আমি এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবো। পড়ালেখার চাপ এসে ভর করেছে চব্বিশ ঘণ্টা। কিন্তু আমি কি সুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে পড়ালেখা করতে পারছি? পারছি না, নানা জায়গা থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। অন্যদিকে স্কুল যাবার পথে, সপ্তাহে চার-পাঁচদিন লম্বা চুলওয়ালা ছেলেটা আমার পিছু নেয়। আমি অনেক দিন ভেবেছি এর একটা বিহিত ঘটাবো। কেন ছেলেটা এভাবে আমার পিছু নিয়ে হাঁটে! পরক্ষণে আবার ভাবনা এসে জড়ো হয়।
ছেলেটাতো আমাকে তেমন ডিস্টার্ব করছে না; রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি আসছি তা' দূর থেকে এক পলক দেখে মাথা নত করে ফেলবে। অতঃপর আমি ওর পাশ কেটে গেলে অনেকটা ব্যবধান রেখে হাঁটে। আমি ভেবেছি ও নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে কিছু একটা চায়, কী চায়?
নাহ্, আমি আর ভাবতে পারছি না। ও যা চায় তা' আমার পক্ষে দেয়াও সম্ভব নয়। পরিবার থেকে সতর্ক বাণী শোনা আছে, বড় আপা পালিয়ে বিয়ে করার কারণে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে আমাদের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই।
আপার কথা ভেবে মনের মাঝে আবেগ-অনুভূতি প্রশ্রয় দেই না। আমি জানি, আমার চাওয়া-পাওয়ার এক রতি মূল্য আমার বাবা-মায়ের কাছে নেই। ওরা যা বলবে আমাকেও তাই করতে হবে।
ওদের কথা ভেবে আমি আগ বাড়িয়ে কিছুই করতে পারবো না। কিছু করতে গেলে খুন হয়ে যাবো। আব্বা-আম্মা আমাকে ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দিবে সে কারণে আমি উদ্বিগ্ন।
কাকা-কাকী এসে বোঝাল, 'লাখি এখন পড়ালেখা করছে পড়ুক না, তাছাড়া ওর বিয়ের বয়স এখনো হয়ে উঠেনি।'
বাবা ধমকের সুরে বললেন, 'বড়দেরকে জ্ঞান দিতে এসো না, জানো না যুগ খারাপ। এ যুগে মেয়ে বড় হলে ঘরে রাখতে নেই তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়াই ভালো।'
কাকা বাবাকে অনেকভাবে বুঝাতে চাইলো। বাবা বুঝ মানলেন না।
আমি কাকাকে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম।
কাকা আমার পিঠে হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'থাক মা থাক, কাঁদিস না, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। শুনেছিলাম আমাদের বংশের পূর্বপুরুষ কিছুলোক পাগল ছিলো। এখনো যে কিছু লোক পাগল রয়ে গেছে জানা ছিলো না।'
এখনো পথঘাটে অনেক লোকে আমাদেরকে পাগলের গোষ্ঠী বলে গালাগাল করে।
সত্যিই তো পাগল না হলে কেউ কি এমনটি করে।
ভাইয়া টাকা পাঠায় বিদেশ থেকে। বাবা সংসারে খরচ না করে জায়গা জমি কিনবে। মেহমান বেড়াতে এলে ভালো মতো সমাদরও করতে পারে না, না আনবে গোস্ত না কিনবে বড় মাছ। মেহমান এলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়।
বাবা শুধু গল্প করবে অমুক স্থানে এত লক্ষ টাকার জমি কিনলাম দুটো ছেলে আছে পুত-নাতিন নিয়ে ভালো মতো চলতে হবে তো। তা না হলে নাতিরা বলবে দাদাজান আমাদের জন্যে কিছুই করে যেতে পারেননি। দোষটা চাপাবে বংশধরদের ওপর।
সত্যি আমার হাসি পায় এসব শুনলে। এতো মানুষের ভিড়ে আমরা যেন অন্য মানুষ। আমি অনেক সময় ভাবি আমার কতটুকু স্বাধীনতা আছে। স্কুল যাওয়া আর বাড়ি ফেরা এটুকুই।
বাবার মুখে কখনো হাসি ফোটে না। রাগি রাগি ভাব করে থাকে কথাও বলবে ঝাঁঝালো সুরে। কোনো কিছু আদেশ-উপদেশ দিচ্ছে ঠিক যেন গালমন্দ করছে।
রাত নয়টার পর আমার ভয় ভয় লাগে, একা বাড়ি। একলা রুমে আমি একা পড়ে থাকি। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো সুর তোলে প্রখরভাবে। কোথাও কোনো টু শব্দ হলে ধ্যান করে শুনি। তারপর আর পড়তে ভালো লাগে না, শুয়ে থাকি হয়তো কখনো স্বপ্ন দেখি, কখনো কল্পনা করি।
যে কল্পনাটা বেশি করি। আমি স্কুল থেকে ফিরছি, পথিমধ্যে লম্বা, ফর্সা, ছেলেটা রাস্তার মধ্যস্থানে দেড় বিঘে লম্বা চুলগুলো মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর পাশ দিয়ে যাচ্ছি ও যেন কিছু বলতে চায়, বলছে না। আমি কয়েক কদম হাঁটার পর ও ডাকে।
'এই শুনছেন?'
