অঙ্কবন্ধ

বন্ধু (জুলাই ২০১১)

প্রজ্ঞা মৌসুমী
  • ৪৪
  • ১৮
ঠিক কিভাবে ভাললাগা শুরু হল বলতে পারবনা। তবে মনে পড়ে, প্রত্যেকদিন বিকেলে জলচৌকিতে মা রাখতেন এক কাপ সর ভাসা দুধ আর পিরিচে তিনটা পাইনএপেল বিস্কিট। দুধ আমার কখনই প্রিয় ছিল না, তবে সরটা ছিল।ঠিক যেন সাদা পদ্মপাতা। সরে দুধের স্বাদ বেড়ে যেত কুড়িগুণ আর সাথে প্রিয় বিস্কিট। দাদাজানও দোকান থেকে ফিরে, আসরের নামাজ শেষ করে চা খেতে বসতেন। বিসমিল্লাহ বলে, চায়ের কাপে শব্দ করে আয়েশি চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকাতেন। তারপর হেসে বলতেন, 'বুঝলিরে তানু, দুধের হর থাকে উপরে আর অঙ্কের হর সব সময় নিচে।' এভাবেই বোধহয় অঙ্কের সাথে আমার পরিচয়। প্রায় প্রত্যেকদিন দাদাভাই এই কথা বলতেন। শেষে এরকম হয়েছে- দাদাভাই যখন বলা শুরু করতেন 'বুঝলিরে তানু,' আমি বলে উঠতাম 'দুধের হর থাকে উপরে আর অঙ্কের হর সব সময় নিচে'। তারপর আমরা দুজনেই হেসে উঠতাম ফোকলা দাঁতে।

দাঁত গুণা দিয়েই শুরু হয়েছিল সংখ্যা চেনা। কয়টা দাঁত পড়ল আর উঠল গুণতাম। নিজে না পারলে জেঠিমাকে বলতাম 'ও জেঠি, আমার দাঁতগুলা গুণে দাও না। কয়টা হলো? গুণে দাওনা।' জেঠিমা হেসে বলতেন,'বাপুরে বাপু। কই দেখি তোর দাঁত! একটা, দুইটা... দশটা... হ্যারে তানু, তুইতো অনেক বড় হয়ে গেছিস।কত্তগুলা দাঁতরে তোর।' আমি একটু একটু করে বড় হওয়ার আনন্দে পুরো উঠান জুড়ে দৌড়াতাম। ভাবতাম একদিন বড় হব ঠিক আমাদের মাধবীলতা গাছটার মত। উঠোন থেকেই উঠে যাব ছাদে। মাধবীলতার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে মাপতাম।

কিন্তু আবার দাঁত পড়ে ভাবনায় ছোট হয়ে যেতাম। কাশেম চাচার সাথে ইদুরের গর্ত খুঁজে, প্রিয় দুধদাঁত রেখে আসতাম। দাদীআম্মার কথামতো ইদুরকে বলতে ভুলতাম না 'ইন্দুররে ইন্দুর, আমার দুধদাঁতটা রাইখা তোর কলইদাঁতটা দিসরে।' অপেক্ষায় থাকতাম কবে ইদুর এসে তার কলইদাঁত দিয়ে যাবে। রাতে পাশের বৈঠকঘরের চালে, ইদুরের হাঁটাহাঁটি শুনে ভাবতাম আজ বুঝি দাঁত দিয়ে যাবে। সকালে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে আবার গুণতাম দাঁত। ভাবতাম কবে আমার বত্রিশটা দাঁত উঠবে...কবে বড় হবো!'

রঞ্জু ভাই খেপাত আমার একফোঁটা বুদ্ধি নাই বলে। আমার আক্কেল দাঁত নেই তো তাই। আক্কেল থাকলে কি কেউ নাটক শেষ হলে কাঁদে? নাটক শেষ হতে পারবেনা বলে আবদার করে? ছোট চাচী বুঝাত 'নাটকের লোকগুলা খাইতে গেছে। ফিরলে আবার নাটক শুরু হবে।' আমি অপেক্ষায় থাকতাম তাদের ফিরে আসার। কিন্তু রাত দশটা বেজে যেত, বিরক্তিকর রাতের খবর শুরু হত। নাটকের লোকগুলা ফিরতনা। আমি কাঁদতাম। রঞ্জু ভাই আবার খেপাত। আমি সাদা-কালো সতের ইঞ্চি টিভিকে মনে করতাম ঘর। কখনো কখনো মোড়ার উপর উঠে টিভিটা খোলার চেষ্টা করতাম। দেখে রঞ্জু ভাইয়ের সে কি হাসি। আমি কি ঠিক বুঝতাম টিভির ম্যাজিক! আমি তো ভাবতাম টিভির কাঁচটা খুলতে পারলেই গয়না, তিব্বত বল সাবান, পাকিজা প্রিণ্ট শাড়ি, বেবী লজেন্স- আরো কত কি সব বের করে নিয়ে আসতে পারব।

