মা

মা (মে ২০১১)

আহমাদ ইউসুফ
  • ১২
  • 0
  • ৭৩
একজন সন্তান হিসাবে মায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস আমার নেই। গর্ভধারণ করেন বলেই তিনি গর্ভধারিণী আবার জন্ম দেন বলেই তিনি জননী। এসবই মায়ের ভূমিকার এক একটি খন্ডচিত্র মাত্র। আসলে মাকে কখনোই সম্পূর্ণ রূপে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কেননা সন্তানের জীবন নাট্যে মা যে অপরিহার্য প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন তা সর্বজন ও সর্বসমাজে বিদিত। ছোট্ট একটি শব্দ "মা" ডাকটি যে কতো মধুর তা সন্তান মাত্রই বুঝতে পারেন। অনেকে হয়তো মা জীবিত থাকতে তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন না। মাকে নিয়ে কবিতা গল্প উপন্যাস এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। মায়ের বন্দনা, স্তুতি সংগীতেও মূর্ছনা ছড়িয়েছে। জেমস এর মা গানটির কথা উল্লেখযোগ্য। ম্যাঙ্মি গোর্কির "মা" আর আনিসুল হকের "মা" এর মধ্যে আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনি। কেননা মা সার্বজনীন। ইংরেজ, আমেরিকান আর বাঙ্গালীর "মা"এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মায়ের আদর ভালোবাসা সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। মাকে নিয়ে এর আগে কখনো লেখা হয়নি। তাই মাকে এতটা উপলব্ধিও করিনি কখনো।

আমার এ পৃথিবীতে আগমন থেকে শুরু কওে আজও মা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। মাকে ছাড়া এ পৃথিবী আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমার বাবা ছিলেন বরাবরই সংসারের প্রতি উদাসীন। মা শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন বলেই আমার আজ এ পর্যন্ত আসা। কথাটি নিতান্তই সাদামাটা ও দায়সারা। বাবার অবর্তমানে মা তো সংসার চালাবেনই। এ আর ব্যতিক্রম কি। তবে আমার মায়ের ত্যাগ ও পরিশ্রম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। আমাদের সংসারে সারাবছর অভাব লেগেই থাকত। মা নারিকেলের ছোবড়া পিটিয়ে দড়ির মতো পাকাতেন। এগুলো আমি বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। এছাড়া হোগলা পাতা দিয়ে চাটাই বুনতেন আমার মা। সেগুলো বিক্রি করে সামান্য আয় হতো এবং অল্প কিছু সুপারি ও নারকেল বিক্রির টাকায় আমাদের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতাম। নাহ! মেটাতে বাধ্য হতাম। সামান্য কিছু ধানী জমি ছিল যা বর্গা দিয়েও সারা বছরের খাওয়ার মতো চাল হতো না। বাবা তখন হয়তো রংপুর, শেরপুর বা জামালপুরে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজে সাব কন্ট্রাক্টরি করছেন। আরাম আর আয়েশে নিশ্চিন্তে বিড়ি টেনে, তাস খেলে দিন গুজরান করছেন। আর এদিকে যে আমরা কটা প্রাণী অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করছি তার খবর রাখার প্রয়োজনও বোধ করতেন না। তবে পাঁচ মাস, ছয় মাস পর হঠাৎ একদিন বাবা বাড়ি ফিরতেন সামান্য কটা টাকা নিয়ে যা হয়তো তার ছুটি শেষ না হতেই ফুরিয়ে যেতো। তবে ফুরাতো না বাবার গল্পের ভাণ্ডার। বাবা চলে গেলে আবারও শুরু হয়ে যেতো মায়ের সংগ্রাম। সেই সাথে আমাদের হাপিত্যেশ। এমনও কতো রাত গিয়েছে যে, মা সামান্য খাবারটুকু আমাদের খাইয়ে নিজে উপোষ থেকেছেন। কখনো