মেয়েটা হঠাত্ ভুনা খিচুড়ি খেতে চেয়েছে। সুরাইয়া বেগম তাই সব কাজ রেখে পোলাওর চাল দিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করছেন। একটু আগে পুরনো অস্টারমিল্কের কৌটা খুলে দেখেছেন মুগ ডাল প্রায় শেষ। টেনেটুনে বড় জোর এক মুঠো হবে। রাত ন’টার পর পাড়ার দোকানটাও বন্ধ হয়ে যায়। কোন উপায় অন্তর না দেখে সুরাইয়া বেগম তার ট্যাপা পড়া লোহার পাতিলে মুগ আর মসুরের ডাল একসঙ্গে মিলিয়ে টেলে নিয়েছেন। অন্তত মুগের ডালের গন্ধটা পাওয়া যাবে।
নাজিমুদ্দিন রোডের এই বাড়িটার রান্না ঘরটি মূল বাড়ি থেকে আলাদা। মূল বাড়ির পেছন দিকে একটা বারান্দা। বারান্দার পেছনে পাকা উঠোন। উঠোন পেড়িয়ে রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘর পাশাপাশি। তারও পেছনে প্রায় তিন কাঠা জায়গা নিয়ে ফলের বাগান। পাতিলে তেল ঢালতে ঢালতে সুরাইয়া বেগম দরজার দিকে তাকালেন। পেছন-বারান্দায় নবীনা পায়চারী করছে। তিন খিলান দেয়া লম্বা বারান্দা বরাবর একবার এ মাথা যাচ্ছে আরেকবার ও মাথা। হাঁটার সময় নবীনার মাথা বাচ্চাদের মত দুদিকে দুলছে। কেউ কান পাতলে শুনতে পাবে ও ফিসফিসিয়ে বলছে, ‘সিকোরস্কি, সিকোরস্কি’।
নবীনার বিয়েটা ছিল ছেলে-মেয়ের পছন্দের। সমবয়সী বলে দু’পক্ষের পরিবার থেকেই অসম্মতি ছিল। কিন্তু পাত্র-পাত্রির জেদের কাছে কোন আপত্তিই শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। মাস ছয়েক পর দু’পরিবারের মাখামাখি দেখে কে বলবে যে এটা অমতের বিয়ে ? স্বামীর মৃত্যুর পর তো সুরাইয়া বেগম কোন দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই মেয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
নবীনার বিয়ের তখন মাত্র দেড় বছর। নবীনা গর্ভবতী, চারমাস চলছে। দিনটির কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে সুরাইয়া বেগমের। জামাই ইকবাল একটা ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকুরী করে। ফরিদপুরে কোম্পানির একটা নতুন ব্রাঞ্চ খোলা হয়েছে। ইকবালকে ছ’মাস ফরিদপুর থেকে নতুন অফিস দাঁড় করিয়ে আসতে হবে। নবীনার আপত্তি ছিল কিন্তু ইকবাল বুঝিয়েছে এই চাকুরীটা ছাড়লে এই মুহূর্তে আর কোন চাকুরী মিলবে না। বড় বড় পোস্টগুলো এমনিতেই ওয়েস্ট পাকিস্তানের ছেলেগুলোর জন্য অ্যালোকেট করা থাকে। তা ছাড়া এই সুযোগে ইকবাল রাজবাড়িতে ওর অসুস্থ বাবাকেও কিছুদিনের জন্য কাছে পাবে।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের দুই তারিখ দুপুর একটা। ইকবাল, সুরাইয়া বেগম আর নবীনা বেবী ট্যাক্সি করে তেজগাঁও বিমান বন্দরে এসে হাজির হলো। রানওয়েতে বিরাট বড় একটা দুই ইঞ্জিনের কমার্শিয়াল হেলিকপ্টার। ইকবাল হেলিকপ্টারে চড়বে বলে সুরাইয়া মনে মনে ভীষণ গর্ব অনুভব করছে। কোম্পানি তো ইকবালকে বলতেই পারত তুমি বাসে যাও কিংবা লঞ্চ আর বাস মিলিয়ে যেভাবে পার যাও। কিন্তু তারা তা করেনি, ইকবালের গুরুত্ব অনুধাবন করে সবচেয়ে দামী বাহনটাই তারা ইকবালকে দিয়েছে। সুরাইয়া ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কি সুন্দর হেলিকপ্টার, রাজহংসীর মত। আমারও চড়তে ইচ্ছে করছে’
‘জান কত সময়ের জার্নি? মাত্র পঁচিশ মিনিটের। বোঝার আগেই শেষ। এই হেলিকপ্টারের নামটা কিন্তু আজব’
‘কি?’
