আর শ্যাডো খুব মেপে লাগানো। ঠোঁট জোরা হালকা লাল।
এইটুকুতেই সে রাজকন্যা।

বাইরে হল্লা বেড়েছে। কেউ বর এসেছে, বর এসেছে বলে চিৎকার করছে। ফারিয়ার পাশের মেয়েরা, যার এতক্ষণ তাকে সাজানো ব্যস্ত ছিল, তারা উঠে গেলো বর দেখতে। ফারিয়া নিজেকে ভালোমতো দেখে নিলো। এই নিখুঁত সাজেও নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। মনের মাঝে তার কত প্রশ্ন নিজেকেই।
ফারিয়া কি পারতো না অনিককে ক্ষমা করে দিতে? ওর কি দোষ ছিল? শুধু শুধুই কি জেদের বশে ওকে অপমান করেনি? অনিক কি অপরাধ না করেও ক্ষমা চায়নি? পারলো না কেন ফারিয়া!
সুযোগ পেয়েই কি সাধারণের বৌ হবার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিলো! শুধু এই দিনটার জন্য!

বর বেশে মাসুদের মুখটা কল্পনা করলো একবার। সব গোছানো, সব কিছুতেই খুশির রঙ। শুধু চেনা মুখটাই নেই। সব আছে, শুধু কাছের মানুষটা পাল্টে গেছে।

রাত বেড়েছে। মেজাজটা ভালো ছিল না এমনিতেই। হঠাৎ আরেকটি ফোন এসে আরো এলোমেলো করে দিলো ফারিয়াকে। জয়ীর ফোন!
এদিকে বিয়ের কাজ শুরু হবে একটু পরেই। ফারিয়াকে নিয়ে যাবার তাড়া। ফারিয়া একমুহূর্ত ভাবল। তারপর সামনের শো-কেস থেকে ঝট করে ছবির এ্যালবামটা বের করে খুলে ফেললো একটানে। কলেজ জীবনের ছবি। অনিকের মিটিমিটি হাসি। সাথে ফারিয়া আর জয়ী।

তিন বন্ধুর গ্রুপ ফোটো। ফারিয়া আলতো করে সাবধানে জয়ীকে টেনে আলাদা করে নিলো। কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ল, দলা পাকাল। জানলার কাছে দিয়ে মুঠো খুলল। কুঁচি গুলোকে আলাদা করে ভাসিয়ে দিলো শূন্যে।

আর একটি কাজ বাকি।
সেলফোনটা তুলে নিলো ফারিয়া। জয়ীর নম্বরটা এখনো আছে। নম্বর পাল্টানোর মত মেয়ে নয় সে। খুব দ্রুত লিখে বার্তা পাঠাল,
-অনিক ফিরেছে। আজ আমার বিয়ে। আর তুই বেহেয়ার মত না আসলেই খুশি হবো।


একটু পর সানাইয়ের সুর বেজে উঠলো। ক্রমশ ভেতরে গেঁথে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ সুরটা। ফারিয়া মাথা নিচু করে বসে রইলো পাশের মানুষটার কাছে, কাছের মানুষের কাছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য বেশ ভাল লাগছে
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
জাকিয়া জেসমিন যূথী গল্পের ভেতরে অনেক ধোঁয়া ছড়িয়েছো , মাহী। আমি বুঝে পাইনা, এত পিচ্চি একটা ছেলে এত ভালো গল্প লিখে কি করে!! অ-সাম! জাস্ট অ-সাম!! একেবারে অনুভূতিতে মিশে গেলাম। খুব ভালো লেগেছে।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ আপু...
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
আপু, পিচ্চি কইলেন!!! আমার কিন্তু বিয়ের বয়স অনেক আগেই হইছে।
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম পন্ডিতের গল্পটা পড়লাম । জয়ীর মনের ঈর্ষাকে সংগতভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । সাবের ভাইয়ের মন্তব্যগুলো নিয়ে মন্তব্য করা দু:সাহস আমার নেই । তবে উনি যে আপনার একজন পরম বন্ধু সেটা ভেবে আমি ঈর্ষান্বিত হচ্ছি। আহারে আমার বাক্যচয়নের দুবর্ল দিক আর বানানের ভুলগুলো যদি উনার নজরে একটু আসত, না জানি কতই উপকৃত হতাম ।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
উনাকে আমি মামা বলে ডাকি। লিখে যান, কথা বলুন, পারস্পারিক মনের মিল হলে আপনার লেখার যোগ্য সমালোচনা পাবেন।
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ সাইফুল্লাহ অনেক সুন্দর হয়েছে |
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় খুব,খুব,ভাল লাগলো গল্পটি--গল্পের মাঝে মাঝে কাব্যিক সুরগুলি ঠিক টের পেয়ে যাচ্ছিলাম আমি।অনবদ্য ভাষার অলঙ্কার চখে পড়ছিল।কাহিনী নির্বাচনও বেশ ভালো লেগেছে,ভাই !গল্প ও কবিতা দুটোতেই আপনি সিদ্ধহস্ত সন্দেহ নেই।অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ তাপস ভাই
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
মামুন ম. আজিজ দারুন বুনট ...দারুন গল্পকার হয়ে উঠেছো....তারুণ্যের মানসিকতা মন গবেষণামূরক চিন্তার বাস্তবতা......বেশ গল্প
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৩
আহা... মন্তব্য পড়ে সাহসী হয়ে উঠলাম।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১৩
মিলন বনিক গল্প..কাহিনী বিন্যাস...আর ধারাবাহিকতা অত্যন্ত চমত্কার...খুব ভালো লাগলো মাহী ভাই...মনে হচ্ছিল যেন ছোট ছোট কথা মালার আদলে কবিতা পড়ছিলাম...আর সাবের ভাইয়ের ছোট খাটো বিষয়গুলো সহমত পোষণ করছি....
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ ত্রিনয়ন ভাই
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব ভালো লাগলো| বেশ সাবলীলভাবে এগিয়েছ, সমাপ্তিত একেবারে মুগ্ধ করেছে|
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ লাভ গুরু
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
Lutful Bari Panna এ কাহিনীর আবেদনটাই আলাদা রকমের...
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ ভাইয়া
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩
রোদের ছায়া ঈর্ষার কারণে কত কিছুনা ঘটে জীবনে , খুব ভালো লাগলো গল্পটি যদিও এর পরিনতি হয়ত সুখের না কিন্তু এটাই তো জীবন ...
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০১৩
ধন্যবাদ আপনাকে
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