এক
ঘন্টাখানেক আগেই অনুপম বাড়ী ফিরেছে। মুখটা বেশ খুশী খুশী দেখাচ্ছে। মনে হয় গত কয়েকদিনের টেনশন থেকে ও মুক্তি পেয়েছে। টেনশনটা ছিল ওর একটা ফেলোশিপের ব্যাপারে। কদিন থেকেই শুনছিলাম ওকে ছয়মাসের জন্য ইংল্যান্ড যেতে হবে। কিন্তু ও কোনভাবেই চাচ্ছেনা ফেলোশিপটা নিয়ে দেশের বাইরে যেতে। সরকারী চাকুরীর ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ। আমি অত কিছু বুঝিনা অবশ্য। অনেকদিন দেশের বাইরে থাকাতে দেশের অনেক আইন কানুন সম্পর্কেই আমি অন্ধকারে আছি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে, “ তুমি বিদেশী মানুষ, তুমি বুঝবেনা আমাদের ব্যাপার স্যাপার’। তাই এই ফেলোশিপের ব্যাপারেও আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি অনুপম চাইছেনা ছয় মাসের জন্য বাইরে যেতে। অনুপম আমার ছোট ভাই। আমরা চার ভাই এক বোন। অনুপম সবার ছোট। আমাদের বড় তিন দাদার মধ্যে দুই দাদা থাকেন কানাডাতে। আমি থাকি আমেরিকাতে। সেজদা ও অনুপম থাকে দেশে। তবে আমাদের সেজদা বাবা মায়ের সাথে না থেকে কাছাকাছি আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। সেজদা বিবাহিত জীবনে খুব একটা সুখী নয়। ভালো চাকুরী করে, একটা মাত্র ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। সেজদা চায়না তার দাম্পত্য অশান্তি বাবা মা’কে কোনভাবেই কষ্ট দিক। তাই এভাবে আলাদা থাকা। তবে সেজদা প্রতিদিন সকাল বিকাল আসে বাবা মা’কে দেখতে। আর অনুপম তার স্ত্রী নীতাকে নিয়ে বাবা মায়ের সাথেই থাকে। অনুপম ও নীতার একছেলে, নাম অরিত্র। নিজের নামের আদ্যক্ষরের সাথে মিল রেখেই অনুপম ছেলের নাম রেখেছে অরিত্র। অরিত্রর বয়স গত অক্টোবর মাসেই বারো পার হয়েছে। কিন্তু ওর বুদ্ধি ডেভেলপ করেনি। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে মানসিক প্রতিবন্ধী, অরিত্র অনেকটা সেই ধরনের। কিন্তু অনুপমের নয়নের মনি হচ্ছে অরিত্র।
অরিত্র আর দশটি বাচ্চার মত সুস্থ স্বাভাবিক নয়। ওকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা চলে, কিন্তু বলতে পারিনা। ছেলেকে কেউ কিছু বললে অনুপম খুব কষ্ট পায়। এদিকে অনুপমকে কষ্ট পেতে দেখলে আমাদের মন ভেঙ্গে যায়। অনুপম আমাদের সবার আদরের। ছোটবেলা থেকেই ও খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের। পড়ালেখাতেও ও অসম্ভব ভাল ছিল। আমাদের সব ভাইবোনের রেজাল্ট ভাল, তবে অনুপমের রেজাল্ট যেনো সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আমার বাবা সব সময় বলতেন, শেষ বয়সে অনুপমকে সাথে করে ‘তেলেভাজার’ দোকান খুলবেন। আমরা সবাই যখন বাবা মা’কে ছেড়ে দূরে চলে যাব, তখন অনুপম হবে বাবার অন্ধের যষ্ঠী। আমরা সবাই খুব হাসাহাসি করতাম বাবার এমন কথা নিয়ে। কিন্তু অনুপমকে নিয়ে তেলেভাজার দোকান খোলার বাসনা পূর্ণ না হলেও বাবার একটা আশংকা সত্যি হয়েছে। অনুপম বাদে আমরা বাকী সবাই বাবা মা’কে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছি। সেজদাটা যদিও কাছাকাছি থাকে তবুও সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে বাবা মায়ের সাথে একটু দূরত্ব রেখেই চলে। মন মানেনা বলে অফিসে যাওয়ার আগে একবার, অফিস থেকে ফিরে একবার বাবা মায়ের সাথে দেখা করে যায়। এটুকুর জন্যও সেজদাকে অনেক চড়া মাশুল দিতে হয়। তেলেভাজার দোকান না খুলেও অনুপমই শেষ পর্যন্ত বাবা মায়ের সাথে থেকে গেছে। বিদেশ যাওয়ার কত রকম সুযোগ এসেছিল অনুপমের হাতে, অনুপম যায়নি। আমাদের বাবা আগাগোড়া খুব আবেগপ্রবণ একজন মানুষ। ছেলেমেয়েকে কখনও কাছ ছাড়া করতে চাননি। আমাদের দুই দাদার শশুরবাড়ীর লোকজন বিদেশে থাকে বলেই স্ত্রীদের সুবিধার্থে এবং অবশ্যই বিদেশে আরও ভালো সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশাতেই তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আমি একমাত্র মেয়ে হলে হবে কি, বিয়ে যখন হয়েইছে তখন স্বামীর ইচ্ছেতেই চলতে হবে জেনেই স্বামীর সাথে আমেরিকাতে যেতেই হয়েছে। আর সেজদার কথাতো বললামই। একমাত্র অনুপমই নিজের ইচ্ছে, নিজের সিদ্ধান্ত মতই বাবা মা’কে জড়িয়ে আছে। এমন একটি ভাই কজনের থাকে! আমরা মনে মনে সব সময় অনুপমের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। আবার অপরাধবোধেও ভুগি। কারণ আমরা জানি, অনুপমের ভবিষ্যৎ অনেক বেশী উজ্জ্বল হতে পারতো যদি ও আমাদের মতই দেশের বাইরে চলে আসতে পারত। তবে আমরা যতই আফসোস করিনা কেন, অনুপম কিন্তু খুব খুশী বাবা মায়ের সাথে থাকতে পেরে। হয়তো ওর মনে এক ধরনের সুখ আর তৃপ্তিবোধ কাজ করে, যখন ভাবে বাবা মায়ের প্রতি ওর দায়িত্ব পালন করতে পারছে। আমরা সেই সুখ বা তৃপ্তিবোধ থেকে বঞ্চিত।
আমাদের অপরাধবোধের আরেকটি কারণ হচ্ছে ‘অরিত্র’। অরিত্র যদি আর দশজন বাচ্চার মতই স্বাভাবিক হতো তাহলে আমাদের এত বেশী খারাপ লাগতোনা। আমরা ভাইবোনেরা এখনও ভেবে পাইনা, অনুপমের সন্তানটিই কেনো এমন হতে গেলো! ওর মত এমন ভালো একটি ছেলের ঘরে কেনো একটি সুস্থ সন্তান জন্মালোনা! রাস্তাঘাটে যখনই গরীব দুঃখী মহিলাদের কোলে সুস্থ সবল বাচ্চা দেখি, আমার বুকের ভেতর কান্নাগুলো উথলে উথলে উঠে। নীতার জন্য মনটা খারাপ হয়। নীতা খুবই ভালো একটা মেয়ে। ভালো মেয়ে না হলে অনুপমের ইচ্ছের কাছেই বশ্যতা স্বীকার করতোনা। আমাদের অন্য বৌদিদের মতই নিজের স্বার্থ বুঝে স্বামী নিয়ে সটকে পড়তো। স্বামী স্ত্রী দুজনেই এতো ভালো, অথচ ওদের ভাগ্যেই কিনা অরিত্রর মত অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু লেখা ছিল!
