অমীমাংসিত গল্প

ঈর্ষা (জানুয়ারী ২০১৩)

সাইফুল করীম
  • ১৫
ঘরের বাইরে বের হলেই বরফ আর বরফ। এই ছুটির দিনগুলোতে রবির ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। এক রুমের ছোট বাসা- কবুতরের খোপের মত। কবুতর তবু এক ঘরে জোড়ায় থাকে- কিন্তু ও একা। তাই বলে মন খারাপ লাগে না। রবির ল্যাপিতে প্রচুর গান -বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সহ নাম না জানা অনেক ভাষার। আজ বাসায় ড্যানিয়েল আসার কথা। ড্যানিয়েল, রবির ভার্সিটির পরিবেশ বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের ল্যাবের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। রবি ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফোন করে তাকে।
-ড্যানি, তুমি কখন আসবে? আমি ত রেডি।

ড্যানিয়েলের গাড়ি আছে। আজ ফলের বাগান দেখার কথা ওদের। দুজনেই ব্যাচেলর, আর বাংলাদেশীদের মত ইন্দোনেশিয়ানরাও ভালই ঝাল খেতে পারে। তাই খাওয়া-খাদ্য তে জাপানিদের মত নাকউঁচু স্বভাব নেই বলে ওর সাথে রবির ভালই জমে। আর ছুটির দিন গুলোতে প্রায়ই বের হয় ওরা- দুজন বন্ধু।
-স্পেশাল ড্রিংক্স নিয়ে আসছি। আজ তোমার কিন্তু খেতেই হবে।
-আচ্ছা আসো আগে, তারপর দেখা যাবে।
রবি ফ্রিজ থেকে মুরগীর মাংস, আলুর চপ, পেঁয়াজ, ক্যাপ্সিকাম দেয়া গরুর ভুনা মাংস আর মাশরুম ভাজি বের করে গরম করতে থাকে। দেশে থাকতে কিছুই রান্না পারতো না ও। আর এখন দাওয়াত দিয়ে মানুষ খাওয়াতে পারে, ঠেকায় পরলে মানুষ কত কিছুই না করে।

রুমের কলিংবেল বেজে উঠে। নিশ্চয় ড্যানিয়েল।

দরজা খুলে পুরা টাশকি খেয়ে যায় সে। মিনি স্কার্ট পরা এক জাপানিজের সাথে ড্যানিয়েল। রবিকে দেখে মুচকি হেসে ড্যানিয়েল বলে ওঠে- দেখতো চলবে নাকি, আজ তোমার বার্থডে, সেলিব্রেট কর ম্যান।
-আসো, ভিতরে নিয়ে আসো।

রবির মাথায় তখন পারদ জমা হতে শুরু করেছে। জাপানে আসার পর কথায় কথায় মেয়ে কেন্দ্রিক ছ্যাকা খাবার বহু কথা সে ড্যানিয়েলকে বলেছে, তাই বন্ধুর জন্য বাজার থেকে “বিশেষ কন্যা” ভাড়ায় এনেছে। পরিস্থিতিটা কিভাবে ট্যাকল দেয়া যায়- ভাবতে থাকে সে।
-ড্যানি, আসো আমরা আগে খাবার টাবার খাই, ঘুরে আসি, তারপর যা একটা কিছু হয় দেখা যাবে।

ড্যানি সান্তোরি হুইস্কির পেল্লাই বোতলটা খুলতে খুলতে বলে- ইজুকি সান কে ১ঘন্টার জন্য এনেছি, কত খরচ হয়েছে জানো?
মেয়েটার নাম ইংরেজিতে বলায় পিট-পিট করে সে ড্যানির দিকে তাকিয়ে জাপানিজে বলে ওঠে- সব কিছু ঠিক আছে ত? কোন সমস্যা তোমাদের?
রবি বলে- দেখো ড্যানি, মেয়ে আনতে কী আমি বলেছি?

