প্রিয়ার চোখের চাহনি আজ সজল মায়া,
জল ঝরাল শ্রাবণ মেঘের বরিষণে,
ফাগুন দিনের শেষ গোধূলির আলোছায়া,
রং ছড়ালো করুণ আবীর সবার মনে।
. . . থাকিতে চরণ মরণে কী ভয় . . .।
গরমের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু শহরতলির এদিকটাতে এখনো গরম কী সেটা বোঝাই যায়না, রাতে বরং গায়ে হালকা কিছু একটা চাপাতে হয়। মতিন তার ছোট ঘরটার মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার দেহের নিচের অংশটা খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখা, দুই হাতে বুকের উপরে একটা বই ধরে আছে সেটা ঠিক, কিন্তু সে সেটা পড়ছেনা, মৃদুস্বরে গান গাইছে।
আট ফুট আর বার ফুটের ঘরটা আসলে ঘর নয়, বারান্দার অর্ধেকটার মত অংশে দেয়াল তুলে একটা রুম বানানো হয়েছে, যেটা পূর্ব পশ্চিমে লম্বা। উত্তর আর পশ্চিম দিকে দেওয়ালের মাঝ বরাবর দুটো জানালা আর পূর্ব দিকে একমাত্র দরজা। দরজাটা ভেজিয়ে রাখা হয়েছে, জানালা দুটো পুরোপুরি খুলে রাখা। খাটটা দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের পাশে আর সেটার উপরে টাঙ্গানো একটা রশিতে একটা কালপ্যান্ট, একটা নীল জামা, একটা সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি, দুটো লুঙ্গি গোটা তিনেক গেঞ্জি আর একটা লাল গামছা ঝুলছে। পশ্চিম দিকের জানালাটার উপরে একটা ক্যালেন্ডার লটকে রাখা হয়েছে।
খাটে তোষকের বদলে গোটা তিনেক কাঁথা বিছানো হয়েছে, তার উপরে মোটা ধরণের একটা একরঙা চাদর। একটা মাথার বালিশ আর সেটার উপরে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে একটা কাঁথা। পশ্চিম দিকে দেওয়ালের গায়ের সাথে বাম পাশটা ঠেকিয়ে রেখে খাট আর উত্তরের দেওয়ালের ভিতরে যেন টেবিলটা আটকে পড়ে আছে। সেটা বুকে ধারণ করে আছ একগাদা বই, খাতা, গোটা দুয়েক পুরানো খবরের কাগজ আর বাংলা ম্যাগাজিন, কলম, পেন্সিল একটা ডাইরি। এদের প্রতিটা জিনিসই নিখুঁত ভাবে আর যত্নের সাথে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরে কোন চেয়ার নেই, সম্ভবত ব্যবহারকারী ঘরটাকে একেবারে একটা গুদামঘর হিসাবে দেখতে চায়না। দরজার উপরে একটা ছোটখাটো দেওয়াল ঘড়ি আটকে আছে, সেটাতে সময় দেখাচ্ছে- দুটো বেজে বিশ মিনিট। দরজার কপাটদুটো নিঃশব্দে খুব ধীরেধীরে আধা ইঞ্চিরমত ফাঁক হল। আর মাটি থেকে প্রায় ফুট চারেক উপরে সেই ফাটলে একটা কাল চোখের মনি উঁকি দিল।
. . . পালারে পালা, ভাগ . . .। গানের চরণের সাথে পালানোর একটা সম্পর্ক থাকলেও আমাদের জাতীয় কবি সম্ভবত এই শব্দ তিনটে এই গানটাতে জুড়ে দেননি, স্বর আর সুর একই থাকলেও ছন্দে দারুণ রকমের অমিল।
‘চা খাবি?’