দুই
অরিত্রের জন্মের সময় আমি দেশেই ছিলাম। নীতার মধ্যে গর্ভাবস্থায় কোন অসংগতি দেখা যায়নি। খাওয়া-দাওয়াতে কোন অরুচি ছিলনা, চলাফেরাতে কোন অসুবিধা ছিলনা, দিব্যি সুস্থ সবল ছিল গর্ভকালীন সময়টাতে। আমাদের পরিবারে একমাত্র আমার কোন পুত্র সন্তান নেই। বড় তিন ভাইয়ের সকলেরই একটি করে ছেলে এবং বড়দার একটি মেয়েও আছে। তবে ওরা অনেকদিন দেশের বাইরে থাকে বলে বড়দার মেয়ে পিউলীর কথা কারো মাথায় আসেনা। আমার ছেলে নেই বলে একটু যে মন খারাপ হয়না তা নয়, তবে মনকে সান্ত্বনা দেই এই বলে যে, আমাদের পরিবারে আমার মেয়েদের স্থান আলাদা। কোন ভাগীদার নেই। আর তাই অরিত্র যখন জন্মালো, প্রথমেই আমি বলে ফেলেছিলাম, “ ভালোই হয়েছে, আমার মিষ্টি আর তুষ্টির জায়গাটা কেউ নিতে পারবেনা”। অরিত্রর জন্ম হয়েছিল সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে। অরিত্রকে প্রথম যখন কোলে নিলাম, আমার কেমন যেনো একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কেউ খেয়াল করেনি অরিত্রর মাথাটা খুব বড় ছিল, হাত পা ছিল কাঠি কাঠি। ঘরে এসে মা’কে বলতেই মা বলেছিলেন আমার বড়দার মাথাও নাকি বড় ছিল। কাজেই এটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
অরিত্র নামটি অনুপমের রাখা। অনুপমেরও কিন্তু খেয়াল হয়নি অরিত্রর মাথা বড় হওয়ার ব্যাপারটা। তাছাড়া অরিত্র নবজাতকদের মত তারস্বরে ওঁয়া ওঁয়াও করতোনা, কেমন যেনো কুঁই কুঁই করে কাঁদতো। আমি ছাড়া আর কেউ এই ব্যাপারগুলো খেয়াল করেনি। নতুন বাচ্চা নিয়েই সকলে ব্যস্ত ছিল। অনুপমতো মহাখুশী অরিত্রকে পেয়ে। তবে খুব বেশী চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে অনুপমের খুশী বা কষ্ট, কোনটাই বাইরে থেকে বুঝা যায়না। আমরা ভাই বোনেরাই শুধু বুঝতে পারি ওর ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপারগুলো। যাই হোক, অনুপম আর নীতাকে খুশী দেখে আমিও ভুলে গেছি অরিত্রর অসঙ্গতির ব্যাপারটা। তবে পাঁচ ছয় মাস বয়সেও যখন অরিত্রর ঘাড় শক্ত হচ্ছিল না আবার আমার মাথায় সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করলো। আমি বলেছিলাম ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই ডাক্তার বলেছিল আর কিছুদিন দেখতে। নয়মাস বয়সেও অরিত্র বসতে শিখেনি, সবাই ধরে নিয়েছে ওকে কোলে কোলে রাখার কারণেই ও বসতে শিখেনি। অনুপমতো আরেক ডিগ্রী উপরে, সে বলতে লাগল, “ অরিত্রর মাথাটা একটু ভারী বলে বসতে অসুবিধা হয়, তবে মাথা বড় হয়েছে বলে চিন্তার কিছু নেই, পৃথিবীর যত মহাজ্ঞানী পণ্ডিত আছে সকলের মাথাই বড়। আমার অরিত্র বাবু বড় হয়ে অনেক বড় পণ্ডিত হবে”। আমি আবার অনুপমের কথায় একটু ভরসা ফিরে পাই। কারণ অনুপম ফালতু কথা বলেনা। ও একাউন্টিং এর নামকরা অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসোসিয়েট প্রফেসার। ছাত্রছাত্রীদের কাছে অসম্ভব প্রিয় একটি নাম। কাজেই ওর কথারতো একটা দাম থাকবেই। তবে দুই বছর বয়সেও যখন অরিত্র হাঁটতে শিখেনি তখন আমি নাছোড়বান্দা হয়েই শিশু ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে গেলাম। আমি ডাক্তারি পড়িনি ঠিকই, তবে মানুষের রোগের উপসর্গ ও উপশম নিয়ে অনেক পড়াশুনা করি, এটা আমার একটা নেশা। আমি সাথে যাওয়াতে অরিত্রর জন্মের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত যা কিছু অসঙ্গতি দেখেছি, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেছি। নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে জানা গেলো অরিত্রর ব্রেইনে অনেক ‘ড্যামেজ সেল’ আছে। এই কারণেই অরিত্রর বৃদ্ধি খুব ধীরলয়ে হচ্ছে। এবং এর কোন চিকিৎসা নেই। শুধুমাত্র বিদেশে যেতে পারলে কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। কারণ ওখানে ‘স্পেশাল চাইল্ড’ এর জন্য স্পেশাল স্কুলে নানারকম এক্টিভিটি থাকে, সরকারী অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। জীবনে কারো সাহায্য ছাড়াও বেঁচে থাকা যায়। বাবা মা’কে খুব একটা বেগ পেতে হয়না।
