\\এক\\
গোঁধূলির রক্তাভ গেরুয়া রঙের উদ্ভাসিত বিজয়ের হাসি বৃক্তাকার দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যটা বিশ্রামে ধরণী কিনারে ডুবে যাচ্ছে প্রায়। সবটুকু আলো তাই তখনও গিলে খায়নি সাঁঝের যুদ্ধমাতাল গতির আঁধার। কারুশৈলীতে গড়া পোড়া মাটির টালি বিছানো দোতলার ছাদের এককোনে সূর্যের সে বিদায়ী হাসির ঝলসে ওঠা নিস্তেজ আলোয় ফুটেছে এক মনকাড়া মায়াবী মুগ্ধতা। পেছনে নারকিলে গাছের সারিকে কিছু গেরুয়া রঙামেঘ গোপনে যেন জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। নান্দনিক প্রাসাদ প্রতিম বাড়িটির জানালা ঘেঁষে উঁচু উঁচু ঝাউ গাছের সরু কচি পাতায় পাতারই গোমাড়া মুখের সরু সরু ছায়া। ছায়া ছেড়ে কচি ডাল বেয়ে নিচে নেমে সবুজ ঘাসের মখমল ছুঁয়ে নানা রঙের কচি কচি রমনী কোমল ফুলের সম্ভার। তারপর পাথর বিছানো পথ। এক পাশে অল্প ক'টি নামী দামি গাড়ী। সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবী পড়া দুটি মানুষ প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু আগেই গাড়ী থেকে নেমেছে দু'জন।
'রোজ-সকাল' নামের দৈনিকের পেছনের পাতায় এমনই এক ছবি ছাপানো হয়েছে। ছবিটি রঙিন। মানুষ দু'জনকে নতুন করে চেনার কিছু নেই। দেশেজুড়ে মানুষ তাদের চেনে। দুজনেই পার্লামেন্ট সদস্য, জন প্রতিনিধি। দু'জন দুটি আলাদা দলের সদস্য। বিরোধের জন্য বিরোধের রাজনীতি ধারায় দু'জনেই তর্ক মুখর। অথচ তারা দুজন সাঁঝ বেলায় নিরালা শহর প্রান্তে শ্রান্ত কুলকুল ধ্বনির ছন্দে মুখর নদীর তীরে এক কাননকুঞ্জের ভেতের প্রবেশের জন্য হাঁটছে একসাথে। তারোপর সখাসঙ্গসুলভ প্রাণবন্ত হাসি। কে না চমকিত হবে দেখে! এ যে দেশের প্রেক্ষাপটে অবধারিত ব্যতয়।
ফ্রি ল্যান্স ফটোসাংবাদিক অরণ্য জাহেদ এই দূর্লভ দৃশ্যটি ক্যামেরা বন্দি করেছে। তার বেশ কয়েক মাসের খাঁটুনির ফসল। প্রাসাদতুল্য এ রঙ্গশালার খবর শোনার পর থেকেই সে ঘুরছে। দাড়োয়ানের সাথে খাতির করতে একটু সময়ই লেগে গেলো। কিন্তু ভেতরে ঢোকার জন্য তাকে রাজী করাতে পারলনা। এতটা সাহস সে দেখাতে উৎসুক নয়। এখানে যেসকল অতিথি আসেন তাদের চটানোর জন্য কেবল দুঃসাহসই নয় দরকার আপন প্রাণের প্রতি ভালবাসার শূণ্যকোঠা। সে কারইবা থাকে! তবু্ও দেয়ালের বাইরে থেকে বিশাল আমগাছটাতে লুকিয়ে উঠে ছবি তুলতে পারলে দাড়োয়ানের কোন আপত্তি ছিল না।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো গত সন্ধ্যায় । দু'জন জন প্রতিনিধি একই গাড়ীতে আসতে দেখল যখন তখন সে আম গাছে লুকিয়েই ছিল। গাড়ী থেমে নেমে এগিয়ে চলেছেন দুই জন প্রতিনিধি। সরকারী পক্ষের এম. এস. আজিম চৌধুরী এবং অন্যজন বিরোধী পক্ষের সাঈফ আহসান মির্জা । ক্যামেরার দীর্ঘ দিনের লোভ চরিতর্াথ হলো। ঢুকে গেলো দুজন বিরোধী মানুষ নির্জন সখ্যতা ক্ষণে ডিজিটাল মেমোরি ঘরে। আগে পড়ে আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি ঢুকলো । সকলকে তার চেনার কথাও নয়, সকলে তো আর পাবিলক ফিগার না।
দেরী করেনি জাহেদ। ঢাকায় চলে এসেছে দ্রুত। রোজ-সকালের সাংবাদিক বন্ধু সান্তনুকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল। তাকে সাথে নিয়ে বেশ গুছিয়ে এত দিনের যোগাড় করা খবরগুলো সাজিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে ঐ প্রাসাদতুল্য বাড়িটির অনেক রহস্য। যেসব রহস্য মনের ভেতর কোন পথচারীর সমাধান খুঁজে নেবার আগেই দৃশ্য মুগ্ধতায় হারিয়ে গেছে ভাবের স্বর্গে। বাড়িটির মালিক হিসেবে শ্বেতপাথরে খোদাই করা আছে রেবতি নামে একজন চলি্লশোর্ধ রমনীর নাম। বাড়িতে তার সাথে থাকে তার একমাত্র কন্যা রায়ানা। কচি তরু তনু দেহ আর বেশ নান্দনিক লাবণ্য শোভিত মুখশ্রী। ইদানীং অগণিত চ্যানেলের অজস্র নাটকের ভীড়ে সে মেয়েটিকে টুকটাক চরিত্রে রূপদান করতে দেখা যায়। তাকে দেখা গেছে শেষ ঈদের ম্যাগাজিনে কত্থক নাচতেও। মেয়েটারর বাবা থাকেন আমেরিকায়। বাড়িটির ভেতরে রয়েছে মিনি বার, এক কোণে র্বর্ির্ণল আলোয় ময়ূখ ছাড়ানো ফোয়ারা। আছে দীর্ঘ ঝাড়বাতি ঝুঁকে কুর্ণিশ করতে থাকা নৃত্যঘর।