‘মার খাবি।’ মাথা না ঘুরিয়ে, এমন কি চোখের দৃষ্টি বইয়ের দিক থেকে না সরিয়ে মৃদুস্বরে মতিন জবাব দিল। তারমানে খাবে, না হলে সোজা বলে দিত, না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামলা মেয়েটা মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে দরজার ফাটলটা আবার জুড়ে দিয়ে ঘুরে হালকা পায়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
চওড়া একটা প্যাসেজেরমত। ডান দিকে একটা কামরা, দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। তারপরে জোড়াবাথরুম, রান্নাঘর আর ষ্টোর। বাম দিকে পরপর তিনটে কামরা। দোতলায় দুইদিকে মোট পাঁচটা কামরা। দুটো করে কামরা নিয়ে থাকে বড় আর মেজো ভাই। বড়জন বিএডিসির কর্মকর্তা, চার বছরের এক মেয়ের বাবা। মেজভাই চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, তার মেয়ের বয়স দুই বছর। দুজনই সকাল আটটার দিকে বের হয়, ফেরে রাত আটটার দিকে, তবে মেজভাইকে মাঝেমাঝেই দু চার দিনের জন্য বাইরে থেকে আসতে হয়। এর আয় বড়জনের চেয়েও বেশি, কিন্তু . . .। আর ছোটটা, যাকে সে এখন চায়ের দাওয়াত দিয়ে এলো, সেটা দিন পনের হয় অনার্স পরীক্ষা শেষ করে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সে বরাবরই খুব ভাল রেজাল্ট করে, অথচ কোন কাজের লোক নেই বলে বাড়ির সমস্ত ফাই ফরমায়েশ তাকেই খাটতে হয়, সে যে কখন পড়ে সেটা জানাটা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
মা মারা গেছে চার বছর আর তাদের বাবা চাকরি ছেড়েছে তিন বছর। বড়জনার চাকরি হয়েছে বাবার চাকরি ছাড়ার এক বছর আগে আর মেজ জনার একবছর পরে। আহ!বাবার চাকরির সময়কার দিনগুলো কত ভাল ছিল। রান্না ঘরে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে ভাবছিল সোমা। কী হাসিখুশিতে দিনগুলো কেটে যেত। এমনকি, মা মারা যাওয়ার পরেও বাবা সেই ভাবটা ধরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু রিটায়ার্ড করার পরে হঠাত করেই একেবারে বদলে গেল মানুষটা। তার মাত্র দু মাস পরেই হার্টের সমস্যায় হাসপাতালে, আর তার মাস খানেক পরেই আক্রান্ত হল পক্ষাঘাতে, বাম হাত পা তার এখন অবশ। আর তখন থেকেই একেবারে খিটখিটে মেজাজের হয়ে পড়েছে। যে ছোট ছেলে ছিল তার সবচেয়ে আদরের, সেই ছেলেই এখন তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তির পাত্র। এই পরিবারের যত সমস্যা তা যেন সমস্তই এই একটা ছেলের কারণে।
‘শোন বাতেন,’ গতকাল বড়ভাই সকালে বের হবার সময় বাবা তাকে ডেকে বলেছিল। ‘মতির তো পরীক্ষা শেষ হল, সে ছাত্র খারাপ না, পাশ করে যাবে। এবার তার জন্য একটা চাকরি টাকরি দেখ, কতদিন আর তোমাদের ঘাড়ে বসে খাবে।
‘না, না, এ সব বলছেন কেন?’ বড়ভাই একটু অবাক হল। ‘সে এখন আর কীইবা চাকরি পাবে, আগে এম.কমটা পাশ করুক, তারপর দেখা যাবে।’
‘না,’ বাবা তাকে বসার ইংগিত করে বলল। ‘তোমরা সংসারের খরচ চালাচ্ছ সেটাই বেশি। এদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নিয়েছ, সেটাই তোমাদের উপরে একটা চাপ। তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ আছে, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এদের দুজনের লেখাপড়ার দায়িত্ব আমার, কিন্তু আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। সোমাকে তোমরা পড়াবে, কিন্তু আমি তোমাদের উপরে অতিরিক্ত চাপ দিতে চাইনা। মতির এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানটাই ঠিক হবে। চাকরি করেও তো লেখা পড়া করা যায়, ঠিক কি না।’
‘না, না,’ বড়ভাই বলল। তার বোধ হয় অফিসের তাড়া ছিল। ‘ও সব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবেনা। আমরা যতদিন পারব ওদের পড়ার খরচ চালিয়ে যাব। যখন পারবনা, তখন নিজেরাই তোমাকে বলব।’ বড়ভাই বের হতে গিয়ে দরজার কাছ থেকে মাথা ঘুরিয়ে আবার বলল, ‘তোমার যেমন, তেমনি আমাদেরও ওকে পড়ানোর একটা দায়িত্ব আছে। আমি অন্তত সেইরকম মনে করি।’
‘না, মানে. . .।’
‘থাক, আমার এখন তাড়া আছে,’ তাকে বাধা দিয়ে বড়ভাই বলল। ‘তোমার আর কিছু বলার থাকলে রাত্রে এসে শুনব।’
বড়ভাই ঘরে ঢুকতেই সোমা বারান্দায় চলেগেছিল, অপ্রিয় কোন কথায় সে থাকতে রাজি নয়। সে সামনের দিকে তাকিয়ে সীমানা পাঁচিলের উপর দিয়ে দূরের ঘর বাড়ি আর গাছপালা দেখতে লাগল। সে বড়ভায়ের বের হয়ে আসার অপেক্ষায় আছে।
তার বাম দিকে মতিনের ঘরের দরজা, সব সময় যেমন থাকে, ভেজিয়ে রাখা হয়েছে। মতিন ঘরে আছে, হয়ত বই পড়ছে অথবা বসেবসে কিছু একটা করছে। বড়ভাই যাওয়ার সময় তাকে বাজারের টাকা দিয়ে যাবে, সেও তারই অপেক্ষায় আছে। সোমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুধু বাবা যদি পারিবারিক কোন বিষয়ে কথা না বলত তা হলে তাদেরমত মত সুখি পরিবার হয়ত খুঁজে পাওয়া কঠিন হত।
বড়ভাই বের হতেই সোমা ভিতরে ঢোকার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ‘বাবার ওষুধপত্র সব আছে তো?’ সে বলল আর সোমা মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। সে সোমাকে অবাক করে দিয়ে লম্বা পা ফেলে বারান্দা থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সোমা বাজারের টাকার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে একবার ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। বড়ভাই কখনো কখনো বড় ভাবীর কাছেও বাজারের টাকা দিয়ে যায়, কিন্তু সেক্ষেত্রে সোমাকে বা মতিনকে সেটা বলে যায়। সে গেট থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত সোমা বারান্দায় সে দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, যদি তার মনে পড়ে, যদি তাকে ডাকে। তারপর ভিতরের ঢুকে উপরে বড় ভাবীর কাছে গেল।
‘ভাবী, ভাবী,’ সোমা দরজার পর্দা ঠেলে ভিতের ঢুকল।
ঘরের কোনার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা বইয়ের সামনে বসে পেন্সিল দিয়ে খাতায় লিখতে থাকা মেয়েটার মুখ হাসিতে ভরে উঠল, কিন্তু সে মুখ তুলে তাকালনা। তার মা ঘরের মাঝখানে মেঝেতে বসে একটা জামাতে বোতাম লাগাচ্ছিল, তার মুখ তোলার সময় হল না, কিন্তু মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল।
‘আয়’, দাঁত দিয়ে সূতা কাটতে কাটতে বলল। ‘বাবা কেমন আছে রে?’ সোমা ভিতরে ঢুকে মিতুর পাশে বসল। প্রশ্নটা অবান্তর, সকালে নাস্তা বানানোরর জন্য নিচে নেমে সে প্রথমেই বাবার ঘরে উঁকি দিয়েছিল, সোমা তখন পড়ছিল। তারপর তারা দুজনে ভান্না ঘরে ঢোকে। সোমা যে কোন কাজে তার কাছে এলে এই প্রশ্নটা হবে তার প্রথম প্রশ্ন। সোমার এটা খারাপ লাগেনা।
‘আজকে একটু ভাল,’ সোমা হাসতে হাসতে বলল।‘বড়ভায়ের সাথে একগাদা কথা বলল।’
‘মতিকে নিয়ে তো?’
‘তা ছাড়া আর কী নিয়ে কথা বলবে।’
‘বাবার যে কী হয়েছে,’ ভাবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। ‘আমাদের এখনো এমন দুরবস্থা হয়নি যে, তোদের দুজনের লেখা পড়ার খরচ চালানো সম্ভব হবে না।’
‘ভাবী,’ সোমা একটু বিব্রত ভাবে বলল। ‘বড় ভাই কি তোমার কাছে বাজারের টাকা দিয়ে গেছে?’
‘না তো?’ এবার তাকে সোমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে হল। ‘আমি তো বরং তোর ভাইকে বলেছিলাম, মেজো আজকে আসছে, একটু ভাল করে বাজার করতে হবে, মতিকে যেন বাজারের জন্য কিছু বেশি টাকা দেয়।’
‘তোমার কাছে টাকা নাই?’ এই মহিলার কাছে কোন আবদারই সোমার অযৌক্তিক বলে মনে হয়না। সে মিতুর হাত থেকে পেন্সিল নিয়ে কতগুলো অক্ষরের দাগ দিয়ে ঠিক করে দিল।
‘না। শ খানেক টাকা থাকতে পারে,’ ভাবী চিন্তিত ভাবে বলল। ‘কিন্তু তাতে কী হবে? মেজটা দু দিন পরে আজ বাড়িতে আসছে, একটু ভাল খাবার বা হলে চলে?’
‘মেজ ভাবীর কাছে গিয়ে দেখব?’
‘না,’ ভাবীর মুখেরভাব কড়া হয়ে উঠল। ‘তার কাছে কি টাকা পয়সা কিছু থাকে?’ সোমার কাছ থেকে কিছু শুনতে পাওয়ার আশায় একটু থেমে সোমার দিকে তাকাল। কিন্তু সোমা মুখ নিচু করে খাতার পাতার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবী হাতের কাজ রেখে উঠে আলমারি থেকে টাকা বের করল। ‘তুই একটু বস, আমি এটা মতিকে দিয়ে আসি, এতে যা হয় হোক। কী আর করব।’ সে ঘর থেকে বের হবার সাথেসাথেই মিতুর মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সোমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
‘পড়ায় ফাঁকি দিয়ে আদর কাড়া হচ্ছে?’ সোমা বলল।
‘হু উ উ উ,’ মিতুর বাধন আরো শক্ত হল। সোমা দুই হাত দিয়ে মিতুকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু তার মুখে চিন্তার রেখা।
‘মতিন।’
ভেজানো দরজার বাইরে ভাবীর গালার আওয়াজ পেতেই মতিন ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। ‘আসেন ভাবী’, সে হাতের বইটা টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে বলল।
‘তোমার ভাই তো শুনলাম তোমাকে বাজারের টাকা দিয়ে যেতে ভুলে গেছে,’ ভাবী দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে বলল। ‘তোমার মেজভাই দুদিন পরে আজ আসছে, ভেবেছিলাম আজকে একটু মাংস টাংশ আনাবো, কিন্তু আমার কাছে মাত্র এই কটা টাকাই আছে।’ সে টাকাসহ হাত সামনে বাড়িয়ে দিল।
‘ভাববেন না ভাবী,’ মতিনের মুখ অনাবিল হাসিতে ভরে উঠল। ‘ওটা আপনি রেখে দেন, আর কীকী আনতে হবে বলেন।’
‘সব কিছু বাকিতে আনবো নাকি?’ ভাবী একটু অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘না, ভাবী,’ মতিন খাট থেকে নেমে একটানে বিছানার চাদর আর তার নিচের সব চেয়ে উপরের কাঁথাটা দেওয়ালের দিকে সরিয়ে দিয়ে হাসিমুখে ভাবীর দিকে তাকাল।
‘ওরে বাবা!’ ভাবীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠেছে। ‘এত টাকা? টাকার গাছ লাগিয়েছ নাকি?’ সে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল। বিছনার উপরে খুচরা পয়সা আর একটাকা, পাঁচটাকা, দশটাকা- এমনকি কয়েকটা পঞ্চাশ টাকার নোট একটা আস্তরণ গড়ে তুলেছে। সেখানে কত টাকা হতে পারে সেটা ভাবীর আন্দাজ করতে পারা সম্ভব নয়। ‘তোমার কি টাকার গাছ আছে?’
‘হ্যাঁ, ভাবী,’ মতিন হাসতে হাসতে বলল। ‘একটা না, দু দুটো, একটায় বেশি ধরে আর অন্যটাতে একটু কম ধরে।’
ভাবীর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে সেখানে একটা কড়া ভাব ফুটে উঠল। ‘আজকে কিছু মাছ আর মাংস এনো। অন্যান্য সব রোজ যা আন, তাই।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘কত টাকা খরচ করলে সেটা আমাকে জানিও।’
‘ঠিক আছে,’ মতিন বলল। সে একটু লজ্জা পেয়েছে, কম বেশির কথাটা তার বলা উচিত হয়নি। ‘আমাকে বাজারের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার থেকে যা ফেরত আসে সেগুলো এখানে জমা হয়।’
এবার ভাবীর মুখে হাসি ফুটল। ‘এবার বুঝলাম,’ ভাবী বলল। ‘কখনো কখনো দেখি, টাকা পাওয়ার অপেক্ষা না করেই আমাদের অর্ডারি জিনিসপত্র আনতে ছুট লাগাও, এটাই তাহলে টাকার আড়ত।’ মতিনের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল ভাবী আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে দরজাটা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল। সংসারের জন্য মতিন টুকটাক কিছু খরচ করে থাকে এটা সে জানত, কিন্তু টাকাটা কোথা থেকে আসে সেটা ছিল তার ধারণার বাইরে। তার একটু খারাপ লাগত, ছেলেটা যদি কিছু উপার্জন করে থাকে তবে সেটা তার নিজের কাজেই লাগানো উচিত, এটাই সে ভাবত। ছেলেটা পরিবারের জন্য যতটা খাটে সেটা যথেষ্টর চাইতেও বেশি।
আজ অবশ্য মতিন বড়ভায়ের কাছ থেকে দুদিনের বাজারের টাকাই পেয়েছে। সোমা চায়ের কাপে চিনি দিয়ে ভাবছিল। অবশ্য সে এটা অনেক আগে থেকেই জানত। কিন্তু কখনই সে নিজ হাতে সেখান থেকে একটা পয়সাও নেয়নি, মতিনের সমর্থন থাকা শর্তেও। কলেজে যাওয়ার সময় সে মতিন থাকলে কখনো কখনো পথ খরচের টাকা চেয়ে নেয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় ভাবির কাছ থেকে তার যা দরকার নিয়ে থাকে।
সে চায়ের কাপ হাতে রান্নাঘর থেকে বের হল। সিঁড়ির কাছাকাছি হতে না হতেই দেখল, মেজভাবী সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে, সে একটু শঙ্কিত হল। মেজভাই আজকে অফিসে যাবেনা, কাজেই এই ‘অসময়ে’ তার বা মেজভাবীর নিজে নামার কথা নয়।
‘বাহ! সোমা,’ কিন্তু তাকে আর বেশি কিছু ভাববার সময় না দিয়েই তার ভাবী বলে উঠল। ‘তোমার ভাই চা খাবে, তা তুমি টের পেয়েগেছ?’ সে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। ‘তোমাকে আর কষ্ট করে উপরে যেতে হবে না আমার কাছে দাও।’ সোমার চোখ ফেটে পানি আসার উপক্রম হল, সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপটা তার হাতে তুলে দিল। তারপর আবার সে রান্নাঘরে ঢুকল।
এই শিক্ষিত মহিলা তাদের সাথে এমন ব্যবহার করে যেন, সোমা আর মতিন কোন একজাতীয় করুণার পাত্র, আর বড়ভাই-ভাবী তার চেয়ে নিচু স্তরের কিছু একটা বলে অবজ্ঞার বিষয়। সে এখানে দয়া করে থাকছে বলে এরা সবাই ধন্য হয়ে গেছে। মেজভায়ের আয় বড়ভায়ের প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু বড়ভাই সংসারের জন্য যা খরচ করে, সে করে তার অর্ধেক। রান্না বান্না বা বাড়ির কোন কাজেই সে নেই, অথচ সোমা আর মতিনকে হরদম নিজের কাজের আদেশ করে চলেছে। তার বা মেজভায়ের জুতো ছিঁড়ে গেছে, সেটা মেরামত করে আনার হুকুম করবে মতিনের বাজার থেকে ফিরে আসার পরে, আগে নয়। এমন নয় যে তাদের মাত্র এক জোড়া করে জুতো। মতিনের কাছে দিয়ে আসতে হয় সোমাকে, মতিন কোন কথা না বলে গায়ে জামা চড়াতে শুরু করে, আর সোমার চোখ ফেটে পানি আসতে থাকে। একে এখন আবার এক মাইল দূরের বাজারে যেতে হবে। যাওয়া আসার খরচ বা মেরামতের খরচ বাবদ একটাও পয়সা কখনই দেবে না সেই ভদ্রমহিলা।
‘কাল সকালে যখন বাজার করতে যাবে তখন দিলে হয়না ভাবী?’ দুদিন আগে ভাবি তার হাতে নিজের স্যান্ডেল জোড়া দেওয়ার সময় সোমা বলেছিল।
‘সে একটা পুরুষ মানুষ, সারা দিন ঘরে বসে থেকে কী করবে? একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করলেই ওর জন্য ভাল।’
সোমা আর কিছু না বলে মতিনের ঘরে গিয়ে রাগ করে জুতোজোড়া মেঝেতে আছাড় মেরে ফেলেছিল, ‘তুই পুরুষ মানুষ, সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাত্রে শোবার সময় বাড়ি আসতে পারিসনা?’ সে রাগ করে বলেছিল আর ওর রাগ দেখে মতিন শুধু মুখ টিপে হেসেছিল।
বাবার ঘরে ফিরে এসে- নিজেও সে এখন এই ঘরেই থাকে, কাজেই এটা তারও ঘর বটে- টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একটা বই খুলে সেটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে শুরু করল। আসলেই সে এমনভাবে সারাদিন ঘরে বসে থাকে কেন? কলেজে, বাজারে বা কোন কাজে কোথাও গেলে প্রয়োজনের চেয়ে এক মুহূর্ত বেশি সময় বাইরে থাকে কিনা সন্দেহ। ভোর বেলায় উঠে রান্নার জন্য কাঠ কেটে রাখবে, সবজি বাগানের যত্ন নেবে তারপরে বাজার।কলেজ যখন ছিল তখন বাজার করে আনত কলেজ থেকে ফেরার পথে, আর সেটাও বড়ভায়ের বেশ কয়েকটা কড়া ধমক খাওয়ার পরে, তা না হলে তাকে একই পথ দুইবার করে যেতে আসতে হত।
এটা ছিল মায়ের বাগান। মা- এটাই হচ্ছে সূত্র, সারাটা সময় সে মায়ের পায়েপায়ে ঘুরত, বড় ভাবির কাছে সোমা শুনেছে। সোমা চোখ বন্ধ করল। বাবা ঘুমাচ্ছে, সেও একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমানোর অভ্যাস তার আছে। কিন্তু তার কপালে ঘুম নেই, অন্তত এই দুপুরে।
‘সোমা,’ দরজার কাছ থেকে আতি মৃদু স্বরে তার নাম ধরে ডাকল মিতু। বাবা ঘুমাচ্ছে, তার না ঘুম ভেঙে যায়। সোমা মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকাল, তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে মিতুর হাত ধরল। মাথার ইংগিতে জানতে চাইল, কী। মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। সে সোমাকে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল। তার হাতে খাতা আর কলম, কিন্তু সে কলেজ থেকে আসেনি। প্রতিবেশীদের ভিতরে এই একটা মাত্র মেয়ে আছে, যে প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসে, কখনো শুধু সোমার সাথে গল্প করতে আর কখনো মতিনের কাছে অঙ্ক টঙ্ক বুঝে নিতে। আসলে তাদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের হাটা পথের দূরত্বের ভিতরে বাড়ি আছে মাত্র তিনটে। অঙ্ক টঙ্ক বুঝে নিতে? হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই, কিন্তু মতিনের সামনে এলে তার চাহনি আর মুখের ভাব যেটা প্রকাশ করে সেটা আন্য কিছু। আর তার ভাইটা যে বিশেষ খুশি হয় তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারেনা। ভাল, এটা সোমার জন্য একটা আনন্দের বিষয়।
মিতুর ছ’বছরের ভাই শান্ত গেটের কাছে হাস্নুহেনার ঝোপটার কাছে বসে কিছু একটা করছে। এদিকে পিছন ফিরে থাকা অশান্ত ছেলেটা কোন এক ভাবে তাদের উপস্থিতি অনুভব করে উঠে প্যান্টের পিছনে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এসে বারান্দায় উঠল।‘আপু, তুমি কেমন আছ?’ সে সোমার হাত ধরে জানতে চাইল।
‘ভাল আছি,’ সোমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল। ‘তুমি কেমন আছ? তোমার আম্মু?’
‘আমি ভাল আছি, আম্মুও ভাল আছে। আম্মু তোমাকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে বলেছে।’
‘আমি আজ বিকালে তোমাদের বাড়িতে যাব,’ সোমা হেসে বলল। ‘তুমি থাকবে তো? তোমাকে তো পাওয়াই যায়না।’
‘হ্যাঁ থাকব। আমি আজ বিকালে কোথাও যাচ্ছি না।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘বিকাল তো হয়েই যাচ্ছে, আমাদের সাথেই তোমাকে যেতে হবে কিন্তু।’ তার কথা বলার ঢঙে এরা দুজনেই হেসে উঠল।
‘আচ্ছা দেখা যাবে।’ সোমা বলল।
‘সোমা, মতিনভাই কি ঘুমিয়ে আছে?’ মিতু একটু উঁচু স্বরে জানতে চাইল। সে জানে, মতিন দিনে কখনই ঘুমায় না, কিন্তু সে বাড়িতে আছে কি না সেটাই আসল কথা।
‘কেন, নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছনা?’ দরজার ওপাশ থেকে শুনতে পাওয়া গেল। এরা দুজন হাসির ধমক সামাল দিতে সামনে ঝুঁকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল।
‘হে , মতিনভাই,’ শান্ত প্রায় চিৎকার করে উঠল। সে ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। মতিন খাটের উপরে একটা বই হাতে বসে আছে। এরা দুজন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে বাড়ির ভিতরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বললনা।
‘বলেন, আপনাদের জন্য আমি কী করতে পারি?’ মিতু আর শান্ত স্যান্ডেল খুলে ভিতরে ঢুকতেই মতিন জিজ্ঞাসা করল। সোমা তাড়াতাড়ি বারান্দার একটা চেয়ার এনে টেবিলের সামনে রেখে দিল, মিতু সেটাতে বসল আর শান্ত ততক্ষণে খাটের উপরে উঠে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে।
‘আমাকে কয়েকটা অংক বুঝিয়ে দিতে হবে।’ মিতু মতিনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখা নিজের খাতাটার দিকে মুখ নিচু করে চেয়ে থাকল। তার সুন্দর ফর্সা মুখটা পুরোপুরি লাল হয়ে উঠেছে। সোমা সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ‘আমার ভাইটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে তোমার কী হয়, লক্ষ্মী সোনা?’ সে মনে মনে বলল।
‘নিশ্চয়,’ সে মতিনকে বলতে শুনল।
বাবার ঘুম ভেঙে গেছে, সে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘সোমা,’ সে ঘরে ঢুকতেই জিঞ্জাসা করল, ‘মিতু এসেছে?’
‘হ্যাঁ।’ সোমা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, সেখানে রাগ বা বিরক্তির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এই মেয়েটাকে তার নম্র আর শান্ত স্বভাবের জন্য এ বাড়ির সবাই- সম্ভবত মেজভাবি ছাড়া- পছন্দ করে।
‘একটু চা খাওয়াবি?’
সোমা তার বাবার মুখের দিকে আবার তাকাল। তাকে, মিতুকে, নাকি সবাইয়ের জন্য বলছে? সোমার মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। ‘হ্যাঁ।’ সে উঠে রান্না ঘরে গেল।
সোমার প্রায় সমবয়সী আর একই শ্রেণির ছাত্রী হলেও মিতু কমার্সের, কাজেই এই বিরান এলাকায় পড়া বুঝে নেওয়ার জন্য মতিনের কাছে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মিতুর বাবা মতিনকে মিতুর প্রাইভেট পড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু খুব সম্ভব নিজের ঘর কুনো আর লাজুক স্বভাবের জন্য সেটা হয়ে ওঠে নি। তবে মাঝে মধ্যেই সে সেখনে যায়, আর মিতুও দরকারে অদরকারে এখানে আসে।
একটা ট্রেতে করে পাঁচ কাপ চা আর সেই সাথে একটা পিরিচে গোটা কয়েক বিস্কুট নিয়ে সোমা রান্না ঘর থেকে বের হল। আজকেও সিঁড়ির কাছাকাছি হতেই দেখতে পেল, মেজভাবি নেমে আসছে। মেজভাবির ভ্রু কুঁচকে উঠল। ‘সোমা,’ সে দ্রুত পায়ে নেমে এসে সোমার সামনে দাঁড়াল। ‘কার জন্য নিয়ে যাচ্ছ?’
‘মিতুরা এসেছে, আর বাবাও খাবে,’ সে আড়ষ্ট গলায় জবাব দিল।
‘মতিনের কাছে এসেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা যাও,’ সে পথ ছেড়েদিল।
সোমা বাবার ঘরে ঢোকার সময় দেখল, ভাবি উপরে ফিরে না গিয়ে সেখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সে বাবাকে চা আর কয়েকটা বিস্কুট দিয়ে যখন মতিনের ঘরে যাওয়ার জন্য বের হল, তখন তাকে বাবার ঘরে ঢুকতে দেখল। তার বুকটা ধ্বক করে উঠল, এই মহিলা এটা কখনই করেনা।
‘. . . আমাদের কষ্ট করে আয় করা টাকা কেন মতিনের বন্ধুদের আপ্যায়নের কাজে ব্যয় করা হবে?’ চায়ের ট্রে টেবিলে নামিয়ে রাখতে না রাখতেই বাবার ঘর থেকে ভদ্র মহিলার রাগি কণ্ঠস্বর এসে তাদের চারজনকে যেন ধাক্কা দিল। মতিন মুখ নিচু করল, মিতু চমকে মুখ তুলে তাকাল। এমনকি, শান্তও স্থির হয়ে গেল। সোমার ইচ্ছা হতে লাগল, এক ছুটে বের হয়ে গিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু সে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল।
‘. . . না, না,’ আবার চিৎকার শোনা গেল। ‘তাকে আমরা খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি লেখা পড়ার খরচ যোগাচ্ছি সেটাই তো বেশি। তারপর যদি তার আর কিছু লাগে, তবে তার সেটা নিজেরই যোগাড় করে নিতে হবে।’
মতিন একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার চেষ্টা করতে করতে খাতায় অংক করে যেতে লাগল। সোমার কারো হাতে চায়ের কাপ তুলে দেওয়ার সাহস হল না।
আধাঘণ্টা খানেক পরে মিতু উঠে দাঁড়াল আর শান্ত খাট থেকে নামল। ‘তোমরা বাইরে একটু দাঁড়াও, আমি পোশাকটা বদলে আসছি।’ সে দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পরেই সে বের হল। তারা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সোমার চোখদুটো সরু হয়ে উঠল, মতিনের পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী হলেও হাতে মাঝারি ধরনের একটা কাগজের প্যাকেট।
‘ছোট, তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ঘুরতে।’ সে আর কিছু না বলে মিতুকে ইশারা করে বারান্দার নিচে নেমে গেল, আরা দুজন তাকে অনুসরণ করল। মিতু মাথা নিচু করে রেখেছে, সে বিড়বিড় করে সোমাকে কিছু একটা বলল, যার কোন অর্থ হয় কিনা সেটা হয়তো মিতু নিজেও জানেনা। সোমা প্রায় একছুটে বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভাবি চলে গেছে। সে অবাক হয়ে দেখল, তার বাবা প্রশান্ত মুখে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। এ যেন তার সেই আগের বাবা।
‘এখানে আয় তো মা,’ সে ঢুকতেই বলল। সোমা নীরবে তার পাশে বিছানার কোনায় বসল। ‘ওরা চলে গেছে?’
সোমা মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিল। তার কোন শব্দ উচ্চারণ করার সাহস হলনা, সে কেঁদে ফেলবে। বাবা সোমার বাম হাতের কব্জির কাছটা ধরে নিজের বুকের উপরে টেনে আনল। তারপর আবার ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘মতিনকে একটু ডেকে আনত, মা।’
‘ভাই অদের সাথে বাইরে গেল,’ সে ধরা গলায় বলল। সে অনেকটা সামলে উঠেছ।
‘ও, আচ্ছা,’ বৃদ্ধ মানুষটা চোখ বন্ধ করল। ‘এলে আমার কাছে ডেকে আনিস।’ সোমার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। সে কোন জবাব দিলনা। তার কেমন যেন ধারণা হতে থাকল, মতিন ফিরে আসার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়নি। আর তার চাইতেও খারাপ যেটা হতে পারে, বাবা তাকে কিছু কড়া কথা শোনাতে চাচ্ছে।
রাত আটটার সময় বড়ভাই আর প্রায় সাড়ে আটটার দিকে মেজভাই ফিরে এসেছে। কিন্তু যার অনেক আগেই ফিরে আসার কথা, যার জন্য পুরোটা সময় সোমা উৎকর্ণ হয়ে থেকেছে আর কাজে অকাজে বারবার বারান্দায় এমনকি গেটের কাছেও কয়েকবার গিয়েছে সে ফিরে আসেনি। বাবা শুধু সন্ধ্যার সময় একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু আর কেউ নয়। বড়ভাবি রাত সাড়ে নটার দিকে খেতে দেওয়ার সময় তাকে ডাকতে বলবে।
রাত শোওয়া দশটার দিকে খাওয়ার পাট চুকল। বাবা নিজের ঘরে, দুভাই আর মেজভাবি নিচের ডাইনিং টেবিলে। বাচ্চা দুজনকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই, সোমা আর বড়ভাবি খাবে একটু পরে। বাবা ভাইদেরকে ডেকে আনতে বলল, তারা এলো, সাথে এলো মেজভাবি।
‘তোমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছ,’ বাবা কোন ভণিতা না করেই বলতে শুরু করল। ‘তোমরা আমার জন্য আর তোমাদের ছোট ভাই বোনদের জন্যও যথেষ্ট করেছ।’ বাবা একটু থামল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘তোমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ আছে, আমাকে সেটা মানতেই হবে। কাজেই আমি চাই, তোমরা এখন নিজেদের সুবিধা মত ব্যবস্থা করে নাও।’
‘কিছু বুঝলাম না,’ বড়ভাই বলল। ‘এখানে আমরা তো কোন অসুবিধা দেখছি না। তাছাড়া তোমাদের সবার প্রতি আমাদের একটা কর্তব্য আছে . . .।‘
‘সেটা তোমারা যথেষ্ট ভালভাবে পালন করেছ, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’ বাবা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। ‘তোমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাড়িটা পুরোটা আমি মতিনকে দিয়ে যাব।’
তাদেরকে হতভম্ব করে দেওয়ারমত কথা। অস্ফুট একটা গুঞ্জন উঠে মিলিয়ে গেল। মেজভাবি মেজভায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছুই বললনা।
‘মতিন কোথায়?’ হঠাত যেন বড়ভায়ের মতিনের কথা মনে পড়ল। সে মুখ ঘুরিয়ে সোমার কাছে জানতে চাইল।
‘এখনো আসেনি।’ সোমা সোজাসুজি বড়ভায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল।
‘এখনো আসেনি? সে কি. . .?’
‘তার কথা থাক,’ তাকে বাধা দিয়ে বাবা বলল। মেজভাই ঝট করে সোমার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। ‘তাকে এই বাড়িটা লিখে দিচ্ছি। সে তোমাদের যাকে রাখতে চায়, আর তোমাদের যারা থাকতে চাও, সেটা নিজেরা বোঝাপড়া করে নেবে। আমাকে আর সোমাকে থাকতে দিলে থাকব, নয়ত গ্রামে গিয়ে থাকব . . .।’
‘এটা হতে পারে না,’ তাকে বাধা দিয়ে মেজভাবি বলে উঠল। ‘এরা আপনার ছেলে, আপনার ওয়ারিশ, এদের আপনি বঞ্চিত করতে পারেন না। দেশে আইন আছে . . .।’
বাবা ছাড়া বাকি সবাই হতভম্বের তার দিকে তাকাল।
‘মনি!’ মেজভাই প্রায় চিৎকার ঞ্জে উঠল।
‘দেশে আইন আদালত সবই আছে, ইচ্ছা হলে তোমরা সবাই সেখানে যেতে পার। আমার আর বলার কিছু নেই, তোমরা এখন আসতে পার।’ বাবা চোখ বন্ধ করল।
‘ভিতরে আসবেন না?’ মিতুদের বাড়ির সামনে এসে মতিন ঘুরে দাড়াতেই মিতু বলল। কণ্ঠে আন্তরিকতা, কিন্তু তার বিষণ্ণ দৃষ্টি মতিনের হাতের প্যাকেটটার দিকে।
‘এখন না, পরে’, মতিন মাথা নেড়ে জবাব দিল। মনে মনে বলল, হয়তো।
‘তাহলে বিকালে সোমা আপুকে নিয়ে আসবেন’। শান্ত বলল, মতিন একটু হাসল। তার হাসিটা মলিন।শান্ত খোলা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে। মতিন তাদেরকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিতে চায়না। সে পিছন ফিরে হাটতে যাবে, কিন্তু সে এক পা উঁচু করে সেভাবেই থেমে গেল।
‘মতিন ভাই,’ এক সাগর কান্না যেন শব্দ করে উঠল। কিন্তু সে পিছন ফিরে তাকাল না। সে জানে, যে চোখ দুটো একটু আগে তার দিকে তাকিয়েছিল, সে দুটো এখন অশ্রু ঝরাতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটা সে দেখতে চায় না বলে নয়, তার নিজের চোখ দুটো থেকে যা ঝরে পড়তে শুরু করেছে সেটা সে তাকে দেখতে দিতে চায়না বলেই সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল না। একটু পরেই সে রাস্তা পার হয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রাস্তার সমান্তরালে ডান দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল, একটা বাস আসছে।
সকাল দশটার দিকে ট্রেনটা এমন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে যেটাকে একটা স্টেশন হিসাবে মেনে নিতে ইচ্ছা করেনা। আর ট্রেনটা সেখানে এতটা বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে লাগল যে মতিন বিরক্ত হয়ে উঠল। রাত সাড় এগারটায় এটা কমলাপুর থেকে ছেড়েছে, সে ট্রেন যাত্রা খুব বেশি করেনি আর হয়তো সেই কারণেই প্রায় তখন থেকেই ঘুমিয়ে আর না ঘুমিয়ে রাতটা শেষ করেছ। এখন আবার তার ঝিমুনি আসছে . . .।