তিন
অনুপম অনেকবার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু একটা সুযোগও ইচ্ছে করেই কাজে লাগায়নি। মুখ ফুটে না বললেও সবাই বুঝতাম বাবা মা’কে ছেড়ে যেতে চায়না। নীতাকে আর অরিত্রকে সাথে করে বিদেশ চলে গেলে বাবা মা একা হয়ে পড়বে। তাছাড়া আমি যতই আহাজারি করিনা কেন, বাবা মা, অনুপম বা নীতা কেউই অরিত্রর ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিয়েছিল বলে মনে হয়না। সবার ধারনা ছিল, আরেকটু বড় হলেই অরিত্র ঠিক হয়ে যাবে। অরিত্র কথা বলতে শুরু করে অনেক বড় হয়ে। তাও খুব অস্পষ্ট উচ্চারণে। কেউ কিছু বলতে বললে সেটাই শুধু বলতো। নিজে থেকে কথা তৈরি করতে পারতোনা। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, অরিত্র শুধু তার বাবা আর মা ছাড়া আর কারো সাথেই কম্যুনিকেট করতোনা। অরিত্রর যখন তিন বছর বয়স, আমি চলে আসি আমেরিকাতে। আমি আসার সময় আমার বাবাকে আর নীতাকে খুব ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, আমার বাবা এবং নীতা বুঝতে পেরেছে অরিত্রর সমস্যা আছে এবং আমি চলে আসার সাথে সাথে তারা বিরাট এক অবলম্বন হারাতে চলেছে।
যাই হোক, আমেরিকাতে এসে আমি অনেক ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছি অরিত্রকে নিয়ে। সকলেই এক কথাই বলেছে, ওর স্পেশাল এডুকেশন দরকার। কিন্তু কাকে কি বলবো! এক সময় বুঝতে পারি, অনুপম খুব বিরক্ত হয় অরিত্রকে নিয়ে কিছু বললে। ও নিজেই অরিত্রকে সারাক্ষণ তার মায়ার বাঁধনে ঘিরে রাখে। এই ধরনের বাচ্চারা বয়স বাড়ার সাথে সাথে মোটা হতে থাকে। আমাদের অরিত্রও মোটা হতে শুরু করেছিল চার বছর বয়স থেকেই। অরিত্র বাথরুমে যাওয়ার কথা বলতে পারতোনা। যখন তখন যেখানে সেখানে ‘হিসি’ করে দিত। রাতে সাত আটটি কাঁথা ভিজাতো। আমার আদরের ভাই অনুপম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই সমস্ত কাঁথা, অরিত্রর জামা কাপড় নিজে হাতে ধুয়ে রোদে মেলে দিয়ে যেত। ও এই কাজটা করতো যাতে করে কেউ অরিত্রকে নিয়ে কোন মন্তব্য করার সুযোগ না পায়। বাড়ী ফিরলেই অরিত্রকে কোলে নিয়ে আদর করে ভরিয়ে দিত। অরিত্র মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। অনুপম রোজ সকালে বাজার থেকে ভালো ভালো মাছ নিয়ে আসে, বাবার জন্য আর অরিত্রর জন্য। তাছাড়া অরিত্র ঘরেই থাকে বলে ওর জন্য কম্পিউটার কিনে এনেছে। আগে ওকে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু অন্য বাচ্চারা ওকে নিয়ে মজা করতো, ধাক্কা দিত বলে অরিত্র স্কুলে যেতে চাইতোনা। নীতা প্রতিদিন ওর সাথে স্কুলে গিয়ে বসে থাকতো। আমাদের শহরে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কোন সুব্যবস্থা নেই বলে প্রতিবন্ধী শিশুরা অসহায়ের মত ঘরের মধ্যেই থাকে। তবে ওরিত্রর বেলাতে তা ঘটেনি, আমার মা একসময় স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। উনার খাতিরে অরিত্রকে স্কুলে ভর্তি নিয়েছিল ঠিকই, তবে ও যেহেতু নিজে থেকে কিছু পড়তে বা বলতে পারেনা, দুই বছর পর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল আর রাখতে চাননি অরিত্রকে।
