কী নিয়ে গর্ব করবো? আমার আর কী আছে এই পোড়া আর না পাওয়া জীবনে? না পেলাম বাবা-মায়ের কাছে, না পেলাম ভাই-বোনদের কাছে, না পেলাম দেশের কাছে! মানুষের জীবনে তো কোনো না কোনো একটি দিক দিয়ে কিছু একটা অন্তত প্রাপ্তি থাকা প্রয়োজন; যে প্রাপ্তিটুকু তার মাথাকে উঁচু করে তুলবে অন্যের কাছে। পরিতৃপ্তি বয়ে আনবে আজন্ম বৈরী প্রতিবেশের হাজারো অতৃপ্তির তিক্ততার মাঝে, এক টুকরো অমৃতের মতোই কিংবা সুমিষ্ট মধুর স্বাদের মতোই মুগ্ধকর! কিন্তু এই পোড়া কপালের দেশে কোথাও কিছু চোখে পড়ে না যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি!
আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে পথ চলেন কফিল উদ্দিন। পরনের প্যান্ট-সার্ট কত মাস ধোয়া পড়ে না বা নিজে কতদিন স্নান-গোসল করেন না তা এই ফকির হাটের কেউই বলতে পারবে না হয়তো। এমন কি তিনি কোথা থেকে এসেছেন বা কোথাকার লোক তার কোনো বৃত্তান্তই কেউ জানে না। অথচ তাকে দেখলে পাগল বলেও মনে হয় না।
আমি যেদিন ফকির হাট থানায় মুন্সি হিসাবে পোস্টিং নিয়ে আসি, সেদিনই ভদ্রলোককে দেখে চমকে উঠেছিলাম। দেখতে হুবহু এবারতপুরের কুদ্দুস আলি হাই স্কুলের কফিল মাস্টারের মতো। কফিল মাস্টারও নিখোঁজ হয়েছেন অনেকদিন হয়ে গেল। প্রথমে হাসপাতাল, থানায় কোনো হদিস না পেয়ে রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি কফিল মাস্টারের। কিন্তু আমি ভেবে পাই না সুদূর রংপুর থেকে এখানে তিনি কী করে আসবেন? এ এলাকায় আসার মতো কোনো সম্ভাবনাও দেখি না। সতের বছর পুলিশে চাকরি করার সুবাদে বা পুলিশীয় জ্ঞানের আলোকেও কোনো সূত্র মেলাতে পারি না।
মাস্টার সাহেবের বড় ছেলে নুরুদ্দিন প্রায়ই থানায় আসতো তার বাবার খোঁজ জানতে। কিন্তু আমাদের লোকেরা তাকে কোনো সুখবর দিতে পারে নি। আসা-যাওয়ার ফলে আমার সঙ্গে তার মোটামুটি ভালো সখ্য হয়ে গিয়েছিলো। একবার সে বলেছিলো, বুঝলেন ভাই, আমাদের বংশটাই মনে হয় অভিশপ্ত। আর এ কথা শুনেই আমার কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তখনই তা প্রকাশ করিনি। তবু সে একটানা বলে গিয়েছিলো তার বংশের পাগলামির ইতিহাস। তার দীর্ঘ কাহিনী থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি, তা মোটামুটি বলা যায় যে, প্রথম পুরুষ পাহাড় মামুদ অবিভক্ত ভারতের নানা আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ব্রিটিশদের নানা অত্যাচার সয়ে সয়ে শেষ কালে যখন গৃহী হলেন, তখনই ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল। পাহাড় মামুদের বড় ছেলে কামালুদ্দিন মারা গেল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়। সেই দেশ ভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাংলাও। তিনি পাকিস্তানে আসতে চাচ্ছিলেন না। মুর্শিদাবাদে কামালুদ্দিনের কবরে পড়ে থাকতেন সব সময়। সেই কবর ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলেন না। যদিও এলেন, পুত্র শোক, দেশভাগ, খণ্ডিত বাংলার শোকে শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
কামালুদ্দিনের ছোট ভাই হেদায়েতুল্লা কফিল মাস্টারের দাদা ছিলেন পাকিস্তানের অন্ধ ভক্ত। মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। অথচ তারই ছেলে কফিল মাস্টারের বাবা মনিরুদ্দিন তিন মাস বয়সের কফিলউদ্দিনকে আর তার মাকে ছেড়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। একজন ঘোরতর মুসলিম লীগ সমর্থক আর কর্মী হিসাবে ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারেন নি হেদায়েতুল্লা। সেই বেদনায় তার মাথায় খানিকটা গণ্ডগোলের মত দেখা দিয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার শোকে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন এই লোকটাই পাকিস্তানটাকে ধ্বংস করে দিলো। বাহাত্তরের দিকে তিনি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন কেউ সেই সংবাদ দিতে পারেনি।
সেই একই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত মুক্তিযোদ্ধা মনিরুদ্দিন পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের সকালে রেডিওর একটি ঘোষণা শুনে একবারই চমকে উঠেছিলেন। সেদিন স্থবির হয়ে সারাক্ষণ বসেছিলেন তিনি। সেদিনের পর থেকে আর কাউকে চিনতে পারতেন না। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু কফিল মাস্টারের এমন কোনো লক্ষণ কেউ দেখেনি যে তিনি মস্তিষ্কের বিশৃঙ্খলায় ভুগতে পারেন। কিংবা এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি যার বিরূপ প্রভাব কফিল মাস্টারের স্মৃতিকে এলোমেলো করে দিতে পারে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো এই ভদ্রলোকটিই নুরুদ্দিনের বাবা কফিলুদ্দিন মাস্টার। আমি যে ক’দিন তাকে দেখেছি, আমার স্মৃতির সঙ্গে তার হাটা-চলা, হাত নাড়ানোর ভঙ্গী চেহারা-সুরত, আকার-আকৃতি সবই মিলে যাচ্ছিলো। তাই বেশ কৌতূহলী হয়েই আমি আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলো না আমাকে। শেষে অনেক ভেবে ঠিক করলাম যে, লোকটির সঙ্গে নিজেই ঘনিষ্ঠ হতে পারি কি না দেখি। হয়তো নানা এলোমেলো কথার ফাঁকে নিজের পরিচয়টাও বলে দিতে পারেন এক সময়।