আরো ভাবতাম টিভির লোকগুলার বাথরুম পায়না। তাই আমি টিভির ভেতর থাকতে চাইতাম। বিছানা যাতে নষ্ট না করি সেজন্য আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে আর বাইরে নিতে হবেনা রাতের বেলা। আমি বড্ড ঘুম ভালবাসি। আপা-ভাইয়া শুনে হেসেই অস্থির। মাও মিটিমিটি হাসে আর আলমারীতে কাপড় তুলে। রঞ্জু ভাই হাসতে হাসতে বলে "তানুরে তোর আক্কেল একটুও নাই।' আমি ওর গায়ে হাতের মার্বেল ছুড়ে দিয়ে, দৌড়ে চলে যেতাম দাদার ঘরে। নামতার বই খুলে মুখ নিচু করে কাঁদতাম। বইয়ের পাতা ভিজে যেত। তার উপর আঙুল দিয়ে হিজিবিজি স্বপ্ন আঁকতাম- একটা আক্কেল দাঁতের স্বপ্ন।

কিংবা তারো আগে, সেই ছোটবেলায় যখন রায়হান কাকা শুয়ে থাকত আর আমি তার হাঁটু ধরে ঝুলতাম। কাকা ঝুলাতে ঝুলাতে বলতো 'গাঙ্গুরে গাঙ্গু কিরে গাঙ্গু, কই পড়বি বল? ময়লার নদীতে নাকি দুধের নদীতে?' এই বলে বাম পাশের ময়লার নদীতে কাত করে ফেলতে চাইলে, আমি শক্ত হাতে হাঁটু ধরে রাখতাম। উল্টো চেষ্টা করতাম ডান দিকের দুধের নদীতে পড়তে। ছোটকা খুশি হয়ে বলতো 'দেখছেন ভাবী কাণ্ডটা। হিসেবে কত পাকা। এই মেয়ে নির্ঘাত কিছু একটা হবে।' ছোটকাই আমার মধ্যে সম্ভাবনা দেখত। আমার তুচ্ছ সাধারণ কিছুই তাঁর কাছে হয়ে যেত অসাধারণ। কাকা চাইত আমি বড় হয়ে তার মত চিকিৎসক হব।

কিন্তু আমিতো কখনো কারো ছায়া হতে চাইনি। কারো পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইনি। আমি হতে চাইতাম নিজের মত। হোক অগা-মগা টাইপ, তারপরো নিজের মত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো সেই লোকটা, যে কাঠিওয়ালা আমড়া বিক্রি করে তার মত স্বাধীন। তাকে কেউ বাবার নাম, দাদার নাম জিজ্ঞেস করেনা।

আমাকেও কেউ জিজ্ঞেস করবে না আমার দাদা কে, জ্যাঠা কে, বাবা কে? আমাকে ওঁদের নাম বলতে হবেনা। কারণ আমি 'র' উচ্চারণ করতে পারিনা। 'র' আমার দাঁতের ফোকর গলে হয়ে যায় 'ল'। রফিকুল, রাইসুল, রশীদুল, রেজাউল এই নামগুলো আমাকে হাসির পাত্র করে সবার কাছে। মজা পেয়ে সবাই ইচ্ছে করে বারবার শুনতে চায়। আমি দৌড়ে এসে নামতার বই খুলে, মুখ নিচু করে কাঁদি।বইয়ের ভেজা পাতায় আঙুল দিয়ে স্বপ্ন আকিঁ- নামহীন, গোত্রহীন- শুধু একজন মানুষ হয়ে পরিচিত হবার। অঙ্ককে সাথী করে স্বপ্ন দেখা, কষ্ট পাওয়া এভাবেই তো শিখেছিলাম।

