আমি আর আমার ভাগ্নে ড়াড্ডিম ‘সিদ্ধেশ্বরী মিষ্টান্নভাণ্ডারে’ বসে তাদের মিষ্টির ভাণ্ডার উদরসাৎ করছিলাম। সিলেটে এমনিতে ভালো মিষ্টি কেউ বানায় না বললেই চলে। বানায় না না-বলে বানাতে পারে না—বলাই ভালো। অনেকদিন ধরে খুঁজে-খুঁজে তাই আমরা এই দোকনটা বের করতে পেরেছি। এদের মিষ্টিটা মোটামুটি খাওয়া যায়। বেশ মোটা-মোটা।
এরা অবশ্য শুধু মিষ্টিই না, দেখলাম চা-ও বিক্রি করে। বেশ ভালো চা।
রসগোল্লায় পেল্লায় একখান কামড় দিয়ে ড়াড্ডিম বলল—মামা, ঈশ্বরী কী?
আমি বললাম—কী না; বল—কে। আমরা, মুসলমানরা, যাকে আল্লাহ বলি হিন্দুরা তাঁকেই ঈশ্বর বলে। অবশ্য শুনেছি,ওঁদের মধ্যে এই ব্যাখ্যা নিয়ে বেশ ক্যাঁচালও আছে। ঈশ্বরের স্ত্রী-রূপই হলো ঈশ্বরী। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরী বলে অবশ্য কিছু নেই—সৃষ্টিকর্তা একজনই।
আমার ভাগ্নে ড়াড্ডিমের আবার বাংলা ভাষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। উত্তর শুনে সে খাওয়া থামিয়ে চোখ বড়োবড়ো করে বলল—মামা! তাইলে তো ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে গেল!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম—কোন ব্যাপার?
ড়াড্ডিম বলল—এদের দোকানের নাম খেয়াল করেছ? সিদ্ধেশ্বরী মিষ্টান্নভাণ্ডার! সন্ধিবিচ্ছেদ করলেই ওটা হয়ে যায়—সিদ্ধ আর ঈশ্বরী! তার মানে দাঁড়াচ্ছে এরা ঈশ্বরীকে সিদ্ধ করে সেইটা দিয়ে মিষ্টি বানায়!
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম—তাই তো! আগে তো খেয়াল করি নি! কিন্তু ঈশ্বরীকে কি সিদ্ধ করা যায়? আর গরম পানিতে ফেলে সিদ্ধ করলেই বা তিনি চুপ করে বসে থাকবেন কেন?
কথা শেষ করে দেখলাম, দোকানের অনেক খদ্দেরই আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে! আমাদের পাশের টেবিলে বসা একজন মুরব্বি গোছের লোক তো ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—কী! এরা আমাদেরকে ঈশ্বরী সিদ্ধ করে খাওয়াচ্ছে?
পাশের টেবিলে বসা আরেক ভদ্রলোক মুরব্বিকে উদ্দেশ্য করে বললেন—আরে বসে পড়ুন, চাচামিয়া। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। যতো দাঙ্গাটাঙ্গা তো এই করেই বাঁধে।
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন—আমি একজন বাংলার প্রফেসর। সেই হিসেবেই বলছি—খোকা তুমিও শোনো—না, খোকা তিনি আমাকে বলেন নি, ড়াড্ডিমকেই বললেন।বললেন—এইখানে সিদ্ধ কথাটার মানে আসলে সিদ্ধি, সিদ্ধিলাভ।
তাঁর কথা শেষ হতেই ড়াড্ডিম চোখ বড়োবড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—মামা, তুমি না গতকাল বলেছিলে সিদ্ধি মানে গাঁজা! তার মানে, এরা আমাদেরকে গাঁজা আর ঈশ্বরী—দুটোই খাওয়াচ্ছে! কী সাংঘাতিক!
ড়াড্ডিমের উত্তরে প্রফেসর-ভদ্রলোক ভয়ানক চটে উঠে বললেন—আমি কি শুধু সিদ্ধি বলেছি? বললাম না যে, সিদ্ধিলাভ?
ড়াড্ডিম আমার দিকে তাকিয়ে তার ছানাবড়া-হয়ে-যাওয়া চোখকে বিশ টাকা দামের বড়োবড়ো রসগোল্লার মতো করে বলল—দেখেছ মামা, এরা সিদ্ধিলাভ করছে! মানে ওই সিদ্ধি বেচেই লাভ করে যাচ্ছে!
ড়াড্ডিমের কথা শেষ হতেই দোকানে বেশ একটা ক্যাঁচাল বেঁধে গেল। প্রফেসর ভদ্রলোক অবশ্য তারস্বরে কি যেন বলে যাচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ততক্ষণে বেশ একটা হইহই বেঁধে গেছে। ব্যাপার সুবিধের হচ্ছে না দেখে আমি ড়াড্ডিমের হাত ধরে তাড়াতাড়ি করে বিল মিটিয়ে দিয়ে দোকান থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলাম। বিল মেটানোর সময় দোকানদার আমার দিকে যেভাবে চাইল, মনে হলো পারলে ঈশ্বরী নয়—আমাকেই সিদ্ধ করে ফেলে!
আমি বাইরে এসে হাঁফ ছেড়ে ড়াড্ডিমকে বললাম—তুই বাপু আর ভিড়ের মধ্যে ওসব মানেটানে জিজ্ঞেস করতে যাস নে। বাংলা শেখা কি অত সহজ নাকি? জানটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে হচ্ছিল!
ড়াড্ডিম মুখ ভার করে বলল—কিন্তু তুমিই তো বলো—যে প্রশ্ন করতে জানে না, তার মগজ বলে কিছু নেই— সে মরার আগেই মরে গেছে।
আমি বললাম—কিন্তু প্রশ্ন করতে জানলেও যে মরার আগেই প্রায় মরেই যেতে হয়, আজকের আগে সেটা আমার জানা ছিল নাকি?
ড়াড্ডিম কিছু না বলে আমার হাত ধরে হনহন করে হাঁটতে লাগল।
এই হাঁটাহাঁটির ফাঁকে ড়াড্ডিমের নাম ড়াড্ডিম কেন—এটা ব্যাখ্যা করে ফেলা যাক।
আসলে, ছোটোবেলা থেকেই আমার মধ্যে একটু কবি-কবি ভাব আছে। প্রতি পূর্ণিমা আর অমাবস্যাতে ওটা একটু বেশি করে চাগিয়ে ওঠে। সেদিন ড়াড্ডিমরা সিলেটে আমার কাছে বেড়াতে এসেচে—পাঁচ বছর আগের কথা বলছি। ওর নাম তখন তানজিম। অবশ্য এখনও অনেকের কাছেই ও তানজিম। যাক গে। তো, ওকে দেখেই কবিতার পোকা আমার মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠল। আমি বললাম—
ওরে ও তানজিম
তুই যে ঘোড়াড্ডিম!
এরপর থেকে ওকে ডাকতে গেলেই তানজিম না বলে মুখ ফসকে ঘোড়াড্ডিম বেরিয়ে যেত! কিন্তু কদিন পর হিসেব করে দেখলাম, সবাই ওকে বলছে তানজিম—তান্ জিম্— মানে কবিতার হিসেবে স্বরবৃত্তে দুই মাত্রা। আমি বলছি ঘোড়াড্ডিম—ঘো ড়াড্ ডিম্—মানে তিন মাত্রা। অর্থাত্ অন্যদের চেয়ে একমাত্রা বেশি বলছি!
কিন্তু আমি কবি এবং সে কারণেই আলসে, তাহলে আমি একমাত্রা বেশি বলে কবিত্বশক্তির অপচয় ঘটাব কেন? কাজেই ‘ঘো’ ছেঁটে ফেলে ওর নাম হয়ে গেল শুধুই—ড়াড্ডিম! এবং মূল নাম তানজিমের সাথেও ড়াড্ডিমের দারুণ মিল!
তো, মিষ্টির দোকানে ওই কাণ্ডটা ঘটার পর আমাদের আর সাহস হয়নি সেখানে যাওয়ার। যদিও দু-সপ্তাহ পর থেকেই মনটা কেমন আনচান করে ওঠে—রসগোল্লার জন্য। চারিদিকে তাকালে শুধুই দেখি শূন্যতা! গোল্লা আর গোল্লা! রসগোল্লা নয়, রসছাড়াই গোল্লা। মনে হয় কী নেই, কী নেই! শেষপর্যন্ত মাসখানিক পর আর থাকতে না পেরে একদিন ড়াড্ডিমকে বললাম—চল যাই। দোকানদার হয়তো ঐ দিনের কথা ভুলেই গেছে। এতদিন মনে থাকে নাকি?
ড়াড্ডিম বলল—কিন্তু, আমাদের তো মনে আছে!
আমি বললাম—এইজন্যই তো রসগোল্লার কথা মনে করে ওটা ভুলতে চাইছি।
তো, যথারীতি আমরা ভয়ে-ভয়ে কাজিরবাজারের সেই সিদ্ধেশ্বরী মিষ্টান্নভাণ্ডারে গিয়ে ঢুকলাম। তখন সকালবেলা। সবেমাত্র বেচাকেনা শুরু হয়েছে। দু-তিনজন খদ্দের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। টেবিলে বসে ভয়ে-ভয়ে দোকানদারের দিকে
তাকিয়ে আমি বললাম—ইয়ে, পাঁচটা করে রসগোল্...
দোকানদার সামনের কাউন্টার থেকে হুট করে দোকানের ভিতরের দিকে চেয়ে তারস্বরে বলল—ওরে বিষ্টু, রামদা রেডি হয়েছে? আর চাপাতি?
ভিতর থেকে কে যেন, বোধহয় ঐ কেষ্টবিষ্টুই হবে, চেঁচিয়ে উত্তর দিল—এই তো হচ্ছে!
এরপর কী হলো সেটা বুঝতে নিশ্চয় কারও বাকি থাকার কথা না। আমি আর ড়াড্ডিম চেয়ার-টেবিল টপকে হুড়মুড় করে খদ্দেরদের গা-মাথার পর দিয়ে লাফিয়ে উঠে যে দৌড়টা সেদিন দিয়েছিলাম—থাক। সে কথা বলে আর মন খারাপ করা কেন!
এই ঘটনার দিন সাতেক পরে আমি আর ড়াড্ডিম কাজিরবাজারে গিয়েছি বাজার করতে, হুট করে সিদ্ধেশ্বরী মিষ্টান্নভাণ্ডারের মালিক নিমাই ঘোষের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে দেখেই আমরা না দেখার ভান করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছি, হঠাত্ উনি সামনে এসে রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন! আমরা তার হাত ছুটিয়ে কোন দিকে দৌড় দেব ভাবছি, এমন সময় তিনি মোলায়েম গলায় বললেন—আপনারা ঐদিন ঐভাবে হুড়মুড়িয়ে চলে এলেন কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম—এইটা আবার কোন ধরনের রসিকতা? চলে এলাম কেন, মানে! আপনি চাপাতি আর রামদা বের করতে বলেন নি?
নিমাই ঘোষ তো কথা শুনে হাসতে হাসতে উল্টে পড়েন আর কি! তিনি তার ভুঁড়িটা হাত দিয়ে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বললেন—ঐদিন কী বলেছিলাম, মনে আছে আপনার?
আমি মেজাজ গরম করে বললাম—সে-কথা কি ভোলার মতো? আপনি বললেন—‘ওরে বিষ্টু, রামদা রেডি হয়েছে? আর চাপাতি?’ আর তাই শুনে আপনার বিষ্টু বলল—এই তো হচ্ছে।
উত্তরে নিমাই ঘোষ দাঁত বের করে ভুঁড়িতে ঢেউ তুলে হাসতে-হাসতে যা বললেন তার মানে দাঁড়াল—রাম হলো তার দোকানের ম্যানেজার। সমবয়সী হলেও নিমাই ঘোষ তাকে রামদা বলেই ডাকে। আর চাপাতি হলো চা-পাতি—মানে চায়ের পাতি। ঐদিন ম্যানেজারবাবু একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে দোকানের ভিতর দিকে রেডি হচ্ছিলেন। আর বিষ্টুও চা-পাতি রেডি করছিল চা চড়ানোর জন্য। তাই চা-পাতি আর রামদা দুটোর খবরই একসাথে নেওয়ার জন্য নিমাই ঘোষ হেঁকে বলেছিলেন—ওরে বিষ্টু, রামদা রেডি হয়েছে? আর চাপাতি?
তো, নিমাই ঘোষের কথা শুনে হাসব না কাঁদব এই দোটানায় যখন ভুগছি ড়াড্ডিম তখন হো-হো করে হেসে উঠল—প্রায় নিমাই ঘোষের মতোই!
দেশটা গণতান্ত্রিক। অতএব, আমিও হাসিতে যোগ দিলাম।
১৩ নভেম্বর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