মরিয়ম

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

রোকন রাইয়ান
  • ১৫
  • 0
  • ১২০
রাত হলেই মরিয়ম কান্না জুড়ে দেয়। প্রথমে উ উ... তারপর মতিন কিছু বললে ভলিউমটা এমতিতেই বেড়ে যায়। মতিন অবশ্য এখন বড় হয়েছে। মরিয়মের কান্না থামানোর দায়িত্ব তার। উল্টাপাল্টা কথা আর বলে না। আজও মরিয়মের কান্নার শব্দ চাউর হয়ে গেল। মতিন চেষ্টা করল কান্না থামানোর। গল্প বলার চেষ্টা করল। মরিয়মের তাতে বোধহয় স্বস্তি হল না। সে কান্নাটা আরো বাড়িয়ে দিল।

ওপাশ থেকে বাবার গলা চড়ল। এই রাইতের বেলা ঘরে হুইয়াও শান্তি্ত নাই। ছেমরিডার চিৎকারে ঘুম পারন যায়? বাবার কথা শুনে মা'র কণ্ঠও চড়ে। পোলাডারে কতবার কইছি মাইয়াডারে এটটু সামলায়া রাখ। এই কামডাও করবার পারে না।

মতিন জোর চেষ্টা চালায়। মরিয়মের কান্না থামে না। মাথায় হাত বুলায়। পিঠ বুলায়। কান্না থামে না। গল্প বলার চেষ্টা করে। কান্না থামে না। শীতে থরথর করে কেপে ওঠে মরিয়ম। অক্টোপাসের মতোই জেকে বসেছে শীত। সাথে যোগ হয়েছে উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস। মরিয়মের গায়ে পাতলা ফিন ফিনে একটা চাদর। ভাঙ্গা ঘরে উত্তরি বাতাস ঢুকে সে চাদর উল্টে দেয়। অসহ্য শীতে ডুকরে ওঠে মরিয়ম। শীত যে মতিনের লাগে না তা নয়। সে সহ্য করতে চায়। বাবা একবার শিখিয়ে দিয়েছেন। শীত-ঠাণ্ডা এমন কিছু না। যার ভয়ে কাঁপতে হবে। শরীর-মন শক্ত রাখলেই শীত সয়ে যায়। সেই থেকে মতিন আর শীত নিয়ে ভাবে না। শীত সইতে চেষ্টা করে। কিন্তু ৪ বছরের মরিয়মের কাছে শীত শীতই থাকে। সে জানে না শীত সহ্য করার কৌশল। রাত বিরেতে তাই ওর কান্না চড়ে যায়।

২.
দিনের বেলা পাতা কুড়োয় মতিন। মরিয়ম তার সাথে সাথে ঘুরে। সেও দু'একটা পাতা তুলে এনে খাঁচায় রাখে। মতিনের মতো করে কঞ্চি দিয়ে ঝাড়ু বানায়। আধ কুঁজো হয়ে পাতা জড়ো করে। দিনের বেলাটা তার ভালোই কেটে যায়। আকাশে থালার মতো সূর্য ওঠে। লাল-সোনালি আলো হয়। মিষ্টি সে আলোয় শীত দূরে সরে যায়। পাতা কুড়োতে কুড়োতে এক সময় দু'জন চলে আসে মজিদ সাহেবের বাড়ি। মজিদ সাহেব বড় মানুষ। জমিদারি আছে। বাড়িটাও পাঁকা। এই গ্রামে এই একটাই পাঁকা বাড়ি। বাড়ান্দাটা বিভিন্ন রঙ দিয়ে নকশি করা। মরিয়ম চিৎকার করে ওঠে! ভাই দেখছ কি ছুন্দর বাড়ি! মতিন রা করে না। পাছে মরিয়মের লোভ লেগে যায়। মতিন হেঁটে মজিদ সাহেবের কাঠের বাগানে চলে আসে। ওইখানটাতে অনেক পাতা পড়ে। দশ-বিশ মিনিট কুড়ালেই খাঁচা ভরে যায়। মতিন আপন মনে পাতা কুড়ায়। হঠাৎ বাগানে লেড়ে দেয়া কয়েকটা কম্বলের ওপর চোখ পড়ে মরিয়মের। আবারো চিৎকার দিয়ে ওঠে। হাতের ইশারায় মতিনকে দেখিয়ে বলে_ ভাইয়া ওইডা কি? কম্বল। মতিন জবাব দেয়। কম্বল দিয়ে কি করে ভাইয়া! মরিয়ম আবারো প্রশ্ন করে। উত্তর দেয় মতিন। কম্বল বিছায়া রাইতে ওরা ঘুমায়। যাতে ঠাণ্ডা না লাগে। কথাটা বলেই মতিন চুপসে যায়। ভাবে এই কথাটা কি মরিয়মকে বলা ঠিক হল। মরিয়ম ঠিকই ধরে ফেলে। বলে ভাইয়া এইডি আমাগর নাই কেন। মতিন কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। কম্বল তাদের কেন নেই। ক'মুহূর্ত পাতা কুড়ানো বিরতি দেয়। কম্বলগুলোর দিকে তাকিয়ে জবাব খুঁজতে চেষ্টা করে।