কিংবা যখন কাশেম চাচা বাতাবি লেবু পেড়ে আনত। মা ঝুড়িতে করে, সবার বাড়ি বাড়ি বাতাবি লেবু পাঠাত। সুমির সাথে ভাবটা গভীর থাকলে, মেঝচাচীকে বলতাম 'আমার বান্ধবীরে কিন্তুক জাম্বুরা বেশি দেয়া লাগব।' আর যেবার বুড়ি আঙুল থুতনির কাছে নিয়ে সে বলত 'আড়ি, আড়ি, আড়ি/ তোর বাপের এত্ত বড় দাঁড়ি!' সেবার রেগেমেগে একশা হয়ে থাকতাম। কি আমার সুদর্শন বাপের দাঁড়ি নিয়ে কথা। রাগ করে বালি ছুড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কথা চলতনা সারা সপ্তাহ। দুজন দুজনকে দেখলে মুখ ভেংচাতাম। মা ওদের বাড়ি গেলে গাল ফুলাতাম। তখন ইচ্ছে করে নিজেই বাতাবি লেবু কমিয়ে দিতাম। কখনো দিতেই চাইতাম না। অঙ্কই এভাবে আমাকে প্রতিশোধ নিতে শিখিয়েছিল। এভাবেই আমার বন্ধু হয়ে গেল অঙ্ক। বিনু আপা ছাদ থেকে কাপড় তুলতে তুলতে গান গাইত 'আহা আজি এ বসন্তে...' আমি ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে, গানের তালে তালে সদ্য শেখা দুইয়ের ঘরের নামতা পড়তাম- 'আহা, দুই একে দুই, দুই দুইয়ে চার, দুই তিনে ছয়...'

এই ছাদেই প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে গানের আসর হত। গান শেষে রানা ভাই পাটিতে শুয়ে শুয়ে সিগারেট খেত। আমি পাশে চুপটি করে শুয়ে থাকতাম। ব্যর্থ চেষ্টা করতাম লাল হয়ে আসা চোখদুটি খুলে রাখার। কখনো আনমনে, কখনোবা আমাকেই উদ্দেশ্য করে রানা ভাই বলত 'অংকের সাথে সঙ্গীতের এক অদ্ভুত যোগ আছে। সংখ্যা দার্শনিক পীথাগোরাস সেটাই বলে গেছেন। সঙীত আর কিছুই না। হিসেবের স্রোতে সুরের নৌকা ভাসানো।" আমি সুরের নৌকায় অংক ভাসাতাম। গানের সুরে সুরে একক কিংবা সূত্র মুখস্থ করতাম। জেঠা আমার এই উদ্ভাবনী ক্ষমতায় একদম মুগ্ধ- 'এভাবে পড়লে তো বাপ-জেঠার নাম ভুলবি কিন্তু এগুলা ভুলবিনা।' সত্যি আমি কোনদিন ভুলিনি। এখনো আমি ঠিক, সেই সুরে সুরে বলতে পারি পুরনো এককঃ 'মিলি, সেন্টি, ডেসি গ্রাম, ডেকা, হেক্টো, কিলোগ্রাম।'

একদিন আবিষ্কার করলাম বৃষ্টির দিনে, জানালার কাছে পাটি বিছিয়ে অঙ্ক করার মজাই আলাদা। ঠাণ্ডা আমেজে কঠিন সব অঙ্ক করতে সহজেই মন বসে যায়। বৃষ্টির দিন মানেই অঙ্ক দিবস। সেদিন আর কোন পড়া নেই। দাদীআম্মার হাতে অমৃত খিচুড়ি, শালুকদের বাড়ির পেছনের কদম ফুল তো আছেই। অঙ্কের জন্য বর্ষার প্রতি ভাললাগা বেড়ে গেল আরো। আর যদি গান থাকে পাশে তবে তো কথাই নেই। রানা ভাই মনোযোগ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য লাগিয়ে রাখতেন বেটোফেন, চপিন, শুবার্ট, মোজার্ট। তখন এতসব বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম গানের কথা কানখাড়া করে শুনতে হয়না। শুধু সুর আর সুর। ভালো লাগত মুনলাইট সোনাটা, সেরেনাদে, চপিনের রোবাতো, ভায়োলিনের মুগ্ধকর সব সুর। সুরগুলা উড়ে এসে যেন বসল অঙ্ক খাতায়। সংখ্যাগুলা হয়ে যেত সুর। বৃষ্টি পরিবেশটাকে আরো অন্যরকম করে দিত। আমি অঙ্কবন্ধুকে নিয়ে আমার প্রিয় বৃষ্টি আর সুরের জগতে ডুবতাম।