জাহেদ তার তথ্য থেকে বেছে বেছে অনেকগুলো নাম রিপোর্টে উল্লেখ করার জন্য বেছে নেয়। সান্তনু সতর্ক করে বলে এসব নাম পত্রিকায় ছাপালে বেঘোড়ে প্রাণ যাবে । সে বলার মধ্যে একটা উপহাস একটা কৌতূক ভাব। তারা দু'জনেই সাহসী হতে চায়। জীবনের টানাপোড়ন আর সাংবাদিকতায় জনপ্রিয়তা পাবার কোন এক সুপ্ত নেশা তাদের এই তথাকথিত বাস্তবতা বিবর্জিত কাজে বিশেষ প্রণোদনা জাগায়। তাদের নামের লিষ্টটা তাই বেশ দীর্ঘ হয়। সেখানে মিডিয়া জগতের অনেক নারীর নাম দেখে দুজনে বেশ রসিকতায় ভারি পরিবেশ হালকা করে নেয় কিছুক্ষণ।
কিন্তু সম্পাদক সাহেবকে রাজি করানো গেলো না। এত বড় রিস্ক তিনি নিতে পারবেন না। মাত্র চার টাকায় বাসে-পথে-ঘাটে দেদারছে বিকাচ্ছে পত্রিকাখানা। ছাপানোর খরচের চেয়ে বিক্রি মূল্য কম। কাটতি আছে, বিজ্ঞাপন আসছে প্রচুর। ভালই পুষিয়ে যাচ্ছে। নিজের পায়ে কে কুড়াল মারতে চায়। অথচ জিদ করছে তার প্রিয় শিষ্য যার সাথে আছে অরণ্যের মত গুনী ফটোগ্রাফারও। অনেক দূর্লভ ছবি পত্রিকার জন্য তার কাছ থেকে পাওয়া যায়। শেষমেষ তিনি রাজী হলেন তবে কেবল ছবিটা ছাপাতে। কোন রিপোর্ট তার পত্রিকায় যাবে না। বড়জোর ক্যাপশনটা একটু বড় হতে পারে ।
তাই হলো। গোমড়া মুখে সেটাই মেনে নিতে হলো দুই বন্ধুকে। ক্যাপশন লেখা হলো ছবির নিচে-
'প্রাসাদতুল্য বাড়ীটি রাজধানীর অদূরে নদী তীরে অবস্থিত। বাড়িটি নিয়ে রয়েছে নানা রটনা। সেখানে প্রায়ই গোপনে পার্টি হয়। হয়তো আড়ালে ঘটে আরও অনেক কিছু। রহস্যঘেরা সে বাড়ীর ভেতের প্রবেশের সময় ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন রাজনীতির মঞ্চে প্রচন্ড শত্রু ভাবাপন্ন দু'জন জন প্রতিনিধি। শত্রুতার চলমান রাজনীতিতে বিষয়টি সত্যিই সুখকর কিন্তু সে সুখের রহস্য কি এই রহস্যময় বাড়িটির মতই অজ্ঞাত?'
\\দুই\\
'মির্জা, ছবিটা কি দেখেছিস?'
হাই তুলতে তুলতে সাঈফ মির্জা উত্তর দেয়, 'কি ছবি রে?'
'এখনও ঘুমের মধ্যেই আছিস দেখছি। নারী আর মদের হ্যাঙ্গ ওভার চলছে এখনও? তা ভাবী নেই?'
'না, লন্ডনে গেছে। কাল না বললাম। হ্যাঙ্গতো তুইই মনে হয় বেশী। ছেলেটার ও লেভেল এঙ্্যাম চলছে। তোর ভাবীর আসতে দেরী হবে।'
'তাহলে বাসায় নিয়েই যেতে পারতি কাল । কয়েকদিন ...উফ্ , নতুন মেয়েটা নাচেও কিন্তু দারুন।'
'ভাল বুদ্ধি বন্ধু! এমনেই আমি বিরোধীদলের । চারদিক থেকে তোরা তো ভালই পিষে যাচ্ছিস। সংসদে গিয়েও বসতে পারছিনা আমরা। এর মধ্যে বাসায় রক্ষিতা এনে তুলি আর তুই তোর ঐ পত্রিকাতে ফলাও করে ছেপে দে। তোর তো পোয়াবার। আমার সাথে আমার দলেরও বাজুক চৌদ্দটা।'
'ও মা! দলের চিন্তা আবার কবে থেকে গো দোস্ত? সে যাক, আগে রোজ-সকাল পত্রিকা যোগাড় কর। দেখ, কি সুন্দর তুই আর আমি, মুখে হাসি। হাঁটছি। শালা ছবিটা কিন্তু দারুন তুলেছে।'
'মানে? কি বলছিস, আজিম? ডোন্ট গিভ এনি টেন্সড। এমনেতই আবার মিছিলে যেতে হবে বিকেলে। শালার এই গরমে ছুটির দিনেও শো ডাউন। কবে যে তোর সরকার মানবে আমাদের দাবীদাওয়া...'
'মানা মানির চল থাকলে কি তোর আমার মত রাজনীতি ব্যবসায়ীর কপালে সৌভাগ্য চমকাতো রে গাধা।'
'তা যা বলেছিস, রাজনীতি ব্যবসা! আরে এই তো পত্রিকাটা টেবিলেই রয়েছে। আরেব্বাবা একি! এ কান্ড করার সাহস কার হলো? দাঁড়া সম্পাদক ব্যাটারে একটা ধোলাই দিয়ে নেই। ...না থাক। তুই সরকারী পক্ষের, এ কাজ এখন তোরই।'
'সে কি আর বলতে রে মির্জা। সকালে ও ব্যাটারেই ঝেরেছি। তাতেই তো রাগটা কমেছে। মোটামুটি তথ্য জেনেছি। সাংবাদিক ছেলেটার নাম সান্তনু। ছবিটা তুলেছে তার এক বন্ধু। চাকুরী করে না। ফ্রি ল্যান্স কাজ করে। সম্পাদক সান্তনুকে বলে দিয়েছে আর আগামীকাল একটা সংশোধনিও লিখে দেবে, ওটা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিটিং ছিল বা ঐরকম কিছু একটা। না, দাঁড়া পেয়েছি, তুই তো সম্পর্কে আমার বেয়াই হস্, পারিবারিক অনুষ্ঠান হিসেবে চালিয়ে দিলেই তো হয়। এটাই করতে হবে, বলে দেবোনে।'
'কিন্তু ঐ পোলাটা, এ যেই হালার পুত ছবিটা তুলেছে। পোলাডারে তো গাড়মুই সাথে ঐ মা বেটি দুইটারে যদি কুত্তা দিয়া না খাওয়াইছি...
