কী করি বলুন তো ?আমরা যারা ছুটকা ফুটকা লেখালেখির সাথে জড়িত,বইমেলা যতই এগিয়ে আসতে থাকে,ততই আকুল হতে থাকি নিজের লেখাগুলো একটা বইয়ের আকারে দেখতে !প্রথম বই যখন প্রকাশিত হয়েছিলো,কিছুই বুঝতাম না এসব প্রকাশনীর ব্যাপার স্যাপার !ফর্মা,১০০-৭০গ্রাম কাগজ,স্ক্রিপ্ট,প্রুফ দেখা,প্রচ্ছদ,বাঁধাই,কম্পোজ,ছাপা,আরও কত কী !প্রকাশকের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে হলো কত যে মহার্ঘ বাণী !একে তো নবীশ লেখিকা তারপর আবার কবিতার বই !এক প্রকাশক তো সরাসরি বলে দিলো কবিতা বুঝিও না,ছাপিও না !আরেক নামকরা প্রকাশক বললো,কবিতার বই ছাপলে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি,নিজের ক্ষতি করে তো আর বই ছাপতে আসি নি?বিখ্যাত কবি আল মাহমুদের বই ই গত মেলায় ১০কপির বেশি বিক্রি করতে পারিনি ।পারলে উপন্যাস লিখে নিয়ে আসুন,আর উপন্যাস যেন ৫-৬ফর্মার বেশি না হয় ।বুঝুন ঠেলা,ফরমায়েশি লেখা,কবিতা ছেড়ে উপন্যাস লিখতে হবে,আপনি বোধহয় বহুপ্রতিভামুখী,আর লেখা মনে হয় জাদুমন্ত্রে হয়ে যায় ।আরে যে কবিতা লেখে সে যে উপন্যাস লিখতেই পারবে এমন কোন নিয়ম কি আছে?তাছাড়া লেখার আগেই কী করে বোঝা যাবে কত ফর্মার লেখা হবে?
কী আর করা,বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে অনন্যা আর সৃজনী থেকে বের হলো আমার ২টি কাব্যগ্রন্থ ।তারপর শুরু হলো আত্মীয়,বন্ধু,চেনা-জানা,একে তাকে বই কেনার অনুরোধ!এ যেন ইলেকশনের ভোট-প্রার্থী !ডা.মোহিত কামাল বললেন,আপা এসবে কাজ হবে না, এ্যাড দেন বড় করে কয়েকদিন,প্রচারে প্রসার ।কিন্তু অত বড় করে বিজ্ঞাপন দেয়ার অর্থটা আমাকে দেবে কে?এমনিতে কাছের মানুষেরা বলতে শুরু করেছে,ঘরের খেয়ে নাকি বনের মোষ তাড়ানোর খায়েস হয়েছে আমার ।তাদের বইয়ের ব্যাপারে কাউকে বলতে অনুরোধ করলেই বলে,ভিক্ষা চাইতে পারবোনা ।এতদিন জানতাম ভোট ভিক্ষুক,এখন শুনলাম বই-ভিক্ষুক !কত সাধ্য সাধনা করে স্ক্রিপ্ট রেডি করলাম,প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিলাম,তারপর আবার রাত জেগে একটা একটা শব্দ অতি সাবধানে দেখে দেখে প্রুফ দেখতে গিয়ে মশার কামড় খেয়ে বাঁধালাম ডেঙ্গু !যমে মানুষে টানাটানি,১৮ব্যাগ রক্ত শরীরে ঢুকিয়ে সে যাত্রায় প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরলাম ।কাছের লোকেরা ভাবল ইহজন্মে বোধহয় আর বই প্রকাশের নাম মুখে আনবো না ।হলো ও তাই,পরের বছর চুপচাপ কাটল,কিন্তু মেলার সময় মনটা বিষাদে ছেয়ে রইলো,ছোট বড় বইয়ের বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম,কার কার বই বেরিয়েছে দেখেও আনন্দ!এর পরের বছর আবার নব উদ্যমে বই প্রকাশের উদ্যোগ শুরু করলাম !