কবির ভিষণ চিন্তিত। হেপাটাইটিস- বি ধরা পড়েছে। সে শুনেছে রোগটি ধরা পরার পর তেমন কিছু করার থাকে না। প্রায় তিন বছর আগে তার অফিসে গ্লাস্কো কোম্পানী থেকে একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল। অফিসের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের একত্রিত করে কোম্পানীর প্রশিক্ষিত লোকজন প্রজেকশনে দেখিয়েছিলেন হেপাটাইটিস- বি এইডস এর চেয়েও বিধ্বসী রোগ। এই রোগ সহজেই ছড়ায়। পার্থক্য এইডস এর প্রতিকার নেই কিন্তু হেপাটাইটিস- বি এর প্রতিষেধক আবিষকৃত হয়েছে। তাবে এই টিকা রোগ প্রতিরোধের জন্য দিতে হবে। রোগ ধরা পরার পর তেমন কিছুই করার থাকে না। এ রোগের ভাইরাস লিভারকে ফঁটো ফুঁটো করে ধ্বংস করে দেয়।
কবির ভাবছে, তখন কেন যেন তিনি টিকা দেয় নি। টাকা পয়সার অভাবতো ছিল না। বাপের রেখে যাওয়া বাড়ি ভাড়া জমা থাকে। তার তো বেতনের টাকা বেদরকারী কাজে ব্যয় হয়। আবার বিবিধ অনৈতিক কাজে বাড়তি উপার্জন হয়। স্ত্রী ছেলে মেয়ে পর পর তিন বার টিকা দিয়েছিল। প্রতিবারই মনে হতো নিজেও টিকা নিয়ে নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেয়া হয় নি।
এ মরণ ব্যাধী তার লিভারে ঢুকল কি ভাবে ! গ্লাস্কো কোম্পানীর লোকজনতো বলেছিল, দোকানের চায়ের কাপে প্রতি দিন হাজারো রকমের লোকজন চুমু দেয়। একশত দশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেটে না ফুঁটালে এই ভাইরাস মরে না। আবার লালার মাধ্যমে, রক্তের মাধ্যমে, ডেন্টিস্ট এর ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সঠিক ভাবে জিবানু মুক্ত না করলে, উত্তরাধীকার সূত্রের মাধ্যমে, পাশা পাশি টুথ ব্রাশ রাখলে আক্রান্ত ব্রাশের মাধ্যমে অন্য ব্রাশে এই ভাইরসের ছড়ায়। এত সব মাধ্যম হতে কেবল রেস্তোরার চায়ের কাপে চুমু দেয়ার মাধ্যমে তার এই রোগের আমদানী হয়েছে বলে মনে হয় ! তার ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেননা গ্লাস্কো কোম্পানীর লোকেরা বলেছিলেন এ দেশে ৮% লোক এই ভাইরাস বহন করে চলেছে।
যাইহোক এখন মরা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। মরতেই যখন হবে তখন ভাল মন্দ বেশি করে খেতে এবং পৃথিবীটাকে ভাল করে দেখে যেতে হবে। মরার পর যদি কোন ইন্টারভিউ দিতে হয় তখন হয়তো এ অভিজ্ঞা কাজে লাগবে। বাবা বলতেন, জীবনটা বড় ছোট। তাই কম সময়ে বেশি করে ভোগ করতে হয়। ছোট বেলায় যে শিক্ষা পায় তারই ছাপ পরে থাকে হৃদয়ের গভীরে। ট্রেড ইউনিয়নের লিডার বাবার চরিত্রের ছাপ আছে কবিরের হৃদয়ে। তাই উত্তরাধীকার সূত্রে সেও লিডার হিসেবে ব্যপক কুখ্যাতি অর্জন করেছে। দীর্ঘ জীবন সরকারী চাকুরী করেও সরকারের এক পয়সার কাজ করতে হয় নি। অসুখের কারণে এখন সে সরকারের কত প্রকারের ক্ষতি করেছে তার একটা হিসেব মাঝ মধ্যে মিলায়। মৌলভীদের কাছ থেকে শুনেছে যত অনিয়ম চালু থাকে যার মাধ্যমে এ সব অনিয়ম যত দিন চলবে তত দিন কবরে শুয়ে শুয়ে নাকি ফলাফল ভোগ করতে হবে। এতসব নৈতিকতা তার হৃদয়ে কখনোই রেখাপাত করে নি। তবু মরন ব্যধীর কল্যানে এখন তার বিধ্বসী চরিত্রের তাপ মাত্রা কমে গেছে। এখন তার হৃদয়ের গোপন অনুভূতি থেকে মনে হয় যত তাড়াতাড়ি এ দেহ মাটির নীচে যাবে মাটির উপরের মানুষদের ততই কল্যান হবে। তারপরও সাহস একেবারে কমে যায় নি। সম্ভবত এ ধরণে লোকের চরিত্র মরার আগ পর্যন্ত বদলায় না। যখন তখন যাকে তাকে ছড় থাপ্পর মেরে দেয়। আন্দোলন করে। জ্বালাময়ী বক্তিৃতা দিয়ে কর্মচারী দরদী নেতা বনে যায়। এতে তার বাড়তি আয়ের পথ সুগম হয়। সবচেয়ে বেশি আয় হয় যখন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের নির্দেশ আসে। এ সময়ে কর্মকর্তাদের গাড়ি দখলে আনা, কর্মচারীদের মিটিয়ে উপস্থিত করানো, ইত্যাদি কাজে ব্যস্ততার কারনে তার কদর বেড়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এইসব পিক আওয়ারে কর্মকর্তাদের ধমকে দেয়া, প্রয়োজনে মার দেয়া ইত্যাদি কর্মকান্ড মামুলি ব্যাপার। তাই কর্মকর্তারাও এ মহাবিপদের সময় সারেন্ডার ভঙ্গিতে সময় পার করেন। এমনিতেই সরকারী অফিসের কর্মকর্তারা নেতাদের ভয়ে ভীত থাকেন।
তবে এখন সে মৃতু্যর পর কি কাজ করতে হবে তার আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে স্লথ গতিতে। বাসার লোকজনকে এখনো বলে নি যে তার হৃদয় কঠিন মরণ ব্যধীর জিবানু বহন করছেন। হঠাৎ করে মরে গিয়ে সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে ! এ কম সময়ে আর কি কি করবে তারই মহাপরিকল্পা নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কেটে যায়।
এক দিন গভীর রাতে উঠে কাপনের কাপড় পড়ে আবার ঘুমাল। মরার আগে একটু ট্রায়েল দিতে হবে। চোখ বন্ধ হতেই দেখে বাবা ডাকছেন। তার মনে পড়ে বাবাতো দু'বছর আগেই মারা গেছেন। কিন্তু কন্ঠতো বাবার মতোই মনে হয়। কিছুই তো দেখা যায় না ! কিছুক্ষণ পর কবির বলল, বাবা তুমি আমাকে ডাকছ ?
এবার পরিষ্কার শুনা গেল হঁ্যা বাবা আমি তোমাকে ডাকছি।
তুমি না মরে গেছ ?
আমি কবর থেকেই ডাকছি।
আমার ভয় লাগে বাবা তুমি আমাকে ডেকো না। মরেই যখন গেছ তখন ডাকা ডাকি কর কেন ?
তুইওতো আমার কাছে আসছিস। তোর টিকেট কাটা হয়ে গেছে।
এসব কি বলছ বাবা!
আমি না তোমার সন্তান। আমি তোমাকে কত ভালবাসি। আমি আরো কিছু দিন বাঁচতে চাই। তুমি এখন যাও বাবা।
তুই কী আমাকে এখনো ভাল বাসিস ?
অবশ্যই তোমাকে ভালবাসি।
যদি তাই হয় তবে তুই একটা কাজ করে দিবি ?
অবশ্যইি দেব। কেবল তুমি আমাকে তোমার কাছে যেতে বল না।
তা হলে শোন। আমি তোদের জন্য চারটি বাড়ি রেখে এসেছি। তুই দু'টি বাড়ি বিক্রি করে দিস।
বল কী বাবা ! বাড়ি বিক্রি করব কেন ? আমারতো টাকা পয়সার কমতি নেই। তুমিইতো অনেক টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে গেছ। তবে কেন বাড়ি বিক্রি করব ?
সেটাই তো এখন আমার মহা বিপদের কারণ হয়ে গেছে। শোন বাবা, আমাকে প্রতি নিয়তই আগুনে গলানো হচ্ছে। লোহাকে যেমন করে চুলি্লতে পুঁড়িয়ে তরল করা হয় এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা করা হচ্ছে। আবার আমাকে জীবীত করা হয় আবার পোড়ানো হয়। আকাশের মতো উঁচু সাপ- বিচ্ছু প্রতি নিয়তই ধ্বংস করছে। আমি মরে ও মরি না। আরো কত রকমের আজাব চলছে বলে শেষ করা যাবে না। বাবা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুই আমাকে বাঁচা।
আমাকে কী করতে হবে, বাবা। তোমার জন্য আমি সব কিছু করব।
তুই দু'টি বাড়ি বিক্রি করে দিস। বিক্রির টাকা এবং ব্যাংকে আমার রেখে যাওয়া সব টাকা তুই আমার নাজাতের জন্য ফিরিয়ে দিস তাদেরকে যাদের টাকা আমি জুলুম করে কামিয়েছি।
এটা কেমন কথা। তুমি কাদের প্রতি জুলুম করে কত টাকা কামিয়েছ আমি জানব কি ভাবে ? আবার বাড়ি বিক্রি করে আমি ফকির হব না কি ! তোমাকেতো আমরা বলি নি আমাদের জন্য বাড়ি গাড়ি করে দিও। এখন এসব বিক্রি করে দিলে তোমার নাতি নাতনিরা পথে বসবে। তুমি কি জান বাবা এখনকার সময়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করাতে কত টাকা লাগে ! আবার আমার অসুখের জন্য অনেক টাকার দরকার। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। বাবা তুমি কি চাওনা তোমার নাতি নাতনিরা অনেক বড় হোক ? তুমি না তোমার নাতি নাতনিদের কত ভাল বাসতে !
ভাল বাসতাম বলেই তো তোদের জন্য এত কিছু করেছি। অর্থের লোভে অন্যায়ের পর অন্যায়, জুলুমের পর জুলুম করে এত টাকা উপার্জন করেছি। মানুষ আমাকে গজব দিয়েছিল। এখন বাবা আমাকে বাঁচা। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তুই ওদের মানে সরকারের টাকা পয়সা ফেরত দিয়ে আয়। ওরা মানে জনগন ক্ষমা না করলে আমার নাকি ক্ষমা নেই।
তোমাকে আমি কেমনে বাঁচাবো বাবা। তুমিতো মরে গেছ। মরা মানুষকে কী বাঁচানো্ যায় ? বলতে বলতে কবিরের তষ্ণায় তার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তৃষ্ণা মিটাতে এখন এক টানে সমুদ্রের তলা শুকিয়ে যাবে। কিন্তু চারিদিকে মরুভূমি। কোথাও কোন ছায়া নেই। সূর্য যেন নেমে এসেছে মাথার উপর। তৃষ্ণার্থ কুকুরের ন্যয় তার জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। এমন সময় এক ফেরীওয়ালা ডাক শুনা গেল। ঠান্ডা পানি আছে। ঠান্ডা পানি। কবির দৌড়ে কাছে গিলে বলল, ভাই আমাকে দয়া করে সবটুকু পানি দিয়ে দিন। আমি খুবই তষ্ণার্থ ।
ফেরী ওয়াল বললেন, বিনীময়ে তুমি আমাকে কি দেবে ?
আমার কাছে তো দেবার মতো কিছুই নেই। আপনার পায়ে পড়ি আমি মরে যাচ্ছি পানির জন্য। দয়া করে কেবল এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিন।
ফেরী ওয়ালা বললেন, আমি বিনিময়ে অনেক অনেক কিছু চাই।
এই পৃথিবীতে আমার চারটি বাড়ি আছে, আপনাকে একটি বাড়ি দিয়ে দেব।
ফেরী ওয়ালা বললেন, হবে না। বলেই তিনি এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, ঠান্ডা পানি আছে। ঠান্ডা পানি।
সময়ের ব্যবধানে তষ্ণায় কবিরের জিহ্বা আরো বেড়িয়ে পড়ছে। বুক ফেঁটে যাচ্চে। কিছুতেই সইতে পারছে না। এত কষ্টের মধ্যেও তার স্মৃতি সচল রয়েছে। সিনেমার পর্দারমতো তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে চলেছে জীবনের সকল অপকর্মের ধারাবহিক সচিত্র প্রতিবেদন। প্রথম যেদিন কর্মকর্তার গায়ে হাত তুলেছিল এবং এই বীরত্বপূর্ণ কাজের বদৌলতে অতি দ্রুত কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছিল সেই কর্মকর্তা আজো তাকে অভিসাপ দিচ্ছেন। এভাবে সরকারী সম্পত্তির আত্বসাধের প্রকৃয়ার ধারাবাহিক ছবি দেখতে দেখেতে কবির হাঁপতে থাকে। তার পিপাসা বেড়েই চলেছে। দিসেহারা কবির আবার ফেরীওয়ালার কাছে গিয়ে বলল, ভাই আপনি আমার চারটি বাড়িই নিয়ে যান বিনিময়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিন।
না ভাই আমি বাড়ি দিয়ে কি করব ! এখানেতো টাকা- পয়সা, বাড়ি-গাড়ি দিয়ে লেন দেন হয় না।
তবে কি দিতে হবে। বলেন, আপনি যা চাইবেন আমি তাই দেব।
ফেরীওয়ালা বললেন, দুনিয়াতে তুমি যত নেক কাজ করেছো সব টাকু আমাকে দিয়ে দাও।
কবির বলল, আমারতো তেমন নেকি নেই তবু যে টুকু আছে আজ আপনাকে সবটুকু নেকি দিয়ে দিলাম। আমাকে এক্ষুনি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিন।
এবার ফেরীওয়ালা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলেন।
কবির পরমতৃপ্তির সাথে পানি পান করল। মনে হলো সে জীবনে কোন দিন পানি পান করে নি।
এমন সময় আসমান থেকে গায়েবী আওয়াজ হলো, করিব মাত্র এক গ্লাস পানির জন্য তুমি তোমারে সারা জীবনের অর্জিত সবটুকু নেকি দিয়ে দিলে! অথচ দুনিয়াতে বিনা মূল্যে তোমাকে আমি কত পানি দিয়েছি, সে সবের মূল্য কোথায় ! কি দিয়ে তুমি আমার এত ঋণ পরিশোধ করবে ! ফেলে আসা জীবনের সঞ্চয় কোথায়? নতুন অসীম এ জীবনতো চলে ফেলে আসা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে।
১২ সেপ্টেম্বর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