\\ এক\\
স্যার, 'এই যে আপনার পরিচিতি, একটু যদি দেখে দিতেন।'
কথাটা বলতে বলতে নিমিতি হক কাগজটা ফয়জুদ্দীন আলামত চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিলেন । আলামত চৌধুরীর ডান হাতে কালচে বাদামী রঙের তামাকের পাইপটা ধরা। সেটা ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সুন্দরী নিমিতির হাত থেকে বাম হাতে কাগজখানা নিতে নিতে একফালি হাসি তার সেই ঠোঁট হতে বেরিয়ে এল দীর্ঘ মোচ দাড়ি পেরিয়ে। ধবধবে সাদা দাড়ি-মোচে সুফি সুফি ভাব লোকটার। তাকালেন কাগজের লেখায়। একটু ক্ষীপ্ত হলেন। বললেন, 'এটা কেনো ? আমার সেক্রেটারী দেয়নি ? ওকে তো কারেকশন করেই দিলাম। সব অনুষ্ঠানে কি সব পরিচয় দেয়া যায়। সেক্রেটোরী, আই সেক্রেটারী...'
চলি্লশোর্ধ বয়সের এক আর্কষনীয় তনুকাঠামোর নারী দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে এলেন। 'স্যার, আমি তো একটু আগে ডিরেক্টর সাহেবকে দিয়ে এলাম।
'স্যার, আমি দেখছি' বলেই নিমিতি সেখান থেকে ছুটে পালাল। ডিরেক্টরের রুমে ঢুকেই দেখল ডিরেক্টর স্যারের সামনে কাগজটা। 'স্যার আলামত চৌধুরীর পরিচয়নামা কি এটা...' বলেই কাগজটা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে বের হয়ে গেলো। ডিরেক্টরর কি যেন বলতে যাচ্ছিল। নিমিতি চোখের ইশারায় সব বুঝিয়ে দিল। তারপর ডিরেক্টরের রুম থেকে স্টুডিও পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার স্বল্প পরিসরের করিডরে পিয়ন শাহিনের সাথে ধাক্কাটা লাগতে লাগতে কোনমতে সরে বাঁচলো। পিয়ন ছেলেটা হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকছিল।
'দেখে চলতে পারিস না শাহিন, চোখের কি মাথা খেয়েছিস'
'সরি আপা, আপনে দৌড়াইতাছেন কেন?'
'কেনো আবার! অতিথির পরিচয়নামার সাপ্লাই এসেছে। এইমাত্র হাতে পেলাম। শু্যটিংয়ের আয়োজন প্রায় সবইতো শেষ। সবকিছূ ঢুকে গেছেনা স্টুডিওতে?'
'না আপা, এই যে নিচ্ছি, কুত্তা বিলাই গুলান এখনও ঢোকেনি।'
'চুপ! ঐগুলান কুত্তা বিলাই না, কুকুর-বিড়াল বল, স্যার শুনলে তোর কিন্তু চাকুরী নট। তাড়াতাড়ি কর। পানি নিচের দিকেই গড়ায়। ওনারা দেরিতে এসেছেন তার জন্য কিছু হবে না, তুই দেরী করেছিস কি মরেছিস।'
'আপা, ও আপা...'
'দূর আবার কিরে?'
'আপা, এই যে এই ব্যাগের ভেতর এই যে এই প্যাকেটটা খোলা , কি সুন্দর খাবার। ঐ স্যারে কি এইসব খায়। আমাগো চা নাস্তা খাইবনা ?'
'কোনটা? আরে বোকা, এইটা তো কুকুরের খাবার। পেডিগ্রি। অনেক দাম। '
'কত দাম হইতে পারে? '
'এই এক প্যাকেট দুই হাজার টাকার মত।'
'যাক, তাইলে পেটের কিছু হইবো না।'
'মানে, তুই কি খোলা প্যাকেটটা থেকে খেয়েছিস, আর ওটা খুললইবা কি করে, সব তো ইনটেক্ট প্যাকেট থাকার কথা। '
'ঐ কুত্তাগুলানের লগে, সরি কুকুরের লগে এক ব্যাটা আইসে হেইডা খুলছিল। ভাবছি হে চুরি করে খাইছে। আমিও চামে এক চামচ খাইয়া হালাইছি।'
'বাহ! খুব ভালো কাজ করেছিস, ডিরেক্টর স্যারের কানে গেলেই বুঝবি ঠেলা, ঐ খাবার সবতো আমরাই কিনে দিয়েছি রে।'
'আপা, আপনে কইবেন না তা আমি জানি, তারপরও সত্যি কিছূ হইবোনাতো ?'