কাছের মানুষেরা বেজার,রোগান্বিত স্বরে বলতে লাগলেন,চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী,একবারেও শিক্ষা হয়নি!বনের মোষ তাড়ানোর কাজ আবার শুরু হলো,আমরা কিন্তু তোর বই বিক্রির জন্য ভিক্ষা চাইতে পারবো না…ইত্যাদি ইত্যাদি।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন তারা ।আমাদের মতো যারা পয়সা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারিনা,তাদের বিভিন্ন ব্লগ আর ফেসবুক বিনি পয়সায় সে সুযোগ করে দিয়েছে।কত লেখক কবিদের যে বইয়ের প্রচ্ছদসহ বিজ্ঞাপন আসছে ,দেখলেই ভালো লাগে ।অথচ এর মাঝেও কিছু কিছু নেগেটিভ চরিত্রের মানুষ উৎসাহ,অনুপ্রেরণা দেয়ার বদলে সমালোচনায় মুখর ।নিজের ঢোল আমরা নিজে পেটাচ্ছি,বই-ভিক্ষুক,লেখক-ভিক্ষুক এইসব ।কোন কোন কবি লেখকদের হয়ে তাদের বন্ধুবান্ধবরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে,তো কথা তো একই হলো,যেই লাউ সেই কদু !আমার বইয়ের কথা কেও যদি না ই জানলো তবে পড়বেটা কে আর না পড়লে লেখার ভালোমন্দ বুঝবেই বা কীভাবে?কত আজেবাজে,বস্তাপচা জিনিষের বিজ্ঞাপনে মিডিয়া সয়লাব,আর বইয়ের মতো ভালো কিছুর প্রচারেই জাত গেলো,মান গেলো,ভিক্ষুক !সত্যি সেলুকাস… !অথচ বিদেশি সাদা চামড়ার লেখকরা তাদের বই কাঁধে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবীময় ।স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করে তারা তাদের বই নিয়ে কথা বলছেন,প্রচার,বিক্রি আর যা যা করা দরকার সবই করছেন ।আর আমরা সে তুলনায় তো কিছুই করছি না।তাতেই যেসব বিরূপ মন্তব্য আর সমালোচনা !ঐ যে কথায় বলে,যত দোষ নন্দ ঘোষ !একেকবার ইচ্ছে করে,নাহ আর নয়,এতো প্রতিকূলতা সয়ে বই প্রকাশের দরকার নেই ।কিন্তু মন যে মানে না ।কী করি বলুন তো ?
মনে মনে ভাবি,দাঁড়াও না,একবার হুমায়ূন আহমদের মতো নামকরা হয়ে নিই,তারপর দেখবে,প্রকাশকরা টাকার বস্তা নিয়ে এসে বাড়ির সামনে লাইন দিবে,ভিড় সামলাতে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে,টাকা গুনতে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট নিয়োগ দিতে হবে ।মনের কথা মুখেও বলে ফেলি ।শুনে সবাই বলে, ঐ বেটা হুমায়ূনের কথা আর বলিস না, সে ও কি কম নির্লজ্জ ,দেখিস না তার বিজ্ঞাপনের রকম সকম,হলুদ পাঞ্জাবি পরিয়ে হিমু ,বর বউ সাজিয়ে সারা বইমেলা চত্বর মিছিল করে ঘোরানো !বলি,তাহলে আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের মলা মাছের মতো ফেসবুক আর ব্লগ বিজ্ঞাপন কী এমন দোষ করলো রে বাবা ?
নিজের ঢাক ঢোল নিজেই পেটাচ্ছি,ছি ছি লজ্জাও নেই ।লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি বই নামক জিনিষটা বোধহয় খুবই ভারি,তাই কেউই বহন করতে রাজী নন,তাই তো নিজেরটা নিজেকেই পেটাতে হয় !