বড় মা

উচ্ছ্বাস (জুন ২০১৪)

এফ রহমান
  • ৩৬
স্কুল থেকে ফিরে সিড়িতে ধুপধাপ শব্দ তুলে দোতলায় উঠে এলো উচ্ছ্বাস। দোতলার দক্ষিণ সারির একটা ঘরের দরজায় তার ছোট হাতে করাঘাত করতে লাগলো। ‘বড় মা দরজা খোলো’। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। এরকম তো কখনো হয় না। সে আরো জোরে শব্দ করে থাপ্পড় দিতে লাগলো কাঠের দরজায়। হাতের তালুতে রক্তের লাল আভা ফুটে উঠলো। গলার সুর আরো চড়িয়ে ডাকলো, ‘বড় মা! দরজা খুলছো না কেন? খাবার দাও। খিদে পেয়েছে’।
ভেতর থেকে অবশেষে সাড়া পাওয়া গেলো। খসখস শব্দ শোনা গেলো। কিন্তু দরজা খোলা হলো না। পরিচিত কন্ঠ শোনা গেলো।

‘খিদে লেগেছে তোর মায়ের কাছে যা। সাজুর মা আছে। তাকে খাবার দিতে বল। আমার শরীর আজ ভালো নেই।’
‘না। আমি তোমার হাতে খাবো’।

উচ্ছ্বাস দরজার দাঁড়িয়ে আরো কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু বড়মা আর কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছেন না। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খুটখুট করতে লাগলো। তবু আজ বড়মা দরজা খোলে না। উচ্ছ্বাস এবার সবে আটে পা দিলো। ক্লাস ফোরে পড়ে। রোজ সকালে বড় মা তাকে স্কুলের জন্য রেডি করে দেয়। বাবা অফিস যাওয়ার পথে নামিয়ে দেয়। বাসার কাছেই স্কুল। পাঁচ মিনিটের পথ। স্কুল থেকে হেঁটেই আসা যায়। কিন্তু ড্রাইভার গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। স্কুল থেকে ফিরেই দেখে বড়মা তার জন্য খাবার বানিয়ে রেখেছে নিজের ঘরে। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম কেন হলো সেটা সে বুঝতে পারছে না। পৌত্রের গলা শুনে উচ্ছ্বাসের দাদী রাজিয়া খাতুন এগিয়ে এসে তার হাত ধরলেন।
‘আসো দাদুভাই। আজ আমি তোমাকে কোলে বসে খাওয়াবো’।
উচ্ছ্বাস টেনে নেয়। যদিও দাদীজান তাকে খুব আদর করে কিন্তু সে তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। দাদীজান সবাইকে সারাক্ষণ বকাঝকা করে। দাদুকে, আব্বুকে, বড় আব্বুকে, বড় মাকে, সাজুর মাকে, ড্রাইভারকে সবাইকে বকে শুধু তার মা কে বকে না। কেন বকে না সেটা সে বলতে পারবে না।

‘না আমি বড় মার হাতে খাবো’।
‘রোজই তো বড়মার হাতে খাও। আজ না হয় আমার হাতে খাবে’।
‘না, আমি বড় মার হাতে খাবো’।

রাজিয়া খাতুন দাঁতে দাঁত চেপে অন্তরালবর্তিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বড্ড বড় মা হয়েছে। পেটে তো ছেলে ধরার ক্ষমতা নেই, কিন্তু জাদু করে ছেলে ভোলানোর ক্ষমতা তার ষোল আনা’।

পৌত্রের হাত ধরে টানতে টানতে রাজিয়া খাতুন নিয়ে গেলেন। কক্ষ অভ্যন্তরে সেলিনা দেঁয়ালের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। নিরবে চোখের জল গড়িয়ে যাচ্ছে। একবার আঁচল তুলে চোখ মুছে নিলো সে। অনেকগুলো বছর হয়ে গেছে বড় বউ হিসেবে এই বাড়িতে এসেছে সেলিনা। খুলনার মেয়ে, লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় ইংরেজী সাহিত্যে। তখন সে প্রথম ইয়ারে পড়ে। কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ্য করলো লাজুক স্বভাবের একটা ছেলে তাকে ফলো করছে। মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা ছেলেদের একটা রোগ বলা যায়। প্রথম প্রথম সে বিষয়টাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো। তবু ছেলেটা তাকে দূর থেকে ফলো করে। কাছে আসে না। কিছু বলে না। একদিন সে নিজেই আগ্রহ বোধ করে ছেলেটার সাথে কথা বললো। নাম সাদিক, অর্থনীতিতে পড়ছে। তার থেকে এক ইয়ার উপরে। ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে।

কিছুদিনের মধ্যে কিভাবে তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলো। মাস ছয়েকের মাথায় এই ভোলাভালা লাজুক ছেলেটা সেলিনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। সাদিকরা অনেক বড়লোক। সেলিনা মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সে সব কিছু ভেবে সাদিককে ফিরিয়ে দিলো। কিন্তু একসময় সাদিকের প্রচেষ্টার কাছে তাকে হার মানতে হলো। সাদিক সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে। অন্য বড়লোকের ছেলেদের মত তার গোপন কোন বদবাসনা ছিলো না। সাদিককে খুব কাছ থেকে দেখেছে সেলিনা। শেষের দিকে সেও কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা রোমান্টিক জুটি হিসেবে পরিচিত ছিলো। নিজের গাড়ি থাকা সত্বেও প্রতিদিন রিকশা করে রোকেয়া হলের সামনে এসে হাজির হত সাড়ে সাতটায়। সেলিনা বের হলে লাজুক একটা হাসি দিত। বড় লোকের ছেলেরা যে লাজুক হতে পারে তা সাদিককে না দেখলে সেলিনা বিশ্বাস করত না। সেলিনাকে ইংলিশ ফ্যাকাল্টিতে নামিয়ে দিয়ে সাদিক তার ডিপার্টমেন্টে চলে যেত। বিকেলে টিএসসির মোড়ে, ফুচকার দোকানে, জাতীয় গ্রন্থশালার সিঁড়িতে তাদের বিকেলগুলো রঙিন হয়ে উঠতো। সাদিক বড়জোর সেলিনার হাত দুটো ধরতো। সেলিনাই একদিন তাকে জড়িয়ে ধরলো। সাদিকের সেকি বিব্রত দশা। সেদিনের কথা মনে পড়লে সেলিনার আজো হাসি পায়। সাদিক কখনো তাকে বন্ধুর মেসে কি হোটেলের রুমে যাওয়ার প্রস্তাব করেনি।

পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা রোমান্টিক জুটি হিসেবে পরিচিত ছিলো। চারবছর পেরিয়ে গেছে। সেলিনা মাস্টার্সে পড়ে। সাদিকের পড়া শেষ। বাবার সাথে কাওরান বাজারের অফিসে বসচে। তাদের বেশ কিছু ইন্ডাস্ট্রি আছে। এই অসময়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যাডার সেলিনাকে উত্যক্ত করতে শুরু করলো। সাদিককে বলবেনা বলবেনা করেও একদিন বলে ফেললো। সাদিকের সেই রুদ্র মূর্তি কখনো সেলিনা দেখে নাই। সরকার দলীয় ছাত্র সংস্থার টেন্টে গিয়ে সেই ক্যাডারের কলার ধরে ঘুসাতে শুরু করলো। ক্যাডারের সাঙ্গপাঙ্গরা সাথে ছিলো। সবাই মিলে সাদিককে আক্রমন করলো। সাদিক অনেক মার খেলো সেদিন। ছয়টা সেলাই করতে হলো। হাসপাতালে রাজিয়া খাতুনের সাথে সেলিনার সেদিনই প্রথম দেখা হয়। রাজিয়া খাতুন ছেলে না জানালেও খবর রাখতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মেয়ের সাথে ছেলের সম্পর্কের কথা। তিনি খুব একটা আমল দেন নাই। আজকালকার ছেলেরা এরকম সম্পর্ক কয়েকদিন বাদেই চুকিয়ে ফেলে।