‘সিকোরস্কি’
‘রাশিয়ান, না?’
‘অ্যামিরিকান, কিন্ত মালিক রাশিয়ান। চিন-পাকিস্তান যুদ্ধের কারনে পাকিস্তান সরকার ইস্ট পাকিস্তানে প্লেন সার্ভিস দিতে পারছে না। তার বদলে এই সিকোরস্কি হেলিপটারগুলোকে পাঠিয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলেই আবার ওয়েস্ট পাকিস্তানে নিয়ে যাবে।’
‘ওগো আমার বিমানবিহারী, তুমি এত কিছু জানলে কোত্থেকে ?’
‘আমার স্কুল ফ্রেন্ড শাহেদ অ্যাভিয়েশনে কাজ করে’
এসব বলতে বলতে ওরা তেজগাঁও এয়ারপোর্টে ঢুকে পড়েছিল। ঠিক দুটো তিন মিনিটে ইকবালকে পেটে পুরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের সাদা হেলিকপ্টারটা যখন ছোট হতে হতে আলো-ঝলমল আকাশে মিলিয়ে গ্যালো, নবীনা তখন তার ফুলে ওঠা পেটটা ডান হাতে চেপে বাঁ হাতে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে। বিয়ের পর কখনই তো সে ইকবালকে ছাড়া থাকেনি।
নবীনা আর সুরাইয়া বেগমের বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে গিয়েছিল। নবীনা কাপড় বদলে ফিলিপ্স রেডিওতে আকাশবানী কোলকাতা ঘুরিয়ে ফিরোজা বেগমের নজরুলগীতি শুনছিল। ঠিক চারটায় নজরুলগীতির বিরতি দিয়ে বাংলা খবর আরম্ভ হয়, ‘আকাশবানী কোলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দোপধ্যায়। প্রথমেই বিশেষ সংবাদ। আজ দুপুর দুটো তেইশ মিনিটে পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুর হেলিপোর্ট থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে পিআইএর একটি যাত্রীবাহী সিকোরস্কি এস সিক্সটিওয়ান হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। হেলিকপ্টারটিতে ২১ জন যাত্রী এবং তিনজন ক্রু ছিল। একজন যাত্রী ছাড়া আর সকলেই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এয়ারলাইন কর্মী জানিয়েছেন, একমাত্র বেঁচে থাকা যাত্রী আবু আহমেদ বিমান থেকে ইঞ্জিন অয়েল চুইয়ে পড়তে দেখেছেন। পিআইএ কর্তৃপক্ষ পূর্ণ তদন্তের আগে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে’। খবর শুনতে শুনতে নবীনার পেটের ডানদিকটা তীব্রভাবে মোচড় দিয়ে ওঠে। এর আধঘণ্টা পর সুরাইয়া বেগম ঘরে ঢুকে দ্যাখেন নবীনা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে আছে, দু পা রক্তে ভিজে গ্যাছে।