'আননেসাসেরি খ্যাপছিস। কথা হয়েছে ওখানেও। দাড়োয়ান হারামজাদাটা ছেলেটাকে হেল্প করেছে। ওটারে পরে দেখা যাবে। রেবতি আসলে কিছু জানে না। সান্তনু ছেলেটার সাথেও কথা হয়েছে। কথা বলে ভালোই লেগেছে। ছেলেটা কাজের। আমি সরকারে আছি না। কেনো চিন্তা করছিস। সান্তনু রওয়ানা দিয়েছে। সব তথ্য নিয়ে আসছে।'
'ব্যাস! হয়ে গেলো? জনগণের মুখ বন্ধ করবি কিভাবে? আমাদের জন্য তাদের অন্তঃপ্রাণ, দ্বন্দ্ব - বিবাদ। আর আমরাই মিলে মিশে হাসছি। একি তারা মানবে রে?'
'জনগনের মুখ-সে তো ক্ষুধার্ত ভীষণ। খুলে থাকে এমনেতেই। এসব নিয়ে মানুষ ক'দিন ভাবে বল। তারপরও একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। ঠান্ডা মাথায় শোন। এলাকার জমি জমা নিয়ে যে গন্ডগোলটা আছে তোদের সাথে আমাদের, সেটা নিয়ে একটা মিথ্যে খবর বানিয়ে বেশ রসিয়ে ছাপিয়ে দেই কাল আমার পত্রিকায। মানুষ সে পড়েই ওই হাসি মাখা মুখের ছবি ভুলেই যাবে। তুইও শুনলাম একটা পত্রিকায় ভালো ইনভেস্টমেন্ট করেছিস। পরদিন সেখানে তুইও আমার বিরুদ্ধে কিছু একটা লিখে দিবি। আর এ সব লেখা ঐ সান্তনু ছেলেটাই লিখে দেবে। সম্পাদক বলল রোজ-সকালের লিড লেখা ও ছোঁড়াই লেখে। ভাল করে ভেবে দেখ এক ঢিলে কয় পাখি মরল।'
'যাক শান্তি শান্তি লাগছে, মাথাও খুলছে। জমি-জমা, আমাদের এলাকা - বাদ দে। হট নিউজে আয়। কাল আমি আগে তোর বিরুদ্ধে একটা নিউজ ছাপাব। সেখানে বলব, সরকারে থেকে সরকারের এক এমপি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার মর্ােকট থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতে আমার দলও খুশি হবে।'
'আর সরকার যে আমার প্রতি বেজার হবে।'
'পরদিন তুই আরও বেশি রসিয়ে বলবি- সব বিরোধী দলের কারসাজি। আমরা কোম্পানীর নাম উল্লেখ করবি। ব্যাস মাঠ গরম। দু'দলই গরম। আমাদের এ ছবির প্রভাব হবে তরল। কিন্তু ঐ ফটোগ্রাফারটারে ধরে আন। ওই ব্যাটারে আমার চাই। ওটারে কি যে করব... মনে আছে তোর সেই ছোটবেলার কথা। ক্লাশ টেনে পরি যখন, কাশেইম্যারে কি শাস্তিটা দিছিলাম।'
\\তিন\\
পাশাপাশি দুটো গ্রাম। দু'গ্রামে দুটি প্রভাবশালী পরিবার। চৌধুরী আর মির্জা। এরাই এলাকার হর্তাকর্তা। বৃটিশ আমলে দু'টি পরিবারেরই কম বেশী জমিদারি ছিল। ছিল আধিপত্য আর দাপটের নানাপদের ঠেলাঠেলি। অনেক প্রাণ গেছে দুই পরিবারের মাঝে ঘটে যাওয়া নানান গোলযোগে। জমিদারী গেছে অনেক আগেই। ততদিনে পরিবারদুটোর অনেক যুবক উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসেছে দেশ বিদেশে থেকে। রাজধানীতে গিয়েও ব্যবসা বানিজ্য করতে শুরু করেছিল অনেকেই।
মির্জা পরিবারের সাবেক জমিদারের এক ছেলে মুসলীম লীগের বড় নেতা হয়ে পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে রেখেছে দীপ্ত পদচারনা। তারই মেজ ছেলে সাঈফ আহসান মির্জা। এলাকার প্রবীণ মানুষেরা আজও নিরবে সাঈফ মির্জার বাবার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধীতা নিযে আলোচনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। সে নিষ্ঠুরতায় এ বাড়ীর অনেকেরই রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সনদ। কি নির্মম পরিহাস! তেমনি ঘটনা চৌধুরী পরিবারেও। মুসলীম লীগের সদস্য হযে পাকিস্তানের সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ না গেলেও বেশীর ভাগ সময় চেয়ারম্যান হয়েছে বড় চৌধুরী এস নাজিম চৌধুরী। তার ছোট ছেলে আজিম। নাজিম চৌধুরী ছিল পিস কমিটির স্থানীয় প্রেসিডেন্ট। অথচ আজ তারও আছে মুক্তিযুদ্ধের সনদ। '৭১ সালে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান অখন্ড রাখার মানসেই দু'টি পরিবার মিলেছিল। এক সাথে বড় মির্জা আর নাজিম চৌধুরী সে সময় মিটিংও করত। ঠিক সে বিষয়টা উল্টে গেছে। কাগজে কলমের ইতিহাসে দু'পরিবারের মিলন সুর ধ্বনিত হচ্ছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিমন্ডলে।
এটাই বাস্তব। ভীষণ প্রভাবের কাছে বাস্তবতা নুয়ে গেছে। কেউ মুখ খোলেনি। প্রতাপ প্রতিপত্তি সে তো এ এলাকায় কেবল এ দু'পরিবারেরই। অবশ্য ভার্সিটিতে পড়তে যাওয়া দু'পরিবারের বেশ ক'জন যুবক ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ এসবও করত। ক্ষমতাই যাদের রক্তে রাজনীতির নেশা তাদের জন্য অবধারিত।
স্বাধীনতা পরবর্তিকালে আবার লোক দেখানো শক্র হয়েছে মির্জা আর চৌধুরীরা। ক্ষমতা দ্বিকেন্দ্রিক রাখার ওটাই তো মুখ্য নীতি। স্বাধীনতার পর চেয়ারম্যান পদে লড়াই হয়েছে। সে লড়াই আরও গভীরে চলে গেছে। দেশের রাজনীতির নানান ঘটনা আর অঘটনার মাঝে দু' পরিবারই মূল ধারার রাজনীতিতে নিজ নিজ স্টাইলে ভালো অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। এর মধ্যে আত্মীয়তাও ঘটেছে। চৌধুরী বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে সাঈফ মির্জার বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে। কিন্তু ক্ষমতার দ্বিকেন্দ্রিক তত্ত্ব তারা মেনেই চলেছে।
বছর তিরিশেক আগে। সাঈফ আর আজিম ক্লাশের টেনের ছাত্র। একই স্কুলে পড়ে দু'জন। অন্যান্যদের চেয়ে দুজনের ততাকথিত জাত উঁচু। ক্লাশে দাপট আর ভিন্নতার ছাপ ফুটিয়ে তোলার সমমনা বাসনাটাই হয়তো দুজনের মাঝে নিবিড় সখ্যতার ঢেউ বয়ে এনেছিল। নিম্নগামী নদী শাখা হয়ে ভেঙে ভেঙে যায়। আর সুউচ্চ পাহাড় মিলে যায় চূড়ায় চূড়ায়।
স্বনামধন্য ইংরেজীর মাষ্টার দীপেন চক্রবর্তী একদিন ক্লাশে তাদের উপর চটে জান। কিন্তু প্রকাশের তীব্রতা আসেনা তার মাঝে। হয়তো ভয়। তবুও শিক্ষক হিসেবে দুই একটা মার্জিত উপদেশ শুনিয়েই দেন। সাঈফ আর আজিম মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়। ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে স্কুলের বাইরে, বাঁশ বাগানের ওপারে, হলুদ সর্ষে বনের আইলে বসে দু'জন বিড়ি টানছিল। দেখে ফেলেছিল একই ক্লাশের কাশেম। গরীব কৃষকের ছেলে। ভালো ছাত্র ছিল। তারা দু'জন কাশেমের নালিশ দেয়ার বিষয় জেনে ফেলেছিল এক চামচার কাছে। বড় লোকের ছেলেদের চামচা জুটে যেতে সময় লাগে না। তাদেরও ছিল ।
সেদিনই পড়ন্ত বিকেলের ঘটনা। দু' গ্রামের সংযোগস্থলে ছোট একটা বিল। ধান কাটা শেষ। পানিও কমে গেছে। খালের তলায় কাদায় কই মাছের নৃত্য স্পষ্ট চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে বিলে এখন হলুদ সর্ষে ফুল। বাতাসের মাঝে হলদে নৃতু্য। ভীষণ অপরূপ। কিছু জমিতে আবার কোন ডালের ক্ষেত। বিস্তৃত সবুজের কার্পেট। আধাপাকা রাস্তার মঝে একটা ছোট কালভার্ট। ডানে বেঁেক একটা সরু পথ নেমে বিলের মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে ঐ দূরে সবুজ গাছের দিগন্তে। ওটা অন্য গ্রাম। সেই সরু পথের এককোণে এক নির্জন আড়ালে বড় চালতে গাছ। দু'বন্ধুর হতাশ কোন বিকেলের আড্ডা জমে সেখানে। তাদের ঘিরে থাকে চামচার দল। আজ অবশ্য কেবল দু'জন। তারা জানে কাশেম এ পথ দিয়েই হাটে যাবে। কাশেমের বাড়ী ঐ দূরে দিগন্তে সবুজ গ্রামে। হাটে চাচার দোকানে হিসাব নিকেষ দেখে পড়ার টাকাটা জোগাড় হয় তার।
কাশেম আসতেই সাঈফ ডাক দিল। আক্রোশের তীব্রতা বুঝলে হয়তো একটা দৌড় লাগাত। কিন্তু বয়সটা কি পলিটিঙ্ বোঝার তাও যদি তা না থাকে রক্তে । চালতে তলায় কাশেমকে আটকাল তারা। তার গলা থেকে গামছাটা নিয়ে সেটা দিয়েই বাঁধল হাত। কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেলো ধানের ক্ষেতে সেচ দেয়ার জন্য তৈরী করা ইঞ্জিন রাখার এক চালা ছোট্ট কুঁড়েতে। বাঁেশর সাথে বাঁধল। তারপর পাশ থেকে বাবলা গাছের কাঁটা শোভিত একটা ডাল হ্যাচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে পালাক্রমে আঘাত করল দু'জনেই। সে কি অনুনয় বিনয় কাশেমের। দু'বন্ধুর তখন রক্ত জেগে উঠেছে। জমিদারী রক্ত। আধমরার চেয়েও একটু বেশী করুন হয়ে গেলো যখন লোকজনও চিৎকারে সন্ধ্যার আধোআলোতে এগিয়ে আসছিল। বাঁধনটা খুলে আইলের ধারে ফেলে রেখে চম্পট দিল।
তারপর শুরু হলো দু'পরিবারের কুট পলিটিঙ্। কাশেম ওদিকে হাসপাতালে মৃতু্যর সাথে লড়ছে। মির্জা পরিবার কেস করল চৌধুরী পরিবারের বিরুদ্বে। কেসের কারন কাশেম নামের এক নিরহ ছেলেকে চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা মেরেছে। পাল্টা কেস করল চৌধুরী পরিবারও। একই রকম। সাঈফ আর আজিম জিজ্ঞেস করে প্রথমে বুঝতে পারলনা এমন কেনো। পরে বুঝিয়ে দেয়া পর বুঝল এটাই রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার উত্তম নীতি।
কেস ওখানেই থেমে গেলো। আসল ঘটনা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কাশেম বেঁচে উঠল ঠিকই। কোন বিচার পাবে না জেনেই তার গরীব বাবা দু'পরিবার থেকেই দান দক্ষিনা যা পেলোা তাতে যেন মনে মনে ভাবল, 'মাঝে মাঝে বাবারা আমার ছেলেডারে এমনে পিটাই যাইও'। হায়রে দারিদ্রতা!