ঢকঢক করে দুই পেগের মত খেয়ে সে ইজুকির হাত ধরে রবির বেডে শুয়ে পরে আর শুধু বলে ওঠে- ফা......ইউ! লুজার! ইফ ইউ ডোন্ট ডু, দেন আই টেক কেয়ার অফ ইট। গো আউটসাইড অর ইঞ্জয়িং আওয়ারসেল্ভস।

লাইভ প্রোগ্রাম দেখার খুব আগ্রহ রবির। কিন্তু ইজুকি ঘটনাটা বুঝতে পেরে ওর বুকের ব্রাটা ড্যানির পরাক্রমতা থেকে কোন মতে বাঁচিয়ে শুধু মাথা দোলাতে থাকে উপর নিচ। তার মানে রবির ঘরে থাকা চলবে না।

ড্যানি চিৎকার দিয়ে লাল লাল চোখ দুটো নিয়ে বলে ওঠে- ম্যান, গেট আউট আদারওয়াইজ আই উইল কিল ইউ, আই মিন ইট।

রবি বুঝতে পারে ৪০% ইথাইল অ্যালকোহল ভাল ভাবেই কাজ করা শুরু করেছে। লাইটার আর সিগারেট টা নিয়ে তাড়াতাড়ি কোন মতে জ্যাকেট টা গায়ে দিয়ে বাইরে বের হয় সে। জীবনটা ঘেন্নায় ভরে ওঠে তার-নিজ গৃহে পরবাসী টাইপ অবস্থা। করুক শালা যতক্ষণ পারে, আজ অনেক রাত করে রুমে ফিরবে মনে মনে ঠিক করে।

সিনেমা দেখতে যাবে সে, কাছেই সিনেমা হল। এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুলে রওয়ানা দেয় সে। দেশে সিনেমা –টিনেমা দেখার সময় কী কেলেংকারীই না ঘটেছিল স্কুল লাইফে।

সবে ক্লাস টেনে ঊঠেছে সে। দাড়ি মোচ পুরোপুরি গজানো, তাই এক টিকিটে দুই সিনেমার টিকেট কাউন্টারে গেলে কেউ কিছু বলে না। হঠাৎ খুব বড় হয়ে যাবার আনন্দে ভাবটাই তখন অন্য রকম।

বেশি টাকা না থাকার জন্য স্টলের টিকেট নিয়েছে সে। সিনেমাগুলো দেখতে এত ভালো লাগত তখন পারলে সিনেমা স্ক্রিনের ভেতর ঢুকে যায় ও। স্ক্রিনের পরে দুই লাইন পরের সিটে বসেছে। সারা হলে তখন বিড়ি সিগারেটের কড়া ধোঁয়া। মুখে একটা রুমাল দিয়ে নিয়েছে যাতে কেউ পরিচিত না দেখে ফেলে এই ভয়ে। পকেট থেয়া ১টা নেভি বের করে পাশের একজনের কাছে আগুন চাইলে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে সে। ওদের ক্লাসের আজিজ স্যার-পিটির টিচার।সিগারেট ওখানেই ফেলে হল থেকে সোজা দৌড়ে বাইরে বের হয় ও।

পরেরদিন আজিজ স্যার পিটি ক্লাসে যতগুলো মেরেছিলেন ঠিক ততগুলো বকা দিয়েছিলেন- কিন্তু একা একা, আর এটাও বলেছিলেন যে এই ঘটনা যদি কাউকে বলে সে তবে টিসি দেবে নাকি রবিকে স্কুল থেকে। রবি হা-হু করে ছাড়া পেয়েছিল তখন। বোর্ডিং-এ আজিজ স্যারের পাশেই হেড স্যার থাকতেন। রবি শুধু চটির দোকান থেকে একটা চটি কিনে হেড স্যারের নামে কুরিয়ার করে যার প্রেরকের জায়গায় নাম লিখেছিল আজিজ স্যারের। বেচারা আজিজ স্যারের উপর ডোজটা এতই কড়া হয়েছিল যে স্কুল থেকে স্যারকে বাদ দেয়া হয়। আজিজ স্যার যেদিন বিদায় হলেন সেদিন রবির দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন- বেঁচে থাক বাবা, বহুদিন বেঁচে থাক।

