দীর্ঘ তিন মাস পর গনি বেপারীর গয়না সহ আজিজ মিয়া যখন আলগী বাজার ঘাটের কাছাকাছি এসে পৌছাল তখন ভোর হয় হয় । দুরের মসজিদ হতে মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে । দোয়েল কোয়েলের শিষ সহ নাম না জানা অসংখ্য পাখির কলরব কানে বাজছে । আজিজ মিয়ার মনটা এখন বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে । সেই ১লা ফাল্গুন বাড়ী থেকে চারটি গয়না নিয়ে ময়ালের উদ্যেশ্যে বেড়িয়ে আজ বাড়ীর ঘাটে এসে গয়না ভিড়িয়েছে । আজিজ মিয়া গনি বেপারীর আড়তে আংশিক অংশীদারসহ সরকারের কাজ করে । বছরের ছয়মাস সে আড়তে থাকে । প্রতি বছর বোর ধান সংগ্রহের সময় তাকে উত্তর ময়ালে যেতে হয় । আশ্বিণ কার্তিক মাসে ধান বিক্রির জন্য দক্ষিনে নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাদপুর, গোয়ালন্দ সহ বড়বড় মোকামে যেতে হয় । উত্তর ময়াল মুলত ভাটি এলাকার সিলেট, ময়মনসিংহের হাওর বাওর এলাকা । ছাতক ,সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর, সল্লা, আজমিরিগঞ্জ, দিরাই, ধরমপাশা, খালিয়াজুরী,মদন,মোহনগঞ্জ, ইটনা, মিটামইন , অষ্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রায় দুই হাজার মন ধান ক্রয়করে গত রাত দশটায় ভৈরব বন্দরে এসে নোঙ্গর করে । দুটো গয়না আশুগঞ্জের আছমত হাজির আড়তে ও একটি গয়না ভৈরব বাজারে ধলু মিয়ার আড়তে ভিড়িয়ে বড় গয়নাটি নিয়ে আজিজ মিয়া ভোরে নিজেদের ঘাটে এসে নোঙ্গর করেছে ।
গয়নায় পাল তুলে কখনো বা গুন টেনে বন্দর থেকে বন্দরে পাড়ি দিতে আজিজ মিয়ার ভালই লাগে । আজিজ মিয়া গয়নার ছৈ এর উপর বসে বসে নদীর দুই পাড়ের দৃশ্য দেখে আর বিচিত্র বন্দরে বিচিত্র মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে । নদী সমুহের তীরে তীরে হাজারো নারী পুরুষ গোসল করে, কেউ বা পুজা অর্চনায় লিপ্ত, কেথাও বা নৌকায় মাইক বাজিয়ে বড় বধূ শশুড় বাড়ী ফিরছে । কোথাও বা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরছে । কখনো কখনো পালতুলে নৌকার হাল ধরে মাঝি মনের সুখে গান ধরছে---মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে ----- ।
বাড়ী থেকে যাবার সময় তার গিন্নিকে পোয়াতী অবস্থায় রেখে গিয়েছিল । বিগত তিনমাস তার কোন খোঁজ খবর আজিজ মিয়া জানে না । সে তার খবর জানিয়ে চিঠি লিখলেও বাড়ী থেকে কোন চিঠি পাবার সুযোগ ছিল না । নদীতে নদীতে ঘুরলেও আজিজ মিয়ার মন পড়ে আছে তার ছোট্ট গৃহ কোনে তার মন্ডার কাছে । মাকে হারিয়েছে সেই কবে । ছোট ছোট ভাই বোনদের সে ই মায়ের আদর বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলেছে । বাবা থেকেও না থকারই মত সংসার বিভাগী এক জন উদসীন মানুষ । মন্ডা বিবি এসে সংসারে হাল ধরায় আজিজ মিয়া এখন নিশ্চিন্ত । আজিজ মিয়ার কাছে মন্ডা বিবি শুধু স্ত্রী নয়, একজন স্নেহময়ী মা, কখনো আদরীনি বড় বোন, সু নিপুনা গৃহলক্ষী, প্রেমময়ী নারী একজন রক্তমাংসের মানুষ । মন্ডা বিবির গায়ের রংটা কলো হলে কি হবে দিলটা অনেক সাফ । সে যখন হাসি দেয় মুক্তার মত দাত গুলো আজিজ মিয়াকে পাগল করে তুলে । আজিজ মিয়া মাঝে মাঝে ভাবে মন্ডা বিবি না হলে হয়তো তাদের সংসারটি, তার ভাই বোন গুলো উচ্ছন্নে যেত। আজ কয়দিন যাবত বার বার মন্ডা বিবির মুখটা আজিজ মিয়ার চোখে ভেসে উঠছে । এখন আর তর সইছে না । আজিজ মিয়া কোন রকমে বিছানা বালিশ বগল দাবা করে আড়তের দাড়োয়ানকে নৌকা পাহাড়ায় রেখে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে ভারত বষের্র স্বাধীকার আন্দোলন তুঙ্গে । বৃটিশ সম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছে । আজিজ মিয়া মাইনর স্কুলের ছাত্র । সংসারে মা মারা গিয়েছে বেশ ’ক’ বছর হলো । বাবা ছোট ছোট ৬টি ছেলে মেয়ে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে । আজিজ মিয়া সংসারের বড় ছেলে ছোট ছোটভাই বোনদের দেখার আর কেউ নেই । তা ছাড়া জমিজমা চাষাবাদ কিংবা তদারকিতেও তার বাবার আগের মত মন নেই। ফলে সংসারে অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে । বাধ্য হয়ে কিশোর বয়সেই আজিজ মিয়াকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে । প্রথম প্রথম কিছুদিন চাষাবাদ সহ অন্যের জমিতে কামলা দেওয়ার মত শক্ত কাজও সংসারের প্রয়োজনে তাকে করতে হয়েছে ।প্রতিবেশী গনি বেপারীর ছেলেটাকে এই অল্প বয়সে এত পরিশ্রম করতে দেখে তার মনে বেশ মায়া জন্মাল ।গনি বেপারী তার বিশাল আড়ত ও ব্যবসার হিসাব পরিচালনার জন্য মনে মনে একজন সৎ লেখাপড়া জানা লোকের খোঁজ করছিলেন । তিনি আজিজ মিয়াকে ডেকে তার ব্যবসার হিসাব দেখা ও নিয়মিত গদিতে বসার প্রস্তাব দিলেন ।
মাসিক ৩০/-টাকা বেতনে আজিজ মিয়া এক বৈশাখে গনি বেপারীর ব্যবসায় সরকার হিসেবে নিয়োজিত হল । আজিজ মিয়া তার সততা, নিষ্ঠা, ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গনি বেপারীর মন জয় করতে সক্ষম হলো । ধীরে ধীরে গনি বেপারী তার ব্যবসার সমস্ত ভার আজিজ মিয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন । গনি বেপারী আজিজ মিয়ার কর্মতৎপরতায় খুশী হয়ে তার নিজ শালিকার সাথে আজিজ মিয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার বাবার কাছে হাজির হয় । উভয় পক্ষের সম্মতিতে শীত কালের এক রাতে মনডা বিবির (মনোয়ারা) সাথে আজিজ মিয়ার বিয়ে হয় । বিয়ের উপটৌকন হিসেবে আজিজ মিয়াকে গনি বেপারী তার ব্যবসায়িক পাটনার হিসেবে যুক্ত করে নেন । দেখতে দেখতে আজিজ মিয়ার সংসারে সুদিন ফিরে আসে ।
ইতোমধ্যে দেশ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়লো । এক দিকে মুসলিম সম্প্রদায় অন্য দিকে হিন্দু সম্প্রদায় । আজিজ মিয়া দেখলো দুদিন আগেও যারা এক সাথে বসে যাত্রাপালা, জারি সারি গান করেছে তারা কেমন যেন একে অন্যের শত্রুতে পরিনত হয়েছে । আজিজ মিয়া তার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এর মর্মার্থ খুজে পায় না । সমগ্র দেশ জুড়ে মারামারি হানা হানি শুরু হয়ে গেল । হিন্দুরা মুসলমানের বাড়ী ও মুসলিমরা হিন্দু বাড়ী আক্রমন করতে শুরু করে দিল । এক দল উশৃঙ্খল উগ্র ধর্মান্ধ এতে ইন্দন যোগিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে লাগল । অল্প কিছু দিন পর দেশটি দুই ভাগে একটি পাকিস্তান ও অন্যটি হিন্দুস্থান হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়ল । পাকিস্তান আবার দুটি অংশ একটি পশ্চিম পাকিস্তান অন্য অংশটি অভিভক্ত বাংলার পূর্বাংশ, পূর্ববাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে বিভক্ত হয়ে পড়লো । আজিজ মিয়া এই নামকরনের অর্থ খুজে পায় না মুসলমান হলেই পাক ও পবিত্র আর বিধর্মী হলেই অপবিত্র এ কেমন বিচার ? ধর্মের আলোকে দেশের বিভক্তি আজিজ মিয়া মন থেকে মেনে নিতে পারল না । আজিজ মিয়ার ধারনা এ দেশ বেশী দিন টিকবে না । কি আর করা আজিজ মিয়ার কথায় তো আর দেশ চলবে না । এই অসম বিভক্তির ফল যে ভাল হবার নয় তা কিছুদিন পরই টের পাওয়া গেল । পূর্ব পাকিস্তানে বঞ্চনার বীজ দানা বেধে উঠতে শুরু করলো । বায়ান্নতে প্রথম ও চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংগালীরা স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে শুরু করল ।