আমি ভাবি ছেলেটা আমাকে অনুসরণ করছে। তাই ভেবে আমি ওর দিকে তাকাই, দেখি না ও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার কয়েক কদম হাঁটি, আবার তার কাঁপা কণ্ঠ ভেসে আসে।
'এই যে, এই যে শুনছেন?'
আমি পেছন ফিরে দেখি ও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভাবলাম, ও কি আমার দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে?
তাই ভেবে আমি ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, 'আপনি কি আমাকে ডাকছেন?'
ছেলেটা দূর থেকে হাঁ যা বোধক ভাবে মাথা নাড়ে।
আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
'বলুন, কেন ডেকেছেন?'
'না মানে, আমার কথায় কিছু মনে করবেন নাতো?'
'মনে করার কী আছে?'
'আছে, শুনলে হয়তো রাগ করবেন।'
'আগে শুনি-ই না; তারপর দেখি, রাগ করা যায় কিনা।'
'রহস্য করছেন, আমি রহস্য করা পছন্দ করি না।'
'ঠিক আছে, রহস্য করছি না।'
'আপনি, আপনি...।'
'বলুন, আপনি, আপনি করছেন কেন?'
'না মানে, আপনি কী আমার কবিতার নায়িকা হবেন?'
'আপনি কবিতা লেখেন?'
'হাঁ যা, লেখি। কবিতা হয় কিনা জানি না।'
'দেখি দু'এক লাইন পড়ে শুনান তো?'
আমি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম
'সরু রাস্তার পাড়ে------। তুমি এসে----।'
'আর শোনাতে হবে না, আপনি কবি হয়ে গেছেন। কিন্তু আমি আপনার কবিতার নায়িকা কী করে হবো? যদি আপনার কবিতার নায়িকা হয়ে যাই; তাহলে আপনার যতো কবিতার লাইনে তুমি শব্দ আছে সবখানে, আপনি লাগাতে হবে। এখন আপনিই বলুন, তুমির স্থানে কী আপনি শব্দ সংযোগ করবেন?'
'আপনি রহস্য ভালো জানেন, তবে এটুকু জানেন না। যত আপন তত তুই।'
'যত আপন তত তুই, তার মানে?'
'মানে হচ্ছে এই, একজনের সাথে আমার পরিচয় ঘটলো, আপনি সম্বোধন করে। অতঃপর চলে আসি তুমিতে, ঘনিষ্ঠতা যখন প্রখর চলে এলাম তুইয়ে। তবে হাঁ, সবার বেলায় নয়। আপনার বুঝে এসেছে?'
'এসেছে। তাহলে এখন আমায় কী করতে বলছেন?'
'আমার কবিতার নায়িকা হবে কি না তাই শুনতে চাচ্ছি।'
'যদি হই।'
'যদি শব্দটার মাঝে ফ্যাক্টর থাকে। একটু লিগ্যাল ভাবে শুনতে চাচ্ছিলাম।'
'হবো আপনার গল্পের নায়িকা।'
'আমার গল্পের নয়; কবিতার।'
'আচ্ছা ঠিক আছে; আপনার কবিতার নায়িকা হবো।'
'কবিতার নায়িকা হলে একটা কিছু করতে হবে।'
'কী করতে হবে?'
'শুনে রেগে যাবেন নাতো?'
'যদি রেগে যাই?'
'রাগলে যে কাউকে দেখতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু কাউকে রাগালে ভয় হয়, দুঃখ পাই।'
'আপনার কথাটা বলে ফেলুন।'
'আমার কবিতার নায়িকা হলে আমাকে ভালবাসতে হবে।'
'কী বললেন, আবার বলুন?'
'না বুঝার কী আছে, আমার মনঃপ্রাণ সঁপে দিতে চেয়েছি তোমার মনেতে, তুমিও যদি দু'হাত বাড়িয়ে দাও, ধন্য হবে স্বপ্নময়, হয়তো জাগবে নতুন আশা, আর সেই আশা-প্রত্যাশার বাণী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি চেয়ে তোমার পথ পাণে, হে চঞ্চলা উদাসিনী, কী ভাবছ বল? তোমার তরে উড়েছে আমার মন পাখি। তাকিয়ে দেখ, চেয়ে দেখ, তোমায় দেখে চারিদিকে উষ্ণতার আভা চাদরের মতো ছড়িয়ে গেলো। দেখ বক পাখি উড়ে যাওয়া কী সুন্দর লাগছে। পড়েছে কৃষকের গায়ে চৈত্র মাসের রঙিন রোদ্র। আবার দক্ষিণ-পূর্ব মেরুর দিকে কালো মেঘ ঝড়-বাদলের সৃষ্টি। এই মেয়ে কী ভাবছ? আপসোস; তবে আপসোস। তোমার ভাগ্য হয়ে উঠিনি। তারপরও বলে যাবো, তুমি ভালো থেকে তোমার সুখের রাজ্যের রাজকার্যে। আমি পথিক নেমেছি পথে, কী হবে আগে পরে ভাবছি না, তবে তোমায় মনে পড়বে, আমার কবিতার নায়িকা হতে বলেছি বলে চমকে উঠেছিলে। কি দুর্ভাগ্য আমার যে তোমার দেখা পেয়েছিলাম, স্বপ্নে কী ভেবেছিলাম। ভাবিনি হয়তো তবু দেখা হয়ে গেলো। আমি চললাম, কোথায় যাচ্ছি জানি না, বিদায় হে প্রিয় সময় বিদায়। দেখা যেন হয় আর একবার; যখন তোমার চারিধারে থাকবে সুখের প্রলয়, বিদায় বিদায় হে প্রিয় সময়।'
'স্বপ্ন কি আমার ভাঙ্গে? হয়তো ভাঙ্গে ভোর বেলায় যখন চারদিকে আযান ছড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্য! সারা রাত আমি কথা কাটাকাটি করি ওই ছেলেটির সাথে। তারপর শুনে যাই বিরামহীন কবিতার লাইন।
'ও ছেলেটা কি কবিতা লিখতে পারে? কী জানি, কখনো ওর সাথে কথাই বলি না। সে কথা জানবো কেমন করে। আচ্ছা, আমি ওই ছেলেটার কথা এতো ভাবছি কেন? সে তো আমার কেউ না। তাকে নিয়ে কী কিছু স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা আমার মনে স্থান পেয়েছে? নাতো! তাহলে ভাবছি কেন? নাহ্ আর ভাববো না। ঘুম পাচ্ছে; ঘুমাই।'
স্কুল থেকে ফিরছি, আমার আশপাশে কেউ নেই। কিছু দূর যাবার পর দেখলাম, সেই স্বপ্নের মহানায়ক দাঁড়িয়ে আছে।
'এতদিন খালি মুখে ফিরে গেছি আজ কিছু একটা বলবো।'
ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। ও আমার দিকে একটু তাকিয়ে ছিলো। যখন দেখলো আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি, তখনি ওর চোখের পাতা নড়ে যায়।
বুকের সাথে বইগুলো জড়িয়ে ওর খুব সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও আস্তে আস্তে মাথা তুলে আমার দিকে একটু তাকিয়ে, পুনরায় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি গলা পরিষ্কার করে নিলাম। বললাম, 'আপনি এখানে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?'
ছেলেটা শান্ত কণ্ঠে বললো, 'ভালো লাগে তাই।'
'যখন আমার পিছু নেন তখনও কি?'
একটু থতমত খেয়ে যায় ছেলেটা, কথা বলছে না, বোঝা যাচ্ছে আমার সাথে তর্ক করতেও রাজি নয়।
আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, 'আসলে আপনি কী চান বলুন তো?'
'আপনি কিন্তু রেগে যাচ্ছেন তা কী খেয়াল করেছেন?'
'রাগবো না আপনি কেন অযথা আমার পিছু নেবেন।'
'সত্যি কথা বললে রাগ করবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে শুধু এক নজর দেখার জন্যে দাঁড়াই। আর যেদিন আপনাকে একনজর না দেখি, মন ভালো থাকে না।'
'সত্যি কথা বলছেন না কেন? আমার সাথে প্রেমটেম করতে চান এই তো?'
ভুল বললেন; এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আপনাকে দেখি না। আর যে প্রেম শব্দটা ব্যবহার করছেন তা' অনেক গভীর ব্যাপার। কেন না চাইলেই তো শুধু প্রেম করা যায় না। যদি না দু'টি মনের গভীরতা এক হয়।'
'তাহলে আমার প্রতি আপনার কি রকম ঝোঁক নিয়ে দাঁড়ান?'
'আপনাকে ভালো লাগে, ভালোবাসি তাই।'
'ভালো লাগা কী প্রেম নয়?'
'না ভালোবাসা আর প্রেম এক নয়। আর আমি ঠিক অভাগা নই সেটা স্মৃতির এলবামে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে।'
'এটা আবার কেমন কথা?
'প্রবাদ আছে। যে লোক কাউকে ভালবাসতে পারলো না এবং কারো ভালোবাসা পেলো না তার মতো অভাগা পৃথিবীতে আর নেই। আমি ঠিক অভাগা নই। তা' বুঝতে পেরেছেন।'
কাউকে ভালবাসতে হলে তার থেকে অনুমতি নিতে হয় তা' কী জানেন?'
'জানি না।'
'আমি আজ বলে দিচ্ছি আমাকে আর ভালবাসবেন না।'
'মেয়ে হিসেবে আপনাকে যতটা বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম, আসলে আপনি ততটাই বোকা।'
'আমি বোকা হই আর যাই হই, আমার পিছু আর নেবেন না।'
'দূর থেকে একনজর দেখতে পারবো তো?'
আমি আর কথা বললাম না, বাড়ির দিকে পা রাখলাম। ছেলেটা শেষ পর্যন্ত আমাকে বোকা বানিয়ে দিলো, আসলে কী আমি বোকা? আসলেই আমি বোকা, আমার কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। আচ্ছা কাউকে বলে এর একটা বিহিত ঘটালে কেমন হয়। কিন্তু ও তো আমার কোনো প্রকার ক্ষতি করছে না। কথাবার্তায় বোঝা যায় নম্র ভদ্র।
আমি একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ও আসছে কি না। না ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন যা পারেনি আজ থেকে ও তো পারবে ঠিক এখন থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে।
আমার কেন জানি ভালো লাগছে না। সেদিন রাস্তার মাটিতে গোলাপ ফুল আঁকা দেখলাম। তার পাশে ইংরেজি অক্ষরে লেখা সজল। তার মানে এই যে, ওই ছেলেটার নাম সজল। আর সজল গোলাপ ফুল এঁকে আমাকে দেখালো। ওই সজল ছেলেটার জন্যে মাঝে মধ্যে খুব খারাপ লাগে। ওর অগ্রসরের পথ এসে ক্রমে দৃঢ়তায় পরিণত হচ্ছে।
'প্রেম কী আসলে আমি বুঝি না। বুঝলাম না জন্মলগ্ন থেকে। কেননা প্রেম করা মানে খুন হওয়া সেটা আমার বেলায়। সেটা শুধু আমাদের ক্লাসের আঁখিকে, নিলাকেই মানায়। কী অবলীলায় প্রেম করে বেড়ায়। পত্র আদান-প্রদান হলে আমাকে এনে দেখায়ও, লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই।
সামনে পড়ালেখার কী দারুণ চাপ। কিন্তু মন দিয়ে পড়তে পারছি না। অনেক ভাবনা এসে জড়ো হয়ে তখন। সে সময় পড়া পড়লেও মনে গাঁথে না। ঘুমাতে গেলে আজকাল স্বপ্ন দেখি বেশি। স্বপ্নের মাঝে সজল এসে আমার সাথে তর্ক-বিতর্কে শামিল হয়। কোনো কোনো দিন ভালো যায়, কোনোদিন খারাপ।
আমি শুয়ে আছি। আমার চোখের পাতা বুজে আসছে। মনে হচ্ছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কিন্তু আসলে ঘুমাইনি; আমার কান সজাগ।
'আমি রাস্তার মাঝে ফুল রেখেছিলাম তুমি কুড়িয়ে নেবার জন্যে। তুমি ফুলটা হাতে না নিয়ে লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কাজটা কী ভালো করলে?'
'ঠিক করেছি!'
'শোন! আল্লাহতা'লা যখন তার বান্দাদের জন্যে রিজিক বরাদ্দ করেন। বান্দাদের মাঝে রিজিক বিতরণের পর যা তাহার কাছে রয়ে যায়। তখন সমস্ত ফুল আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ জানায়, তাদের মাঝে যেন সেই রিজিক বিতরণ করে সুগন্ধি ঘ্রাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর সেই ঘ্রাণ বান্দাদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ফুলেরা এই ফরিয়াদ জানায়। সেই ফুলকে তুমি অসম্মান করেছো। দেখবে একদিন সেই ফুলের অভিশাপে তোমাকে দুঃখ পেতে হবে। ফুলকে জেনে রেখো পাগলও ভালোবাসে; অর্থাৎ তুমি কারো ভালোবাসা পেতে বঞ্চিত হতে পারো। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।'
'আই এম ভেরি সরি। আসলে তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না।'
'তুমি দু'হাত তুলে বিধাতার কাছে ক্ষমা চাও।'
'অবশ্যই চাইবো, নামাজ শেষে মুনাজাত তুলে।'
'আর শোন। তোমার চোখের সামনে যা কিছু ঘটে স্বাভাবিক চোখে দেখবে। এতে তোমার সমস্ত জটিলতা কমে যাবে।'
'ঠিক আছে, ঠিক আছে।'
'লাখি, এই লাখি, লা-খি।'
'উহ্।'
'লাখি।'
'কে?'
'কি কথা বলছিস? কার সাথে?'
'কই কথা বলছিলাম, না তো।'
'স্বপ্ন দেখেছিলি?'
'হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখেছি।'
'কি দেখেছিস?'
'কি জানি, মনে পড়ছে না।'
'মাঝে মধ্যে আমি টের পাই, দেখি এক নাগাড়ে কথাই বলে যাচ্ছিস।'
'আচ্ছা প্রতিদিন কি স্বপ্ন দেখিস?'
'হ্যাঁ।'
'বলিস কি?'
'এখন প্রতি রাতেই দেখি। তবে আজকে স্বপ্নটা ভালো।'
'কি স্বপ্ন?'
'আপনি যান। এখন বলতে পারবো না। ঘুম পাচ্ছে।'
'আচ্ছা ঘুমা, সুরা কেরাত পড়ে ঘুমাস।'
'মা চলে গেছে, এখন কি আর সহজে ঘুম হবে। কী যে হচ্ছে সব স্বপ্ন দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে যায়। স্বপ্নের কথা ভাবতে আচমকা কেঁপে উঠলাম, ঘরে উপর দিয়ে কো কো শব্দে দুটো পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেলো। এখন প্রচণ্ড শীত পড়ছে বাহিরে তাকালে কুয়াশার সব ধোঁয়া দেখা যায়।
পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। পরীক্ষা শেষে ঢাকা গিয়েছি কাকীদের বাসায় বেড়াতে। বেড়ালাম ঘুরলাম, অনেক জায়গায়। অতঃপর আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। এখন আর বাড়ির বাইরে যাওয়া হয় না আমার।
যে সজল আমাকে একদিন না দেখলে শান্তি পায় না। সে বেচারার মুখোমুখি হইনি অনেক দিন। হয়তো এখন আর রাস্তায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে না।
নীলার সাথে দেখা হয়নি আজ অনেক দিন। নীলার সাথে দেখা করবো ভেবে বাড়ি থেকে চুপি চুপি বের হলাম। বাবা জানতে পারলে যেতে দিবে না। মা অবশ্য না করবে না, বলবে তাড়াতাড়ি আসিস।
মাথার উপর ওড়নাটা দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। নীলাদের বাড়ি স্কুলের কাছে।
হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকে লক্ষ্য করলাম। ঝিলের মাঝে কৃষকরা ক্ষেত নিড়াচ্ছে ট্রাক্টর দিয়ে হাল দিচ্ছে, আর সেই ট্রাক্টরের শব্দে চারিদিক কাঁপিয়ে তুলছে।
আমি লক্ষ্য করলাম, সেই ছেলেটাকে কোথাও দেখা যায় কি না। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি আরো কিছুদূর হাঁটলাম, রাস্তায় সজল নেই নিশ্চিত হলাম। ছেলেটা তা হলে, আমাকে না দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে ফিরেছে। এ কথা যখন ভাবছিলাম তখনি কেঁপে উঠলাম সজলকে দেখে।
সজল ঐ যে বিলের ভিটেমাটিতে আমগাছের নিচে বসে আছে। হাতে কি যেন আছে তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, তবুও বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয় বই কিংবা কাগজ। কাগজই হবে ও বোধ হয় কবিতা লিখছে। ও আমাকে এখনো দেখতে পায়নি। ও দেখার আগেই আমি কেটে পড়ি।
নিলার সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরতে পথে দেখলাম সজল আছে কিনা। সজল নেই। রাস্তার মাঝে মাটিতে লেখা দেখলাম।
'তুমি আজো এলে না।'
অপেক্ষার পালা শেষ হবে কবে জানি না।
আমি কয়েক বার পড়ে লেখাটুকু মুখস্থ করে ফেললাম।
আমাকে দেখতে এসেছিলো, ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়েছে। আব্বা বললো, 'এ বিয়ে হবে; ছেলের সবদিক ঠিক, বংশও ভালো। ছেলে বিদেশ ছিলো পাঁচ বছর। বাড়িতে এসে বিল্ডিং করছে।' আরো অনেক কিছুর গুণগান গাইলো।
সপ্তাহ খানিক না পেরুতেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আহ সেকি আনন্দ সবার! অথচ, আমার সমস্ত আনন্দ সাবাড় হয়ে যাচ্ছিলো। মনের গভীর একটা চাপা কান্না অস্পষ্ট ধ্যান করে কেঁদে যাচ্ছিলো।
আমার মত-অমতের ব্যাপারে কিচ্ছু আসে যায় না। আমার বাবা-মা যা ডিসিশন নিবেন তাই মেনে নিতে হবে। ঠিক তাই মেনে নিতে হলো। আমার বিয়ে হলো, স্বামীর ঘর করছি। সুখে আছি না দুঃখে আছি বুঝতে পারি না।
তবে কিছুদিন আগে স্বপ্ন দেখলাম কে যেন কাঁদছে। আমি চারিদিকে তাকালাম কাউকে দেখলাম না। ঢেউয়ের মতো কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো। তারপর থেকেই সজলের কথা মনে পড়ে গেলো। সেই কান্নার মাঝে সজলের কণ্ঠ মেশানো ছিলো। আমার তখনি বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল সজল এখন কেমন আছে এখন ও কী আমাকে দেখার জন্যে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করে, ভালোবাসে? নাকি ভুলে গেছে? ও কি কবিতা লিখে আমাকে নিয়ে, ওর কয়টা কবিতা লেখা হয়েছে।
এ জীবনে আমি কাউকে ভালবাসতে পারিনি, অথচ আমাকে ভালবেসেছে সেই পথে দাঁড়িয়ে আমায় একনজর দেখত সেই সজল। সজলের ভালোবাসা, স্বর্ণ-রূপার পানির মতো স্বচ্ছ। আমাকে নিয়ে কখনো এমন স্বপ্ন দেখেনি যে আমি তার ভোগের সামগ্রী হয়ে তাকে পুঁজ করি।
শুধু ভালোবাসতো; অথচ তার দিকে একটু আগ্রহ ভরে তাকাইনি। শুধু দু'চোখ ভরে অবহেলার ভ্রান্তি নিয়ে তাকাতাম। সজলের কথা ভাবতে ভাবতে আজ আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছে। সজলের বাস্তবতা ব্যাখ্যায় ছন্দের মাঝে নারীদের না জানি কত কঠিন মন প্রকাশ করে।
অনেক দিন সজলের সাথে দেখা নেই আমার ভাবলাম রাস্তার মাঝে হাঁটলে হয়তো তাকে কোথাও না কোথাও দেখা যাবে। কিন্তু আমি বাড়ি থেকে কোন অজুহাতে বের হবো। একদিন সত্যি সত্যি কাউকে উপেক্ষা না করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় লক্ষ্য করলাম ভিটায় একটা ছেলে বসে আছে। সে যে সজল নয়, স্পষ্ট বোঝা যায়। আরো কিছু দূর হাঁটলাম সজলকে দেখা গেলো না। অচেনা তের চৌদ্দ বছর একটা ছেলেকে পেয়ে বললাম, 'সজলকে চিন?'