'কুকুরের খাবর খেয়েছিস সে জন্যে না কি স্যার জানলে...'
'আমরা ঐ কুকুর-বিড়ালগো চেয়ে অধম। এই পেটে সহ্য হইয়া যাইবো, স্যারের ভয়ডাই পাইতাছি এখন।'
\\দুই\\
স্টেজ সম্পূর্ন রেডি করা হয়ে গেছে। কুকুর আর বিড়ালের খাঁচা বসার স্থান হতে ডানে একটু দূরে এক কোনায় স্থাপন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরুর সিগন্যাল দিলেন ডিরেক্টর। আলামত চৌধুরী ঠোঁট হতে পাইপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে আয়েস করে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন।
'দর্শকমন্ডলী আপনাদের পছন্দের অনুষ্ঠান -দেশপ্রেমীক- এ আজকের অতিথি আপনাদের অতি পরিচিত একজন। হ্যাঁ তার দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। সংক্ষেপে তিনি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবী, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক কূটনীতিবীদ, সাবেক রাজনীতিবিদ, জনদরদী, গরীবের বন্ধু, ধর্মপ্রান মুসলীম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জনাব আলহাজ্ব ফয়জুদ্দীন আলামত চৌধুরী। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা ওনার সাথে আলোচনাই কেবল করব না সাথে তিনি তার এক গবেষনাও আমাদের কে বাস্তবিকভাবে ব্যাখ্যা করে দেখাবেন। '
নিমিতির কথাগুলো ক্যামরায় টেক হবার পর ক্যামেরা ধরা হলো আলামত চৌধুরীর উপর। তিনি একরাশ হাসি দিলেন। সেই হাসি আবারও মোচ দাড়ি পেরিয়ে ক্যামেরার লেন্সে ছড়িয়ে পড়ল।
এর পর অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক নিমিতি হক সাধারণ প্রশ্নগুলো করা শুরু করল - 'স্যার কেমন আছেন?'
'ভালো,তবে আরও ভালো থাকতে পারতাম যদি এই শেষ বয়সে দেখতে পারতাম দেশে একটা সুন্দর শাসক আর প্রজার সহ অবস্থান গড়ে উঠেছে। সুন্দর একটা দেশ গড়ে উঠেছে। সবার মাঝে দেশপ্রেম জেগে উঠেছে। '
'আপনি কি মনে করেন তাহলে দেশের বর্তমান নেতানেত্রীর দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে।'
'ঠিক,তা না ,তবে দেশপ্রেম আমজনতা এবং নেতা শাসক সবারই থাকতে হবে, যেখানে যতটুকু প্রয়োজন।'
'আচ্ছা স্যার, আপনা পরিচয়ে নতুন একটি শব্দ পেলাম, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, এটার মানে কি? আমরা তো জানি পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট এর বাংলা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। '
'না, আমি ঠিক সেটা ঠিক মনে করছি না, পলিটিঙ্ মানে কেবল রাষ্ট্র নয়, এর মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে মানে যেটাকে রাজনীতি বলা হয়, তাহলে পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট এর বাংলা রাষ্ট্র বিজ্ঞানী না হয়ে রাজনৈতিক বিজ্ঞানী হওয়াটাই কি বাঞ্চনীয় নয় ?'
'হয়তো ঠিক স্যার । '
'স্যার, আপনার ছেলেতো বর্তমানে বিরোধী দলের এমপি। আগে তো আপনি যে দল করতেন সেখানেই ছিল। দলত্যাগের কারন কি বলে মনে করেন? এটা কি কেবল নমিনেশন বিষয়ক জটিলতার কারনে? আপনি এটাকে কিভাবে দেখছেন? '
ক্যামেরার দিকে হাত তুলে আলামত চৌধুরী বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। বললেন, 'এসব প্রশ্ন পরে কর। প্যাট ডগস আর ক্যাটস গুলো অনেক ক্ষুধার্ত। ওদেরকে সকাল থেকে না খাইয়ে রাখা হয়েছে। আগে আমার গবেষনা আর থিউরিটা দেখাতে দাও। ওটার শু্যট কর। পরে সব উত্তর দেব। ট্রেনারের দিকে হাত তুলে রেডী হতে নির্দেশ দিলেন।
ডিরেক্টরর ছুটে এলেন স্টেজে। নিমিতির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, 'তুমি স্ক্রীপ্টের বাইরে এসব প্রশ্ন কেনো করছ? তুমি কি জানো না আলামত সাহেব আর তার এমপি ছেলে দুজনেইর এই টিভি মিডিয়াতে শেয়ার আছে। তাড়াতাড়ি এই কুকুর বিলাই খেলা শেষ করতে দাও। ওগুলোর পিছনে কম খরচ হয়নি। আরও থাকলে আরও খরচ। '
'কিন্তু স্যার। দর্শকের চাহিদা বলে একটা কথা আছে। জনপ্রিয়তা পেতে হলে এসব প্রশ্ন...।
'সে পরে দেখা যাবে। তুমি তো ভাবার জন্য নও। ভাবার জন্য তো আমরা অনেকেই আছি।'
ক্যামেরা ম্যানের খুব কাছে দাঁিড়য়ে ছিল শাহিন। নিমিতির মত ক্যামেরাম্যান আন্দালিবের সাথেও তার বেশ সখ্যতা। তার দিকে ফিরে বলল, 'হায় হায়, এর আগে হেই দিন আরেক বুইড়া ভিআপি আইছিল। নিমিতি আপারে জিগাইলাম, একটা কাম কইরাই অত বড় দেশপ্রেমিক কেমন হইলো, আপায় কইলো, সবচেয়ে উপরের পরিচয়টা দিলেই তো হয়, মানুষের সব পরিচয়ক আর নামের আগে বলা সম্ভবব নাকি। এই স্যার দেহি সব পরিচয় কইয়া দিল। হেইর ল্যাইগ্যাই নিজে লিখা পাঠাইছে।'
আন্দালিব হাসলো একটু । তারপর আবার মনোযোগ দিল অনুষ্ঠান ধারনে।
'হ্যাঁ, স্যার রাজনৈতিক বিজ্ঞানীর কথা বলছিলেন।'
'ঠিক। রাজনীতি থেকে অবসরে গিয়েছি তো অনেক আগেই। মাঝে কিছুদিন মেজ ছেলেটার ওখানে ইউসএ গিয়ে কাটালাম। হার্টের বাইপাসটা করালাম। ওখানে থেকেই কুকর আর বিড়ালের প্রতি একটা আর্কষণ জাগে। ছোট নাতিটার কুকর আর বিড়ালের খুব শখ। দেশে আসার পর নাতিই আমাকে কয়েকটা কুকুর আর বিড়ালগুলো পাঠায়। পরে নিজে আরও কয়েকটা বিদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করেছি। এদের নিয়ে আমি একটা গবেষনা চালিয়েছি। পলিটিক্যাল গবেষণা। এখনও চলছে। বর্তমানে রাজনৈতিক একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। সেটাই ডিসপ্লে করে দেখাব।'
'এই বিষয়ে দুটি প্রশ্ন করব। এর পরেই দর্শকমন্ডলী আমরা চলে যাব গবেষনা দেখতে। প্রথম প্রশ্ন -সেটা কি দেশপ্রেম বিষযক কোন গবেষনা? ২য় প্রশ্ন - দেশীয় কুকর -বিড়াল দিয়ে কি এই গবেষণা করা সম্ভব?
'প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব, ঠিক তা না, তবে এ থেকে আমি বুঝিয়ে দেবে আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান সমস্যা আসলে কোনটা। আমরা যারা যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছিলাম, আমরা কেনো যুদ্ধে গেছি? তার পেছরেন দুটি মূল কারন। নিজের অস্তিত্বের প্রতি ভালবাসা আর নেতার প্রতি আনুগত্ব আর বিশ্বাস থেকে । আমি এখানে দুটি কুকুর আর দুটি বিড়াল এনেছি। এরা আমার খুব আদরের। কোন দেশি খাবার এদের খাওয়ানো হয়না। বোঝ। রাতে এসি রুমে ঘুমাতে দেয়া হয়।
দর্শক মন্ডলী আপনারা যে সাদার মধ্যে কালো ফোটা ফোটা দেয়া কুকরটি দেখতে পাচ্ছেন এটাহলো ডালমেশিয়া কুকুর। বেশ প্রভূ ভক্ত কুকর। এটাকে গৃহস্থালী কাজে বেশ ব্যবহার করা যায়। আর বড় যে কালো কুকরটি দেখছেন এটার নাম ল্যাবরোডার। ব্লাক ল্যাবরেডোর। বেশ স্পোর্টিভ। বিড়াল দুটিও বিদেশ থেকে আনা । দুটোই মগিস জাতের বিড়াল। ক্রস ব্রিডিং করে এই ধরনের সুন্দর বিড়াল তৈরী করা হয়েছে। কত উন্নত ঐসব দেশের প্রযুক্তি আর আমরা এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতার বেড়াজালেই আটকে আছি। এর থেকে মুক্তির উপায় আমি বের করে করার চেষ্টা করেছি আমার এই কুকুর বিড়াল গবেষনায়। '
'স্যার, দর্শকের আগ্রহ হতে পারে বলেই জানতে চাচ্ছি -আপনার বাসায় মোট কতগুলি বৈদেশিক কুকর বিড়াল রয়েছে। একজাক্ট সংখ্যাটাকি আমাদের দর্শকদের জন্য বলবেন ?'
'কুকর সব মিলিয়ে মানে পাপ্পিগুলোসহ মোট ১৫টা। তুমি যদি প্রজাতি বল তাহলে সাত প্রজাতির কুকুর আছে আর বিড়াল একটু কম, এখন ১০টি। এই সবগুলো কুকর-বিড়াল দিয়ে আমি বারবার এই পরীক্ষাগুলো করেছি। ফলাফল সেম হওয়ার পরেই মূল সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। '
'ধন্যবাদ স্যার। দর্শক মন্ডলী এখন আমরা দেখব কুকুর বিড়াল নিয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সের এই গবেষণা...।'
'না, আগে একটু ব্যাখা করে নিতে হবে।
এই খাঁচাটার দুটো অংশ। মাঝখান থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়া যায়। প্রথমে আমি খাঁচার এই মাঝের অংশের একপাশে রাখব কুকুর দুটো আর অন্য পাশে বিড়াল দুটো। পুরো পরীক্ষায় আমাকে সহযোগিতা করবে আবার প্যাট সহচর জনাব মোঃ জনাবুল মিয়া। জনাবুল কুকুর গুলোকে কোন খাবার দেবেনা। খাবার দেবে বিড়ালের অংশে। বিড়াল খাবার খাবে আর কুকুর গুলো লাফালাফি করবে। চিৎকার করবে। ক্ষিপ্ত হবে। এটা অসম বন্টন। দুর্বলকে সুবিধা প্রদান আর সবলকে প্রহসন। এই অবস্থা বাঞ্চনীয় নয়। দ্বিতীয় স্টেপে, কুকুর দুটোর পাশে দুই কুকুরকেই আলাদা আলাদা খাবার দেয়া হবে আর বিড়ালদুটোর পাশে কিছূ দেয়া হবে না। এবার বিড়ালরাও মিউ মিউ করবে কিন্তু কুকরের ভয়ে আষ্ফালনটা তীব্র হবে না। এই অবাস্তও বাঞ্চনীয় নয়। '
'স্যার , আপনি কি কুকুর-বিড়াল এর মাধ্যমে আসলে এ দেশের আম জনতার স্বভাব-চরিত্র ব্যাখার চেষ্টা করছেন। জনগণকে কুকর বিড়ালর সাথে তুলনা করা হলো না?'