বাড়ী ফিরেই অজিজ মিয়া জানতে পারে ভোর রাতের ফজরের আজানের ওয়াক্তে তার প্রথম সন্তান এর জন্ম হয়েছে । বাচ্চা ও তার মা উভয়েই ভাল আছে । তবে মনডা বিবি বারবার তার পথের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল মুছেছে । আজিজ মিয়া গোসল অজু সেরে ঘরে এসে প্রবেশ করে । আজিজ মিয়া দেখতে পেল একটি ছোট্ট ফুটফুটে মানব শিশু বিড়াল ছানার মত পরম নিশ্চিন্তে মনডা বিবির বুকের কাছে শুয়ে আছে । অজিজ মিয়াকে দেখতে পেয়ে মনডা বিবির প্রানে যেন আনন্দের বান ফিরে এল । আজিজ মিয়া মনে মনে খোদার দরবারে দোয়া করে বলে- হে খোদা তুমি আমার আধার ঘরে যে ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুটিকে দিয়েছ তাকে তুমি অনেক বড় করার তৌফিক দাও। শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান গরিমায় দেশের এক জন সন্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সে যেন প্রতিষ্ঠা পায় সে যোগ্যতা অর্জনের ক্ষমতা তাকে দিও খোদা ।
গনি বেপারীর আড়তের এক কালের সরকার আজিজ মিয়া আজ আজিজ বেপারী হিসাবে সমাজে পরিচিতি পেল । তার পাঁচপাঁচটি সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ইতোমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে । মেঝো দুজন হাই স্কুলের গন্ডি না পেরিয়েই বাবার সাথে আড়তে ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়েছে । ফলে আজিজ বেপারী অনেকটা নির্ভার । ছোট দুজন এর মধ্যে একজন নবম শ্রেনীতে ও অপরজন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে । আজিজ বেপারীর ইচ্ছা তার এই তিন ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও দশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করুক ।
উনিশ একাত্তর সাল দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে নয়মাস হতে চলল। আজিজ বেপারীর ব্যবসা প্রায় বন্ধ । ডিসেম্ভর মাস চারদিক থেকে মুক্তি যোদ্ধাদের বিজয়ের খবর আসছে । আজিজ বেপারীর বড় তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছে । আজিজ মিয়া নিজেই পাঠিয়েছে তার সন্তানদের । আজিজ মিয়া বুঝেছে পরাধীন দেশে বেচে থাকার চেয়ে যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে হলেও দেশ শত্রু মুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করা জরুরী । মনডা বিবি প্রথমে একটু বাধা দিলেও পরে দেশের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ও তার সন্তানদের বাচিয়ে রাখা তথা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর বাধা দেয়নি । আজিজ মিয়া বেশ কদিন যাবৎ ছেলেদের কোন খোঁজ পাচ্ছেন না । ছেলেদের জন্য মনটা বেশ অস্থির । অনেক দিন পর লোক মারফত খবর পেয়েছেন তারা আশে পাশেই আছে এবং ভাল আছে । একদিন মাঝ রাতে প্রচন্ড বোমার শব্দে আশেপাশের সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল । এমনিতে যুদ্ধ শরু হওয়ার পর থেকে বড় তিন ছেলে কাছে না থাকায় শান্তিতে ঘুম হয় না । তার উপর কাছাকাছি এত প্রচন্ড শব্দে বোমার আওয়াজ । ঘর থেকে বেড়িয়েই দেখতে পেল মেঘনা ব্রিজটি দাউদাউ করে জ্বলছে । ঠিক এর পাঁচ দশ মিনিট পরই আবার একটি বোমা স্বজোড়ে ফোটে উঠলো । আশে পাশের গ্রাম গঞ্জ নদী নালায় হঠাৎ করে যেন দিনের আলো ফুটে উঠলো । শব্দটা থামতেই দেখা গেল ব্রিজের আর একটি অংশে আগুন জ্বলছে ও দুটি গার্ডার ভেঙ্গে নদীতে পড়ছে । ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে পাকবাহিনীর উপর সাড়াশি আক্রমন চালিয়ে তাদের কে পর্যোদস্ত করে তুলেছে । পাক বাহিনী টিকতে না পেরে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেবার জন্য মেঘনা ব্রিজ ভেঙ্গে দিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছে । এদিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী হেলিকপ্টার যোগে নরসিংদীর দিকে ছত্রী সেনা নামিয়ে দিয়ে চারদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে । পাকবহিনী নিজেদের রক্ষার জন্যে বেপরোয়া হয়ে পরদিন বিকেল থেকে ক্রমাগত সেলিং করে যাচ্ছে । মিত্রবাহিনী ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশ্ববর্তী গ্রামের লোক জন কে ট্রেন্স খুড়ে আশ্রয় নেবার অথবা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার জন্য হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ফেলে আহ্বান জানিয়ে গেল ।
আজিজ মিয়া পরিবারের সকল কে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দিয়ে বাড়ি পাহাড়ায় রয়ে গেল । শীত কাল অমাবশ্যার রাত, তখন রাত প্রায় নয়টা হঠাৎ বাড়ীর আঙ্গীনায় একদল পাক সেনা এসে হাজির । আজিজ মিয়া ও তার প্রতিবেশী যে কয়জন ছিল তাদের সবাই কে ধরে এনে গোলাবারুদ পাহাড়াসহ আশ্রয়ের জন্য ট্রেন্স খুড়তে বাধ্য করল । পাক সেনারা আজিজ মিয়াদের তোপের মুখে রেখে ছোট্ট মড়া নদীর ওপারে অবস্থানরত মুক্তি ও মিত্রবাহিনীকে লক্ষ্য করে অনবরত মেশিনগান চালিয়ে যেতে থাকলো । মুক্তি বাহিনীও থেকে থেকে গুলি ছুড়ে তাদের উপস্থিতি জানিয়ে যেতে লাগলো ।
ভৈরব থেকে পাক বাহিনী মুহূর মুহু কামানের গোলা ও সেল ছুড়ে মিত্র বাহিনীকে সরিয়ে ঢাকায় ফেরার পথ তৈরী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে । রেল লাইনের আশপাশের এক মাইল ব্যাপি এর বিস্তার চলতে লাগলো । রাতের আধার চিড়ে ক্ষণে ক্ষনে আর্তচিৎকার ও কান্নার রোল হাজারো গুলাগুলির মাঝেও বাতাসে ভেসে আসছে । ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ এদিক ওদিক ছুটা ছুটি করছে । মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপন মানুষ জনকে নিরাপদ গর্তে, ট্রেন্সে কিংবা বড় বড় গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে বাচাবার চেষ্ট করে যাচ্ছে । সারা রাতের সেলিং ও কামানের গোলার আঘাতে দশ বারটি গ্রামের ৩৪ জন নারী পুরুষ শিশু প্রাণ হারিয়েছে এবং শতাধিক লোক আহত হয়েছে। যারা আজো এ ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে ।
রাত তখন প্রায় একটা হবে বাইরে ঘুদগুটে অন্ধকার । ঝিঝি পোকারাও যেন কামান আর মেশিন গানের গোলাগুলির ভয়ে কোথায় পালিয়েছে । আজিজ মিয়া , সুরুয ও রহমত আলী গুটিমেরে ঘরের আড়ালে বসে বসে দোয় দরুদ পড়ছে । পাক সেনারা মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর আক্রমন ঠেকাতে ব্যস্ত । অন্ধকারে দুহাত দুরের কিছু দেখার বা বুঝার উপায় নেই । মেশিন গানের গুলির স্ফুলিংয়ে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুত চমকের মত আলোকিত হয়ে উঠছে । আজিজ মিয়ারা বুঝতে পারল এখান থেকে পালাবার কোন পথ নেই । ডানে বায়ে, পেছনে পাকবাহিণী এম্ভোস নিয়ে সামনের দিকে গুলি ছুড়ে যাচ্ছে । গোলাগুলির মাঝে থেকে তাদের বাচার