এক বছরের আলাপের চেয়েও এক ঘন্টার খেলায় একটা মানুষকে ভালো জানা যায়- প্লেটো ওরকমটাই বলেছেন। অরণির ধারণা খেতে বসেও জানা যায়। এই যেমন ও বুঝে গেছে ইসহাকের সাথে সংসার যাপনটা দুঃখের হবে। পকেটে টাকা না-ই থাকলো, অরণিই না হয় বার্গার কিনে দিল। তাই বলে গপগপ করে খেতে থাকবে! যতই সে বলুক খেয়ে এসেছে, প্রেমিকাকে একটু খাইয়েও তো দিতে পারতো। রোমান্টিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই, সব শুধু ঐ পাঁচ পাতার চিঠিতেই। উল্টো দিকে অবশ্য অন্য উজান। কোনদিন নিজের হাতে খিচুড়ি রান্না করে অরণি যখন মুখে তুলে দেয়, ইসহাক ভাবে সংসার যাপন নেহাৎ মন্দ হবে না। রোদবৃষ্টির শেষে কোথাও থেকে যাবে একটুকু রঙধনু ।
টিভির বিজ্ঞাপনের মতোন তারপর ট্ৰেনে করে বাড়ি ফেরা আসে। জানালার মাপের দূরবীনে চোখ রেখে অরণিও চেষ্টা করে রঙধনু ভাবার। ছিটকে আসা কোন ভিখেরীর মতো ভাবনায় তখন ছেলেবেলা দাঁড়ায়। আস্ত ছেলেবেলাও ঠিক নয়, ফুঁশ করে একটা ভাজা ডিম আসে। ছোটবেলায় ডিম ভাজাকে মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার। একদিন ওর কবিবন্ধু আবুল হাসান বলেছিল 'গোলাপ ফুলের চেয়ে মূল্যবান মনে হতো সকালে সিদ্ধ ডিম। এখনো অভ্যাসবসে গোলাপ ফুলের চাইতে সিদ্ধ ডিমই প্রিয় মনে হয়।' অরণিরও বুঝিবা তাই। ডিম ভাজার মতো প্রিয় কিছু ছিল না কখনো। আম্মা রাগে, অসহ্যে, বিপণ্ণতায় নানাবাড়ি চলে গেলে, আব্বা 'অগত্যা' ভাব নিয়ে ডালের চচ্চরির সাথে ফুল তোলা কাঁথার মতো যে ডিম ভাজা তুলে দিত সেটা প্রিয় ছিল মায়ের চেয়েও। মা না থাকার ব্যথা ঐ ডিমের কাছেই পরাজিত হয়ে গেছে বারবার।
আহ, স্মৃতি! যেন দড়িতে শুকোতে দেয়া একটা ভেজা মোজা। আঁটসাটের সংসারে পুরো ডিম কখনো খেতে পারেনি ওরা। মুরগি ছিল তিনটে। তার থেকেই একেক মুরগি একেকদিন ডিম দিত। আম্মা একটা ডিম জমিয়ে রাখতো মুরগির তা দেয়ার জন্য। বাকি দুটো ছিল ওদের। কোন কোনদিন দোতলার সুমিদের মুরগি ঢুকে পড়তো বাসায়। চারদিক উলোট পালট করে ডিম পাড়ার জায়গা খুঁজে নিত। অরণির দায়িত্ব ছিল সেই ডিম ফেরত দেয়ার। আম্মা জোর দিতেন নগদ দুটো কথাও যেন শুনিয়ে আসে- 'মুরগি সামলে রাখতে পারেন না? দরজাটা খুলে রাখতে পারেন না? আবার ঢুকলে দিমু পাখনা কাইট্টা।' অত ঝাঁঝে কথা বলতে পারেনি অরণি তখনও। তাই কোনদিন ওর প্রতিশোধ গড়াতো অন্য পয়ারে। ডিমটা হাতের মুঠোতে নিয়ে চলে যেত ছাদে।
পাপ আর পুণ্যের মাঝামাঝি দুলে যেত ডিম। ডিম ফুঁড়ে কোন রাজকুমার বেরুতো না বলে ডিমটাই হয়ে যেত রাজার কুমার। সঙ্গমের মতো অস্থিরতায়, কাল্পনিক সাহসে খেয়ে নিত সেই ভাজা রাজার কুমার। এই ছাদেই একদিন কেউ তার গোলাপি প্যান্টি নামিয়ে দেবে। বাকি জীবনের দুপুরে নামিয়ে দেবে মধ্যরাত। সেইসব ভূতুরে দুপুর আর ছাদ অবশ্য আরও পরের অঙ্কে। তারও আগে কুসুমের মতো পাপ সুখে ও একটা আস্ত ডিম ভাজাকে ভাবতো। তারপর বাড়ি ফিরে ডিমটা লুকিয়ে ফেলতো ডিম জমানো ঝুঁড়িতে। অবশ্য শেষ পৰ্যন্ত রাজার কুমার কখনোই ওর হতো না । বিকেল গড়ালে দোতলার কাজের মেয়ে জোহরা এসে ডিমের খোঁজ নিত। আজকের ডিমটা তো পাওয়া যাইতেছে না। আম্মা বুঝে যেত ষড়যন্ত্র। কিছুক্ষণ হম্বিতম্বির শেষে যাদুকরের মতো ফিরিয়ে দিত হারানো ডিম। সেই কবের একটা ডিম অরণিকে শিখিয়েছিল চলে যাওয়ার মানে।
একটা ভাজা ডিম ওরা চার ভাইবোন ভাগ করে খেত। আরেকটা ডিম আব্বার জন্য। ভাজা ডিম আর তিনটে পরোটা। আব্বা সকালে সাদা রুটি-ভাত-মুড়ি খেতে পারতো না। অরণিরা অপেক্ষায় থাকত কখন আব্বা খাওয়া শেষ করে উঠে যাবে, কখন ছুট্টে যাবে থালার কাছে। একটা ডিম অরণিকে শিখিয়েছিল অপেক্ষার মানে। আব্বা যেন ওদের অপেক্ষা টের পেত। তাই সবার শেষে খেতে বসে পেতলের বাসনে করুণার মতো রেখে যেত এক আধটা পরোটা, আধ ফালি ডিম। ওদের উচ্ছ্বাসে ত্যাক্ত-বিরক্ত আম্মা বলতো, ‘কি আদিখিলা তোদের, ছিঃ, ঘিনও লাগে না!’
