বাবার চিঠি

বাবা (জুন ২০১২)

সোমা মজুমদার
  • ২১
  • 0
  • ৩১
অফিস থেকে অনেক্ষণ ফিরে এসেছে পৌলমী। অন্যদিন এতক্ষণে মায়ের সাথে বসে গল্প করে। কিন্তু আজ ও জানেনা মায়ের কি হয়েছে। অফিস থেকে ফিরে দেখে মা নিজের শোবার ঘরে আলো বন্ধ করে শুয়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এল ও। ঢাকা
খুলে দেখে চিঁড়ের পোলাও। ওর প্রিয় খাবার। আজ খিদেও পেয়েছে খুব। দুপুরে শুধু আলুকাবলী খেয়েছিল। তাড়াতাড়ি খাবার টা শেষ করে নিল। বেসিনে হাত ধুয়ে মার কাছে এল ও।
-মা, এখন ঘুমোচ্ছ? শরীর খারাপ?
-না, এমনি। খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ রাতে কিছু খাবনা। তোর খাবার ফ্রিজে আছে। গরম করে নিস।
মার কাছে এগিয়ে এল ও। মাথায় হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, জ্বর আছে কিনা। গা ঠান্ডা দেখে নিশ্চিন্ত হল। মার শরীর খারাপ থাকলে ওর একদম ভাল লাগেনা। মার আরও কাছে সরে এল ও।
-ও মা, কি হয়েছে তোমার? বল না।
-কিছু হয়নি রে, বলছি তো। যা তোর কাজ কর।
-তোমার মন খারাপ? আমাকে বলবে না তো। ভাল বোল না! তুমি শুয়ে থাক তাহলে। আমি যাই।
মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা তে এল পৌলমী। প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিল। সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে আজ বিকেল থেকে। মন টা খুচখুচ করছে ওর। মার কি হয়েছে বুঝতে পারল না। মা কি কিছু লুকোচ্ছে ওর কাছে! কি এমন কথা! মা তো কখনও কিছু লুকোয়
না ওর থেকে। অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল মন টা।
বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এল পৌলমী। একটা প্রেসেন্টেশন বানাতে হবে। ল্যপটপ টা চালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কাজ করতে একদম ইচ্ছে করছেনা।
-মনা, তুই কি কাজ করছিস?
পৌলমী তাকিয়ে দেখে, মা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে।
-কি গো, তুমি? কিছু বলবে? আসো। কি হয়েছে, বল।
-তুই কি জরুরী কিছু কাজ করছিস?
-না তেমন কিছু নয়। তুমি বলনা কি বলবে।
-তোর সাথে একটা জরুরী কথা আছে। কিছু কথা আছে তোকে বলার।
-কি কথা?
-আজ সকালে তোর নামে একটা চিঠি এসেছে।
-আমার নামে? কার চিঠি? আমার নামে আবার কে চিঠি লিখবে?
-চিঠি টা তোর বাবার।
নিজের কান কেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, পৌলমী। মনে হল যেন স্বপ্ন দেখছে। আজ ৩০ বছর ধরে যে মানুষ টা কে মৃত বলে জানত, সে আজ চিঠি দিয়েছে।
-কি বলছ তুমি মা? কি বলছ এসব?
-ঠিকই বলছি। তোমার বাবা আজও জীবিত।
-মানে? এতদিন ধরে আমি একটা মিথ্যের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছি? কেন মা? কেন তুমি আমাকে এভাবে বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করলে? কেন কেন? কিসের অপরাধে তুমি আমাকে এই শাস্তি দিলে, মা?
রাগে দুঃখে মার প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা জন্মাতে শুরু করে দিল, পৌলমীর, মুহুর্তের মধ্যে। সবচেয়ে কাছের মানুষ টাকে কেমন দূরের মনে হতে লাগল।
-কিগো, চুপ করে কেন রয়েছ? মা, প্লিজ কিছু বল। আমি কিছুই বুঝছি না। তুমি কেন এতদিন এই কথা টা আমাকে গোপন করে এসেছ? আমি তোমাকে যতবার জিজ্ঞেস করেছি বাবার মৃত্যুর কারণ, তুমি আমাকে এড়িয়ে গেছ। কেন তুমি এভাবে আমাকে কষ্ট
দিলে? কি সুখ পেলে তুমি?
