বি.এ.পরীক্ষা সবে শেষ করেছে সাজেদ।রেজাল্ট বের হতে এখনও অনেক বাকি।পড়াশুনা করে এ পর্যন্ত আসতে, অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাকে।অভাবের সংসার।দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম অবস্থা,তার উপর আবার পড়াশুনা!যেন ‘গরীবের ঘোড়ারোগ।’তবুও অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর মনোবল তাকে এ পর্যন্ত এনেছে।এবার একটা কিছু করা দরকার।কত গুলো ভাই বোন। তাদের পড়াশুনা,পোশাক-আশাক,খাওয়া-দাওয়া কম নয়।কিন্তু কি করবে সে।কে তাকে কাজ দেবে।ভাবতে ভাবতে অবশেষে সে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
একদিন সে নীলফামারী স্টেশন থেকে টিকিট কেটে চেপে বসলো ট্রেনে।রাত নয়টার দিকে ট্রেন ছাড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেন সস্তির নিশ্বাস ফেললো সাজেদ।জানালার পাশে ছিট।হু হু করে বাতাস এসে তার সারা শরীর জুড়িয়ে দিল।ট্রেন চলার একটানা শব্দ ছাড়া,পুরো কম্পার্টমেন্ট ধীরে ধীরে নীরব হয়ে এল।
সহসা পাসের সিটে বসা, মেয়েটির চোখে চোখ পড়ল তার। চোখে চোখ পড়তেই, চোখ নামিয়ে নিল মেয়েটি। গায়ের রং শ্যামলা। মাঝারি গঠন।হরিণীর মতো টানা টানা দুটি চোখ।অপরূপা সুন্দরী না হলেও, চোখে পড়ার মতো।
তার পাশের ছিটে বসা একটি ছেলে।তাদের দুজনকে দেখে ভাই বোন বলে মনে হলো না সাজেদের।তাহলে কে ঐ ছেলেটি?ভাবতে থাকে সাজেদ।তাদের কথা বর্তা ও সন্দেহজনক।ভাব সাব দেখে কেন যেন তার মনে হয়,ছেলেটি মেয়ে পাচারকারী দলের সদস্য।যদি তার অনুমান সত্যি হয়!তাহলে মেয়েটির কি হবে?ওরা হয়তো ওকে বিদেশে পাচার করে দেবে, নতুবা কোন পতিতালয়ে বিক্রি করে দেবে।হায়!হায়!তাহলে কি হবে?কি করা যায়? কিভাবে ওকে বাঁচানো যায়?এমন সব উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায়।ইদানীং তার কি যেন হয়েছে।যে কোন ব্যাপারেই তার দুঃচিন্তা।
ছেলেটি ছিট থেকে উঠে বাথ রুমের দিকে গেল।সাজেদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই দিকে।হ্যাঁ,ছেলেটি বাথরুমেই ঢুকেছে।এবার তাকালো সে মেয়েটির দিকে।মেয়েটিও যেন, তাকিয়ে ছিল তার দিকে।চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি চোখ নামিয়ে নিলো ।
কি ভাবে অলাপ শুরু করা যায়।একে তো অপরিচিত,তার উপর আবার মেয়ে বলে কথা।ভাবতেই বুকের ভিতর, হাতুড়ির ঘায়ের শব্দ, শুনতে পেলো সে ।সময়ও বেশি নেই।সাহসে ভর করে বলেই ফেললো- ‘ঢাকায় যাচ্ছ বুঝি?’
-হ্যাঁ ।
তোমদের গ্রামের বাড়ী কোথায়?
নীলফামারীর ডোমারে।
ও ডোমার!ওখানে তো অমার খালার বাড়ী।বেশ ভালো জায়গা।
প্রসঙ্গ পাল্টে এবার সে আসল কথায় এলো। ‘‘ঐ লোকটি কে? মানে যিনি এইমাত্র বাইরে গেলেন,উনি আপনার কে?’’
ও,উনি।উনি তো আমার বড় ভাই।
হু।মাথা দোলালো সাজেদ।ইতিমধ্যে ছেলেটি এসে পড়ায় আলাপ আর এগুতে পারলো না।
ছেলেটির কথা-বার্তা, আচার-আচরণে যেন তার সন্দেহ, আরো বাড়তে লাগল।তা ছাড়া তাদের মাঝে বয়সের ব্যবধানও অনেক।সে সুধু ভাবতে থাকে, মেয়েটির কথা। তার সব কথাই বিশ্বাস হয়, কিন্তু তার পাশের ছেলেটি যে তার ভাই, একথা সে বিশ্বাস করতে পারে না কিছুতেই। মেয়েটি হয়তো কিছু লুকচ্ছে তার কাছে।যাকগে সব। ওর জন্য আমার এত ভাবনা কেন।সে তো আর আমার আপন কেউ নয়।ওদের ব্যাপারে তার নাক গলানো উচিত নয় ।আবার ভাবে ,সত্যিই যদি লোকটি নারী পাচারকারী দলের সদস্য হয়! সংবাদ পত্রে এমন অনেক ঘটনা সে পড়েছে।এই মুহূর্তে নিজেকে যেন সে, কোন সি. আই. ডি. অফিসার বা কোন হিন্দি সিনেমার নায়ক বলে ভাবতে লাগল।মেয়েটিকে উদ্ধার করা যেন তার নৈতিক দায়িত্ব।কিন্তু মেয়েটির কাছ থেকে তো তেমন কোন তথ্য পাওয়া গেল না।সে তো কিছু খুলে বললো না তাকে। আরে ধ্যাত, কি সব আবোল তাবোল চিন্তা ভাবনা।মেয়েটি যদি জানতেই পারত যে, ছেলেটি নারী পাচার কারী দলের সদস্য, তাহলে কি আর সে ছেলেটির সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ী ছাড়তো।হয়তো কোন চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে,তাকে নিয়ে যচ্ছে।
এবার সে ছেলেটির সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলো।যদি কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।ছেলেটির হাতে পানির বোতল দেখে সাজেদ বললো-
একটু পানি খেতে পারি ভাই?
ও সিওর।সিওর।
পানির বোতলটি এগিয়ে দিলো ছেলেটি সাজেদের দিকে।পানি পান করে বোতলটি ফেরত দিল সাজেদ।
ধন্যবাদ ভাই।ঢাকায় যচ্ছেন বুঝি?
-হ্যাঁ।
লোকটি যেন বেশি কথা বলতে চাইছে না তার সাথে।সে যেন কিছু গোপন করতে চাইছে তার কাছে।
ভাই কি ওখানে চাকুরী করেন?
না বেড়াতে যাচ্ছি।বাবা ঢাকায় কন্টাক্টরী করেন।ওখানেই যাচ্ছি বেড়াতে।
-ও।
আর কথা বাড়ালো না সাজেদ।আবার চিন্তার সাগরে ডুব দিলো সে।ধীরে ধীরে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো তার।কিন্তু ঘুম এলো না দুচোখে।সুধু ট্রেন চলার একটানা শব্দ তার কানে বাজতে লাগলো।
আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা, এসে ভিড় করতে লাগল তার মাথায়।বাবা ঢাকায় থাকেন।তাহলে তো মা গ্রামেই থাকেন।মেয়ে বাবার কাছে বেড়াতে গেলে,মারও সাথে যাওয়ার কথা।মা যেহেতু সাথে নেই, সেহেতু তারা বাবার কাছে যাচ্ছেনা।সব শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে,ছেলেটির সব কথা মিথ্যা।দর্শনের ছাত্র সাজেদ।যুক্তি-তর্ক, অনুমান কোন কিছুই বাদ গেল না তার কাছে।তাহলে সে নিশ্চিত, মেয়েটি পাচার কারীর খপ্পরে পড়েছে।ভাবতেই বুকের গভীরে এক অব্যক্ত বেদনা অনুভব করল সে।
চঞ্চলা হরিণী সারা দিন বনে বনে ঘুরে বেড়েয়।কচি ঘাসের ডগা চিবিয়ে খায়, আর মনের সুখে লাফালাফি করে।কিন্তু ধূর্ত শিকারির ফাঁদে কখন যে আটকে পড়ে, তা সে আগে আঁচ করতে পারে না।যখন সে বুঝতে পারে,তখন ছট ফট করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।মেয়েটির দিকে একবার করুন চোখে তাকায় সে।হায় বেচারি,নিষ্পাপ হরিণী!তুমি তো বন্দী হতে যাচ্ছ, শিকারির জালে।মনের অজান্তেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, তার বুকের গভীর থেকে।
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে, ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছিল পাশের ছেলেটি।সাজেদ একবার তাকাল মেয়েটির দিকে।মেয়েটিও যেন তাকে কিছু বলতে চাইছিল। ব্যাগ থেকে কলা ও রুটি বের করল মেয়েটি।রুটি-কলা বাড়িয়ে দিল সে সাজেদের দিকে।
নিন না, খানিকটা।
না,ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের কিছুই নেই।রাত অনেক হয়েছে।আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। আপনার ও বোধ হয় পেয়েছে।
তা পেয়েছে।
তাহলে নিন না,সুরু করুন।নাকি আপনার মা আবার, পথে অপরিচিত জনের কিছু খেতে নিষেধ করেছেন।হাঃ হাঃ হাঃ।
আমার তো মা’ই নেই, নিষেধ আবার করবে কে।
ছরি! না জেনে আপনাকে কষ্ট দিলাম।কিছু মনে করবেন না।
না,না । মনে করবার কি আছে।জন্মের পর থেকে যে মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত,তার আবার কষ্ট!