গর্ভপাতের পর নবীনা কেমন শান্ত হয়ে যায়। কোন মৃত্যুই যেন তাকে স্পর্শ করেনি। একে ওকে বলে ইস্ট পাকিস্তান এঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে হেলিকপ্টারের মেকানিক্সের উপর কয়েকটা বই আনিয়ে নেয়। দিনরাত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। মাস খানেক পর একদিন গভীর রাতে ঘন ঘন পায়চারীর শব্দে সুরাইয়া বেগমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সুরাইয়া বেগম কোমরের ব্যথা নিয়ে বারান্দায় ছুটে এসে দ্যাখেন, নবীনা বারান্দার এক দিক থেকে আরেকদিকে হাঁটছে, বিড়বিড় করে বলছে, ‘ইঞ্জিন অয়েল ফুরিয়ে গ্যালো, গিয়ারে ফ্রিকশন বাড়ল, গিয়ার ফেইল করল,সিকোরস্কি পড়ে গ্যালো। পড়বেই তো এতে অবাক হবার কি আছে?’। নবীনার গায়ে ছায়া আর ব্লাউজ ছাড়া কিছু নেই।
ঘটনার তীব্রতা দিনে দিনে বেড়ে যেতে লাগলো। নবীনা যখন তখন রাতের বেলা উঠে যায়, বারান্দায় চিৎকার দিতে দিতে হাত পা ছুঁড়ে দৌড়াদৌড়ি করে, বেশবসন অসংবৃত হয়ে পড়ে। উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজন আর অতিষ্ঠ পাড়াপড়শির চাপে নবীনাকে একসময় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। মাসে দু’মাসে একবার নবীনার পছন্দের খাবার রেঁধে নিয়ে তিনি মেয়েকে হাসপাতালে দেখে আসতেন। তারপর কিভাবে প্রায় পাঁচ বছর কেটে গ্যালো। অবস্থা কিছুটা স্থিত হওয়ায় এই তো গত সপ্তাহে তিনি হেমায়েতপুর থেকে মেয়েকে নিজের কাছে আনিয়ে রেখেছেন। এখন খিচুড়ি রাঁধতে রাঁধতে ভাবছেন, পাগল হোক আর যাই হোক মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখা ঢের ভালো। এই বৃদ্ধ বয়সে মেয়েকে তিনি আর কাছ ছাড়া করতে চান না। তাছাড়া একটা ক্ষীণ আশার আলো সুরাইয়ার বেগমের মনশ্চক্ষে ধুকপুক ধুকপুক করছে। এই যে মেয়েটা হঠাত্ খিচুড়ি খেতে চাইলো, এটা কি তার সেরে ওঠার লক্ষন নয় ?
খিচুড়ি রাধার পর সুরাইয়া পিয়াজ, মরিচ, ধনিয়াপাতা আর টমেটো মিলিয়ে খুব যত্ন করে ডিম ভাজা করলেন। টেবিলে খাবার বাড়ার পর নবীনাকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন বারান্দায় সে নেই। নবীনার ঘরে গিয়ে দেখলেন সেখানেও নেই। সবগুলো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও মেয়েকে না পেয়ে সুরাইয়া বেগম পেছনের বাগানে গেলেন। শুক্লা চতুর্দশীর রাত, আলাদা করে আলোর প্রয়োজন হলো না। কিন্তু নবীনা যে সেখানেও নেই। এই রাত এগারোটায় তিনি নবীনাকে আর কোথায় খুঁজবেন?