ক্লাস সেভেনে আমাদের অঙ্কের টিচার সুকুমার স্যারের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার প্রথম ভালবাসার স্মৃতি। বোর্ডে তিনি অংক করান, আমি তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের ভেতর জন্ম নেয় কৈশরিক ভালোলাগা। আমি স্বপ্ন দেখতে থাকি একটা বাড়ি, জানালার পাশ ঘেষে এক কৃষ্ণচূড়ার গাছ। পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের বাসা। ঐ বাড়িটা আমার- কোন এক জানালার ধারে আমার পড়ার টেবিল। আমি অঙ্ক করছি,স্যার আমার সামনে বসে। স্যার একদিন নীল শার্ট পড়ে এসেছিল ক্লাসে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে ছিলাম। সাদারঙের অঙ্কগুলো হয়ে যায় আকাশী নীল। আমি স্বপ্নে, নীল দিয়ে সংসার সাজাতাম। ঘর জুড়ে শুধু নীল আর নীল। ঘরের নীল দেয়াল জুড়ে লেখা 'স্যার, আমি আপনাকে ভীষণ ভালবাসি।' প্রত্যেক অংক পরীক্ষায় আমি নীল জামা পড়তাম। চাইতাম স্যারও নীল শার্ট পড়ে আসুক। না পড়ে আসলে বিষন্ন নীল রঙটা ছড়িয়ে পড়ত মন জুড়ে। আমি কাউকে বলতে পারিনি আমার ভাললাগার কথা। কি করে বলি? বয়সের হিসাব আছে, আছে সামাজিক হিসাব। আমার আর তার মাঝে সমাজ আর ধর্ম দিয়ে গড়া, উঁচু দেয়ালটা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অনেক বড়। আমি শুধু অঙ্কের খাতায় তাঁর করা সাইনগুলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। তাঁর হাতের স্পর্শ পেতাম...

স্কুল পেরোতেই চলে এলাম কানাডাতে। সুকুমার স্যারকে না দেখতে পাবার কষ্ট কি ভেতরে নাড়িয়ে ছিল? কোণে কি কোথাও খচখচ করছিল মন খারাপের ফর্মূলা? আমার ভাললাগা কি ঠিক স্যারের জন্য নাকি গণিতের জন্য? আমি দ্বিধায় ভুগি। অঙ্ক বন্ধু আমাকে শেখায় জটিল এক সম্পাদ্যের মত মানসিক জটিলতা। বছর গড়ায়। আমি আস্তে আস্তে ভুলে যাই সুকুমার স্যার...কালো বোর্ডের সাদা অঙ্ক। ঠিক ভুলে কি যাই? ভালো লাগে কলেজের অঙ্কের টিচার ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েলের নীল চোখ কাঁপিয়ে দেয় আমায়। এ যেন সুকুমার স্যারের সেই শার্ট! কি করে ড্যানিয়েলের চোখে চলে এল! আমি চক্রে যেন পড়ি বারবার। তারপর আবার নীল ভুলি। কলেজের ম্যাথ লেবে জব পাই ম্যাথ টিউটর হিসেবে। আমার জীবনের প্রথম চাকরি! অফুরন্ত সময় আমার অঙ্কের সাথে থাকার। পড়ি আর নাম্বারগুলো বাড়ে। ১০০ তে ১০০ পাবার চমকপ্রদ ঘটনা আমাকে উৎসাহিত করে। বিস্মিত করে এডভ্যান্সড ক্যালকুলাস, নাম্বার থিওরি আর ম্যাটিক্স থিউরির নতুন নতুন মুখ।