আম্মার নাচানো ভ্রু'টা চকের মতো এসে কেটে দেয় একটা চতুৰ্ভুজে আটকে থাকা ডিমের বানান। অরণি তখন উঠোনের কথা ভাবে। মেঝ চাচার পয়তাল্লিশতম পাত্রী দেখা নিয়ে আজও হয়তো তোলপাড় চলছে। বাড়ির হর্তাকর্তা মেঝ চাচা এমনিতে দারুণ পরিপাটি। একটা পাতাও উঠোনে পড়ে থাকা যাবে না। দুপুরে শুয়ে চাদরে রাখা যাবে না আখের ছোবড়ার মতো একরত্তির ভাঁজ। বড়ো সড়ক থেকে চাচার সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ কানে এলে এ বাড়ির মেয়েরা দৌড়ুয় ঝাড়ু নিয়ে শেষ যতি চিহ্নের মতো পড়ে থাকা দুই-একটা পাতা দাবড়ানি দিতে। পাত্রীও হতে হবে নিপাট, ঐ পাতা খেদানো উঠোনের মতোন। কন্যা দেখায় যেমন অস্বস্তি নেই, তেমনি নিজেকে দেখাতেও ওদের অস্বস্তি নেই এতটুকু। উঠোন-ঘরের মতো খাবারের আয়োজন হয় মনে রাখার মতো। অতিথির হিসেব করে মন ভুলানো চা পৰ্বটা পর্যন্ত আসে সোবহানের চায়ের দোকান থেকে। ইমপ্রেশনটাই তো আসল। আর যাই হোক কন্যাপক্ষ কিপটে দূৰ্নাম দিতে পারবে না।
এবারও হয়তো কন্যাপক্ষ হবে ভদ্ৰ বাঙালি যারা কাপের তলানিতে অতখানি চা রেখে যেতে ভুলে না। দাদী হয়তো আজও তলানির সব এঁটো চা কাপে জমিয়ে ফুড়ুৎ করে খাচ্ছে, হয়তো দু একটা বুড়িকেও ডেকে নিয়েছে দলে। দাদী বলে চা আর বিড়ি ও দুটিতে এঁটো বলে কিছু থাকে না। আম্মা হয়তো এঁটো চা খাওয়ার অপরাধে ছোটনের ঘাড়ে-মাথায় গাট্টা মেরে, ভ্রু নাচিয় বলছে- ‘কি আদিখিলা তোদের, ছিঃ, ঘিনও লাগে না!’
আম্মার নাচানো ভ্রু চকের মতো এসে কেটে দেয় চায়ের বানান। অরণি তখন বাটির কথা ভাবে। বাটিতে পুনশ্চঃ জলের মতো টুপ করে ঝরে যায় ফুফু- ভাই, একটু দই বাটিতে রাখছি মায়ের জন্য। কলতলার অসংখ্য কচুপাতা থেকে একটা ঢলঢলে পাতার
সবুজে দইটা ঢেলে নেয় ভাই। বাতাসা স্বাদের গলায় বলে- বুড়া মাইনষের এত খাওন লাগে না। তারপর মানুষটা হেঁটে যেতে থাকে তেঁতুলের গাছ ছাড়িয়ে আরজুর বাড়ির দিকে। যে আরজু ভাবী ডিমের মতো ভেঙে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার অনুমতি ছাড়া হিকমত বিয়া করবে না।’
আবার দুটো ভ্রু হুটপাট ভেসে উঠে, ডেকে উঠে- চুপ, চুপ। যেন চুপ নামের এক অস্বস্তি দাঁড়িয়ে থাকে দূরবীনের মধ্যবৰ্তী জ্যামিতিক রেখায়। জ্যামিতিতে একটা ভেজা মোজা দোল খায়, দুলে ওঠে ভাজা ডিম। আর রোদরে বড়ো বেশি দইয়ের মতো দেখায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
কৃপণতা শেষে নিষ্ঠুরতার দিকে যায় নয়তো ট্রাজেডির দিকে। সেটাই দেখার চেষ্টায় কৃপণ নয় এমন উদার একটা পরিবারকে ভাবনাৱ কেন্দ্রে নিয়ে।
১০ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