অরিত্রর বাবা কত ছাত্রকে পড়িয়ে মানুষ করছে অথচ নিজের ছেলের বেলাতে কিছুই করতে পারছিলনা। নীতার কাছে যখন শুনেছে প্রিন্সিপ্যাল ‘না’ করে দিয়েছে, অনুপমের মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেছে। নীতাকে আড়ালে কি বলে সান্ত্বনা দিয়েছে জানিনা, তবে ঘরে রেখেই অরিত্রকে পড়াতে বলেছে। টিচার রেখে দিয়েছে, কিন্তু টিচার শুধু আসে আর যায়। যা কিছু করার নীতা আর অনুপম মিলেই করে। অনুপম দেখেছে কম্পিউটারে থাকলে অরিত্র ভালো থাকে। তাই প্রচুর গেম কিনে নিয়ে আসে প্রতিদিন। অনুপমের রোজগার ভালোই, খরচও ভালোই করে। প্রতিবন্ধী বলে অরিত্রর ব্যাপারে ও একটুও হেলা ফেলা করেনা। বরং বাচ্চাটা অসহায়, নির্বোধ বলে ওকে আরও অনেক বেশী যত্ন করে। এইজন্যই যতই প্রতিবন্ধী হোক না কেনো, অরিত্র কিন্তু বাবাকে চোখে হারায়। অনুপম যদি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরতে একটুও দেরী করে অমনি অরিত্রও কথা ভালো করে বলতে না পারলেও ‘বাবা আসবে’ বাবা আসবে’ বলতে থাকে।
আমি আর আমার দুই দাদা প্রায় প্রায় দেশে ফোন করে অনুপমকে বলতাম, “ অনু এভাবে কতদিন, চলে আয়। অরিত্রকে এখানে নিয়ে এলে দেখবি অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে”।
অনুপম আমাদের ফোন রিসিভ করতোনা শেষের দিকে। মা’কে বলে দিয়েছিল, আমরা ফোন করলে যেনো ওকে না চাই। আমার দুই দাদা একটু কষ্ট পেয়েছিল মনে কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনুপমের অনুভূতির ব্যাপারটা। অনেক পরে অনুপম আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল, ওখানে অন্য অনেক কথার পাশাপাশি অরিত্র সম্পর্কে লিখা ছিল “ তোমরা সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসো। আমার ভালো চাও, তা আমি জানি। কিন্তু অরিত্র প্রসঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগেনা। সেই জন্যই আমি তোমাদের ফোন ধরিনা। দেখো, অরিত্র সম্পর্কে আজকে খোলাখুলি কিছু কথা বলি। এরপরে আমাকে অরিত্রকে নিয়ে আর কিছু বলোনা। এখানে অরিত্র দাদু ঠাকুমার আদর পাচ্ছে, পাড়া প্রতিবেশীর আদর পাচ্ছে, তাতেও যখন হচ্ছেনা তখন বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে শুধুমাত্র ট্রেইনারের কাছে থেকে আর কি হবে। ট্রেনিং পেয়ে ও যেটুকু শিখবে, তার জন্য আমি বাচ্চাটাকে সকলের আদর থেকে বঞ্চিত করবো? আমার কপালে ভগবান যাকে রেখেছেন, আমি আমার সাধ্যমতই তার জন্য কাজ করে যাবো। আমি আমার বাবাকে ফেলে কোথাও যেতে পারবোনা। বাবা তাঁর নিজের জীবনটা ক্ষয় করেছেন আমাদের জন্য। নিজে কত কষ্ট করেছেন, সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্য পাননি জীবনে, তবু আমাদেরকে কত যত্নে মানুষ করেছেন। এখন বাবার বয়স হয়েছে, তোমরাও কেউ কাছে নেই। সেজদাটার জীবনে নাই শান্তি, এখন তোমরাই বলো, আমি চলে গেলে এই বৃদ্ধ বয়সে একা একা কিভাবে থাকবে বাবা? তোমরা কি জানো, যতবার আমার ফেলোশিপের জন্য কাগজপত্র আসে, ততবার আমি না করে দেই। কারণ ফেলোশিপের কথা শুনলেই বাবার মুখটা শুকিয়ে যায়। কেমন দিকহারা মানুষের মত লাগে। আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়। আমার অরিত্রতো কোনদিন স্বাভাবিক হবেনা, বাবাকে ফেলে যেতে পারতাম যদি কেউ গ্যারান্টি দিতে পারতো অরিত্রর ব্যাপারে। সেই জন্যই আমি বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবিনা। আমি কি অরিত্রর জন্য কম ভাবি? আসলে এটাতো ভাগ্য, তাইনা? নাহলে আমার ঘরে কেনো এমন অসম্পূর্ণ এক শিশু জন্মাবে! যে শত চেষ্টাতেও অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, হয়তো একটু উনিশ বিশ হতে পারে বিদেশ গেলে, কিন্তু আমার বাবাতো আমাকে পাবেনা। আমাকে নিয়ে তেলেভাজার দোকান দিবে বলেছিল বাবা, আমার মনের মধ্যে সেটা এখনও ঘোরে। কতটা ভরসা করেছিল আমার উপর, আমি কি করে আমার বাবাকে ফেলে চলে যাব সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের আশায়! তবুও আমার অরিত্র সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারলে আমি ভেবে দেখবো”।
এরপর থেকে আমরা অনুপমকে আর খোঁচাখুঁচি করিনা। তবে আমি যখন আমেরিকার সিটিজেনশীপ পেয়ে গেছি, তখন ভয়ে ভয়ে একদিন অনুপমকে ফোনে বলেছি, “ অনু, আমরাতো অরিত্রকে নিয়ে আর তোকে বিরক্ত করিনা। তবে আমাদের বাবা মা তো অমর নয়, আমরাও কেউ অমর নই। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তেমন কোন সুযোগ সুবিধাও নেই। আমি যদি তোকে স্পন্সর করি, সেটা প্রসেস হতে হতেও সাত আট বছর লেগে যাবে। ততদিন বাবা মা বেঁচে থাকলে আমরাই বাবা মায়ের ব্যবস্থা করবো সবাই মিলে। তাছাড়া এখন সবাই অরিত্রকে ভালোবাসে, আমার মেয়েরা তো অরিত্রকে চোখে হারায় কিন্তু আমার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে ওরাই কি অত খোঁজ রাখতে পারবে অরিত্রের ব্যাপারে। কিন্তু তোরা এখানে চলে এলে আমরা যদি নাও বেঁচে থাকি, সরকার থেকেই স্পেশাল শিশুদের রক্ষনাবেক্ষনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। তুই অমত করিসনা। আমাকে এপ্লাই করতে দে। আমাদের মনের ভেতরটাওতো জ্বলেরে! বুঝিসনা কেনো”?
এই প্রথম অনুপম মাথা নোয়ালো। এপ্লাই করতে গেলে যত ডকুমেন্টস লাগে তার সবকিছু জোগাড় করে আমাকে পাঠালো। আমিও এপ্লাই করে দিলাম। চলতে থাকুক প্রসেসিং। মনের মধ্যেতো একটু শান্তি পেলাম এই ভেবে যে আমাদের অনুপম রাজী হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আমি মানুষের মনের ভাব বুঝতে পারি। সেইজন্যই ওকে ‘সাত আট’ বছর লাগার কথা বলেছি, সাথে বাবা মায়ের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেবো বলেছি। আমার উপর অনুপমের অনেক আস্থা আছে, সেই জন্যই আমার কথায় সম্মত হয়েছে।
চার
তা আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছেই জানতে পেলাম, অনুপম সাত সকালে হোম মিনিষ্ট্রিতে গিয়েছিল যদি কোনভাবে বাইরে যাওয়ার অর্ডারটা ক্যান্সেল করা যায়। ফেলোশিপের ব্যাপার, কিভাবে এটা মিনিষ্ট্রি থেকে ক্যানসেল করা যায় তা আমি অবশ্য বুঝিনি। তা অনুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে ক্যানসেল করাতে পেরেছে। গতবারও আমি যখন দেশে এসেছিলাম, অনুপম দুই মাসের জন্য ইংল্যান্ড গিয়েছিল। কিন্তু সেবারও যাওয়ার আগে থেকেই ওর মন খারাপ ছিল। কিন্তু আমরা সকলে ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়েছিলাম। দুই মাস শেষ হতেই অনুপম দেশে ফিরে এসে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনদিন ও অরিত্রকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। দুইমাস ও ভালো করে খায়নি, ঘুমায়নি। ওর নাকি মনে হয়েছে ‘বাবা’কে না পেয়ে অরিত্র বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলবে। কারণ বাবা প্রতিদিন অরিত্রর জন্য কম্পিউটার গেম এনে দিত, কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে কম্পিউটার ঠিক করে দিত। মাঝে মাঝে অরিত্রকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেত। এগুলো তো আর কেউ করে দেওয়ার নেই। এগুলো না পেলে অরিত্রর মাথা গরম হয়ে যায়। ভীষণ মারমুখী হয়ে উঠে।
একবার কারেন্ট চলে গেছিল সারা দিনের জন্য, অরিত্র কম্পিউটারে বসতে পারছিলনা। অনুপম ডিপার্টমেন্টে গেছিল কিছু একটা জরুরী প্রয়োজনে। আমার বাবা তাঁর ঘরেই দরকারি কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। এর মধ্যেই অরিত্র পেছন থেকে গিয়ে হঠাৎ করেই তার দাদুকে ধাক্কা মারতেই দাদু তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। বাবার মাথাটা টেবিলের কোনায় প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেতেই বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাসায় পুরুষমানুষ কেউ ছিলনা। নীতা আর আমার মা দুইজনে ধরাধরি করে বাবাকে বিছানায় তুলতে গিয়ে হাঁফয়ে উঠেছিল। তারপর ডাক্তার ডাকার কেউ নেই, সেজদাকে অফিসে ফোন করেছে, সেজদাও পড়িমরি করে ছুটে এসেছে। প্রতিবেশী এক ছেলেকে ধরে কয়ে ডাক্তার আনিয়েছিল মা। ডাক্তার দেখে বলে গেছিল চব্বিশ ঘণ্টা ওয়াচে রাখতে। সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। বাবার জ্ঞান ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু ঘটনাটা আমাদের সবার মনে দাগ কেটে গেছিল। আর অনুপম? অনুপমের মনের কথা আমি পড়তে পারি। তার এত আদরের বাবা, তার নিজের অতি আদরের নির্বোধ শিশুটির হাতে মরতে বসেছিলেন। এ যে কি যন্ত্রণা মনের মধ্যে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। এই জন্যই অনুপম আর বাইরে যেতে চায়না। কি মেধাবী ছেলে অনুপম, কি ডিসিপ্লিন্ড, বাবা মায়ের প্রতি অবিচল ভক্তি, স্ত্রীর প্রতি মমতা এবং সবার শেষে অসহায় অরিত্রর প্রতি একবুক ভালোবাসা, অথচ কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ নেই! আমি মাঝে মাঝেই ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন করি, “ ঈশ্বর, আমার ভাইটা কি এর বেশী কিছু পেতে পারতোনা? তোমার যদি পরীক্ষা করতেই হয়, তাহলে দুর্বৃত্তদের উপর কেনো তোমার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাওনা? তোমার নিজের বিচারই তো ঠিক না, আমরা হচ্ছি মানুষ, এই জন্যই আমাদেরও বিচার ঠিক হয়না। তুমি নিজে একচক্ষু ভগবান, তুমি নিজে দুর্বৃত্তদেরকে ভয় পাও, অনুপমের মত ভাল ছেলেকে ঠকাও, আমরাও তাই এর বাইরে যেতে পারিনা। আমরাও তাই দুর্বলের উপর অত্যাচার করি, সবলকে ভয় পাই। তাহলে আমাদেরকে কেনো পাপ-পুণ্য শেখানো হয়। পাপীরাই যদি জিতবে তাহলে আমরা কেনো বোকার মত পাপ থেকে দূরে থাকলাম! আমরা একূল ওকূল দুইই হারালাম”। পাগলের প্রলাপ বকি, কাঁদি। অনুপমকে মনে মনে হাজারবার মাথা নিচু করে প্রণাম জানাই। বার বার ওকে একটা মেসেজ দিতে চেষ্টা করি, ভাই তোর ভয় নাই, আমরা আছি তোর জন্য, তোর অরিত্রের জন্য আছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। তুই বাবার প্রতি যে কর্তব্য পালন করে গেলি, তা দিয়ে মহাকাব্য রচনা করা যায়। তুই নিজে বাবা হিসেবে যা করছিস তা দিয়ে অমর কাব্য রচিত হতে পারে! আমার সাধ্য থাকলে আমি তোকে নিয়ে অমরকাব্য রচনা করতাম! কিন্তু ঈশ্বর আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। আমি ছোটখাটো গল্প লিখতে পারবো, কিন্তু ‘অরিত্রর বাবা’ কে নিয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তবে কেউ লিখুক আর নাই লিখুক, অরিত্রর অন্য রকম ভুবনে তার বাবাই হচ্ছে একমাত্র ‘হিরো’!