সিনেমার নাম অ্যামাজিং স্পাইডার ম্যান। থ্রি-ডি মুভি। মাঝে মাঝে মাকড়শা মানুষটা এমন ভাবে লাফ দিচ্ছে যে আজিজ স্যারের কথাটা মিথ্যা মনে হচ্ছে ওর। মাকড়শার ঝাঁকিতেই যদি এই অবস্থা হয় তবে কী হবে? তবু বেশ ভালো লাগছে। আচ্ছা আজিজ স্যারের মত ড্যানির বাচ্চাটার কিছু করা যায় না- ভাবতে থাকে। মাথার ভেতরে মাকড়শার মত জাল বুনছে সে। এক ঢিলে দুই পাখি মারবে-স্যরি এক ঢিলে একটা পাখিই মারবে সে।

ঘটনাটা সাজানো যাক এই ভাবে-
বাসায় ফিরে প্রথমে ড্যানিকে ফোন দেবে, যদি না ধরে ওর বাসায় যাবে। বলবে তার বাসা থেকে একটা জিনিস হারিয়েছে সে, সে দেখেছে নাকি। খুব হই-চই করবে যাতে পাশের ফ্লাট থেকে কমপ্লেন করতে আসে। রবি এমন কথা বলবে যে ড্যানি রেগে ওকে মারতেই আসবে। এটাই দরকার। সবার সামনে মারলে জাপানিজরা পুলিশ নিয়ে আসবে- ওকে ধরবে, আর সাক্ষী দেবে যে রবি কিছুই করে নাই। মাথার ভেতরে এত বুদ্ধি দেখে সে নিজেকেই চুমা খায় স্পাইডার ম্যানের নায়িকার মত শূন্যে। স্মোকিং জোনে গিয়ে সিগারেট খেয়ে প্রবল উত্তেজনায় আর সিনেমা দেখতে ভালো লাগে না ওর।

রাত তখন প্রায় নয়টা, কিন্তু পথ-ঘাট গুলো পুরোপুরি শূন্য- চারদিকে আবারো সেই বরফের খনি। বাসায় ফেরার পথে কম্বিনি স্টোর থেকে ওনিগিরি (তিনকোনা ভাতের দলা টাইপ খবার, ভেতরে টুনা মাছ থাকে), রিংগো স্টু (আপেলের সাথে পাউরুটি) খেয়ে নেয়।

বাসায় ফিরে দেখে রুমের লাইট তখনো জ্বলছে। স্টোভ জ্বালানো আছে- ঘরে সিগারেট, মদ, আর তেলের পোড়া গন্ধ- সব মিলিয়ে দম বন্ধ করা পরিবেশ।

ড্যানিয়েল হা করে ঘুমুচ্ছে, ইজুকি কখন চলে গেছে আল্লাই জানেন।
রবি গা ধরে ঝাকাতে থাকে ওর।
হুড়মুড় করে উঠে বসে ড্যানি। তারপর খানিক ধাতস্থ হয়ে বলে- আসো কিছু খেয়ে নিই, রাগ করেছো খুব না?

রবির মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় ওর ন্যাকামি দেখে। কিছু না বলে আবার খাবারগুলো গরম করতে থাকে আর চিন্তা করতে থাকে ব্যাটাকে সাইজ করা গেলো না এবার, কিন্তু আবার যদি এইরকম করে?

ড্যানি ঐ অবস্থাতেই খেতে বসে রবিকে না ডেকেই। খাওয়া-দাওয়ার মাঝে শুধু জাপানিজ কায়দায় বলতে থাকে- খুব স্বাদের খাবার, অনেক মজা!

হঠাত রবির মনে হয় সালাদ করতে ভুলে গেছে ও।টমাটো আর হাক্সেই (এক ধরনের বাঁধাকপি) কেটে সালাদ করতে বসে। ড্যানি একটু আস্তে খাও, আমি সালাদ বানাচ্ছি।–রবি বলে। হঠাত ড্যানি চোখে প্রায় পানি এনে বলতে থাকে- তুমি ত দেখি আমার মায়ের মত, কিছুই করতে পারো না ঠিক মত......হা হা হা।

রবির আর চুপ করে থাকা চলে না- তুমি যত ইচ্ছা মেয়ে নিয়ে আসবা আজ থেকে যা ইচ্ছা করবা আমার রুমে, সমস্যা নেই বুঝেছো? কিন্তু দোহাই লাগে ফ্যামিলি-ট্যামিলি নিয়ে কিছু বলো না।

ড্যানি গরুর মাংস খেতে খেতে শুধু মাথা ঝাঁকায়, পরম তৃপ্তিতে খেতে থাকে।

এই বরফ ঝরা রাতে রবির ভেতরেও তুষার পরছে। সেই তুষার স্থান-কাল-পাত্র বোঝেনা, আগুন চেনে না। তুষার যদি আগুন হয়ে যায় তবে উষ্ণতাবোধ হবে না শুধুই পুড়ে দেবে- এতসব চিন্তা করতে করতে ড্যানিকে বলে ওঠে রবি- আর একটু ভাত দেবো?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য চমৎকার বুননে অসাধারণ মানবিক একটা গল্প যেখানে ভৌগলিক আর আত্মীয়তার সীমা পেরিয়েছে মানবিক প্রেম ভালবাসা।
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১৩
রোদের ছায়া ঈর্ষা করতে চেয়েও না পারা বেশ ভালো মানুষ বেচারা রবি । আপনার গল্পের বর্ণনা খুব ভালো লাগলো। খুব বেশি নাটকীয়তা না থাকলেও সুন্দর গল্প । শুভকামনা ।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১৩
তাপসকিরণ রায় ভালো স্ট্যান্ডার্ডের গল্প।ভাবনার সুন্দর পরিবেশনা।শেষ কটি লাইনে লেখক কাব্যিক ভাবে ডুবে গেছেন।অনেক ধন্যবাদ লেখককে।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব সুন্দর গল্প, সুনিপুন উপস্থাপনায় লেখক নিজেকে বলিষ্ঠ হিসেবে প্রমান করেছেন| অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো|
ভালো লাগেনি ১৯ জানুয়ারী, ২০১৩
মিলন বনিক সুন্দর গল্প...প্লট নির্বাচন আর ধারাবাহিকতা....খুব ভালো লাগলো....অনেক শুভেচ্ছা সাইফুল ভাই...
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩
মোঃ সাইফুল্লাহ ভাল লাগল। ধন্যবাদ। ।ভাল থাকুন।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩
পন্ডিত মাহী গল্পের প্রথম দিকের তুলনায় শেষের দিকটা বেশী আকর্ষন করলো। এক কথায় ভালো গল্প। (অনেক আগে পড়েছিলাম, কমেন্ট আজ করলাম)
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩
স্বাধীন এত অসাধারণ একটা গল্প পড়তে বেশ দেরিই হয়ে গেল ভাই। এক টিকিটে দুই ছবি আর আজিজ স্যার হেড সারের ঘটনায় ফিক করে হেসে দিয়েছি। ঘরটাকে নোংরা করায় মর্মাহত হয়েছি, আবার যখন হঠাৎ করেই ড্যানি তার মায়ের সাথে রবিকে মিলিয়ে নিল খুব আবেগাপ্লুতও হয়েছি। অসম্ভব ভাল লাগল গল্পটা................ দু:খ বোধও হচ্ছে পাঠক কম দেখে।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩
আহমেদ সাবের ড্যানিয়েলের প্রতি ঈর্ষা কি দারুণ ভাবে অনুকম্পায় পরিণত হয়ে গেলো, লেখার যাদুকরী কুশলতায় - "ড্যানি একটু আস্তে খাও, আমি সালাদ বানাচ্ছি।"। অসাধারণ একটা গল্প। শেষ দুটো লাইন অনেকদিন মনে থাকবে।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০১৩
এশরার লতিফ সুন্দর গল্প, শুভেচ্ছা রইলো.

২১ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী