আনোয়ার হোসেন সাহেবের বড় পরিবার।৩ ছেলে ৪ মেয়ে।কর্ম জীবনে নিরঙ্কুশ আপসহীন ব্যাংক কর্মচারী আনোয়ার হোসেন এখন অবসর নিয়েছেন।জীবনের শেষ সময় গুলো উপভোগ করার চেষ্টা করছেন তিনি।অবশ্য শেষ সময়ের মাত্র শুরু হয়েছে তার।৫৮ বছর আর এমন কি বেশি বয়েস।৩ মেয়ে ২ ছেলের বিয়ে দেয়া শেষ।বাকি ছোট ছেলে আর মেয়েটা,দুজনেই পড়াশুনা করছে।স্ত্রীকে বলেন আনোয়ার হোসেন
-জানো জীবনটা মাঝেমাঝে সার্থক মনে হয়
ফাতেমা আক্তার সারাটা জীবন স্বামীর কথার বিপরীতে বলে গেছেন,অবশ্য এরপর ও দুজনের মধ্যে ভালবাসার এতটুকু কমতি ছিল না।
-কি এমন কাজটা করেছ শুনি
বিরক্ত হলেন আনোয়ার হোসেন
-আরে এমন কাজ কয়জন করতে পেরেছে দেখাও দেখি,মেয়ে ৩ টা কে এমন ঘরে বিয়ে দিয়েছি,জামাই গুলো সোনার টুকরো একেকটা।২ ছেলে বিয়ে করে চাকরি করে যথেষ্ট সুখে আছে।ছোট দুইটাও ভাল মানুষ হয়ছে।আমার দায়িত্ব আমি সঠিক ভাবে পালন করেছি।
-মনে হয় আর কেউ এ ভাবে সন্তান মানুষ করে নি?
-করেছে তবে আমার মত করেনি অথবা করেও আমার মত সুখি হয়নি
গত বছর হজ্জ পালন করেছেন আনোয়ার হোসেন।এই বছর আবার স্ত্রী কে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।মানুষ যখন উনাকে হাজী বলে গর্ববোধ করেন তিনি,অবশ্য এটা গর্ব করার মতই ব্যাপার।আনোয়ার হোসেনের বড় ছেলেটা প্রকৌশলী,চাকরির ৮ বছর চলছে তার।দুর্নীতির এটাই সময় কিন্তু ছেলেটি কখনও ওই পথে যায়নি।অফিসে অথবা ডিপার্টমেন্টের লোকের মুখে মুখে ফিরে ছেলেটির কথা।আনোয়ার হোসেন এর ছোট ছেলেটা বিভাগীয় পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে।পুলকিত হন আনোয়ার হোসেন,সারা জীবন চাকরি করেও দেশের কোন ক্ষতি করেননি।তার ছেলেগুলো তার মত হয়েছে।ছোটটাকে আনোয়ার হোসেন বলেছেন
-বাবা আমিতো ক্রিকেট বুঝি না কিন্তু আমি তোমাকে বাধা দেব না,তুমি ক্রিকেট খেল,কারন তুমি দেশের জন্য খেলছ,এটাই আমার কাছে বড় কথা,কথাটা তুমিও মনে রাখবে।
এশার নামায শেষে যখন বাড়ি ফিরেন আনোয়ার হোসেন মনটা একটু খারাপ হয় তার।মেয়ে গুলোকে বিয়ে দিয়েছেন,ছোট মেয়েটাও তার মেঝ বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে।বড় ছেলেটা চাকরির খাতিরে ঢাকায় থাকে,দ্বিতীয়টা দেশের বাইরে,ছোটটা ও সব সময় থাকে না।একা লাগে তার ভীষন একা।আসলে না মানতে চাইলে ও এটাই চিরন্তন সত্য বাবা মা ছেলে মেয়েকে যে আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করে,নিজেদের শেষ বয়েসে সেই আদর ভালবাসা আকাঙ্কা বাতুলতা মাত্র।অবশ্য আনোয়ার হোসেন অত দুখী মানুষ না।প্রায়ই বেড়াতে যান তিনি মেয়েদের বাড়ি।আনোয়ার হোসেন এর সারা জীবনের কামাই শহরের এক কোনে ২০ শতক জায়গায় আধাপাকা একটি বাড়ি।বাড়িতে পা রাখলেই সবাই বলে অনেক সুন্দর।হরেক জাতের ফুল গাছ,সবজি বাগান,সুপারি,ফল গাছ।দিনের প্রায় সময় তিনি এই বাগান করেই কাটান।রাতের খাবার শেষে ফাতেমা আক্তার তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন।কিন্তু আনোয়ার হোসেন এর ঘুম আসে না।ফাঁকা বারান্দায় অন্ধকারে ইজি চেয়ারটায় বসেন তিনি।ঝিঝির গান শুনেন অথবা জোনাকিদের আলো দেখেন,ভাবেন তিনি দেশটার কি হবে,কোন পথে এগুচ্ছে এই সোনার জন্মভূমি।রাজনীতি হয়ে উঠেছে এই দেশের অন্যতম জঘন্য পেশা।অথচ ডাক্তার এর চেয়ে একজন রাজনীতিকের আবেদন কোন অংশে কম নয়।দেশের বড় বড় চোর চ্যাচর গুলোর মাথার ছায়া হল রাজনীতি।হায়রে দেশ।আনোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।তিনি কখনই যুদ্ধ বিগ্রহ,রক্ত,মানুষের হায়েনা হয়ে উঠা পচন্দ করতেন না।মাত্র কিশোর বয়সে যুদ্ধ করেছেন তিনি,মানুষ মারতে তার কখনই ইচ্ছে হয়নি।মনে মনে সব সময় চাইতেন কখন দেশ স্বাধীন হবে।ভাবেন আনোয়ার হোসেন তখন কি আজকের এই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন তিনি,অবশ্যই না।তখন জানলে পিশাচ বংশধর গুলোকে মারতে তার হাত এতটুকু কাপতঁ না।যুদ্ধে যারা দেশদ্রোহিতা করেছে,যারা ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা করেছে হাতে গোনা সেই সব মানুষ গুলো এখন দেশের অনেক বড় বড় রাজনীতিক।অন্ধকারে হেসে উঠেন আনোয়ার হোসেন,সেই হাসিতে যে কেউ ভয় পাবে।অসহায় হয়ে আত্মসর্মপনের হাসিতে যে কত ঘৃনা,কত শাপ থাকে তা অকল্পনীয়।
আজ কাল প্রায়ই হরতাল ডাকছেন বিরোধী দলীও নেত্রী।দেশে গুঞ্জন তার নিজের আমলে করা তার দুই সন্তানের পাপ ডাকতে অথবা দুই সন্তানকে রক্ষা করতে এই হরতাল।ভাবেন আনোয়ার হোসেন এরা আবার রাজনীতিক।
আষাঢের মাঝামাঝি।জুলাই এর ৭-৮ তারিখ।টানা দু দিন হরতাল ডেকেছে বিরোধীদল বিএনপি।আনোয়ার হোসেন মেয়েদের বাড়িতে আম কাঠাল পাঠাবেন,মেয়েরা বেড়াতে আসবে নাতি নাত্নি সহ,কিছুই সম্ভব হচ্ছে না।এর আগে ও হরতাল গেছে,অস্থির একটা পরিবেশ পুরো দেশে।ছোট ছেলেটা বাড়িতেই আছে।রাত পুহালে হরতাল শেষ।আনোয়ার হোসেন খুব শখ করে বিকেল বেলা আম কাঠাল কিনতে রওনা হলেন।সব মেয়েদের বাড়ি পাঠাবেন তিনি ছোট ছেলেটা কে দিয়ে।রিকশা করে ফিরছেন তিনি,একা বুড়ো মানুষ বাজার করে ফেলেছেন বেশি,হিমশিম খাচ্ছেন সামলাতে।রিকশাওয়ালাকে বলেছেন তিন আস্তে যেতে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ছে।শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট পেরোতে যাবে রিকশা গলি থেকে বেরিয়ে এল ৪-৫ টা ছেলে।উদত্য ভাব তাদের শরীরে,রিকশাওয়ালা ভয়ে রিকশা থামাচ্ছে না।ছেলে গুলো মারতে এগুলো রিকশাওয়ালা কে,সজোরে ব্রেক চেপে দিল রিকশাওয়ালা,এমনিতেই জিনিসপত্র সামলে ছিলেন আনোয়ার হোসেন,শক্ত করে চেপে ধরতে পারলেন না কিছু,ছিটকে পড়লেন রিকশা থেকে।রক্তে ভাসল আবারও রাজপথ,যেন ‘৫২র সেই দিনগুলি।বালতি থেকে কেউ যেন রক্ত ডালছে রাস্তায়।হঠাৎ বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করেছে অঝর ধারায়।পুরো রাস্তাটা রক্তে একাকার।মাথাটা ফেঠে দু ফাঁক হয়ে গেছে আনোয়ার হোসেন এর।আনোয়ার হোসেন এর ছোট ছেলেটা পাগলপ্রায়,মফস্বল শহর,রাত ৮টায় ডাক্তার বললেন
-এখানে রাখলে বাঁচানো সম্ভব না বিভাগীয় সদরে নিয়ে যান এখুনি
বাইরে হরতাল,তার উপর বাদলা দিন।ছোট ছেলেটা পাগলের মত ঘুরল কোন গাড়ির মিলল না তার।বাবার এই অবস্তায় স্ট্রোক হয়ছে,সে বুঝতে পারছে দেরি করলে পরিনতি কি হবে।রাত ২ টায় গাড়ি মিলল।মাথায় ১৭টি সেলাই আনোয়ার হোসন এর,ফাতেমা আক্তার কেঁদে কেটে সারা।সবাই জেনেছে এই ঘঠনা,ছেলে মেয়েরা পাগল হয়ে ছুটছে বাবাকে দেখার জন্য।ভোর ৫টায় গাড়ি পৌঁছাল হসপিটালের গেটে।
ডাক্তার জানালেন ব্যবস্থা হয়ছে এখন সব উপরওলার হাতে।২৪ ঘন্টায় জ্ঞান না ফিরলে কিছু করার থাকবে না!
বাইরে অঝর ধারায় আকাশ কাদঁছে।আনোয়ার হোসেন এর দেহটি এখন তার মেঝ মেয়ের বাড়িতে।গাড়ি ঠিক হয়ছে,মফস্বলে নিজের ভিঠায় একটা জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন আনোয়ার হোসেন নিজের জন্য।আত্মীয় স্বজনরা এসেছেন,সব ছেলে মেয়েরা এসছে।শোকের হাওয়ায় বাদল দিনের উদাসী অনুভূতি গুলোও লজ্জা পাচ্ছে।একজন মুক্তিযুদ্ধা,একজন দেশপ্রেমিক,একজন ভাল মানুষ এ ভাবেই বেঘরে মারা পরেন।আনোয়ার হোসেন এর হুশ আর ফেরেনি এবং ফিরবেও না।আচ্ছা আমরা কি হুশে আছি।এই যে দেশে এত তুলকালাম কান্ড ঘঠে যাচ্ছে জাতির বিবেকটা কোথায়।রাজনীতি নামে যে নগ্ন দৌড় প্রতিযোগীতা চলছে তার শেষই বা কোথায়।আমরা কি তাহলে স্বৈরাচারে বাস করছি না বিশেষ এক ধরনের স্বৈরাচারি গনতন্ত্রে,যেখানে স্বামীর পর স্ত্রী, স্ত্রীর পর সন্তান বংশক্রমে নেতা নেত্রী।সহজ হিসাবে এক পরিবারের সব মানুষ কখনই নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।কিন্তু বাংলাদেশে তা হচ্ছে তা ও আবার গনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে।এমন গনত্রন্তের কি কোন দরকার আছে।হরতাল বছর ৫ আগেই নিষিদ্ধ হওয়ার কথা,অথচ ৫ বছর পর নতুন করে আবার দেশে হরতাল হচ্ছে।ধিক এই গনত্রন্তকে ধিক এই সরকার ব্যবস্থাকে।আমরা চাইলেও এখন কিছুই করার নেই...।।কারন এটাই সিস্টেম,এই সিস্টেমে আনোয়ার হোসেনরা মারা গেলও কিছু যায় আসে না।