বা আমাদের দুপুরের খাবার হতো সরিষার তেল মাখা একপোয়া মুড়ি, কিংবা চাল ভাজার গুড়া। এমনি কেটেছে আমাদের শৈশব। আর সহযাত্রী আমার মা । স্নেহময়ই মা। অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি আমাদের ছয় ভাই বোনকে দিয়েছেন নুন্যতম শিক্ষার আলো। যা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোন মা হলে আমরা পেতাম না। হয়তো এ বয়সে রিকশার পেডেল ঘুরিয়ে কিংবা দিনমজুরি করে জীবন নির্বাহ করতে হতো। আমার মা ছিলেন যথেষ্ট আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। কারো কাছে সাহায্যের জন্যে হাত পাততেন না। আমার নানা বাড়ির অবস্থা ভালো থাকলেও তাদের কাছ থেকেই সাহায্য পেয়েছি সামান্য। মা কখনোই কারো কাছে ছোট হতে চাইতেন না। না খেয়ে থাকলেও চাচীদের ঘরের সামনে গিয়ে "এইমাত্র খেয়ে এলাম" জাতীয় নির্ভেজাল মিথ্যা কথাটা বলার অভ্যাসটা মা ই তৈরি করে দিয়েছিলেন। মায়ের মতে সম্মান বাচাতে এটুকু মিথ্যা বলা মোটেও দোষের কিছু নয়। আমার "মা" টা ভারী অভিমানী। কখনো সামান্য কারণে বাবার সাথে রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। আমাদের শত অনুরোধ ও কান্নাকাটি কোন কিছুই মায়ের মন গলাতে পাত না। শেষ পর্যন্ত বাবাকে মায়ের রাগ ভাঙ্গানোর কঠিন কাজটা সম্পন্ন করতে হতো। তবে আমার মায়ের বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ। বাড়ির মধ্যে কিংবা মামা বাড়িতে মেয়েলী যে কোন সিদ্ধান্ত বা পরামর্শের জন্য আমার মাকে ডাকা হতো। মায়ের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত সবার মনঃ পুত হতো। আমার নানারও আস্থার প্রতীক তার বড় মেয়ে। অর্থাৎ আমার মা। আমার মায়ের আর একটা গুন হলো মা ধাত্রীবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী। মা এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটা বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখতে সাহায্য করেছেন। আমাদের ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম পঞ্চম। আমার তিন কি চার বছর বয়সে আমার মনে পড়ে মা আমাকে লোকসঙ্গীত গেয়ে শুনতেন আর নাচতেন। আমি অবুঝ ছিলাম বলেই আমার সামনে নাচতেন। তবে আমার মা যথেষ্ট পর্দানশীন মহিলা। এখনো প্রায় ৫৫ বছর বয়সে তিনি বোরকা ছাড়া বাইরে বের হন না। যখন একটু বড় হয়েছি অর্থাৎ ১২/১৪ বয়সে ও মায়ের কাছে ঘুমতাম আমি। এমনকি এখনো মাঝে মাঝে এই ২৫ বছর বয়সে মায়ের সাথে ঘুমাই আমি। মা আমার চুলে বিলি কেটে দেন আমি শান্তিতে চোখ বুজি। আমার ছোট বোন আর আমার মাঝে প্রায়ই কাড়াকাড়ি হতো কে আগে মায়ের শরীরের ঘামাচি গালিয়ে দেব এই নিয়ে। যদি কেউ ছাড় দিতে না চাই তবে ভাগাভাগি হতো আমি মায়ের শরীরের বাম পাশ আর ছোট বোন ডানপাশের ঘামাচি গুলো ঝিনুকের খোল দিয়ে গালিয়ে দেব। ছোটবেলায় মা অনেক পিঠা বানাতেন, আমি পছন্দ করতাম বলে। এখন বাড়িতে থাকিনা। তাই মা আর পিঠা বানাতে চান না। আর খেজুরের রসের পায়েস ও রাধা হয়না আগের মতো। আমার মায়ের সাধারণ জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি খুবই প্রখর। একবার স্কুল জীবনে আমার একটা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক হয়। আমাদের মধ্যে প্রায়ই চিঠি চালাচালি হতো। ওই মেয়ের দেয়া একটা