২
একহাতে ভারী ব্যাগ আর অন্যহাতে আলমারির দরজার সমান পারটেক্সের বোর্ড নিয়ে হাঁটাই মুশকিল। তারপরও ইদ্রিস যাদুকর জোরে হাঁটার চেষ্টা করছেন। ব্যাগটা বার বার বাম কাঁধ থেকে পিছলে হাতের কাছে নেমে আসছে। ইদ্রিস যাদুকর থেমে থেমে ব্যাগ ঠিক করে নিচ্ছেন। দিনের বেলা হলে কোন সমস্যা ছিল না। রিক্সা হোক, ট্যাক্সি হোক একটা কিছু জুটেই যেত। রাত বেশী হয়ে গেলেই মুশকিল। বিশেষ করে শেখ সাহেবের ভাষণের পর রাতগুলো যেন আরও নিঃশব্দ আর থমথমে হয়ে গ্যাছে। ঝড়ের আগের নিম্নচাপের মত।
ইদ্রিস যাদুকর হাত উঁচিয়ে ঘড়িটার দিকে তাকালেন। সেই নাইন্টিন সিক্সটি ফাইভের ঘটনা, ইদ্রিস যাদুকরের ছুড়ি খেলা দেখে মুগ্ধ ইস্পাহানি সাহেব নিজের বাম হাত থেকে খুলে এই রেডিয়াম ডায়াল সিকো ঘড়িটা ওকে উপহার দিয়েছিলেন। এই নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ানেও সেই ঘড়ি ঠিক দমে দমে চলছে। রাত বারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। নাহ, এর পর লালবাগের মেলায় আসার আগে ইদ্রিস যাদুকর দু’বার ভাববেন। পয়সা ভালো মেলে বটে কিন্তু রাত না হলে লালবাগের মেলা যেন জমেই না। এই বয়সে কি আর রাত করে বাড়ি ফেরা পোষায়?
হোসেনি দালান রোড থেকে নাজিমুদ্দিন রোডে মোড় ঘুরতেই টুং টাং চুরির শব্দে ইদ্রিস যাদুকরের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরও কুঞ্চিত হলো। সামনে একটা বেবুশ্যে মেয়েছেলে হাঁটছে না? ভালো করে তাকিয়েই ইদ্রিস যাদুকর তার ভুল বুঝলেন। চুল আলুথালু, মুখে কোন প্রসাধন নেই, পরিশিলিত সালোয়ার কামিজ, এ তো লাগে ভদ্রঘরের মেয়ে! রাত বাজে দেড়টা। এত রাতে এই মেয়ে এখানে কি করছে? বিপদে পড়েনি তো? মেয়েটা মনে হলো ফিস ফিস করে বলছে ‘কি করস কি, কি করস কি’। মেয়েটা কি অপ্রকৃতস্থ?
এই বয়সী একটি মেয়ে তার নিজেরও আছে। অচেনা মেয়েটির জন্য ইদ্রিস যাদুকর একটা করুণা আর দায়িত্ব অনুভব করছেন। ইদ্রিস যাদুকরের মনে হলো এই মেয়েটির জন্য নিশ্চয় কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও রাত জেগে অপেক্ষা করছে। মেয়েটিকে সেইখানে পৌঁছে দেয়া তার কর্তব্য। ইদ্রিস যাদুকর একটু দূরত্ব রেখে মেয়েটির পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন।
ঠিক এই সময় দূর থেকে ভারী গাড়ির কর্কশ আওয়াজ ভেসে এলো। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে রাস্তার শেষ মাথায় এখন দুটো জ্বলজ্বলে হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। মিনিট খানেকের ভেতর হেডলাইটের আলোর তীব্রটায় ইদ্রিস যাদুকরের চোখ ধাঁধিয়ে গ্যালো। ইদ্রিস যাদুকর রাস্তা ছেড়ে এক পাশে সরে দাঁড়ানোর সময় লক্ষ্য করলেন সামনের মেয়েটি রাস্তার মাঝখানে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর হেডলাইটের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলছে ‘হেলিকপ্টার, হেলিকপ্টার, অয়েল লিক হচ্ছে কিন্তু, অয়েল লিক’।
মেয়েটির সামনে এসে গাড়িটা কষে ব্রেক চাপলো। ইদ্রিস যাদুকর দেখলেন গাড়ি আসলে একটা নয় দুটো। টয়োটা কোম্পানির ছাদ খোলা মিলিটারি জিপ। সামনের জিপ থেকে একজন অফিসার আর দু’জন সৈনিক লাফিয়ে নেমে এলো। আধ মাইল দূরে নাজিমুদ্দিন রোডের কাছে জেলখানার সাইরেনটা হঠাত্ কি কারনে বেজে উঠেছে। ঘন ঘন গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। পেছনের জিপে আরও চারজন সৈনিক। অফিসারটি পেছনে গিয়ে কিছু একটা বলতেই পেছনের গাড়িটা নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে দ্রুত ছুটল। ইদ্রিস যাদুকর ঠাহর করতে পারছে না এসব কি হচ্ছে। আর্মি অফিসারটি এখন মেয়েটির কাছে চলে এসেছে। অফিসারটি অর্ধেক রাগ আর অর্ধেক লালসা মিশ্রিত কন্ঠে উর্দুতে জিগেস করলঃ
‘নাম কি তোমার’
‘নবীনা’
‘নবীনা? হিন্দু?’
‘সিকরোস্কি, পড়ে যাবে’
‘উর্দু জানো?’
‘মাত্র পঁচিশ মিনিট, বোঝার আগেই শেষ’
‘কলেমা জান?’
‘ইঞ্জিন অয়েল লিক করছে’
আমি অফিসারটির ক্রোধ দ্বিগুণ হয়ে গ্যালো। অফিসারটি যেন সহসা নিশ্চিত হলো নবীনা হিন্দু। নবীনার চুলের মুঠো ধরে টানতে টানতে সামনে সাইকেল পার্টসের দোকানের কাছে নিয়ে গ্যালো। জোর করে নবীনাকে রাস্তায় শুইয়ে দিয়ে আর্মি অফিসারটি তার উপর উপগত হলো। তারপর ধস্তাধস্তির শব্দ। পাঁচ মিনিট পর প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আর্মি অফিসার উঠে এসে বললো,
‘সৈনিকেরা, যাও গনিমতের মালে সব সাচ্চা মুসলমানের সমান হক’
সৈনিকরা যখন একজন একজন করে সাইকেলের দোকানের সামনে থেকে উঠে এলো ততক্ষণে নবীনার নাভির নীচ থেকে আরম্ভ করে পা পর্যন্ত রক্তে ভিজে গ্যাছে। ভয়ে আর ঘৃণায় ইদ্রিস যাদুকরের গা গুলিয়ে বমি আসছে। হাত দিয়ে নিজের মুখ কোন মতে চেপে ধরে ইদ্রিস যাদুকর শুনতে পেলেন নবীনা চিত্কার করে বলছে ‘মা কোথায়, মাকে না ভুনা খিচুড়ি রাঁধতে বললাম। মা, মা…’। ইদ্রিস যাদুকরের বা কাঁধ পিছলে ভারী ব্যাগটা এই সময় রাস্তায় পড়ে গ্যালো। ভারী লোহার ধাতব শব্দে সরু গলিটা যেন চমকে উঠলো। এই প্রথম খান সেনারা খেয়াল করল রাস্তার কোনায় অকেজো ল্যাম্প পোস্টের নীচের এক টুকরো অন্ধকারের আড়ালে কেউ একজন দাঁড়িয়ে কাঁপছে।
জোয়ান দুজন মহা উত্সাহে ইদ্রিস যাদুকরকে টেনে হিঁচড়ে অফিসারটির সামনে নিয়ে এলো। ইদ্রিস যাদুকরকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে অফিসারটি বললঃ
‘কে?’
‘আমি ইদ্রিস, স্যার’
‘কারফ্যুর সময় কি কর?’
‘কারফ্যু?’
‘একটা দশ থেকে থেকে কারফ্যু। দিজ ইজ কোয়ার্টার টু টু নাও। ইন ফ্যাক্ট দিজ ইজ দা মর্নিং অফ টুয়েন্টি সিক্সথ মার্চ’
‘জানতাম না স্যার’
‘পায়জামা খুলো’
‘জি স্যার?’