৩.
পাতাভর্তি খাঁচাটা মাথায় ওঠানোর পর প্রচণ্ড রাগ হয় মতিনের। কার প্রতি রাগ? নিজের? না বাপজানের? এই ক'দিন আগেও তাদের অভাব ছিল না। সারাদিন কাজ করে বাবা একব্যাগ চাল আর তরকারি আনত। বাবা বাজার থেকে ফিরলেই মরিয়ম দৌড়ে যেত। বাজারভর্তি ব্যাগ জড়িয়ে ধরত। মিনমিন করে বলত_ বাপজান আমার লাগি কিছু আন নাই? কথা শুনে বাবা হাসত। ব্যাগ থেকে বের করত দুই টাকার টুস্ট বিস্কুট। সেটি পেয়ে মরিয়মের সে কি খুশি? মা দৌড়ে এসে ব্যাগ নিত। রান্না হত গরম ভাত আর ভাজি। গরম ভাত-ভাজি আর লাল টুকটুকে একটা মরিচ দিয়ে কি সুন্দর করে ভাত খেত মতিন। এখন আর তিন বেলা ভাত পায় না। বাবা জোয়া খেলে। প্রথম প্রথম এমনিতে খেলত। পড়ে শুরু হল বাজির খেলা। বাজিতে হেরে যেত বাবা। এভাবেই চলল বেশ কিছু দিন। বাবা বাজিতে জিতেন না। তবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন একদিন না একদিন বাজি জিতবেন। অনেক অনেক টাকা কামাবেন। আমাদের বড় বাড়ি হবে। সেই বিশ্বাস বিশ্বাসই থাকল। বাবা বাজি জিতলেন না। জমি বেচলেন। তারপর বাড়িঘরের জিনিসপত্তর। আমরা ধীরে ধীরে ফকির হতে থাকলাম। এখন বাবা দিনমজুরির অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছেন।
রাত গড়ায়। আবারো শীতে কাঁপে মরিয়ম। কান্না থামে না। মা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন_ এইতো আর একদিনই ঠাণ্ডা। কালই আমরা কম্বল পামু। চেয়ারম্যান কাইল আমগ এলাকায় কম্বল বিলাব। আমগর আর ঠাণ্ডা থাকব না। মার কথা মরিয়মের কানে যায় কিনা কে জানে। তবে মতিন অবাক হয়। বড় করে বলে_ আসলেই মা কাইল চেয়ারম্যান সাব আমগ কম্বল দিব? মা বলেন_ তাইলে কি আর মিছা কতা কই! দেহিস! আমগো আর শীতের কষ্ট থাকবো না।

৪.
ভোর বেলা একটুকরা কয়লা হাতে বের হয় মতিন। দাঁতে ঘঁষা দিতে দিতে চৌরাস্তার মোড়ে ওঠে। সামনেই চেয়ারম্যান বাড়ি। আর একটু উঁকি দেয়। লোকজন আসতে শুরু করেছে। কম্বল তাহলে ঠিকই দিব। এবার বিশ্বাস হয় মতিনের। মতিনকে রাস্তায় দেখে মজিবর চাচা চিৎকার করে। কিরে এহনো বাইর হছ নাই। লাইন তো বড় হইয়া যাইব। মতিন দাঁত বের করে হাসে। সেই হাসি সূর্যের আলোকেও হার মানায়।

দেখতে দেখতে বেলা বাড়ে। মা পান্তা রেডি করেন। মতিন পাতিল থেকে একটা লাল মরিচ নেয়। লাল মরিচ ওর খুব প্রিয়। পান্তার সাথে খেতে কি যে স্বাদ। মতিন মরিচ ডলে পান্তা খায়। মরিয়মকেও খাওয়ায়। মরিয়ম অবশ্য এখনো মরিচ খাওয়া শিখেনি। ও শুধু নুন নেয়। এতেই ওর মজা।
খাওয়া হলে মরিয়মকে কোলে নিয়ে বের হয় মতিন। মাও আসে পাছে পাছে। মরিয়ম জিজ্ঞেস করে_
আইজ খাছা নিবা না ভাই!
না! আইজ পাতা কুড়ামু না। চেয়ারম্যানের বাড়ি যামু। চেয়ারম্যান আমগরে কম্বল দিবো। উত্তর দেয় মতিন।
মরিয়ম বলে_ সত্যিই চেয়ারম্যান আমগ কম্বল দিব? আমগর আর রাইতে ঠাণ্ডা লাগব না?
মতিন মাথা নাড়ে। হ! সত্যিই কম্বল দিব। আমগর আর ঠাণ্ডা থাকব না।
মরিয়ম কি বুঝল কে জানে। লম্বা একটা হাসি ঝুলে পড়ল তার মুখে।

৫.
পাড়াসুদ্ধ মানুষ এখন চেয়ারম্যানের বাড়িতে। মানুষের আওয়াজে গম গম করছে। তিনটা লাইন বেশ লম্বা। মাথা দেখা যায় না। মতিন-মা আর মরিয়ম দাঁড়ায় এক লাইনে। মরিয়ম অবশ্য এখন মায়ের কোলে। সময় হয়। কম্বল বিতরণ শুরু হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে লাইন। বেলাও বেশ বেড়েছে। সাথে রোদের তাপ। হঠাৎ কেঁদে ওঠে মরিয়ম। এতক্ষণ বেশ ভালই ছিল। মা ধমকে ওঠেন। ধমক শুনে কান্না থামে না মরিয়মের। মা দেখেন মরিয়মের মুখে ফেনা। চিৎকার করে ওঠেন। আল্লাগো... আমার মরিয়মের কি হইল গো। মতিন বুঝতে পারে না মরিয়মের কি হয়েছে। মা কেঁদেই চলেন। পেছন থেকে একজন বলে ওঠে_ ওই বেডিরে লাইত্থাইয়া বাইর কইরা দেও। নাচ দেহাবার আইছে এহানে। এইডির জন্য তো আগাইবার পারতাছি না।

মরিয়ম ভালো হয় না। মতিন সামনের পুকুর থেকে এক আজলা পানি এনে মাথায় দেয়। মজিবর চাচা দৌড়ে আসে এদিকে। ধমক দিয়া বলে এহনো কি করছ। এরে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়া যাও। মতিনকে দাঁড় করিয়ে রেখে মা চলে যান বাড়ির দিকে।