কিন্তু তার বোকা ছেলেটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতেই শেষমেষ কিনা এই হাড়হাভাতে ঘরের মেয়েটাকে বিয়ে করার কথা বললো। কি আছে মেয়ের বাপের? দু তিন বিঘে জমি। আর স্কুল মাস্টারীর চাকরিটা। সম্পত্তির লোভে এই মেয়েটা তার ভোলাভালা ছেলেটাকে হাত করেছে। রাজিয়া খাতুন কিছুতেই রাজি হতে পারেন না। সাদিকও অনড়। সে সেলিনাকেই বিয়ে করবে। অনেক বাধাবিপত্তি ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে তাদের বিয়ে হয়। এতে সেলিনার শ্বশুরের অনেক অবদান ছিলো। কম কথা বলা লোকটি বিষয় সম্পত্তির তুলনায় ছেলের ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিলেন। রাজিয়া খাতুনকে বোঝালেন তোমার আরো দুটি ছেলে আছে তাদেরকে তোমার পছন্দ মত বিয়ে দিও। মেজ ছেলে কথা দিলো সে মায়ের পছন্দমত বিয়ে করবে। ছোটটার তখনো বিয়ের বয়স হয়নি। বিয়ের বয়স হবে কি, সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। সে কাঁধ নেড়ে বলে, ‘কখনোই না। আমার বউ আমি নিজে পছন্দ করবো’। সেলিনার শ্বশুর তাকে মেয়ের মত যত্ন করতে লাগলেন। সেলিনাও একজন পিতা পেলো। রাজিয়া খাতুন প্রথম থেকেই দূরে দূরে রইলেন। তাদের সম্পর্কের বরফ গললো না।

ফ্যামিলি প্লানিংয়ের এই যুগে যখন বিয়ের তিন বছর হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের ঘরে কোন নতুন মুখ এলোনা তখনো রাজি খাতুনের সন্দেহ করার কিছু ছিলোনা। ততদিনে বড় বউয়ের সাথে তার সম্পর্ক সহজ হয়ে এসেছে। এত খোটা শুনেও সেলিনা কোনদিন শ্বাশুড়ির কথার প্রতিবাদ করে নাই। সে নিজেকে বোঝাতো সেও রাজিয়া খাতুনের জায়গায় থাকলে তার মত বিত্ত বৈভবের মাঝে বড় হলে তারও এরকম মন মানসিকতা গড়ে উঠতে পারতো। একদিন বড় বউকে ডেকেই বললেন তার মনের কথা। সেলিনা চুপ করে রইলো।

তারপর আরো তিনবছর কেটে গেলো। ততদিনে রাজিয়া বুঝে গেছেন সব। সেলিনা কখনো মা হতে পারবে না। সেলিনাকে দেখলে তার ঘেন্না হতে শুরু করলো। যা তা বলে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। জানতেন সফল হবেন না তবুও ছেলেকে বিয়ে করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। বিফল হয়ে মেজ ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আনলেন। নিজের পছন্দে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। দেখতে সুদর্শনা, মার্জিত ব্যবহার, বাপ তিন তিনটা ইন্ডাস্ট্রির মালিক আর কি চাই। বছর না ঘুরতেই মেজ বউ বাড়ি আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো।

বাংলা সিনেমা আর উপন্যাসে মেজো বউকে যেভাবে মূল্যায়িত করা হয় এই মেজো বউ ঠিক তার উলটো। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ছাত্রী ছিলো। প্রায়শই গুনগুন করে রবীন্দ্র সংগীত গায়। আমুদে প্রকৃতির। ব্যবহারে মার্জিত হলে কি হবে উচিত কথা বলতে ছাড়ে না। কি নিয়ে রাজিয়া খাতুন একবার তাকে বকাঝকা করতে শুরু করলে সে মুখের উপর বলে দিলো, ‘দেখেন মা, আমাকে ক্যাঁচতে আসবেন না। ভূল হয়েছে শুধরে নেবো। এটা নিয়ে সারাদিন কথা বলে বাড়ি মাথায় তোলার কি আছে’। রাজিয়া খাতুন কখনো মুখের উপর কথা শোনেন নাই। মেজাজী মহিলা বলে সবাই তাকে তোঁয়াজ করে চলে। হঠাৎ মুখের উপর প্রতিবাদ শুনে তিনি আর কথা খুঁজে পেলেন না। বহুদিন পর রাজিয়া খাতুন স্বামীর কাছে নালিশ করলেন। যে স্বামীকে সকাল বিকেল তিনি পেঁয়াজ কুচানোর মত কুচান। আসলে সাদিকের বাবার তুলনায় মায়ের বাপেরা অনেক সম্পদশালী ছিলেন। বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে বিয়ে করে সাদিকের বাবার জীবনটা অনেকটা পরাধীনের মত কেটেছে। বউয়ের নিয়ন্ত্রণের জাল তিনি ছিঁড়তে পারেননি। এজন্যই মূলত সাহস করে তিনি বড় ছেলের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সাদিকের বাবা রাজিয়াকে বললেন, ‘রাজু এটা কি বলো! সব মানুষ তো একরকম হয় না। একটু মানিয়ে চলতে তো হবে। সব বউয়ের সাথে ঝগড়া হলে তো লোকে তোমাকেই দোষ দিবে’। কথাটা রাজিয়ার পছন্দ হলো। সেই থেকে মেজ বউকে তিনি আর ঘাটাতে যান না।

মেজ বউয়ের সাথে তার মতের অমিল হতে লাগলো। ছেলেটার ডাক নাম রাখলো উচ্ছ্বাস। আরে উচ্ছ্বাস মানে কি? মেজ বউকে জিজ্ঞেস করাতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ টাইপের কি একটা খটোমটো অর্থ বলল। সেই কিছুই বুঝলো না। এই হিন্দুয়ানী নাম তার পছন্দ না। গিয়ে দেখো উচ্ছ্বাস হয়তো হিন্দুদের কোন চার মাথা আট হাতওয়ালা দেবতার নাম! তবুও রাজিয়া খাতুন মেজবউকে কিছু বলেন না। সব রাগ ঝাড়েন বড় বউয়ের উপর।

মেজবউয়ের বাচ্চা হওয়ার পর থেকে বড় বউ কিছুটা দূরে দূরে থাকতেন। শিক্ষিত আত্মীয়স্বজনেরা পর্যন্ত তাকে বাঁজা বলে কটাক্ষ করতে দ্বিধা করত না। কিন্তু মেজবউ নাছোড় বান্দা। সেলিনার কোলে বাচ্চাটাকে ছুড়ে দিত। রাজিয়া বিরক্ত হতেন এসব আদালিপনা দেখে। বাচ্চারা কথা বলার সময় আধো বলে বিশেষ একটা শব্দ উচ্চারণ করা শেখে প্রথম। কা, মা, বা, বু ইত্যাদি কোন শব্দ। উচ্ছ্বাস প্রথম মা বলা শেখে। বড় বউ তখন উচ্ছ্বাসকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে বসে ছিলেন। কোনায় ঝোলানো খাঁচায় ময়না পাখি দুটি আপন সুরে গান গাইছে। এরই মধ্যে উচ্ছ্বাস মা জাতীয় একটা শব্দ করলো। সেলিনার বুকের মধ্যে মোঁচড় দিয়ে উঠলো। সন্তানহীন এই নারী উচ্ছ্বাসকে বুকে চেপে ধরলেন। চোখ ফেঁটে কান্না এলো। এতদিন কষ্ট পেয়ে কাঁদছেন। আজ এই কান্না বড় সুখের। বড় বউয়ের উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন শুনে সাদিক ঘরে ছেড়ে বেলকনিতে চলে এলো। সেলিনাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা সাদিক অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। সে সেলিনার পাশে চুপটি করে বসে রইলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেলিনাকে সে ভালোবাসতো এবং অনেক শ্রদ্ধা করত। সেলিনার ব্যক্তিত্বের জন্য শ্বদ্ধা করত। তার বউ হয়ে আসার পরেও সেই শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে গেছে বিশেষ কিছু ঘটনার জন্য।

সেলিনা কখনো উচ্ছ্বাসের মা হতে চায়নি। নিজেকে চাচী বলেই চেনাতে চেষ্টা করে। উচ্ছ্বাসকে বলানোর চেষ্টা করাতো, ‘বলো বাবা চাচী’।
উচ্ছ্বাস বলতো, ‘চাচচ’
মেজ বউ শেখালো বড় মা, বড় আব্বু বলতে। বড় বউয়ের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে উচ্ছ্বাস মায়ের শেখানো ডাক শিখে ফেললো। বড় বউ হয়ে গেলো বড় মা। উচ্ছ্বাসের কচি মুখে মা ডাক শুনে তার মনের ভিতর উথাল পাতাল করত। সে ভূলেই যেত যে উচ্ছ্বাসের মা নয়। সারাক্ষণ উচ্ছ্বাসকে নিয়ে মেতে থাকত। রাজিয়া খোঁটা দেয়, ‘মা হওয়ার মুরোদ নেই তার আবার মা ডাক শোনার শখ!’

মেজ বউয়েরা সাধারনত বড় বউকে হিংসা করে। কিন্তু এই মেজো বউ বড় বউকে অনেক শ্রদ্ধা করে। কারণ সে বিশেষ একটা সত্য জানে। যে সত্য এবাড়ির আর কেউ জানে না। সবাই যে বড় বউকে বাঁজা বলে খোটা দেয় অথচ বড় বউ বাঁজা নয়। সমস্যা বড় ভাসুরের। কিন্তু ভালোবাসার টান এই সমস্যার সমাধান করেছে। বিয়ের মাস ছয়েকের মাথায় মাঝ রাত্রিরে তার ছাঁদে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। নিঝুম রাত ছাদের উপর অন্ধকার। সে এক কোনায় গিয়ে নিঃশব্দে গিয়ে বসলো। ছাদে যে আর কেউ থাকতে পারে এটা তার কল্পনাতেই আসে নাই। হঠাৎ চাপাকান্নার শব্দ শুনতে পেলো। যদিও সে ভূতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু গাঁয়ের ভেতর ছমছম করে উঠলো। বড় ভাসুরের গলা শুনতে পেলো। যদিও তার উচিত হচ্ছে না আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনা। কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের ঝোঁক বরাবরই বেশী থাকে। সে কান পেতে রইলো। বড় ভাসুর বড় ভাবীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ভাবী শুনতে চাচ্ছেন না। শেষের দিকের কথাগুলো ভাবী জোর দিয়ে বলায় স্পষ্ট শুনতে পেলো।

‘সাদিক, আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ভালোবেসেই মরতে চাই। না হয় এই জীবনে মা হতে পারলাম না। সবার সব ইচ্ছা আল্লাহ পূরণ করেন না। আমাদের ইচ্ছে নাহয় নাইবা পূর্ন হলো। তোমাকে ছেড়ে আমি মা হওয়ার লোভে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। তার থেকে মৃত্যু ভালো। আর তুমি এই ডাক্তারী রিপোর্টের কথা আর কাউকে বলতে পারবে না। আমার গা ছুঁয়ে বলো। কেউ তোমাকে ছোট ভাবুক এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো’।

মেজ বউ নিঃশব্দে চলে এলো। ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকলো। এত ভালো মানুষ কিভাবে বাসতে পারে! এত নিঃস্বার্থ ভাবে কি কাউকে ভালোবাসা যায়? পাশে তার স্বামী নিঃসাড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। এই লোকটার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। বৈবাহিক সূত্রেই তাদের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। এই মানুষটাকে কি সে বড় ভাবীর মত ভালোবাসতে পারবে? সে রাতে মেজ বউয়ের ঘুম হলো না। ভোররাতে সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো বড় ভাসুর বড় ভাবীর ভালোবাসার উচ্ছ্বাসের মূল্য সে দিবে। আল্লাহ যদি তাকে প্রথম যে সন্তান দেবেন তাকে বড়ভাবীকে দিয়ে দেবেন। তার ছেলে হলে নাম রাখবে উচ্ছ্বাস আর মেয়ে হলে ভালোবাসা। অনেকে বলবে, ভালোবাসা এ আবার কেমন নাম। বলে বলুক। সে মেয়ে হলে মেয়ের নাম ভালোবাসাই রাখবে।

রাজিয়া খাতুন উচ্ছ্বাসকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। মেজ বউ আবার প্রেগন্যান্ট, বেশীদিন বাকি নেই, খুব একটা রুমের বাইরে আসে না। উচ্ছ্বাসের চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজিয়া খাতুন উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন, ‘তুমি আবার বাইরে এলে কেন?’
‘মা, বড় ভাবীর কি হয়েছে?’
‘কি আর হবে। মাঝে মাঝে ঘরে দরজা দেবার অভ্যেষ আছে তার। এ আর নতুন কি!’
‘অনেক বছর তো হলো। এক বিষয় নিয়ে তাকে আর কত কথা শোনাবেন মা?’
‘এটা তুমি কি বললে বউ! আমি তাকে কথা শোনাই! আমার কথা তুমি কেন একবারও ভাবো না। আমার কি ইচ্ছে করে না বড় ছেলের একটা বাচ্চা দেখতে। সাদিকের জন্য কি আমার কলিজা পোড়ে না। অনেকে তো দুইটা বিয়ে করে। বড় বউ কি পারে না আমার ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করাতে’।
‘তুমিও তো মা নিজে থেকে বুঝে নিতে পারো’।
‘কি বুঝবো? কি বোঝাতে চাইছো তুমি?’
‘ধরো বড় ভাবী তোমার নিজের মেয়ে। এই অবস্থায় তুমি কি চাইতে জামাই আবার বিয়ে করুক?’

রাজিয়া খাতুন উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ করে বসে রইলেন। মেজ বউ উচ্ছ্বাসকে বললেন, ‘যা বড় মাকে বল দরজা খুলতে। আমাকে যদি সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হয় তাহলে মিস্ত্রি ডেকে দরজা ভেঙে দেবো। যাতে আর দরজা না দিতে পারে কখনো’।

উচ্ছ্বাস ছুটে গেলো বড় মা দরজায়। দরজায় সামনে গিয়ে ডাকলো, ‘ বড় মা দরজা খোলো। না হলে মা কিন্তু তোমার দরজা ভেঙে দেবে। তখন রাতে গলাকাটা ভূত এসে তোমার ঘরে ঢুকবে। ও বড় মা।’

বড়বউ শ্বাশুড়ীর কথায় আজকাল কিছু মনে করেনা। প্রতিদিনের মত আজ সকালেও তাকে ঠেস দিয়ে কাজের বুয়াকে শুনিয়ে কতগুলো কথা বললো রাজিয়া। সাজুর মা টেবিলে গোশতের গামলা নামিয়ে রাখার পর রাজিয়া গলার স্বর মাঝামাঝি স্কেলে রেখে বলল, ‘আল্লাহ আমরা তো অলক্ষীর হাতের খাবার খাচ্ছি, তুমি এই বাড়ীর আওলাদকে রক্ষা করো। যাতে কারো মন্দ ভাগ্যের ছোয়া লেগে তার কোন ক্ষতি না হয় সেটা তুমি দেইখো আল্লাহ’।

সেলিনা ভাগ্যে বিশ্বাস করে। সকাল থেকে তার মনে হতে লাগলো একজনের জন্য কি অন্যের ভাগ্য প্রভাবিত হয়! হোক আর না হোক সে উচ্ছ্বাস থেকে দূরে থাকবে। প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। যতই সে দূরে থাকার চিন্তা করছে ততই তার মন দূর্বল হয়ে পড়ছে। চোখের জলকে কিছুতেই বাঁধা মানাতে পারছে না। এখন উচ্ছ্বাসের ডাক শুনে সে আর কিছুতেই পাষানের মত স্থির বসে থাকতে পারলো না। দরজা খুলতেই উচ্ছ্বাস তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বড় বউ তাকে জড়িয়ে ধরলেন। উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন স্বরূপে আবির্ভূত হলো।

রাজিয়া খাতুন দোতলার দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘আল্লাহ, তুমি হতভাগীকে মা বানাও। তার মনের কষ্ট দূর করো’।

মেজ বউ রাজিয়া খাতুনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আল্লাহ তাকে মা বানিয়েছেন। বড় মা বানিয়েছেন। তার মত এত বড় মনের মানুষ আমি কখনো দেখিনি মা। মা তুমি তো কখনো উচ্ছ্বাস মানে বুঝতে পারো না। উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরার পর বড় ভাবীর চোখে যে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে এটাই উচ্ছ্বাস।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজ্ঞা মৌসুমী 'পৌত্র', 'অন্তরালবর্তিনী'- এই শব্দগুলো অনেকদিন পর দেখে অন্যরকম ভালো লাগলো। গল্পের থিমটা চমৎকার; প্রায় সব চরিত্র ভালো লাগলো। এমনকি শেষে এসে রাজিয়া খাতুনকেও দারুণ লাগলো। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই বাংলা সিনেমার মেঝ বউ সিনড্রোম থেকে বের হয়ে আসার জন্য। আমি নিজেও এখন মেঝ বউ :)... আমার ছোট বোনের সংসারে দেখেছি- ভাসুরের ছেলে-মেয়ে নেই বলে ওর ছেলে তাঁদের বাবা-মা বলে। আসলে পারস্পরিক ভালোবাসা, সমব্যথী হওয়া, পাশে থাকা -এইতো পারিবারিক মূল্যবোধ। অনেক শুভ কামনা
আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু মূল্যবান বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
আমি মনে করি একজন গল্প লেখক তখনই স্বার্থক যখন পাঠক তার লেখা পড়ে ভালো লাগার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ভালো থাকবেন।
রোদের ছায়া খুব মন ছোয়া একটা গল্প পরলাম, বাস্তবতাকে সামনে রেখে বেশ মানবিকতায় পূর্ণ গল্প। অনেক ভালো লাগা রইলো।
আপনার ভালো লাগায় আপ্লুত হলাম। ভালো থাকবেন।
রীতা রায় মিঠু গল্পটিকে নাট্যরূপ দেয়া যাবে, ঠিক তেমন গল্পই হয়েছে।
রীতাদি আপনার মন্তব্য আমাকে ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করেছে। মাথায় তো ভূত চাপিয়ে দিলেন। সত্যি কি নাটক হওয়া সম্ভব! মা সংখ্যায় আরেকটি গল্প লিখেছি। মতামত দিলে খুশি হবো। ভালো থাকবেন।
সৌমিক বিশ্বাস গল্পটি পড়লাম। অনেকটা ক্লাসিক গল্পের ছায়া আছে। লেখকের জন্য শুভ কামনা।
আপনাকে ধন্যবাদ জানাই সৌমিক ।
সুগত সরকার খুব ভালো লাগলো , শুভেচ্ছা রইল ....
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এফ, আই , জুয়েল # গভীর ভাবনার অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।
আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ এফ, আই, জুয়েল ভাই

০৪ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