'নিমিতি তুমি বড্ড বেশি প্রশ্ন কর। ডিরেক্টর, ফাইনাল এডিট করার আগে আমাদের দেখিয়ে নিও। এইসব কথাবার্তা রাখলে হবে নাতো। সেক্রেটারী তুমি এটা খেয়াল রাখবা। নিমিতি এইসব প্রশ্ন আর করোনা, সিকোয়েন্স নষ্ট হবে। তোমার মত সম্ভাবনাময় অ্যাঙ্কর..., না আমার বাড়ীতে তুমি এসো মঝে মাঝে , দেখে যেও কুকুর বিড়ালের কান্ড নিজ চোখে, তোমার লাভ হবে।'
'নিমিতি একটু নরম হয়, বলে, জি স্যার।'
'ঠিক আছে, ডিরেক্টর এ টুকু ফেলে দিয়ে আবার শুরু কর।'
\\ চার\\
'...তৃতীয় স্টেপে, কুকরকে আলাদা খাবার আর বিড়াল দুটোকেও আলাদা খাবার দেয়া হবে। তবে একটা একটা পাত্রে। দেখা গেছে এ ক্ষেত্রে বিড়ালদুটো সু্ন্দর খেতে শুরু করবে কারন তারা একই প্রজাতির। কিন্তু কুকুর দুটো দুই প্রজাতির হওয়ায় এবং ল্যাবরাডোর আকারে ও শক্তিতে বড় হওয়ায় সে একাই সব খেতে চাইবে। চতুর্থ স্টেপে, খাঁচার মধ্যবর্তী বাঁধা সরিয়ে দেয়া হবে। এবার খাবার দেয়া হবে চার পাত্রেই। কিন্তু কুকরদুটো দুই দিকে গিয়ে দুটি করে পাত্র আগলে খেতে থাকবে আর বিড়ালদুটো একটু দূরে মিউ মিউ করতে চেষ্টা করবে। ঠিক তখন আমি আর জনাবুল গিয়ে কাছে দাঁড়াব এবং তারা খুব সুন্দর ভাবে চারজনেই চারটি খাবারে এগিয়ে খেতে শুরু করবে। এটাই হলো যোগ্য লিডারশীপের প্রতি কিংবা মুনিবের প্রতি আনুগত্যের দৃশ্য। ঠিকএভাবেই সুন্দর সুষম পরিবেশ বিরাজমান হবে। যেকোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।
এবার আর কোন কথা নয়। আগে আমরা চলুন প্যারাকটিক্যালি বিষয়টা দেখি। তাহলেই ক্লিয়ার হয়ে যাবে।'
প্রথম স্টেপ শুরু হলো। বিড়ালদুটো বিড়ালের মত খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কুকরদুটো ঘেউ ঘেউই করছেনা। জনাবুলকে ডাকলেন আলামত চৌধুরী। কানের কছে মুখ নিয়ে বললেন, 'বিড়ালের খাঁচার কি পেডিগ্রি দাও নাই, খালি বিড়ালের শুকনো খাবার নাকি?..
'দিয়েছি স্যার।'
'তাহলে? কুকুরকে কি গাড়ীতে কিছু খেতে দিয়েছিলে?'
'স্যার, খুব চিৎকার করছিল, এই একটু না দিলে আর থামছিলইনা।'
'তুমি না একটা... হারামজাদা, এখন কি হবে ? ...হারামী যা কুকরদুটোর সামনে খাবার কিছুক্ষণ রেখে তারপর সরা। লোভ জাগা। এতে কাজ হবে? আমি এই ফাঁকে চা নাস্তা খেয়ে একটু সময় নষ্ট করাচ্ছি।'
শাহিন মুচকি মুচকি হাসে। সে পেডিগ্রির প্যাকেট খোলা দেখে পরে জনাবুলের সাথে কিচুক্ষণ খাতির করে জেনেছে খুব চিল্লাছিল কালোটা। খাবার প্যাকেট খুলে খাবার দিয়ে তবে থামিয়েছে। জনাবুল তাকে আরও বলেছে সে নিজেও খেয়ে দেখেছে আগে, কোন ভয় নেই। শাহিন খুব আনন্দে আছে তাই। ঘোড়ারডিমের এই গবেষণা এখন বারোটা বাজবে। শিপন আর হাসি থামাতে পরেনা।
একটু নাস্তা পর্ব চলছে। হঠাৎ সেক্রেটারী মহিলা উঠে আসে আলামত সাহেবের দিকে। বিমর্ষ চেহারা। এগিয়ে গিয়ে বলে, 'স্যার, ঘটনা ভয়াবহ। সব টিভি চ্যানেল আপনার ছোট ছেলে আলিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে কিসব উল্টোপাল্টা দেখাচ্ছে। এই চ্যানেলেও।'
আলামত চৌধুরী কুকুরগুলোকে পেট ভরে খাবার নির্দেশ দিয়ে অনুষ্ঠান থেকে উঠে নিউজ রুমের দিকে চলে গেলেন। চেহারা তার রক্তিম হয়ে উঠেছে। সাদা দাড়ির গোঁড়ায় গোঁড়ায় আগুনর জ্বলছে এখন। তার ছেলের সম্পর্কে আজেবাজে কথা। অন্য টিভি বলছে সে এক কথা কিন্তু তার নিজের টিভিতেও।
ঘটনা যত সহজ ভাবছিলেন ততটা না। বেশ ভয়ংকর। র্যাব গিয়েছিল জাল নোট ছাপানোর খবর পেয়ে। গিয়ে সেখানে জালনোটে ছাপানোর সরঞ্জামের পাশাপাশি অন্য এক তলায় নকল স্যালাইন, নকল প্যারাসিটামল এসব ওষুধ তৈরীর কারখানও মিলেছে। আর সবচেযে ভয়াবহ ঘটনা হলো ঐ একই বিল্ডিংয়ের টপ ফ্লোর মানে ছয় তলার এক রুম থেকে মিলেছে উঠতি মডেল আনায়ার ফাঁস দেয়া লাশ। র্যাব বলছে আজই সকালে মারা হয়েছে ফাঁস দিয়ে। ঐ বাড়িটি শাহজাদুপরে অবস্থিত এবং এর মালিক আলামত চৌধুরীর ছোট ছেলে আলিফ চৌধুরী। বিল্ডিংটির তিন তলা পর্যন্ত আলিফ চৌধুরীর অ্যাড এজেন্সি ক্রিস্টাল ডিসপ্লে অবস্থিত।
এই বুড়ো বয়সে এমন একটা ধাক্কা হঠাৎ সহ্য হলোনা। মাথাটা আলামত চৌধুরীর ভেতরে ভেতরে চক্কর খেলো। পাইপ টানার পরিমাণ বেড়ে গেলো। তার চারপাশ ঘিরে ধোঁয়ার আবরণ। তবুও তার প্রজ্ঞা জেগে উঠল ঠিকই। দীর্ঘ কালের অভিজ্ঞতা। কারও উপর ভরসা করে লাভ নেই। নিজেকেই সব সামাল দিতে হবে। সেটাই আগে। পরে দেখা যাবে। তিনি দ্রুত নিউজ এডিটরকে ডাকলেন। বুঝিয়ে বললেন, আধঘন্টা মধ্যে তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। সাথে তার বড় ছেলের তারও। তাকে আনানোর ব্যবস্থা তিনি করছেন।