লাভ হয়েছিল। স্কুলে আর কখনও কেউ দু'বন্ধুকে ঘাটাতে আসেনি। সেই সে কাশেম ইন্টারের পর আর পড়তে পারেনি। তবে এখন সে ভালো আছে। ঐ স্কুলেরই সে মাষ্টার হয়েছে। দু'জন এমপি তার সহপাঠী- এ পরিচয়ের দাপটা সে বুঝে নিয়েছে। রাজধানীতে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কোন কাজ থাকলে তাকেই পাঠানো হয়।
দুই বন্ধুর সখ্যতায় নিরবে দু'গ্রামের লোকই বেশ খুশি ছিল। মনে ছিল তাদের ভবিষ্যত সুখস্বপ্ন। তারা ভাবত এ বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই হয়তো ঝগড়া বিবাদ কোলহলহীন এক মধুর মিলন ঘটবে দু' গ্রামের।
\\ চার \\
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সাঈফ আর আজিম একসাথে নিকটস্থ মফস্বল শহরের সরকারী কলেজে ভর্তি হয়। সেখানেই মূল ধারার রাজনীতির সাথে দুজনের সংযোগ ঘটে। তারা সক্রিয় রাজনীতি শুরু করে। এত ঘনিষ্ঠ দুজন, তবুও দুজনের রাজনীতির আস্তানা হলো দুটি ভিন্ন দলে। বিষয়টা হয়তো পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার্থে, তাছাড়া বন্ধুত্বের সুবিধায় বাড়তি কিছু সুবিধার কোন গোপন কারন, গোপন পরিকল্পনাও হয়তো ছিল, সেতো কেবল তারাই জানে। তবে তারা বুদ্ধিমান এবং চতুর তো বটেই।
চতুরতার এক নিকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় কলেজ জীবনের এক ঘটনায়। সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য পরিচয়জনিত সুবিধা গ্রাম হতে ষাট সত্তুর মাইল দূরের মফস্বলের ছোট শহরে বেশ অনেকাংশে উদিত ছিল। একটা নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে সে প্রভাবের বায়বীয় আবরণে তাদের ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠা ঔদ্ধত্যও সুরক্ষিত ছিল।
আজিম থাকত তার এক চাচাত বোনের বাসায়। আর সাঈফ মির্জা থাকত তাদেরই গ্রামের এক চালের আড়তদারের বাড়ির দোতলার উপরে তিনতলায় ছাদের সুন্দর ছোট চিলেকোঠার ঘরটিতে। দক্ষিণে মুখ করা ঘরটির জানালা দরজা আর যত ভেন্টিলেটার সবখান দিয়ে হু হু করে বাতাস এসে জুড়িয়ে দিত মন প্রাণ। ওদিকেই মাত্র কিছু দূর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট শান্ত স্বচ্ছ নদী। মেসে থাকার মত পরিবার থেকে তো তারা আসেনি। দুই বন্ধূুর অবশ্য একসাথে থাকার সাধ ছিল। পরিবার থেকে গ্রীন সিগন্যাল পায়নি। তাতে বিষয়টা আধিপত্যে সাধারণ মানুষের কানাঘুষা নামক ঘুনে পোকার জন্ম দিলেও দিতে পারত।
আজিমের নিয়মতি সাঈফের চিলেকোঠায় যাওয়াটা ছিল অবধারিত। নদীর তীর থেকে বয়ে আসা সিক্ত সুস্মিত বাতাসের টান কিংবা বন্ধুর নৈকট্য এবং ঐ বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার তরুন তন্বী মেয়েটার প্রতি নিদারুন দৈহিক আকর্ষণ জনিত কারন সে যাওয়ার পেছনে মিলেমিশে আলাদা ব্যঞ্জনাহীন। মেয়েটা ক্লাশ টেনে উঠেছে তখন সবে। মনে রাজ্যের সব রঙিন এবং সাদাকালো পাখিরাও পাখনা মেলে উড়ে বেড়াতে চায়। সুন্দরী সুদর্শনার মফস্বলের মত ছোট এলাকায় কদর তাই জনে জনে । ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠা এবং বখাটে অনেক বন্ধু জুটে যাওয়া আজিম আর সাঈফের সাথে ছাদেই পরিচয় হয় মেয়েটির। কথা, খুনসুটি, তারপর বন্ধু ভাবনা ঘটে যায় তার অন্তরে। দু'বন্ধুর বিস্তৃ দাপটে মেয়েটি মহল্লার অলি গলিতে তার উন্নত বুক আরও একটু চেতিয়ে হাঁটা শুরু করে দেয়।
তারপর একদিন সূর্য মাথার উপরে উঠে যাওয়া তপ্ত দুপুরে সাঈফ ছিল না ঘরে। হয়তো সেটাও দু'বন্ধুর পরিকল্পনার কোন অজানা অংশ। দুপরের দিকে স্নান সেরে ছাদের উপর মেয়েটা কাপড় শুকাতে উঠেছিল। খোলা দরজার ওপাশে শুয়ে থাকা আজিম কে দেখেই আহ্লাদী কণ্ঠে মুখে হাসির রেখাকে প্রলম্বিত করে ফেললো সে। আজিম তাকে ঘরের ভেতের এসে বসতে বলল। মেয়েটা কাপড় দড়িতে টানিয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় ঘরে ঢুকল। তার চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছিল মেঝেতে। সদ্য ভেজানো শরীর থেকে সে নারীর তখন চাপা রহস্য মেশানো সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে ছোট ঘরে। আজিম মাতোয়ারা হয়। শুয়ে থেকেই হাতটা বাড়ায় আজিম। এক টানে কাছে টেনে নেয়। প্রথমে হালকা বাধা দেয় মেয়েটা। মিষ্টি কণ্ঠে কৌতূক জাগিয়ে বলে ওঠে, 'ভাইয়া, দূর কি করছেন, ছাড়েন তো।' আজিম ছাড়ে না। কপাল, নাক ছেড়ে ছুঁয়ে ফেলে ওষ্ঠ্য দিয়ে কোমল ওষ্ঠ্য। মেয়েটা তখন সম্বিত ফিরে পায়। ছাড়িয়ে নেয়ার অসফল চেষ্টা চালায় কয়েকবার। পারল না। 'ভাইয়া আমি চিৎকার দেবো কিন্তু...'। অথচ চিৎকারের তীব্রতা প্রবল হবার আগেই থেমে যায়। আজিম চৌধুরীর একটা হাত পুরো নিয়োজিত হয় কণ্ঠধ্বনী আটকাতে। সেই ভর দুপুরে রোদের চঞ্চলতা মাঝে দরজাটা পা দিয়ে ভিড়িয়ে দেবার পর কোন আওয়াজই পৌঁছলনা কারও কানে।
ঘটনার পর অনেকদিন আর আজিম ওখানে যায় না। মেয়েটাও নিরুত্তাপ। বলে কি হবে এই ভাবনার কোন স্থায়ী সমাধানে সে আসতে পারেনা। সাঈফ মির্জার সাথে ছাদে দেখা হলে মুখ লুকিয়ে দ্রুত নেমে যায়। সাইফও মুচকি হাসে। একদিন সাঈফই ছাদে তার সামনে গিয়ে পথ আটকায়, এড়িয়ে চলার কারন জিজ্ঞেস করে। মেয়েটা সাঈফের সহানুভূতির কোমল বানোয়াট রূপে মোহিত হয় মনের গহীনের ছাইচাপা দীর্ঘশ্বাস ভরা সে কষ্টকথন এক নিমিষে ব্যক্ত করে হালকা হয়। নোনা জলগুলো চোখ থেকে নেমে ভিজিয়ে দেয় সাঈফের টি-শার্ট। শুরু হয় সহানুভূতির উৎকর্ষতা। তারপর নিবির গোপন প্রেম। প্রেম টেনে নিয়ে যায় পুনঃ ধর্ষিত হবার পথে। তবে এবার মিলন মাঝে সেচ্ছা আত্মসমর্পন। এবার সে পতিত হলো প্রেমের বাঁধন প্রহসনে।
আরও কিছুদিন পরে মেয়েটা যখন দু'বন্ধুর পরিকল্পনা বুঝতে পারল। তখন আর কিছূই করার নেই। তখন সে কখন যেন হয়ে উঠেছে দু'বন্ধুরই নিয়মিত ভোগের উপাত্ত। তেমনি আজও। বিয়েও একটা হয়েছিল। সেটাই হয়েছে রক্ষা কবচ। প্রাসাদতুল্য সেই লাল বাড়িটি তথাকথিত মালিক, রেবতিই সে নারী। দু'বন্ধুর নিবির আপন। হয়তো শত্রু অথবা হয়তো মিত্রই পরম।
কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে মোটামুটি গোছের নেতা বনে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি। তখনও দু'জন দু'দলে। ততদিনে তাদের দু'পরিবার দেশের দুটি ভিন্ন দলের উল্লেখযোগ্য প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। দু'জন দুদলে থাকায় সুবিধা ছিল অনেক। হল সংক্রান্ত মারামারি, আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র -এসবের খবরাখবর শেয়ার করে নিতে পারত। অবশ্য পুরোটাই হত অতি গোপনে। তারা বুঝে গিয়েছিল রাজনীতিই হতে পারে তাদের আরও অনেক উঁচুতে ওঠার একমাত্র ও পরিপুর্ণ ব্যবসা। তারা রাজনীতিকে সেবা নয় ব্যবসার দৃষ্টিতেই গ্রহণ করেছিল। তাইতো এত ধূর্ততা, এত হিসেব নিকেষ। '৯০ এর শেষের দিকে স্বৈরাচারী সরকার তখন পতনের পথে। দু'বন্ধুর দু'দলই স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে মিলেমিশে এক সাথে মাঠে। স্বৈরাচার নিপাত গেলো। তারপর হু হু করে গড়ে উঠতে লাগলো দু'বন্ধুর অনেক উপরে ওঠার সিঁড়ি।
রাজধানীতে মির্জা পরিবারের ছিল পারিবারিক কাপড়ের মিল। সাঈফের এক কাকা সেটা দেখতেন। মির্জা সেটাকে ক্ষমতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও বড় করল। ইন্ডাষ্ট্রী বাড়াল। অন্যদিকে চৌধুরীও তাদের পারিবারিক ষ্টীল ব্যবসাটাকে বেচাকেনার পর্যায় থেকে বড় আকারে উৎপাদনের পর্যায়ে নিয়ে গেলো। দুই রাজনীতি ব্যবসায়ী রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠল বিশিষ্ট শিল্পপতিও। দলে তাদের কদর বাড়ল আরও। ক্ষমতা মির্জার হাতে থাকুক কিংবা চৌধুরীর, সাহায্য সহযোগীতা আর উপরে ওঠার সিঁড়ি শেয়ার করার বিষয়ে তারা সদাই ছিল নিরব গুপ্ত পরিপূরক। তারা সবকিছুর উপরে যে নিবির বন্ধু।
\\পাঁচ\\
এ বছর গরমটা অনেক বেড়েছে । বেড়েছে সূর্যের তাপ। সকালেই তার প্রকোপ পাওয়া যাচ্ছে । ধূলোগুলোর তাপ সহন ক্ষমতায় টান পড়েছে। তারা এলোপাথাড়ি উড়ে চলে। কখনও তীব্র ক্রোধে বৃত্তাকারে চক্র বানিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে যায়। তীব্র তাপে ঘামতে ঘামতে সান্তনু এমপি আজিম চৌধুরীর গুলশানের বাড়িটির গেটে এসে দাঁড়ায়। এ ঘাম পুরোটাই রোদের দেয়া। ভয়ের কারনে নয়। ভয় পেয়েছিল প্রথমে। সকাল সকাল এমপি সাহেব কথা বলার পর সেটা দূর হয়েছে। এই সুযোগ সে কাজে লাগাতে চায়। ভাগ্য ভালো সম্পাদক সাহেব এমপিকে ম্যানেজ করেছিলেন। না হলে সব শেষ হয়ে যেত। আর সাংবাদিকতা করা লাগতো না। মনে মনে ভাবতে থাকে- কেনো যে অরণ্যর কথা শুনতে গেলো। আরে এটা কি সেই যুগ আছে নাকি। এ হলো কলি যুগ। যে দিকে হাওয়ার ভাও সেদিকেই নৌকা বাও। এমপি এমপি গলায় গলায় ভাব আর আমরা এসেছি তাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে। যেখানে রাজনীতির মঞ্চে এত এত বিরোধ সেখানে দু'দলের দু'এমপির নিবির বন্ধুত্ব । জনগনের ভালোর জন্যই এ সত্য তাদের না জানাই ভালো।
কিন্তু শুদ্ধ প্রবাহে প্রবাহিত হতে চাওয়া মনখানি তার হঠাৎ আবার বলে ওঠে, 'তবুও-একি করছিস সান্তনু। এ কারনইে কি সাংবাদিক হতে চেয়েছিলে? সত্য হতে পিছপা হবার সাধতো কখনও তোমার হয়নি। তবে কেনো এখন?'
বিবেকের সে প্রশ্নের উত্তরে মন নিজেকেই উত্তর দেয়, 'আমি বাস্তবতার পক্ষে।'
গেটের গার্ড জিজ্ঞেস করে,' অ্যাপয়েনমেন্ট আছে?'
'আছে, স্যারই আসতে বলেছিলেন'
গার্ড ভেতরে বার্তা পাঠিয়ে কনফার্ম হয়ে গেট খুলে দেয়। ভেতরে প্রবেশ কালে একটু যেন হৃদয় কেঁপে ওঠে। প্রিয় বন্ধু অরণ্যর জন্য একটু মায়াও হয়।
ড্রইং রুমে বসার পর ভয় বেড়ে যায়। হয়তো সেটা ভয় নয়, অসস্তি কিংবা বিবেকের অসমাপ্ত আস্ফালন।
আজিম চৌধুরী সামনে আসার পর সে আস্ফালনও যেন থেমে গেলো।
'তোমরা নামই সান্তুনু? তা তোমার কি মনে হয়- যা করেছে তা কি ঠিক করেছো?'
' না, স্যার, মানে...'
'চুপ, ভয় পাবার দরকার নেই। আমি জনগণের সেবক। ভয় দেখানোর কেউ না। অত কথার দরকার নেই, কি কি তথ্য আর ছবি আসে আগে দাও। '
মুহূর্তে সব বের করে দিল সান্তনু। তারপর বলেই ফেলল, 'স্যার আইএম ভেরি ভেরি সরি। অরন্যকেও বুঝিয়ে বলব। বুদ্ধিমান ছেলে । বুঝবে নিশ্চয়। '
'আরে দূর! ভয় পাচ্ছ কেনো। তোমার লেখার হাত খুব ভালো। তোমাকেই আমার দরকার। দৈনিক প্রথম সকাল, পত্রিকাটা চেনো তো , ওখানে তোমার চাকুরী হয়ে গেলো আজ থেকে । আমার এক কাজিন ওটার সম্পাদক। আজই জয়েন করবে। তোমার সম্পাদককে আমি বলে দিয়েছি। ওখানে পার্টটাইম করতে পারবে। বেতন ওখানের থেকে অনেক বেশিই পাবে। '
'স্যার, আপনার দয়া।'
'দয়া না , এ তোমার যোগ্যতা আর কপাল যা তোমাকে টেনে এনেছে । মনে রেখে পৃথিবীতে কোন কিছু এমনি এমনি হয় না। আমি কি বলছি বুঝতে পারছ নিশ্চয়। ও আচ্ছা শোন। পত্রিকায় জয়েন করার আগে মির্জা সাঈফের বাসায় যাবা। উনি একটা রিপোর্ট লিখতে দেবেন। ওনার নির্দেশ মত, যা যা বলবেন সেভাবে রিপোর্টটা লিখে যেভাবে যেখানে বলবেন সেখানে পাঠিয়ে দেবে। যা বলবে তাই লিখবে, আমার বিরুদ্ধে কিছু থাকলেও লিখবে। আমাকে একবার ফোন করে কেবল শুনিয়েনিও। একই সাথে আমাদের পত্রিকায় পরের দিনের জন্য ওটার একটি এন্টি রিপোর্ট তৈরী করবে। কি লিখতে হবে সন্ধ্যায় আমি বলব। আশা করি তুমি নিজের যোগ্যতা প্রমানের সুযোগ হাতছাড়া করবে না। যত্ন করে কাজ করবে।'
'জি স্যার। আপনার মেহেরবাণী।'
'ঠিক আছে এখন যাও।'
ভীষণ এক স্বপ্ন বিজয়ের হাসি কোনমতে লুকিয়ে সান্তনু উঠে দাঁড়ায়। আজিম চৌধুরী আবার বলে উঠেন, 'মির্জার বাসায় যাবার সময় অরণ্যকে সাথে করে নিয়ে যেও। কি বলে নেবে সেটা তোমার ব্যাপার। তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেটা তুমি অব্যশই পারবে। ভয় পাবার কিছু নেই। অরণ্য ক'দিন ওখানে থাকবে কেবল। হ্যা,ঁ আর আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তোমার নিমন্ত্রন ছবির ঐ লাল বাড়িতে। নিজেই দেখে আসলে। আফটার অল ইউ আর অ্যা মেম্বার অফ আওয়ার ইন্ডাষ্টি নাও।'
এবার একটু ভয় পেয়ে যায় সান্তনু। মনে মনে ভাবে, কি হবে এখন। অরন্যকে কি করবে এরা?