ও বললো, হ্যাঁ চিনি।
'ও এখন কোথায় বলতে পারো?'
'এখানেই তো থাকে।'
'এখন কোথায় আছেন?'
'তাতো জানি না, হয়তো আশপাশে কোথাও আছে। ওনাকে আপনার কি দরকার?'
'একটু দেখা করলেই হতো।'
'জানেন উনি কারো সাথে কথা বলেন না।'
'ও কেন কথা বলে না, কেউ বলতে পারবে না।'
আমার কাছে যেন কেমন লাগছে মাথাটা ঘুরছে, আমি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। বাড়ি ফেরার পথে ভাবলাম, যেখানে সজলকে সর্ব শেষবার বসে থাকতে দেখেছিলাম সেখানে গিয়ে একবার দাঁড়াই।
সজল যেখানে বসেছি তার পাশে কিছুক্ষণ আগে যে ছেলেটা দেখলাম সে এখনো বসে আছে। আমাকে দেখে কিছু ভাববে না তো। নাকি তার কাছে সজলের খোঁজ নেবো।
আমি আস্তে আস্তে অগ্রসর হলাম, ক্ষণিকটা যেতেই আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়াই, আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে। আমি যাকে সজল না ভেবে চলে গেছি, সেই তো সজল। কিন্তু ওকে চিনবো কেমন করে। সজলের মাথার চুলগুলো কেটে ফেলেছে। পোশাকের উপর ধুলাবালি লেপটে আছে। পুরো স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের পানিতে।
আমি ডাকতে চাইলাম সজলকে। কেন জানি না আমি সজলকে ডাকার মতো শক্তি পাচ্ছি না। তারপর বহু কষ্টে সজলকে ডাকলাম, আমি এসেছি সজল। সজল শুনতে পায়নি। আমি আবার ডাকি, সজল আমি এসেছি। কোনো সাড়া নেই। এবার আমি আস্তে আস্তে সজলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। ওর পিঠে হাত রাখি। সজল আস্তে আস্তে ওর হাত বাড়িয়ে আমারটা ওর পিঠ থেকে সরিয়ে দেই। তারপর আমি সজলের পাশে বসে মুখের দিকে তাকাই। ঠিক তখনই দু' চোখ বেয়ে টপটপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে পানি। সজল আমাকে একনজরও তাকিয়ে দেখলো না।
আমি বললাম, 'সজল একবার আমায় তাকিয়ে দেখ চিনতে পারে কি না।'
সজল আমার দিকে তাকায় না। আমি কষ্ট মনে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। তারপর শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বললাম, 'তাকিয়ে দেখ, আমি সেই তুমি যাকে ভালবাসতে।'
সজল বলে উঠলো, 'মিথ্যে কথা। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম না। আমি ভালোবাসতাম, মেঠো পথ ধরে যে মেয়েটা সকাল-বিকেল স্কুলে আসা-যাওয়া করতো তাকে। আমি ভালোবাসতাম, যে মেয়েটা আমাকে অবহেলার চোখে দেখত তাকে। আমি যাকে ভালোবাসতাম, সে আমাকে ভালবাসুক তা' চাইনি। অবহেলা, অনাদর পেতে পেতে আজ আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না। তুমি চলে যাও। যদি ক্ষণিকের জন্য ভালোবেসেই থাকো, তবে দূর থেকে ভালবেসো।'