কিছু বোঝার সৈনিক দুজন ইদ্রিসের পায়জামা টান মেরে খুলে ফেলল। অফিসারটি ইদ্রিসের পুরুষাঙ্গের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
‘হুম, এর বেশী কাটলে তো আর কিছুই থাকতো না। হা হা হা। পায়জামা পড়’
ইদ্রিস যাদুকরের চোখে পানি চলে এসেছে, ইদ্রিস যাদুকর দ্রুত পায়জামাটা কোমরের কাছে টেনে নিল।
ক্যাপ্টেন এবার ইদ্রিস যাদুকরের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে জিগেস করল,
‘এই ঝোলায় কি ?’
‘কিছু না স্যার। খেলার সরঞ্জাম’
‘কিসের খেলা?’
‘ছুরির খেলা স্যার, নাইফ থোরোইং’
ইদ্রিস ব্যাগ উপুর করতেই লোহার বাঁটের কতগুলি ছুরি রাস্তায় গড়িয়ে পড়লো। ইদ্রিস যাদুকর আড় চোখে লক্ষ্য করলেন অফিসারটির জামার পকেটের উপর ছোট ট্যাগে লেখা ক্যাপ্টেন সুলায়মান।
ক্যাপ্টেন সুলায়মান বললো, ‘নাইফ থ্রোয়িং? বটে? বাইট্টা বামন বাঙ্গালীরা ছুরির খেলা জানে? তাজ্জব কান্ড। কয়টা ছুরি তোমার?’
‘দশ ছুরির খেলা। আমার চোখ বান্ধা থাকে স্যার’
‘দেখাও দেখি তোমার চোখ বান্ধা ছুরির খেলা’
একটা ইলেক্ট্রিক পিলারের সাথে ইদ্রিস যাদুকরের আলামারির দরজার সমান পারটেক্সের বোর্ডটা সাঁটা হয়েছ। সৈনিক দুইজন নবীনাকে কোন রকমে উঠিয়ে এনে বোর্ডের সামনে বেঁধে ফেললো। জিপ গাড়ির হেডলাইটের আলো নবীনার দিকে তাক করা। নবীনা ভাবলেশহীন।
ক্যাপ্টেন বললো,
‘এই বাজারি মেয়েছেলের হিন্দুয়ানী চামড়া ঘেঁষে ঘেঁষে ছুরি মারবে। সবগুলি নিশানা ঠিক হলে তুমি খালাস। যদি একটাও ভুল হয় তুমি খতম। সাচ্চা মুসলমানের এক বাত্। আর হ্যাঁ শেষ তিনটা ছুরি কই তাক করবে জানো ?’
‘গা ঘেষে স্যার?’
‘না। দুটো ছুরি গাঁথবে মালাওন বেটির দুই বুকে, এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফুটানো দ্যাখো নাই? ওই রকম। আর একটা ছুরি দু’পায়ের মাঝখানে জোড়া মতন, হা হা হা’। ক্যাপ্টেন সুলায়মান এখন তার হুইস্কি খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হায়নার মত হাসছে।
ইদ্রিস যাদুকর এই তল্লাটের সেরা ছুরিয়ালদের একজন। অনেক বড় মানুষ, সম্মানিত মানুষ ইদ্রিস যাদুকরকে বায়না করে খেলা দেখাতে নিয়ে যায়। সেই ফরমায়েশি খেলা হয় ভয়ঙ্কর আর রোমহর্ষক। ঘুরন্ত চাকতির মধ্যে সার্কাসের মেয়ে বাঁধা থাকে আর ইদ্রিস যাদুকর সাই সাই করে ছুরি মারে একের পর এক। চাকতির ঘূর্ণন গতি ক্রমশ বাড়তে থাকে, সেই সাথে বাড়ে ইদ্রিস যাদুকরের ছুটন্ত ছূরির তুরন্ত বেগ। ছুরি চলে সোজা মতন একটানে, বাতাসে কোন ঘূর্ণি না খেয়ে। এ তো খেলা নয় যেন বাহারি যাদু। এই জন্যই পাবলিক তাকে খেলুড়ে, খেলারাম এই সব বলে না, বলে যাদুকর।
ইদ্রিস যাদুকর প্রথম ছুরিটা হাতে নিলেন। হাতের তালুতে ছুরিটা নেড়েচেড়ে ভরকেন্দ্র স্থির করে নিলেন। ভালো করে লক্ষ্যের দিকে তাকানোর পর ইদ্রিস যাদুকরের দুচোখ কালো পট্টি দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে। ইদ্রিস যাদুকর আল্লাহর নাম নিয়ে প্রথম ছুরিটা ছুঁড়লেন। চোখের পলকে নবীনার কানের লতি ঘেঁষে ছুরি গেঁথে গেলো পারটেক্সের বোর্ডের ভেতর। নবীনার কোন বিকার নেই, ইদ্রিস যাদুকরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওই তো রোটর ঘুরছে, হেলিকপ্টার উড়বে এখুনি’
নিখুঁত নিক্ষেপে ভ্রুক্ষেপহীন নবীনার আশপাশ ঘেঁষে আরও সাত সাতটা ছুরি গেঁথে গ্যালো একের পর এক। ক্যাপ্টেন সুলায়মান উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘তুমি তো বহুত আচ্ছা। এবার শুরু কর খতম-খালাশ। একজন খতম তো একজন খালাশ। হা হা হা’
‘জি স্যার’ বলে ইদ্রিস যাদুকর নিশানা ঠিক করা আরম্ভ করলেন। প্রথমে ঘড়ির কাঁটার দিকে ৩০ ডিগ্রী, তারপর তার কাঁধের সমতল থেকে মাটির দিকে ১০ ডিগ্রী। ইদ্রিস অবশ্য এভাবে ডিগ্রীফিগ্রী হিসেব করছে না। সবই ঘটছে অভ্যাসের বশে। শব্দের তরঙ্গ আর বাতাসের সূক্ষ্ম নড়াচড়া আঁচ করে। হাতের টিপ তার অব্যর্থ, প্রতিটি পেশী, অস্থি আর চামড়া জানে ইদ্রিস যাদুকর কি চায়।
ইদ্রিস যাদুকর আট নম্বর ছুরিটি প্রক্ষেপ করলেন। কিছু বুঝবার আগেই ক্যাপ্টেন সুলায়মান মৃগী রোগীর মত মাটিতে আছড়ে পড়ে ছটফট করছে। লোহার বাঁটের উপর ‘সোনার বাংলা’ খোঁদাই করা ছুরিটা নিখুঁতভাবে গেঁথে গ্যাছে ক্যাপ্টেনের পুরুষাঙ্গে।
যন্ত্রণায় তড়পানো অফিসারের দিকে তাকিয়ে নবীনা যখন ক্লান্ত কন্ঠে বলছে ‘অফিসার তোমার তো মুসলমানি হয়ে গ্যালো। আগেই বোঝা উচিত ছিল হেলিকপ্টারের পাখায় ব্লেডের মতই ধার’ ঠিক তখুনি আরও দুটি ছুরির সূক্ষ্ম ফলা তির্যককভাবে ধেয়ে সিধিয়ে গ্যালো দুই আপাত কিংকর্তব্যবিমূঢ় সৈনিকের বুকে।
ইদ্রিস যাদুকর দৌড়ে গিয়ে নবীনাকে বন্ধনমুক্ত করলেন। ইদ্রিস যাদুকর নিয়ত করেছিলেন এই মেয়েটিকে বাসায় পৌঁছে দেবেন। এই মেয়েটি তো তার নিজের মেয়েও হতে পারতো। সাইকেলের দোকানের পাশ দিয়ে একটা সরু হাঁটা গলি ডানে ঢুকে গ্যাছে কোথায় কে জানে। নবীনাকে কাঁধে নিয়ে ইদ্রিস যাদুকর সেই বরাবর দৌড়ানো আরম্ভ করেছেন। দূরে আরেকটা মোটর গাড়ির শব্দ। চারজন সৈনিকসহ দ্বিতীয় জিপটা অন্ধকারের চেয়েও কদর্য আলো ফেলে এদিকেই ফিরে আসছে।