বলেই ফেলে, ' স্যার , ও নাদান, আমি বুঝিয়ে বললে বুঝবে। এবারের মত ওকে মাফ করে দেয়া ...'
সান্তনুর মুখের কথা কেড়ে নেয় আজিম চৌধুরী, 'ভয় পেও না সাংবাদিক। তুমি নির্ভয় দেখেই তো তোমাকে এত নামিদামী পত্রিকার একজন সহ সম্পাদক করে দিলাম। আমরা দু'বন্ধু ব্যবসায়ী। আমরা সবকিছুতে বানিজ্য খুঁজি। তার উপরে জনগনের সেবক। সেবাই কর্ম। খুন খারাবী আমাদের কাজ না।'
'সরি স্যার, আমি আসলে সে রকম কিছু বলতে চাইনি। '
'অসুবিধে নেই। স্বার্থের জন্য একে অন্যকে সেক্রিফাইস করতে হয়। না হলে উপড়ে উঠতে পারবে না। আর বললাম তো ভয় পেওনা। বৃহস্পতিবার অরণ্যকে নিয়ে যেও ওখান থেকে। হয়তো সেও তোমার সাথে সহকর্মী হিসেবে চাকুরী করবে তখন। এখন যাও। দুপুরের আগেই চলে যেও। '
'জি স্যার। অবশ্যই স্যার। '
\\পরিশিষ্ট\\
ভেজা ভেজা ঘাসগুলো বড্ড সবুজ। আয়নার প্রলেপ মাখা পাতায় পাতায়। পাথর বিছানো পথটাও ভিজেছে খানিক আগে। এখনও বৃষ্টি ঝরছে দু'একফোঁটা করে। আজ সূর্য সময়ের আগেই বিশ্রামে গেছে। সিক্ত আবহাওয়াটা বিশ্রামের জন্য বেশ সুখকর। লাল ইটের সেই বিনোদনে বিতত রহস্য বাড়িটিতে আজও পার্টি জমেছে। আজ বৃহস্পতিবার। অনেক মানুষের সমাগম। নামিদামি, ক্ষমতার আসমান তুল্য আসনে আসিন ব্যক্তি অনেক সেখানে। স্বার্থ সচেতন মানুষ কতেক এক সূত্রে মিলে হয়েছে স্বজন। গুচ্ছ গুচ্ছ আলাপদল এ পাশে ওপাশে হয়েছে জড়ো। সিক্ত আবহাওয়ার মাঝে এসির শীতল বাতাস কানে, গায়ে, মনে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। সান্তনুর মাঝে উপরে ওঠার এক উদ্ভাসিত সুখের অন্তঃজলপ্রপাতের প্রবল ধারা বয়ে চলেছে। তথাপি একটা উৎকণ্ঠা বোধ। চোখ দুটো বেসামাল মানুষগুলোর ফাঁকফোকর গলে খুঁজতে থাকে বহুদিনের বন্ধু অরন্যর মুখ। এক প্রান্তে ষ্টেজে অত্যন্ত উত্তেজক পোষাকে চরম আকর্ষন জাগিয়ে যে মেয়েটা নাচছে তাকেও বেশ চেনা চেনা লাগছে। অনেকগুলো চোখ সেদিকেই খুঁজছে সুখ। কে যেন কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, 'ওহ্ ব্রাদার! ইওর লাষ্ট ডেজ রিপোর্ট ওয়াজ রিয়েলি ওসাম, এনজয় ম্যান। '..বলতে বলতেই লোকটা ঢলে পড়ার উপক্রম হয় তবুও সে হাসছে। হাতে তার রক্তরঙা পানিয় ভরা স্বচ্ছ গ্লাস। হঠাৎ অদূরে ষ্টেজের কিনারে ক্যামেরার আড়ালে ঢাকা পড়া যুবকের দিকে দৃষ্টির ক্ষমতা মেলে ধরে সান্তনু। কিন্তু আবছা আলোয় পুরো চেনা যায় না। আজিম চৌধুরী আর সাঈফ মির্জাকে দেখা যাচ্ছে একটু দূরে অন্যপাশে সোফায় বসে আছে। সাথে এক সুন্দরী পৌঢ়া নারী, গল্পে মত্ত। একবার ভাবে ওখানে গিয়ে অরণ্যর কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ওনারা তো অনেক উচুঁতে সে উঁচুতে কি একবারে ওঠা যায়। সেখানে যে যেতে হয় ধীরে ধীরে, অনেক মায়ার পালক মাড়িয়ে। তার চেয়ে ক্যামেরাম্যান ছেলেটার দিকেই এগিয়ে যাওয়াই যথার্থ মনে হয়। সে এগিয়ে যেতে থাকে ... ... ...
( প্রকৃতপক্ষে এ গল্পের কোন পরিশিষ্ট হয় না। এ যেন স্বাভাবিক আজকালের বাস্তবতায়। হয়তো অরণ্য জাহেদ মিশে গেছে স্বার্থের বাস্তবতায় উন্মার্গের অরাজকতায় নিজেই। অথবা হারিয়ে গেছে বাস্তবতার বিষাক্ত ছোবলেই চিরতরে। সান্তনু হয়তো দুটোর যেকোনটাই মেনে নিতে পারবে কারন সে হয়তো বুঝেই গেছে সাঈফ মির্জা আর আজিম চৌধুরীদের বন্ধুত্বের চরম পরাকাষ্ঠার কাছে তাদের বন্ধুত্ব ক্ষুদ্র বালুসম; সে হয়তো আরও বুঝে গেছে এই তো তথাকথিত বিরূপ বাস্তবতা।)