৬.
বিকেল গড়িয়ে যায়। লাইন শেষ হয় না। হঠাৎ সামনের দিকে চিৎকার শুরু হয়। হারামিরা- বেবাক লুকে কম্বল পাইলে আমরা পামু না কেন। সবাই ল। চেয়ারম্যানের বাড়ি আইজ রাকমু না। মতিন তাকায় সামনের দিকে। কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করে।

চেয়ারম্যানের লোকেরা লাঠি নাড়াতেই ফাঁকা হয়ে যায় সামনের জায়গা। এই সময় চেয়ারম্যানকে দেখা যায়। তার ভারি মোটা গলা ছোড়ে পাবলিকের সামনে। এ্যা! ভোটের সময় তো এত লম্বা লাইন দেহি নাই। এহন কই থাইকা বাইর হইল এত লোক। তারপর কয়েকজন লোককে ইশারা করল। খবরদার আর একটা কম্বলও দিবা না। সব এইহানেই দিয়া দিবা! আমগোর আর লোক নাই?
মতিন বুঝে না এইখানে এত মানুষ রেখে আর কে বাকি আছে! তাদের কি আর সত্যি সত্যিই কম্বল দেবে না! তাহলে আজ রাতে সে কি বলবে মরিয়মকে। মরিয়ম যখন প্রশ্ন করবে আমগর কম্বল আন নাই ভাইজান?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম N/A প্রথমেই স্বাগতম জানাই - গল্পের প্রথমে ভেবেছিলাম সৎ মা হবে হয়ত তাই সন্তানের কান্নায় রাগ প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু পরে জানলাম সৎ মা নন ! একজন মা সন্তান যত বড়ই হোকনা কেন কান্নার উৎস জানা স্বত্বেও বুকের মাঝে মমতার ওম না দিয়ে রাগ প্রকাশ করা একটু অবাস্তবই মনে হল ! তবে গল্পের ঘটনা প্রবাহ বাস্তবভিত্তিক এবং লেখাও বেশ সাবলীল ভাল লেগেছে । আগামীতে আরো লেখা পাবার প্রত্যাশায় শুভকামনা ও শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১২
সালেহ মাহমুদ খুব কষ্টের গল্প। মানুষ এত কষ্ট পায় কেন? ভালো লাগে না কিছুই।
ভালো লাগেনি ২৭ জানুয়ারী, ২০১২
মাহমুদুল হাসান ফেরদৌস অসাধারন লিখেছ, নিয়মিত তোমার লেখা চাই।
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
রোকন রাইয়ান মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ... গল্প কবিতায় এটা আমার প্রথম পোস্ট, আপনাদের সবার সাড়া পেয়ে খুবই ভালো লাগলো..
ভালো লাগেনি ২১ জানুয়ারী, ২০১২
আহমেদ সাবের গল্প-কবিতায় গল্পকারের প্রথম লেখা – আর প্রথম লেখাতেই বাজিমাৎ। চমৎকার বর্ননাশৈলী। অসাধারণ গল্প।
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১২
F.I. JEWEL N/A # গল্পের সামাজিক গভীরতা বেশ বিশাল । লেখার ষ্টাইল সহ সবকিছু অসাধারন । লেখককে ধন্যবাদ----৫ দিলাম ।।
ভালো লাগেনি ১৪ জানুয়ারী, ২০১২
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) মরিয়ম পড়ে ,হৃদয় নিল কেড়ে /
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০১২
তৌহিদ উল্লাহ শাকিল N/A besh valo ekoti lekha , ridoy bidarok o bote . niymito likhben asha kori
Mohammad Alvi দুঃখজনক বাস্তব ঘতনার সাবলিল উপস্থাপন...ভাল লাগলো
ভালো লাগেনি ১০ জানুয়ারী, ২০১২
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বাস্তবতা বড়ই নির্মম! --বেশ ভাল লাগল|
ভালো লাগেনি ১০ জানুয়ারী, ২০১২

০২ ডিসেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "আতঙ্ক”
কবিতার বিষয় "আতঙ্ক”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ অক্টোবর,২০২৫