হাত বাড়িয়ে রুটি ও কলা নিল সে।এবার সে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল সরাসরি।মলিন সে মুখ।কোথায় সেই হাস্য চঞ্চলা চেহারা।।কোথায় গেল সেই হরিণীর মত দৃষ্টি।সাজেদ চোখ নামিয়ে নিল।
এবার ধমকের সুরে মেয়েটি বললো, ‘নিন সুরু করুন এবার।’।
সাজেদ কোন কথা না বাড়িয়ে, খেতে সুরু লরলো।
যার দেওয়া রুটি কলা খাচ্ছি,এতক্ষণ তার নামটাই জানা হল না।
ও হ্যাঁ, আমার নাম সাবা।আপনার নামটাও নিশ্চয়ই জানতে পারি?
তা জানতে পারো।কিন্তু জেনে কি লাভ!কয়েক ঘণ্টা পরেই তো আমরা হারিয়ে যাব অজানার পথে।
তা হয়তো ঠিক।কিন্তু নিয়তি হয়তো আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে আবার কোন এক দিন।
হয়তো পারে। আমার নামটা না হয়, সেদিনই জেনে নিও।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে,তা না হয় জানবো।এবার বলুন তো, যাওয়া হচ্ছে কোথায়, কোথায়-ই বা ঠিকানা?
এত প্রশ্ন একবারে করলে গুলিয়ে ফেলবো সব।
আচ্ছা ঠিক আচ্ছে,তাহলে একটা একটা করে উত্তর দিন।
যাচ্ছি, অজানার পথে।আর, ঠিকানা নাই বললেই চলে।
তা, মহাশয়ের কি করা হয়?
বি এ পরীক্ষা সবে শেষ করেছি।সেই অর্থে বলা যায়,বর্তমানে বেকার।
হু,তাও ভালো।বিয়ে পাশ করেননি এখনও তাহলে।
বেকার জীবনে আবার বিয়ে!আগে তো বি এ পাশ করি।পরে ওসব নিয়ে ভাবা যাবে।
তাহলে বেকাররা বুঝি চির কুমার হয়ে থাকে?
বেকার জীবনে তাই ভালো।পেটে ভাত না থাকলেও, একবেলা চালিয়ে নেওয়া যায়।কারও জন্য চিন্তা করতে হয় না।
মানুষ তো আর সারা জীবন বেকার থাকে না।কথায় বলে, “ইছা থাকিলে উপায় হয়।’’
আমার কথায় নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ,‘‘আমি এক ছন্নছাড়া, চাল-চুলো হীন শ্রীকান্ত।”
হ্যাঁ,তা যা বলেছেন।আপনার শ্রী ও আছে আর কান্ত ও আছে।আপনার নাম ‘শ্রীকান্ত’ হলেই ভালো মানাত।
আমার কোন আপত্তি নেই।নিজেকে শরত বাবুর ‘শ্রীকান্ত’ বলে ভাবতে, ভালোই লাগে।
ট্রেন চলছে তো চলছেই।মাঝে মধ্যে দু একটি বড় স্টেশনে ক্ষণিকের জন্য থামছে,সেদিকে লক্ষ্য নেই তাদের।তারা যেন অনন্ত লোকের যাত্রী।এ চলার যেন শেষ নেই।ধীরে ধীরে বাইরের অন্ধকার হালকা হয়ে আসে।ভোরের আলো জানান দেয়, আর একটি দিনের।
আমাদের কি আর কোন দিন দেখা হবে না? অপলক দৃষ্টিতে সাবা তাকিয়ে থাকে সাজেদের দিকে।
হয়তো হবে,হয়তো হবে না।পৃথিবীতে কত ফুল ফোটে, আবার অকালেই ঝরে যায়।সব ফুলই তো আর, মালা হওয়ার সুযোগ পায় না।
ধীরে ধীরে ট্রেন কমলাপুর ষ্টেশনে ঢোকে।প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায় লৌহ দানবটা। যাত্রীরা নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।হৈ চৈ হট্টগোল,কুলির হাঁক ডাকে কান পাতার যো নেই।ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে ছেলেটি।ব্যাগ ও লাগেজ গুছিয়ে নেয় চট-পট।
কম্পার্টমেন্ট প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।
কি হলো ,চল সাবা।আমাদের নামতে হবে।তাগাদা দেয় ছেলেটি।লাগেজ নিয়ে সে এগুতে থাকে দরজার দিকে।
তার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সাবা।ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।শেষ বারের মতো তাকিয়ে থাকে সাজেদের দিকে।করুন সে চাহনি।পৃথিবীর সব জিজ্ঞাসা যেন তার দুটি চোখে।