কখনো পাশে কখনো বা কাছাকাছি হয়ে বুঝতে চেষ্টা করি যে, তিনি বিড়বিড় করে কোন কথাগুলো বলেন। নিশ্চিত হয়ে নোটবুকেও টুকে ফেলি। তারপর একদিন তার মুখোমুখি হতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, পুলিশের লোকেরাই আমাদের দেশটার অর্ধেক পচিয়েছে। আমি নিজে দেখেছি তারা নিজেরা কীভাবে নির্দোষ মানুষকে দাগী আসামী বানায়। ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করে।
আমার কৌতূহল বাড়ে। বলতে বাধ্য হই নাকি মুখ ফসকে বলে ফেলি, সব পুলিশ তো আর খারাপ না!
তিনি ঠিক মাস্টারের অহংকারেই যেন বলে উঠেছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট কিবরিয়া মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ খেয়ে আমার কেসের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। থানার ওসি এক হাজার টাকা ঘুষ খেয়ে আমার বিরুদ্ধে কোর্টে সাক্ষী দিয়েছিলো। আমার ভাই মাত্র চৌদ্দ হাজার টাকার ঈর্ষার কাছে হেরে গিয়েছিলো। নারায়ণকে যদি নয়জন চোরের পাশে বসিয়ে দাও, তাহলে লক্ষ্মীও স্বামীকে চোর সাব্যস্ত করতে দ্বিধা করবে না।
আমি কী বলবো? মাস্টার সাহেব যেন আমার দু গালে দুটো থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছেন এমনই এক যন্ত্রণায় আমার মনের ভেতরটা দগদগে হয়ে উঠেছিলো। আমি সেদিন কিছুই বলতে পারিনি। মাঝে মাঝে দেখতাম শিবুর স্টলে দাঁড়িয়ে তিনি চা খাচ্ছেন। তাই চায়ের উপর ভরসা করেই তার আরো কাছাকাছি হতে চেষ্টা করলাম। প্রতিদিন আমার ডিউটি শেষ হলেই বাজারে চলে আসি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এগিয়ে যাই তার কাছে। তিনি হাসি মুখে চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলেন, চায়ে আমার অরুচি নেই, যতটা অরুচি এই দেশটার প্রতি।
কেন আপনার অরুচি। দেশটা কি পচে গেছে?
আমার জিজ্ঞাসায় তিনি সতর্ক হয়ে কাপ হাতে দূরে সরে যান। এভাবেই দিন কাটে আমার। একদিন মানে গতকালই সেই সুযোগটা আসে, তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই বলে উঠলেন, কী নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি? এই পোড়া দেশে এমন কিছু নেই যা নিয়ে গর্ব করা যায়।
আমি তখনই বলে উঠি, যায় স্যার। এমন অনেক কিছুই আছে যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের গর্ব হয় তাদের জন্য, উনিশ শো বাহান্নতে উর্দুর বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে উঠেছিলেন বাংলা ভাষার জন্য। যাঁরা মাতৃভাষার জন্য নিজের প্রাণটাকেও উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। গর্ব করতে পারি তাঁদের জন্য, যারা ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে রাজপথ থেকে আইয়ুবের কলিজা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা গর্ব করতে পারি আমাদের দেশের সেই সূর্য সন্তানদের জন্য যাদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, শ্রম আর দেশপ্রেম পৃথিবীর মাঝে দিয়েছে আমাদের আলাদা মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে আমাদের ভাষা শহিদ দিবসটি। এর বেশি আর কোন কিছুর প্রয়োজন আছে নাকি স্যার? পৃথিবীর আর কোন দেশ এত কিছু নিয়ে গর্ব করতে পারে? এ নিয়ে ভাবলে আমার তো অহংকারে আর গর্বে বুকটা ভরে যায়। আপনার কি একবারও এ কথা গুলো মনে হয় না?
তারপরই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই কেমন অচেতন হয়ে গেলেন। তারপরই স্যারকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আপনাদের থানায় রেডিওতে সংবাদ পাঠাই।
আঠারো বছর ধরে এবারতপুর ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মেহেরুল্লা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আসলে কফিল মাস্টারই শুধু না, আপনেও শুধু পুলিশ বিভাগের না আমাদের দেশেরও গর্ব।
চেয়ারম্যানের কথায় লজ্জা পেলেও আমাদের ঘিরে রাখা এলাকার মানুষের ভিড়টাতে কোনো পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়ে বেশ স্বস্তি অনুভব করি।
৩০ আগষ্ট - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