চিঠি আমার সেজো আপা পেয়ে মাকে দেখালেন। মা তার নিজস্ব বিচার বুদ্ধি ও বিশ্লেষণী শক্তি দিয়ে চিঠির লেখিকাকে উদ্ধার করে ছাড়লেন। আমিও অবাক হলাম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, মা আমাকে তেমন কিছুই বললেন না। আমি যখন চাকরিতে জয়েন করি তখন মা আমার সাথে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলেন। পরে মামা মাকে বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে ট্রেনিং সেন্টারে অনেক কাড়াকাড়ি। ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যাবহার নিষিদ্ধ। সপ্তাহে একদিন পাঁচ মিনিটের জন্য মা বাবার সাথে কথা বলতে দেয়া হতো। মা প্রায়ই বলতেন , বাবা তোমার কথা তো শুনি দেখতে তো পাইনা। এমন কোন ব্যবস্থা নাই যে, কথা বলার সাথে সাথে দেখাও যায়। আমার অশিক্ষিত ক্লাস থ্রি পড়ুয়া মায়ের পক্ষে তো এতকিছু জানা সম্ভব নয়। আমি বললাম আছে মা , ইন্টারনেটের মাধ্যমে কল করতে হবে। তাতো এখন সম্ভব নয়। সান্ত্বনা দিলাম মাকে। ইতোমধ্যে বড় ভাইয়া মিডল ইস্টে চলে যাওয়ায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ হলো। আমি তখন ট্রেনিং শেষ করে ঢাকায় পোস্টিং এ এলাম। মাকে সাইবার ক্যাফেতে নিয়ে ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারের সামনে বসিয়ে দিলাম। মা চোখ মোছেন আর কাঁদেন। এই আমার মা। আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ আমার মা। কিন্তু সময়, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এখন আর মাকে সময় দিতে পারিনা। ফোনে মায়ের খোজ খবর নেই সাধ্যমতো। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা সেই চিরন্তন ও সার্বজনীন। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ ধারা চলে আসছে। যদিও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা মায়ের মর্যাদাকে ধূলি ধূসরিত করছে। যেমন শিশু সামিউলকে মায়ের সহযোগিতায় হত্যা, একটি অন্যতম ও ব্যতিক্রমী ঘটনা তবুও আমরা মাকে অনেক শ্রদ্ধা জানাই। আসছে মা দিবসে মাকে আমরা আর একটু বেশি বেশি স্মরণ করি। পরিশেষে জগতের সকল মায়ের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায় কামনা করে শেষ করছি
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহমুদা rahman চিরন্তন এক মায়ের গল্প......অনেক সুন্দর ..সাবলীল বলার ভঙ্গি...তবে গল্পে রূপান্তর করলে আরো ভালো লাগত ....ভালো থেক লেখা ভালো লেগেছে
নাসির হোসেন গল্প হয় নাই , ভালো প্রবন্ধ হয়েছে
আহমেদ সাবের সুন্দর স্মৃতিচারন।
মুজিবুর রহমান ভালো লাগলো গল্পটি ,
মামুন ম. আজিজ আপনার মাকে নিয়ে লেখা প্রশংসা বাণী সম্বলিত প্রবন্ধটি সত্যি নান্দনিক হয়েছে।
বিন আরফান. net slow , tai onek kicho lekha somvob holona. valo laglo . aro lekha chai. niyomito likhbe.
আহমাদ ইউসুফ হ্যা অািম নতুন। অাপনােদর মন্তেব্যর জন্য অেনক ধন্যবাদ।
এস, এম, ফজলুল হাসান প্রবন্ধ আকারে লিখেছেন বলে একটু খাপছাড়া মনে হচ্ছে , তবে ভালো ই হয়েছে , ধন্যবাদ আপনাকে
sakil সম্ভবত আপনি লেখ্লেখিতে নতুন . প্রবন্ধ আকারে লিখেছেন তবে তাতে দোষের কিছু নাই . আপনার লেখার হাত নিসন্ধে ভালো . আরো বেশি বেশি লিখবেন

২২ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী