কালাম সাহেব বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক খাটাখাটনি করে নিজের মেয়ের জন্য এবং কাজের মেয়ের জন্য একই রকমের একই দামের দু'টি কোট কিনলেন। শীত মৌসুমে বঙ্গবাজারের অনেক দোকান যাচাই বাছাই করে প্রায় তিন ঘন্টা পরিশ্রম করে অবশেষে এই কোট দুটি পছন্দ করেছেন। বন্ধের দিন ছিল বিধায় তিনি মহাখালী থেকে বঙ্গবাজার পর্যন্ত হেঁটেই গিয়েছেন। কালাম সাহেব এক সময় স্পের্টসম্যান ছিলেন। তাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তার কোন অসুবিধে হলো না। তিনি ছোট বেলা থেকেই সব ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন। যদিও খেলাধুলার জন্য জীবনে কখনো পুরস্কার পাননি, তথাপি তিনি নিরলসভাবে সকল প্রকারের খেলায় অংশগ্রহণ করতেন। যেহেতু পুরস্কার কেবল প্রথম তিন জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো আবার যেহেতু তার অবস্থান সব সময়েই শেষ তিন জন প্রতিযোগীর মধ্যে থাকত, সঙ্গত কারণেই তিনি কখনোই পুরস্কার পাননি। তাই পুরস্কার না পাওয়ার জন্য তিনি নিজেকে কখনো দায়ী করতেন না। একারণে তার কোন মনোবেদনাও নেই। তবে তার দু:খ হয় এই জন্যে যে, আজকালকার ছেলে মেয়েরা নিজেরা না খেলে কেবল কম্পিউটার নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। এ যুগের ছেলে মেয়েরা না খেলাধুলা করে, না খেলাধুলার সুযোগ পায়, না হাঁটাহাঁটি করে। তারা দৌড়াতেও চায় না। ফলে তারা পুষ্টিহীনতায় না ভুগলেও দুর্বল খাঁচায় আবৃত মাংসপিন্ডের সত্থপের মতো বেড়ে উঠছে। তারা ইন্টারনেট আর টিভির মধ্যে মনের অজান্তে নিজেকে সন্ধান করে চলেছে। বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না। এড়িয়ে চলতে চায় বাস্তবতাকে। অবশ্য গ্রামের এবং বস্তির ছেলেমেয়েরা এ শ্রেণীভূক্ত নন।
যাই হোক, আজকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার মধ্যে কালাম সাহেবের বাড়তি লাভ হলো- কম দামে ভাল কোট কিনতে পারা। কোটের যেমন রং তেমনই ডিজাইন। একেবারে আধুনিক। মনে হয় এই ডিজাইনটি এদেশে প্রথম এসেছে। কালাম সাহেব ভাবছেন, কোট পরে মেয়েটি তার বান্ধবীদের বলবে, আব্বু আমেরিকা গিয়েছিলেন, সেখান থেকে কিনে এনেছে। না এমন ডাহা মিথ্যা বলা ঠিক না। সে বলবে, মামা ইংল্যান্ড থেকে পাঠিয়েছেন। এ কথা বললে কম মিথ্যা বলা হবে। কেননা তার বড় মামাতো ইংল্যান্ডে থাকে। কিন্তু মুসিবত হলো আজকালকার স্কুলেযাওয়া বয়সী ছেলে মেয়েরা মিথ্যা বলতে পারে না। তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি এত যে কম, না শিখিয়ে দিলে নিজে থেকে বুদ্ধি করে কিছু বাড়িয়ে বলতে পারে না। তাছাড়া এসব অনৈতিক কথাতো পিতামাতা শিখিয়ে দিতে পারে না। নিজের মগজ থেকে বের করতে হয়। আবার এ রকমের বুদ্ধি না থাকলে ভবিষ্যতে নেতা হতে পারবেনা। এখন চাকুরীর বাজারের চেয়ে নেতা জাতীয় পেশার কদর বেশি। রাতারাতি বড় লোক হওয়ার এটাই এক মাত্র সহজ সরল পথ।
যাই হোক, আসলেই কোট দু'টির দিকে তাকালে মনে হয় ইংল্যান্ডের তৈরী। এসব ডিজাইন তিনি দু'বছর আগে একজন ইংরেজ মেম ইঞ্জিনিয়ার এর গায়ে দেখেছিলেন। ইংরেজ মেম এদেশে এসেছিলেন একটি প্রকল্পের কাজ তদারকির কাজে। কোটটি মেমকে এত সুন্দর মানিয়েছিল যে, কালাম সাহেব তখন ভেবেছিলেন, যদি তিনি এমন একটি কোট মেয়েকে কিনে দিতে পারতেন তবে নিজেকে ধন্য মনে হতো। মেয়েটি সারাক্ষণ তার হৃদয়ে বসবাস করে। নিজের ব্যর্থতার কথা ভেবে কালাম সাহেব সেদিন গোপনে কেঁদেছিলেন। অথচ আজ সেই রকমই দুটি কোট বঙ্গবাজার থেকে কিনেছেন মাত্র এক হাজার টাকায়।
আজ কালাম সাহেবের মনে অনেক ফূর্তি। অনেক কম দামে অনেক ভাল জিনিস কিনেছেন। ফলে বঙ্গবাজার থেকে বের হয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। আজ অনেক টাকা বেঁচে গেছে। তাই খাদ্য বাবদ কিছু খরচ করলে মনোবেদনা হবে না। এ খরচ পুষিয়ে যাবে কোটের দাম থেকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজকাল মনকে সব ধরনের হিসেব দিতে হয়।
চা নাস্তা খেতে খেতে কালাম সাহেব ভাবলেন, আজ বাসায় গিয়ে সবাইকে চমকে দেবেন। কোট দেখে স্ত্রী বলবে, আসলেই তুমি বুদ্ধিমান। ইংল্যান্ড-আমেরিকার জিনিস বাংলাদেশ থেকে খুঁজে বের করলে কিভাবে ? এতদিনে তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে। আগে তুমি যা-তা কিনে আনতে। সারাজীবন কেবল বই পড়েছ। এতদিনে তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে। এবার মেয়েটি বলবে, আব্বু তুমি আসলেই জিনিয়াস। তারপর ইংরেজিতে বিভিন্ন কায়দায় ধন্যবাদ দিবে। কাজের মেয়েটিতো খুশীতে বাকবাক হয়ে যাবে। তার মন চাইবে খালুর পা ছুঁয়ে একটা সালাম করতে। তারতো আবার বাবা থেকেও নেই। তাই মনে মনে ভাববে, বাবা যদি খালুর মতো হতো! কিন্তু সে সালাম দিবে না। সালাম দিতে আসলে না হয় তখন পা দু'টি এগিয়ে দেয়া যেতো। আর মনে মনে নিজেকে সার্থক মনে করতেন। আর মুখে বলতেন, বেঁচে থাক অনেক দিন। কাজ কামে বেশি ফাঁকিঝুকি দিস না। রাগ করে গ্লাস ভাঙ্গিস না। অবশ্য তার একটা সুবিধা ছিল। রাগ করে গ্লাস ভেঙ্গে খালাম্মাকে বলতে পারতো রাফি ভেঙ্গেছে। রাফি কালাম সাহেবের ছোট ছেলে। হাঁটাহঁাঁটি শিখেছে। হাতের কাছে যা পায় তাই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। খেলনাগুলো জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে সে আনন্দ পায়। তার সুবিধা হলো সে ছোট। তাই কেউ তাকে শাসন করে না। এ বয়সে যত বেশি জিনিস ফেলা যায় অথবা যত বেশি জিনিস ভাঙ্গা যায় তাতে দোষের কিছুই থাকে না। বরং এক ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু কী ধরনের আনন্দ লাগে সে বয়সে বলতে না পারলেও বড় হয়ে সে আনন্দের ধরন মনে থাকে না। তাই কাজের মেয়ে মাঝেমধ্যে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে গ্লাস ভেঙ্গে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
কিন্তু কাজের মেয়ে মরিয়মের বাবাতো ছোটবেলায় চার ভাই বোনকে ফেলে আবার বিয়ে করেছে। তারপর থেকে বাবার দেখা নেই। মা পরের বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে বড় করেছে। উড়াল দেয়ার বয়সেই একেক করে সবাইকে বাসায় বাসায় কাজে দিয়ে দিয়েছে। কী করবে! এত মানুষের খাবার একজনের রোজগারে চলে না।
কোট দুটি নিয়ে কালাম সাহেব হেঁটেই মহাখালীস্থ বাসার কাছাকাছি পেঁৗছেছেন। এবার ভাবছেন আজ যখন মনে এতই ফূর্তি তখন আরেকটা সিগারেট খাওয়া যায়। তবে টাকা পয়সার যতই ঘাটতি থাকুক সিগারেটের পয়সা শয়তানেই মিলিয়ে দেয়। তাই শয়তানের দেয়া টাকা দিয়ে বেশি দামী সিগারেই খেতে হয়। আবার সিগারেট তো আজকাল সবার সামনে খাওয়া যায় না। যেমন ছোটদের সামনে খেলে ওরা ভাববে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা যে জিনিস খায় তাতে দোষের কিছু থাকে না। আবার মা'দের পায়ের নীচে বেহেস্ত থাকে। তাই মহিলা জাতির সামনে সিগারেট খেলে তাদের অসম্মান করা হবে। এ অসুবিধা দূর করার জন্য অতি সঙ্গোপনে এ খারাপ জিনিস খেতে হয়। আবার সিগারেট খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাসায় যাওয়া যাবে না। সিগারেট খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে মুখের অসহনীয় দুর্গন্ধ দূর করে আধা ঘন্টা পরে বাসায় ঢুকতে হবে। আজকালকার সিগারেটে যে দুর্গন্ধ বের হয় এই দুর্গন্ধ সারাতে আধা ঘন্টা লেগে যায়। সিগারেট খেয়ে সাথে সাথে ঘরে ঢুকলে মমতা নাকে হাত চেপে ধরে বলবে, আবার ছাই খেয়েছ। আজকাল রিঙ্াওয়ালারা ছাড়া কোন ভাল মানুষকে সিগারেট খেতে দেখিনি। ওয়াক! ওয়াক! আমার বমি আসছে। ছিঃ ছিঃ ঘিন্না। তারপর মেয়েকে ডেকে বলবে, তোর আব্বু আবার সিগারেট খেয়েছে। ক্যান্সার হবে। সবাইকে ভোগাবে। রোগ বাঁধালে আমরা কেউ হাসপাতালে যাব না। ডাস্টবিনে ফেলে আসব। তোর মামাকে টাকা পাঠাতে নিষেধ করে দিস। ছেলে মেয়ের খরচ চালাতে পারেন না তিনি বেনসন সিগারেট খান। এবার মেয়ে এসে বলবে, আব্বু তুমি আবার সিগারেট খেয়েছ ! বড় ছেলে ফারহান দৌড়ে এসে বলবে ছিঃ ছিঃ আব্বু তোমার লজ্জা নেই। (মরিয়মের এত অভিযোগ থাকার পরও স্বামীকে ছাড়া তার এক দিনও কাটে না। তার ধ্যান স্বামী-সন্তানদের নিয়ে।)
তখন কালাম সাহেবের কাছে মনে হবে আগের কালের স্ত্রীরাই ভাল ছিল। তারা সিগারেট নিয়ে হৈচৈ করতো না। প্রেমিকেরা মনে করত সিগারেট না খেলেতো পুরুষই হওয়া যায় না। আজকালকার ডাক্তাররা ও যে কেন এত বাড়াবাড়ি করেন। আরে ভাই সিগারেট না খেলেতো ডাক্তারদের লস। রোগী কমে গেলে তারাই ক্লিনিকে বসে বসে মশামাছি মারবে। বিদেশের ডাক্তাররা যেমন রুগী না পাওয়ার মনোবেদনায় ভোগেন। তাই তারা গবেষণার কাজটি করেন গরীব দেশগুলিতে এসে। এটাও এক ধরনের সেবা। আমাদের ডাক্তারদের উচিত সিগারেট খাওয়ার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা। তবেইতো ব্যবসা জমজমাট হবে। এদেশের ডাক্তাররা পলিটিঙ্ও বুঝেন না ব্যবসাও বুঝেন না। আগের কালের ডাক্তাররাতো নকল করে পাশ করেননি। তাই তারা সিগারেট নিয়ে হৈছৈ করতেন না।
এসব ভাবতে ভাবতে সিগারেট খাওয়ার ঠিক আধ ঘন্টা পর কালাম সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, আজ আর সিগারেট খাইনি। ভাবলাম, সিগারেটতো ভাল মানুষের খাদ্য নয়। এসব রিঙ্াওয়ালাদের খাবার। তাছাড়া ধুয়া পুঁিড়য়ে টাকা উড়ানোর অর্থই হয় না।
বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ফারহান দৌড়ে এসে বলল, আব্বু হঁ্যা করতো দেখি তোমার মুখে গন্ধ আছে কি না ?
কালাম সাহেব একটু টতস্থ হয়ে বললেন, তুমি আর কত দিন বাপের হোটেলে খাবে। আমরাতো তোমার বয়সে রোজগার করেছি।
ছেলেটি জানতে চাইল, আব্বু রোজগার মানে কি ?
এবার কালাম সাহেব বললেন, দেখিতো তোমার বাংলা বইটা নিয়ে এস।
ছেলেটির দুর্বল জায়গায় আঘাত করায় সে আর কোন কথা না বলে চলে গেল।
এবার মমতা বলল, কাজের মেয়েটির জন্য গরম কাপড় এনেছ ?
কালাম সাহেব বললেন, হ্যাঁ সিঙ্গাপুরের কোট এনেছি। তাও একটি নয় দু'টি। একটি তানিয়ার জন্য অন্যটি বুয়ার জন্য।
কালাম সাহেব সবাইকে ডাকলেন, এবার ব্যাগ থেকে কোট দুটি বের করে দেখালেন।
কাজের মেয়ের জন্য কোট এনেছেন দেখেতো মমতা রেগে আগুন হয়ে গেল। তোমার আসলে বুদ্ধিশুদ্ধি জীবনেও হবে না। কাজের মেয়ের জন্য কেউ কোট কিনে ?
কেন তুমিইতো বলতে, হাদিসে আছে, নিজে যা খাও কাজের লোকদেরকে তাই খেতে দিও, নিজে যা পর তাই পরতে দিও, নিজে যেমন বিছানায় শুবে তাদেরকেও সেইরকম করবে। এতে আল্লাহ খুশী হবে। তখন তার কাছে কিছ ু চাইতে লজ্জা লাগবে না। তাই মেয়ের জন্য যা কিনেছি কাজের মেয়ের জন্য তাই কিনেছি।
তাই বলে কোট আনবে ?
কেন অসুবিধে কোথায় ?
আরে হাদা রাম, কোট পরে সে কাজ করবে কিভাবে ?
কেন বিদেশেতো দেখেছি মেয়েরা কোট পরে কাজ করে।
এটাতো বিদেশ নয়। কোট পরে সে কিভাবে কাপড় কাচবে ? ঘর মুছবে ?
কালাম সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। ভাবলেন কথাতো ঠিক। এত বই পড়েছেন, কোন বইতেতো এসব জরুরী কথাবার্তা লেখা হয়নি। না, আসলে জীবনেও তার বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না। টেকনিক্যাল বই পড়তে পড়তে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যেখানে জীবনের কত কথা নেই। সেসব জরুরী কথা বাস্তবতা থেকে জানতে হয়। যেমন আমাদের ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা ছেড়ে কম্পিউটার আর টিভি নিয়ে থাকে। সেখানেও জীবনের সব কথা নেই।
১২ সেপ্টেম্বর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