-আমি যা করেছি, কোনটাই আমার সুখের জন্য করিনি। তুই যদি জানতিস তোর বাবা বেঁচে আছে, তুই তাকে দেখতে চাইতিস, আর যখন তুই জানতিস যে তিনি তার মেয়েকে ঘৃণা করে, তার মুখ দেখতে চায়না, তখন তুই কি আরও কষ্ট পেতিস না?
-বাবা আমাকে ঘৃণা করত! কেন মা? কেন? কেন বাবা আমাকে ঘৃণা করত?
-তুই জানিস না, আমি তোকে কখনও বলিনি, তুই যখন জন্মেছিলিস, তোর পায়ে একটা সমস্যা ছিল। তুই হাঁটতে পারতিস না। প্রতিবন্ধী তাও আবার কন্যা সন্তান, ও তোকে মানতে পারেনি। ভাবতে পারিস তুই, ডাক্তার যেদিন বলল তুই হাঁটতে পারবিনা, ও তোর
মুখ দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি তাই তোকে নিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসি। ওই দিন থেকেই তোর বাবা আমার কাছে মৃত। বড় ডাক্তার দেখিয়ে, অপারেশন করে তোর পায়ের সমস্যা ঠিক করেছি। এই বাড়ি চলে আসার পর ও একবারও দেখতে
আসেনি। তোর যখন দু বছর বয়স, আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তারপর ও আবার বিয়ে করে, এবং সেই স্ত্রী সম্প্রতি মারা গেছে। আমি একা তোকে মানুষ করেছি। তুই শুধুই আমার, তোর ওপর আর কারও অধিকার নেই। আমি চাইনি তুই আমার ছাড়া আর
কারও পরিচয়ে বাঁচিস। এর জন্য যদি তুই আমায় স্বার্থপর ভাবিস, তো হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর। আজ তোর বাবা আমাদের জীবনে ফিরে আসতে চায়। ও তোর বাবা তুই চাইলে ওকে ক্ষমা করতে পারিস। কিন্তু আমি জীবনে আর কোনদিন কখনও ওই লোকটাকে ক্ষমা
করতে পারবোনা। এটা তোর বাবার চিঠি। পড়ে বলিস তোর কি মত। তুই যদি তোর বাবার সাথে এখানে থাকতে চাস, তাহলে বলিস, আমি এখান থেকে চলে যাব। তবে যা করবি, বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে করবি। আবেগ দিয়ে কাজ করলে ঠকতেই হয়। আমিও
ঠকেছি। আমাকে ভুল বুঝিসনা, মনা। মার ঘর থেকে চলে যাওয়া, অশ্রু সিক্ত ঝাপসা চোখে দেখল পৌলমী। ওর মনে হল ওর মাথার ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় চলে গেল। স্বপ্ন কি এভাবেই পূরণ হয়। কারোর প্রত্যাবর্তনের সময় টা কেন সর্বদা সঠিক হয়না।
অনেক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর চিঠি টা হাতে তুলে নিল পৌলমী। খামের ভেতর থেকে চিঠি টা বের করে পড়তে শুরু করল, পৌলমী।
পৌলমী,
আমি তোমার এবং তোমার মার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। যে বড় মিথ্যের মধ্যে দিয়ে তুমি বড় হয়েছ, তার জন্য আমিই দায়ী। বাবার কোন কর্তব্যই আমি করিনি। জীবন থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি।
পাপের শাস্তিও পেয়েছি। বাকি জীবন টা তোমাদের সাথে কাটিয়ে পাপ থেকে মুক্ত হতে চাই। তোমার মা আমাকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবেনা, আমি জানি। তুমি কি পারবে, তোমার বাবাকে ক্ষমা করতে? যদি পার চিঠি দিও। আমার ঠিকানা, ফোন নম্বর লেখা
কার্ড চিঠির সাথে দিলাম। আমি তোমার উওরের অপেক্ষায় থাকব।
ইতি, তোমার বাবা
আজ আর রাতে খাওয়া হবেনা, তা জানে পৌলমী। খাবার সব তুলে দিয়ে মার ঘরে এল ও। হাতে বাবার চিঠি।
-মা!
-আয়। খেলিনা কেন?
-এমনি, ভাল লাগছে না। তুমি এখনও জেগে, ঘুমোওনি কেন?
-আমাকে ঘৃণা করছিস তো? রাগ হচ্ছে নিশ্চই, আমার ওপর?
-না, তুমি যা করেছ, ঠিক করেছ।
-চিঠি টা পড়েছিস?
-হ্যাঁ।
-তুই কি চাস? কিছু ভেবেছিস?
-তোমায় একটা প্রশ্ন করব মা?
-বল।
-তুমি বাবাকে এখনও ভালবাসো?
-কারোর মধ্যে যখন ভালবাসার মত আর কোন গুন অবশিষ্ট থাকেনা, তখন কি আর তাকে ভালবাসা যায়!
-তবে সব কিছু জেনেও, ওই মহিলা কি করে ওনাকে বিয়ে করল, মা?
-আমাদের দেশে এখনও অনেক মহিলা আছে, যারা শুধু মাত্র নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। নিজে কষ্ট না পেলে অন্যের কষ্ট বোঝার মত ক্ষমতা কি সবার থাকে? হয়ত আমার সাথে এমন না ঘটলে আমিও বুঝতে পারতামনা। যাক সে সব পুরনো কথা। তুই
কি ঠিক করলি, বল।
-আমি তোমার সাথেই থাকব মা। আমার আর কারোকে দরকার নেই। শুধু একবার বাবার সাথে কথা বলতে চাই।
-তাই বলিস।
ছোটবেলা বারবার যেটা মনে মনে চেয়েছে সত্যি হোক, আজ সেটা বাস্তব। তবু আজ মন বলছে, বাবা তুমি কেন ফিরে এলে। কেন এতদিনের জানা মিথ্যেটাই সত্যি ছিলনা। সব স্বপ্ন বোধহয় পূর্ণ হতে নেই।
পৌলমী টেলিফোনের রিসিভার টা তুলে নেয়। হাতে বাবার ফোন নম্বর লেখা কার্ড টা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান খুব সুন্দর লিখেছ- অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো|
Lutful Bari Panna অনেক সুন্দর একটা গল্প..
ম্যারিনা নাসরিন সীমা সাবলীল সুন্দর আবেগ দিয়ে লেখা বাবার চিঠি । ভীষণ ভাল লাগলো ।
anek anek dhanyabad amar galpo ti parar janya........
রুহুল আমীন রাজু অনেক ভালো লাগলো গল্পটি .............আমার 'আলোয় অন্ধকার 'গল্পটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো .
dhanyabad valo lagar janya........ami abashyai apnar galpo ti pore nebo.
এস.কে.দোয়েল অনেক সুন্দর করে লেখা গল্পটা। এযেন সৃজনশীলতার মননশীল সক্ষমতা। লেখিকাকে শুভেচ্ছা।
মাহবুব খান বাবা চরিত্র টাকে অন্য ভাবে ডিসেক্সন করা হলো / কারো এমন যেন না হয় / অনেক ভালো লাগলো
আহমেদ সাবের খুব সুন্দর এবং সার্থক একটা গল্প। স্বার্থপর বাবার চরিত্র বেশ সুন্দর ভাবেই ফোটানো হয়েছে। "তিনি তার মেয়েকে ঘৃণা করে, তার মুখ দেখতে চায়না," - এখানে "তিনি" 'র বদলে কি "সে" হবে?
dhanyabad amar galpo ta parar janya. apni katha ta manda balenni. tabe shata ghrina satweo amra kakhano kakhno evabei sambodhan kore thaki bodh hay........
বুঝলাম। "তিনি" - ব্যঙ্গার্থে।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি সমাজের চরিত্র উঠে এসেছে গল্প সুন্র ঝরঝরে লেখা সুখ পাঠ্যতো বঠেই....খুব ভালো লাগলো সোমা দি আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ.......
anek dhanyabad vai tomake amar galpo ta parar janya............
বশির আহমেদ সুন্দর খুব সুন্দর একটা গল্প । লেখিকার জন্য প্রীতিও শুভেচ্ছা ।
dhanyabad apnake........amar lekha pore valo lagar janya.........

০৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