আবার স্টুডিওতে ফিরলেন। খোলামেলা জায়গা। এসি আছে। তবুও ঘামছেন। এখানে বসলেই মাথা খুলবে। খুব বিরক্ত হচ্ছেন। ছেলেগুেলো বুড়ো বয়সেও বাবাকে রাজনীতির চাল দিতে বাধ্য করবে এখন। খুব খারাপ। কোথায় গবেষণা নিয়ে মাতবে তা না এখন এইসব উটকো ঝামেলা। লাশ! তাও ঐ মডেলের। আরে বাবা লাশ গুম না হয়ে পড়ে থাকবে কেনো? এ কোন পলিটিঙ্? কিছুই শিখলোনা ছেলেটা।
অলরেডী বড় ছেলে টিভিতে অন্য চ্যানলে বিবৃতি দিয়েও দিয়েছে। সে বলেছে এ বিরোধী দলের চাল। তাকে হেয় করার জন্য তর ছোট ভাইকে ফাঁসানো হয়েছে।
ওদিকে বিরোধী দলেই তো একদা আলামত ছিলেন। ছিল তার বড় ছেলেও। দলের সেক্রেটারী ফোন করেছেন আলামত চৌধুরীর কাছে। তাদের দলের নাম উঠে এলে তার ছেলের সাহায্যে তারা থাকবেনা। তিনি আর কি করেন। দ্রুত বড় ছেলেকেও ফোন দিয়ে চুপ থাকতে বললেন। আর বললেন স্টুডিওতে চলে আসতে।
মাথাটা গরম গচ্ছে। সমস্যা জটিল মাত্রা পেতে সবে শুরু করেছে। চা দরকার। শাহিনের ডাক পড়ল।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সেক্রেটারী এতক্ষণে আলিফের মোবাইলে ঢুকতে পেরেছে। স্যারের কাছে মোবাইল এগিয়ে দিল। মোবাইলে ছেলেকে এক হাত ঝারলেন। এত বড় ভুল সে কি করে করে।
ঠিক সেই সময় শাহিন চা নিয়ে ঢুকলো। শুনে ফেলল মোবাইলের কথোপকথন। আলিফকে আলামত চৌধুরী এখনই ওপারে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন সব। নিয়ে যাওয়ার লোক রেডি আছে। শুধু মুভ করলেই হবে। এর মধ্যে সব ঝামলোর উপর অন্য রঙ দেয়ার একটা ব্যবস্থা তিনি করবেনই। ছেলেক জানালেন মাথার ভেতর একটা পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। ছয়মাস আগেই বিল্ডিংটা সুলতান মৃধাকে লিস দেয়া হয়েছিল। সুলতান মৃধাও তোর সাথে ওপারে চলে যাবে। ওর জন্য এসব কোন ব্যাপার না। সবাই জানে সে টপ টেরর ট্যারা নয়নের লোক। কিন্তু সবাই জানেনা কেবল ট্যারা নয়নটা কাল্পনিক চরিত্র। একটা কাল্পনিক ট্যারা নয়ন কত বার কত কাজে এসেছে তার আর তার বন্ধুদের। আবারও কাজে আসবে। প্রশ্ন উঠবে ওমন লোক কে কেনো লিস দেয়া হলো। সহজ উত্তর সুলতান মৃধা ট্যারা নয়নের লোক জানলে নিশ্চয় দেয়া হতোনা। আর ঐ ক'মাস ধরে ক্রিস্টাল ডিসপ্লের সকল কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। অফিসে সার্বক্ষনেই ছিল তালা। সো আলিফের কোন ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঐ বিল্ডিংয়ে নেই। ছয় মাস ধরে সে যায়ই না সেখানে।...
শাহিন শুনে খুব মর্মহত হলো। মনে মনে মনে ভাবল, 'এ নাকি দেশপ্রেমিক, কিসব রাজনীতি, কুত্তা-বিলাই গবেষক। সকালে বাসায় ছোট বোনটার বাচ্চাটার জন্য স্যালাইন কিনে দিয়ে এসেছে। বিধাব বোনটা তার সাথেই থাকে। গতকাল থেকে পেটের অসুখ। বস্তির মোড়ের দোকানের স্যালাইন। যদি এই নকল স্যালাইনই হয়। সে ভয় পায়। দেশের অগণিত গরীবের জন্য মায়া হয। দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় মন।
নিমিতি ম্যাাডামের রুমে ছোটে। ওনার পরামর্শ নিতে চায়। কিন্তু উনি দরজাটা ভিড়িয়ে কাঁদছেন একা একা। নিউজ রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় টিভিতে আনায়ার চেহারাটা দেখে আরেকবার । চিনতে পারে এখন। এই অফিসে নিমিতি আপার কাছে এসেছে কয়েকবার। ওনার ঘনিষ্ট বান্ধবী। শাহিন নিমিতি আপাকে আর বিরক্ত করেনা। সে আর কাউকে বলার মত খুঁজেও পায়না। তার কিছু ভালো লাগে না। সে একটু আগেই শুনে এসেছে সব ঐ বুড়া ভিআইপি আর তার ছেলেদের কৃতকর্ম। কিন্তু সবতো লুকিয়ে ফেলা হবে। সে বুঝে উঠেতে পরেনা তার কি করা উচিৎ। যার তিন বেলা পেটের ভাতই জোগার হয়না, তার জন্য এইসব অপরাধ জেনেও ধরিয়ে দেয়ার কি করার আছে । সে বুঝতে পারে না।
\\ পরিশিষ্ট \\
অশিক্ষিত, হতদরিদ্র শাহিন দেশপ্রেমের তত্ত্ব বোঝেনা। সে ন্যায় অন্যায়ের শিক্ষিত রূপ বোঝেনা। কিন্তু তার মন মানছে না। সে মনের কি এক প্ররোচনায় ছুটে যায় তাদের অফিসেরই কাছের পুলিশ স্টেশনে। থানার সেকেন্ড অফিসারকে সে চেনে। তাদের অফিসে অনেকবার এসেছে। কত চা বানিয়ে খাইয়েছে। লোকটাকে তার বেশ ভালোই মনে হয়। তাকে বখশিসও দিয়েছে অনেকবার।
সব খুলে বলে সেকেন্ড অফিসারকে। শাহিনকে সাথে করে ইনচার্জের কছে নিয়ে যায়। শাহিনের পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বাহবা দিলো ইনচার্জ । তারপর সাথে করে সেকেন্ড অফিসার সহ শাহিনদের টিভি চ্যানেলের অফিসে রওয়ানা হলো।
সরল সোজা শাহিন কি করে জানবে গাড়ীতে ওঠার আগেই ইনজার্চ আলামত সাহেবের সেক্রেটারীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে শাহিনের এই দেশপ্রেমের কাহিনী।
...আলামত সাহেবের রক্তচক্ষু দেখে ভয় পেয়ে যায় শাহিন। ডিরেক্টর সাহেব তাকে স্পটেই চাকুরী চু্যত করলেন। শাহিন কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারছিলনা। নিমিতি ম্যাডামকে খুঁজছিল তার চোখ। কোথাও দেখা মিললোনা। আলামত চৌধুরীর সেক্রেটারীর সাথে আরেকটা লোক এসে তাকে দু'হাতে ধরে নিয়ে গেলো। গাড়ীতে কুকুর বিড়ালগুলো উঠানো হয়ে গেছে। সেই একই খাঁচায় ভরা হলো তাকেও। সেক্রেটারী মহিলাটি চলে যেতে যেতে একটি কথাই বললেন, 'স্যার এখন বুড়ো হযেছেন, তাই বেঁচে গেলে, উনি কোন খুন খারাবী আর চান না। ক'টা দিন একটু খাঁচাতেই থাক।...'
স্টুডিওতে তখন আলামত আর তার এমপি ছেলে আলিফকে বাঁচানোর সাজানো সাফাই জনগণকে খাওয়াতে ব্যস্ত। শাহিন জনাবুলের হাতে পয়ে ধরেছিল। বিধাব বোন আর ভাগি্নর কথা মনে পড়ছিল। নকল স্যালাইন খাওয়া থেকে তাকে বিরত করতেই হবে। এখান থেকে বের হবে কি করে। বেচারা কুকুর বিড়াল পালতে পালতে মনটা তার সত্যিই নরম হয়ে গিয়েছিল। অনুরোধ না রেখে সে পারেনি। খাঁচার দরজাটা জনাবুল খুলে দিয়েছিল কোন এক নতুন জাগা মায়ায়।
মুক্ত হতেই শাহিন রাস্তা পার হয়ে ছুটে চলছে। তার সাথে ছুটছে কালো ল্যাবরাডোরটা। সেটা তাকে কামড়াতে আসছে না। বরং সেটা ছুটছে পাশে বন্ধুর মত। জনাবুলও ছুটছে তাদের সামনে। তারা সবাই পালাতে চায়। কিন্তু সীমানা তো অসীম নয়।