আর উপাই নেই । সামনে গেলে মিত্র ও পাকবাহিনীর ক্রসফায়ারে পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে । আজিজ বেপারীরা বুঝতে পারল তারা এখন শাখের করাতের মাঝখানে অবস্থান করছে । তারা সিদ্ধান্ত নিল মরতে যখন হবেই তখন শুধু শুধু মরে লাভ নেই । তিনজনে হাতে হাত ধরে মনে মনে শপথ করলো দু’এক জন জালিম হায়েনা কে মেরেই মরবে । পাক সেনাদের চোখের আড়ালে তারা চুপিচুপি ট্রেন্স খোড়ায় ব্যবহৃত কোদাল, খন্তা, শাবল নিজেদের কাছে টেনে নিল । আজিজ মিয়ার উঠানের দুপাশে দুটি ট্রেন্সে থেকে দুজন পাক সেনা একাধারে মেশিন গানের গুলি ছুড়ে যাচ্ছে । অন্য এক জন আজিজ মিয়ার বড় ঘরটির ভিটির আড়ালে শুয়ে এলএমজি চালিয়ে যাচ্ছে । গুটি গুটি পায়ে তারা সামনে এগিয়ে গেল । এক সাথে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে তারা তিন জনের উপর ঝাপিয়ে পড়লো । আজিজ মিয়ার কোদালের কুপে ঘরের আড়ালে থাকা পাক সেনাটির মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল । সুরুযের শাবলের আঘাতে ট্রেন্সের ভেতরে এক জন বিদ্ধ হয়ে পড়লো । রহমত আলীর খন্তার আঘাতটা তেমন একটা জোড়ালো না হওয়ায় পাকসেনাটি ট্রেন্স থেকে দাড়িয়ে এক ম্যাগজিন গুলি তাদের তিন জনের উপর ঢেলে দিল । গুলিতে ক্ষতবিক্ষত ও ঝাঝড়া হয়ে, তারা উঠানে লুটিয়ে পড়ল ।
মিত্র বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে না পেরে পাকবাহিনী ভোরের আলো ফোটার আগেই পেছনে ফিরে পুনরায় ভৈরবে এসে জড়ো হলো । আজিজ মিয়া ও তাদের কোপে ঘায়েল হওযা মৃত দেহ গুলো উঠানে আর ট্রেন্সের ভেতরেই পড়ে রইল ।
আজিজ মিয়ার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসছে । চারিদিকে ঘন গভীর অন্ধকার । দুর বন থেকে শিয়ালের হাক কানে বাজছে । আস্তে আস্তে চারদিক ফর্সা হয়ে উঠছে । পুর্ব দিক থেকে প্রকান্ড একটি লাল আগুনের পিন্ড মাটি ফুরে বেড়িয়ে আসছে । দেখতে দেখতে পিন্ডটা রক্তিম সূর্যের আকার ধারন করলো । আলোটা সারা সবুজ ফসলের মাঠে ছড়িয়ে পড়ে ।মাঠ জুড়ে আলোর নাচন শুরু হলো ।নাচের তালে তালে সবুজ ফসলের মাঠ সবুজ বর্নের পতাকা হয়ে ফুটে উঠতে শুরু করলো । দুর হতে একদল লোক সেই সবুজ পতাকা হাতে জয়বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে বিশাল মিছিল নিয়ে আজিজ মিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে । মিছিলের নেতৃত্বে ও কে ! তাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে আর একটু কাছে আসতেই আজিজ মিয়া চিনতে পারল এযে তার বড় ছেলে ইমরান । তিন ছেলেই তার বাবাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসছে । আজিজ মিয়াও এগিয়ে চলেছে । আজ কত দিন পর ছেলেদের দেখছে । ছেলেরা শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা ॥ শুকাবে ই বা না কেন ? যুদ্ধের ময়দানে কি তারা সব সময় খেতে পেয়েছে ? আর একটু এগোলেই ছেলেদের ধরে ফেলতে পারবে । আজিজ মিয়া চাচ্ছে বড় ছেলের হাত থেকে লালসবুজ পতাকাটা নিজ হাতে নিয়ে তিন ছেলের গায়ে জড়িয়ে দিতে । আজিজ মিয়া দুই বাহু বাড়িয়ে দিয়েছে । ক্রমে চোখে দুটি বন্ধ হয়ে আসছে, এক সময় ঘণ গভীর অন্ধকার নেমে এল। আজিজ মিয়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ছেলেদের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে কিন্তু মুখ দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না ।
০৭ এপ্রিল - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