একদিন পরিচয় হয় সুমনের সাথে। দিনটা ছিল ভীষণ বৃষ্টির দিন। ক্যাফেটেরিয়ার আলো-আধাঁরীতে মায়াময় হয়ে উঠি আমরা। মায়া আমাদের কাছে টানে। সে হয়ে যায় আমার কাছের একজন। আমরা ফোনে অঙ্ক নিয়ে আলাপ করি। মেইলে অঙ্কের সমাধান নিয়ে ভাবি। কখনো কখনো অঙ্কটাকে দূরে সরিয়ে, গল্প করি অন্যকিছুর। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট এক ঘরের স্বপ্ন দেখি। দিনের হিসেব ঠিক থাকেনা। শুধু জানি বন্ধুত্ব যায়, ভালবাসা আসে মনের চৌহদ্দিতে। তখনো কি বুঝেছি কখনো কখনো হিসেবেও হয় ভুল? ভেবে বের করা সমাধান দাঁড়িয়ে থাকে ভুলের চিহ্ন নিয়ে! এতটা ভালবাসা নামতে নামতে যায় হারিয়ে! আমাদের গড় উঠা সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল যেদিন, সেদিনটা ছিল ঝকঝকে রোদেলা। কিন্তু রোদও কেমন মেঘলা হয়ে ভিজিয়ে দিতে পারে বুঝেছিলাম সেদিন।

আমি সারাদিন বিয়ের কল্পনা করছি। কিভাবে কি করব সেসবই ভাবছি। মা আমার চোখ দেখে বলেছিল, 'তুই তো বেশি ভালবেসে ফেলেছিসরে।' বেশি ভালবাসলে চোখ কি বেশি মায়াবতী হয়? ভালবাসা কি সৃষ্টি হয় তবে চোখে; হৃদয়ে নয়? নাকি ভালবাসলে চোখ হয়ে যায় হৃদয়; এক মায়াবতী হৃদয় জুড়ে বসে দুইচোখে? জানিনা, শুধু জানি ক্যালকুলাস বইয়ের ভেতর বসে থাকা চিঠিগুলা আমাকে মায়ার জগতে ভাসিয়ে নেয়। চিঠির প্রতিটা অক্ষর আমার চোখ ধুইয়ে দেয় ভালবাসায়। কিন্তু সেদিন মায়ার নদী ছেড়ে কষ্টের বর্ষা ছুয়েছিল চোখে...হৃদয়ে। ভাবিনি এভাবে শেষ হবে। অপ্রত্যাশিত বলেই কি কষ্ট হয়েছিল বেশি? হতাশায় আর রাগে আমি দিগ্বিদিকজ্ঞাশূণ্য নাবিকের মত। সব চিঠি কুচি কুচি করে ফেলেও আমার শান্তি হচ্ছিলনা। আমাদের মধ্যে যা দেয়া-নেয়া হয়েছিল- সব ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে নাও। সব ফেরত কি দেয়া যায়! এত সহজেই কি চুকে যায় জীবনের হিসেব! আমার কোন হুশ থাকেনা। আয়নায় মেঘ পড়ে, রোদ আসে। আমি তাকিয়ে থাকি কিন্তু দেখিনা। অনুভূতির অঙ্কগুলাকে বড্ড বেশি জটিল মনে হয়।

আমার অঙ্কবন্ধুরো মন খারাপ হয়। বৃষ্টির পানি জমে ভেতরের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে পড়ে। উঠে যায় সংখ্যার শরীর। কে জানে সেও হয়তো কারো বিরহে বিরহী? কিন্তু আমাকে মন খারাপের বন্ধ দরজা থেকে, বের করে নিয়ে আসে ওই আমারই অজান্তে। মিস এথিনা আমার সামনে মেলে ধরে খবরের কাগজ। সেখানে ৯ ফন্ট সাইজের অক্ষরে লেখা আমার নাম তানিয়া তাবাসসুম- ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্রীর মুখ। জীবনে না পাওয়ার সূত্রগুলো যখন বড় হয়ে উঠছিল, তখন এই কয়েক ইঞ্চির প্রাপ্তি আমাকে ফিরিয়ে আনে বাস্তবতায়। যে চলে যায়, প্রকৃতির নিয়মেই চলে যায়। চলে যাওয়া নিয়ে, অতীত নিয়ে দুঃখ কেন? আমার চারপাশের বর্তমানের এত সব আসা, অতীতের যাওয়ার কাছে হার মেনে আমার অস্তিত্বকে মুছে ফেলবে এত সহজে! অনুপাত-সমানুপাতের রহস্যে আটকে পড়া বোধ একটু একটু করে মুক্তি পায়। হেসে উঠি আনমনে; বুকে জড়াই সেই চিরচেনা অঙ্কবন্ধুকে। দাদাজানের মুখে ফুটে উঠা সেই ভ্রুণটা, এক- দুঘরের নামতা পেরিয়ে এখন অনেক বড় হয়েছে আমারই মত। নতুন অথচ সেই চিরচেনা প্রিয় কোমল বন্ধুটি আমার জড়িয়ে আছে ভালবাসা হয়ে।

আমি তো আমাকে নিয়েই এতদিন ছিলাম। কোনদিন চারপাশে তাকায়নি। আজ দেখি চারপাশ। দেখি সামনে বসে থাকা অন্ধ ছাত্রী লিসার মুখ। আমার সাথে তার পার্থক্য কি খুব বেশি? অন্ধত্ব আমার উপলদ্ধিতেও যে বাসা বেঁধেছে। আমার চারপাশ অবোধের কালো রঙে আটকে পড়ে আছে কি ভীষণভাবে! আমাকে ঘিরে রেখেছে এক হতাশার উপপাদ্য। কই তাকে দেখে, জীবন তাকে বঞ্চিত করেছে বলে মনেই হয়না। সারাক্ষণ হাসছে, কথা বলছে। অনবরত কথা বলতে পারে মেয়েটা। মাঝে মাঝে মিস এথেনা চোখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলছেন 'কোয়ায়েট'। ও তো কারো চোখে বিরক্তি পড়তে পারে না। একটু থেমে শুরু করে আবার কথা; যেন কথার জোনাকী। হঠাত আমাকে জিজ্ঞেস করে, 'তানু, আমার জামার রঙ কি?' আমি বলি হলদে। সে ভীষণ ভালোলাগায় হাত বুলায় হলদে রঙয়ের উপর। হলদে রং কেমন হয় সে কি চেনে? তাকে যে হলদে এক প্রজাপতির মত লাগছে সেকি বুঝতে পারে! ও কি চেনে প্রজাপতি কি? জানে একটা শুয়োপোকা থেকে, কিভাবে জন্ম হয় আশ্চর্য সুন্দর প্রজাপতি! তবুও তো তার গ্লানি নেই; অভিযোগ নেই জীবনের কাছে। তার অর্ধপূর্ণ পৃথিবীটাকে সে অনুভব করছে, উপভোগ করছে পূর্ণভাবে। ও পৃথিবী দেখছে তার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে, হাতের স্পর্শ দিয়ে। কই আমিতো অনুভব করিনা পূর্ণভাবে আমার জীবনের রঙ? আমাকে সেই রঙে কেমন মানায় কোনোদিন তো দেখিনি। পেয়েও মনে হয় কতকিছু পাইনি। পৃথিবীর এত সব সুবিধা নিয়েও কি অসীম আমার গ্লানি!

কথা বলতেই বলতেই উঠে দাঁড়ায় লিসা। আমি এগিয়ে দিতে চাই। মিস এথেনা বলে উঠেন, 'না তানু, তুমি যাবে না। ওকে একা চলতে দাও, চিনে নিতে দাও জীবনের ত্রিকোনমিতি। অনেকদূর তাকে একা চলতে হবে।' একাই চলে যায় লিসা। হোঁচট খায়। আবার সামলে নেয়। পথ ঠিক করে নেয় তার অনুভূতি দিয়ে। ঢং ঢং করে ক্যাম্পাসের বড় ঘড়িতে চারটা বাজে। আমিও বের হই। ম্যাথ ল্যাবটাকে পিছনে ফেলে হাঁটতে থাকি। আমাকেও একা হাটতে হবে... অনেক দূর। আমার হাত একের পর এক দরজা খুলে দেয়। আমি খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেই। অন্তহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করি এক বিশালত্বকে। ভাবি ঈশ্বরের চেয়ে বড় গণিতবিদ কে আছে? পৃথিবী তো তার ভাবনার হিসেব দিয়ে তৈরি। আমরা শুধু একটা দীর্ঘ অঙ্কের কিছু ধাপ। এভাবে একদিন সব ধাপ শেষে মিলবে সমাধান।

সেদিন একটা গান শুনেছিলাম 'তুমি চেয়ে আছ তাই/ আমি দূরে হেঁটে যাই/ হেঁটে হেঁটে বহুদুর... বহুদূর চলে যাই।' ভেতরে আমিও অনুভব করি, কেউ একজন সত্যি চেয়ে আছে। আমি অন্ধ; তাকে ঠিক দেখতে পাচ্ছিনা। আমার হিসেবে ভুল হচ্ছে। কোন দিকে গেলে তাকে দেখব- তাও জানিনা। শুধু জানি, তাকিয়ে আছেন এক বড় গণিতবিদ মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে। অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখছেন আমি কি করে ভালবাসা,দুঃখ-সুখের সূত্র শিখছি; কিভাবে আমাকে করতে দেয়া জীবনের অঙ্কগুলা মেলানোর চেষ্টা করছি। তিনি আমার অপেক্ষায় আছেন জীবনের শেষপ্রান্তে সমাধন নিয়ে। আমি হাঁটতে থাকি অন্তিম সমাধানের দিকে, জীবনের অঙ্কময় পথ ধরে। আমি দেখিনা কিছুই আর; শুধু অনুভব করি একজন আলো, একজন মহাবিস্ময়। আর অনুভব করি বুকে জড়িয়ে থাকা গাঁদাফুল রঙা আমার চিরচেনা প্রিয় অঙ্কবন্ধুকে...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নিলাঞ্জনা নীল অঙ্ক কে বরাবরই ভয় পাই তবে আজ এই লেখাটি পড়ে অঙ্ক কে ভাললাগাতে ইচ্ছে হচ্ছে৷৷
প্রজ্ঞা মৌসুমী আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। @সাবের ভাই, আমার দাদার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই একটা কল্পনার দাদু নিয়ে আসলাম। ধরেই নিলাম তিনি হানির দেশের মানূষ। 'দুধের হর' কথাটা যে ঠিক কার কাছে শুনেছি মনে করতে পারছিনা। হ্যাঁ আমাদের একটা জলচৌকি ছিল; ছোটরা ঐটাকেই টেবিল বানাতাম। মনে হয় প্রিয় ছিল, ঘুরেফিরে তাই হয়ত চলে আসে সেটা।
আহমেদ সাবের অসাধারণ একটি গল্প – অমানবীয় প্রেম কাহিনী। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। কিছু ব্যক্তিগত মন্তব্য - আপনার গল্পর দাদা কি হানির (দুধের হর থাকে) দেশের মানুষ? জলপিঁড়ি বা জলচৌকি মনে হয় আপনার প্রিয় বস্তু। কারন আপনার আরো লেখায় তার উল্লেখ আছে।
AMINA ওয়াও! ভাবতে পারছিনা তুমি নিজেকে এত চমৎকার করে প্রকাশ করতে পার!এক্সেলেন্ট-----।
R k shamim অনেক অনেক ভালো লাগলো।
Israt খূঊউব ভাল লাগলো. দিনের প্রথম লেখা পরলাম, মনটাই ভালো হয়ে গেল
উপকুল দেহলভি প্রাঞ্জল ভাষার গল্পটি খুব ভালো লাগলো, এগিয়ে যান আলোকিত আগামীর পথে, শুভ কামনা রইলো.
বিন আরফান. আপনি কেগো, কি গো ? রবি ঠাকুর ভর করেছে নাকি ? ছাত্র শিক্ষকের লেখায় কলম ধরা বেয়াদবি তাই শুভ কামনা জানায়ে আগামী লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম. প্রথম হবার মত ছিল. গল্পকবিতার পরবর্তী সংখায় বিজয়ী হতে পারবে না সিদ্ধান্তের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানায়. যদিও লাভ নাই. সরকারী দলের যা ইচ্ছা তাই করবে.
সেলিনা ইসলাম গল্পটা পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম শৈশবে । অংক করা নিয়ে হয়ত এক একজনের কাছে পরিবেশগত পার্থক্য ভীন্ন ভীন্ন । যেমন আমি অঙ্কে বরাবরই ভাল ছিলাম তবে অঙ্ক করতে গেলেই গান শুনতে মন চাইত তাহলেই অঙ্ক মিলে যেত কিন্তু মা বুঝত না । আর আপু অঙ্কের স্যারের প্রেমে পড়া ভাবাই যায়না গল্প পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল আমার অঙ্ক স্যার মিহির বাবুর কথা । এখনও মনে উঠলে ভয় লাগে । হাহাহা । যাইহোক আপনার গল্প পড়ে ভোটের অপশন খুজতে গিয়ে ্মনে পড়ল ভোট আপুকে দেয়া যাবে না কারন সেইতো অলরেডী জয়ী । অনেক ভাল লাগছে আপু এবারও এই গল্পের জন্য যদি আপনি বিজয়ী হোন তাহলেও আশ্চর্য হব না । শুভ কামনা । প্রিয়তে নিলাম গল্পটা ।

১০ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী