পাষণ্ড টা আজও গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সাত দিন ধরে একি ভাবে আমার প্রাইভেটে যাবার সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ওপাড়ার ছেলে জ্যাক। নাম তার জেকি। পাড়ায় বলে বেড়ায় জ্যাক। পড়ালেখার ছিটেফোঁটাও নাই। এইচ. এস. সি নাকি দু 'বার ফেল করছে । মোটরসাইকেল নিয়ে দিন রাত টহল দেয়া কাজ। ঠোঁট দেখলেই বোঝা যায় চেইন স্মোকার,নেশাগ্রস্ত। কি নাকি রাজনীতি করে বেরায় এখন।
দু'দিন আগে কলেজ থেকে আসার পথে বৃষ্টি পড়ছিল। কোন রিকশা পাচ্ছিলাম না।হঠাৎ মোটরসাইকেল চেপে দুটো ছেলে পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি আর অঙ্কিতা দাঁয়িয়ে আছি।
কুদ্দুস , আমাদের পাড়াতেই থাকে। এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলল, নে এটা ধর।
আমি, কি এটা!!আমি কেন নেব??
কুদ্দুস, এটা ভাবীর জন্য,
অঙ্কিতার দিকে ইঙ্গিত করে ,বড় ভাই দিয়েছেন। মোটরসাইকেল এ বসা ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করে।আমি তাকাতেই চেহেরা চিনতে পেলাম। এই ছেলেকে কুদ্দুস আর কয় জনের সাথেই গলির মুখে দেখেছি। সে থেকে প্রতিদিন এই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি দেখেও না দেখার ভান করে হাঁটছি।গলির মুখে যেতেই, জ্যাক আমাকে ডাকল। আমি শুনেও না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগলাম।
এবার সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি চমকে উটলাম। বুক ধুক- ধুক করতে লাগলো। আশেপাশে তাকালাম কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। আমার শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো।
জ্যাক, কানে যায় না ডাকছি?
আমি,ঢোক গিলে,আমতা - আমতা করছি শুনতে পাই.....নি
আমার কথা শেষ না হতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলো কানে সমস্যা আছে ভাই।
জ্যাক,চুপ।
আমার চোখ ছলছল করছে।
জ্যাক, অঙ্কিতা কি বলেছে? কোন উত্তর নেই কেন?
তোমাকে না বলেছিলাম ওকে বলবে চিঠির উত্তর দিতে। তুমি বল নাই?
আমি, বলেছি।ও কোন উওর দিতে পারবে না বলেছে। একটু সাহস নিয়ে, আমাকে বিরক্ত করছেন কেন? আমি যা বলার বলেছি।
জ্যাক, ওকে তোমাকে আর বিরক্ত করব না।তুমি যাও।অতটুকু গলি হেঁটে আসতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
গলির মুখে ওপাশে আমাদের বাসা অঙ্কিতাদের গলির এপাশে।আমি এসে বাসার সামনে দাঁড়ালাম।অঙ্কিতা দাঁড়িয়েই ছিল।
দুজন মিলে স্যারের বাসায় যাচ্ছি। আমি সব খুলে বললাম। ও মুখে একটা চিন্তার ছাপ।
মুখ টা কালো করে ফেলেছে। ওর ভেতর টা আমি পড়তে পারছি।
অঙ্কিতা,প্রেরণা তুই ঝামেলায় পড়ছিস না আমার জন্য। আমি,তোর জন্য কেন পড়বো? এটা তো আমার সাথেও হতে পারত।
অঙ্কিতা, বাবা জানতে পারলে আর বাসা থেকে বের হওয়া হবে কিনা ভাবছি। কেন এমন হয় বলতো দোষ করবে অমানুষ গুলো তার জন্য মেয়েদের কেন ভুগতে হবে? রিপা রেগে কথাটা বলল।
আমি ও তাই ভাবছি। আমরা কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেছি।
স্যার এর বাসা থেকে বের হয়েছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে তখন, আমারা ফিরছি।
হাঁটছি , হঠাৎ পাষণ্ড টা এসে হাজির। পথ আগলে দাঁড়ালো।অঙ্কিতা কে বলল, উওর পাইনি কেন?
অঙ্কিত,আপনি আর আমাকে বিরক্ত করবেন না। প্রেরণা কে বিরক্ত করবেন না। খুব দৃঢ় ভাবে কথা গুলো বলল সে। পথ ছাড়ুন।
জ্যাক, এখন ই এত বিরক্ত হলে চলবে?
ঘরে নিয়ে গেলে আরও কত বিরক্ত সহ্য করতে হবে। এখন থেকেই না হয় একটু অভ্যাস থাকুক।
অঙ্কিতা,আপনি একটু বেশি ই ভাবছেন যা কখনোই সম্ভব না।
জ্যাক,সময় কথা বলবে। কোন ছেলের সাথে যাতে তোমাকে না দেখি। অঙ্কিতা,আপনাকেও যাতে আর এ পাড়ায় না দেখি। আমি ওর দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি । এবার যদি শিক্ষা হয় পাষণ্ড টার।
মোটরসাইকেল আওয়াজ তুলে হর্ন দিতে - দিতে পাষণ্ড টা চলে গেল।
আমি,অঙ্কিতা.....
হুম।
এভাবে কিভাবে বলতে পারলি তুই!! আমি তো ভয়েই মরে যাচ্ছিলাম । অঙ্কিতা, কাল থেকেই ভেবে রেখেছি সামনে আসলে কি বলব । মা বলেন, কোন প্রতিবন্ধকতা এলে তা শক্ত হাতে দৃঢ় থেকে দমন করতে।
আমরা বাসায় চলে আসলাম । এভাবে কয়েক দিন চলে গেল পাষণ্ড টাকে আর দেখি নি। আমরা ভয়ে- ভয়ে থাকি । কয়েক দিন না দেখে ভাবি রিপার কথায় কাজ হয়েছে । সেদিন কলেজ থেকে ফিরছি । হঠাৎ পাষণ্ডটা পথ আগলে দাঁড়ালো আবার । আমি আর অঙ্কিতা চোখাচোখি করলাম। মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না।
জ্যাক, কয় দিন বাহিরে যেত হলো কাজে। তোমাকে দেখতে এলাম রিপা।
আমরা দ্রুত একটা রিকসায় উঠে পড়ি । জ্যাক পিছন- পিছন আসছে । ভয়ে কাঁপছি দুজন । রিপা আর আমি দুজন দুজনার হাত ধরে রেখেছি ।
মফস্বল শহর এটা । কোন মুরুব্বী দেখে ফেললে আমাদের ই খারাপ ভাববে। কিছু করো আর না করো সব দোষ ঐ মেয়েদের।
বড় রাস্তা থেকেই চলে গেল জ্যাক।
দুজন মিলে ভাবছি কাকে বলা যায় ?
আমরা বাসায় ফিরলাম।
বিকেলে দুরুদুরু বুকে বাসা থেকে বের হয়েছি।
উঁকি দিয়ে দেখলাম গলিতে কেউ আছে কিনা।
কাউকে দেখতে পেলাম না । হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তবুও ভয় নিয়ে অঙ্কিতার বাসার সামনে গেলাম ।
অঙ্কিতা দাঁড়িয়ে আছে । পড়া শেষে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
স্যার,"কিছু বলবে"?
অঙ্কিতা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে । আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে বলব।
স্যার,"কোন সমস্যা? বলো কি বোঝনি, এতে এত লজ্জা পাবার কি আছে"?
আমি,স্যার বিষয় টা পড়া নিয়ে নয়। অন্য কিছু নিয়ে।
স্যার, "কি নিয়ে? এত ভয় পাচ্ছ কেন? বলো"।
আমি, স্যার ও পাড়ার জ্যাক সে আমাদের কলেজে, বাসার সামনে, প্রাইভেটে সব খানে ডিস্টার্ব করে । রহমত চাচার ছেলে কুদ্দুসও তার সাথে থাকে।
স্যার,চিন্তিত একটা ভাব নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,কত ছাত্র আমার হাত দিয়ে মানুষ করলাম। সবাই বাড়ি এসে সালাম করে ।
আর একেই মানুষ করতে পারলাম না। অমানুষ হলো একটা। তোমারা চিন্তা করো না যাও। আমি দেখছি।
স্যার কে সালাম দিয়ে বের হয়ে আসলাম আমারা।
কিছুদূর এগোতে ই দেখি পাষণ্ড টা দাঁড়িয়ে আছে। আমারা দম বন্ধ করে হাঁটছি। মনে হল কেউ ছবি তুললো । দুজনই তাকিয়ে দেখি জ্যাক এর হাতে মোবাইল।
আমি কিছু একটা বলতে যাব অঙ্কিতা আমাকে থামিয়ে দিল।
সিদ্ধান্ত নিলাম দুজনই বাসায় গিয়ে সব বলে দিব । আমি মাকে গিয়ে সব বললাম । মা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন । বাবা আসলে সব খুলে বললেন বাবাকে। বাবার মুখে ভয় দেখতে পেলাম।
মা, তুলি...অঙ্কিতা কল করেছে।
আমি,অঙ্কিতা ....
ও পাশ থেকে, মা কে সব বলেছি।শুনে মা কাঁদছে।বাবাকে সব বলেছে। বাবা এখনই স্যার এর বাসায় যাবেন।
আমি,বাবাকেও মা সব বলেছে।
অঙ্কিতা,আব্বু কথা বলবে আঙ্কেল এর সাথে।
আমি, ওকে দিচ্ছি।
আমি, বাবা আঙ্কেল কথা বলবেন।
বাবা, আসসালামু আলাইকুম।
জ্বী, আমি আসছি এখন ই।
বাবা, আমি বের হচ্ছি অঙ্কিতার আব্বু স্যার এর বাসায় যাবেন। কথাটি যেন আমারা ছাড়া আর কেউ না জানে।
আমরা, আচ্ছা।
আম্মু, সাবধান এ যেও।
আমি সারা ঘর পাইচারি করছি। কি হলো ভাবছি। ছবিটা কি পাওয়া গেল?
অঙ্কিতাকে কল করলাম,সেও চিন্তিত।
বাবা আসলেন পাক্কা দুই ঘন্টা পর। এই দুই ঘন্টা টাকে দুই বছর মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল ঘড়ি কাটা বড় ক্লান্ত। চলতে বড় দেরি করছে।
আমি, এক রাশ উৎকন্ঠা নিয়ে, বাবা কি হলো ছবিটা পেয়েছো?
বাবা,স্যার এর বাসায় গেলাম রিপার আব্বু আর আমি। স্যার সহ জেকি দের বাসায়।
সে বাসায় ছিল না।
তাকে কল করে আনানো হলো বুঝানো হলো। স্যার ছবি ডিলিট করে দিয়েছেন।
সবাই বুঝিয়েছি।
ওর বাবা অসুস্থ আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন তার ছেলের হয়ে।
আর বোধ হয় ডিস্টার্ব করবে না।
রাস্তায় কাউকে দেখি নি। মা দিয়ে আসেন আন্টি রিপার আম্মু নিয়ে আসেন। এভাবে সপ্তাহ খানেক চললো। রাস্তায় আর তাদের দেখা যায়নি।
একদিন আমার খুব জ্বর হলো আমি সেদিন প্রাইভেটে যাইনি।
সন্ধ্যায় অঙ্কিতার আম্মু কল করলেন। মা আন্টি কে বললো আমার খুব জ্বর আমি আজ যাইনি।আর রিপা আমাদের বাসায় আসেনি।আন্টি আমাকে চাইলেন।
হ্যালো, আন্টি....
আন্টি,আজ বাসায় মেহমান এসেছিল আমি আনতে যেতে পারিনি। স্যার এর বাসায় কল করেছিলাম উনি বললেন ছুটি হয়ে গেছে সবাই চলে গেছে।অঙ্কিতা তো ফেরেনি এখনও। তোমার কাছে কার কার নাম্বার আছে আমাকে দাও। তুমিও একটু খোঁজ নাও।
আমি সবাই কে কল করলাম কারও বাসায় যায় নি সে।
আমি আর আম্মু অঙ্কিতাদের বাসায় চলে গেলাম। সবাই কে জানানো হলো।
সবাই মিলে অঙ্কিতাকে খুঁজতে বের হয়েছি আমরা।
স্যার এর বাসা পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন।
তার পাশেই একটা বন। ঝোঁপ ঝাড় গুল্ম আর গাছে ভরা। খুব বেশি বড় না হলেও ছোট ও নয়। অন্ধকারে ভয়ঙ্কর লাগে তাকাতে। আমরা খুঁজতে খুঁজতে বনে ঢুকে পড়লাম। গোঙনির আওয়াজ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। আমারা এগোচ্ছি সেই শব্দ লক্ষ্য করে। আমি ভয়ে পা ফেলতে পারছি না। আমার পা যেন আর চলছে না টলে যাচ্ছে। সবাই দৌড়াচ্ছে।
আমরা শব্দ টার কাছে চলে এসেছি। আমি অঙ্কিতা বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে তার পাশে বসে পরি।অঙ্কিতার মা জ্ঞান হারালেন।অঙ্কিতার মুখ বাঁধা,পেছন থেকে হাত বাঁধা।শরীরের কাপড় ক্ষতবিক্ষত।আমি আমার ওড়না দিয়ে ওকে ঢেকে দেই।মুখ খুলে দেই।হাত খুলে দেই।অঙ্কিতা শুধু বাবা বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়।আমার ছোট ভাই রাহাত পানির জন্য দৌঁড়ে যায়।অঙ্কিতা আর আন্টির মাথায় পানি দেই।আন্টি কথা বলেন।তবে তার দুচোখ জুড়ে শুধু শুন্যতা।অঙ্কিতাকে ধরে তার চোখ দিয়ে শুধু অশ্রুর ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।সবাই কাঁদছে।
এ্যাম্বুলেন্স আসে আমারা অঙ্কিতাকে হসপিটালে নিয়ে যাই। সারা রাত বারান্দায় বসে থাকি সবাই। অঙ্কিতার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু কারও কথা বলা বারণ। জ্ঞান ফিরলেই সে পাগলারে মত চিৎকার করছে। তাকে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
মেডিকেল চেকআপ হয়। দুদিন পর তাকে বাসায় নিয়ে আসি আমারা । আঙ্কেল জেকি, কুদ্দুসদের আসামি করে থানায় জিডি করেন । আমি অঙ্কিতার সাথেই আছি সার্বক্ষণিক । এর মাঝে একটি কথাও বলেনি সে। শুধু হাত ধরে বসে থাকে, শুন্য দৃষ্টি। ঘুমের মাঝে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। চোখে বিরামহীন পানির ফোয়ারা। এই দুই দিন পানি ছাড়া তাকে কিছুই খাওয়াতে পারিনি। নিজেও মুখে কিছু তুলতে পারিনি। কোন কিছু ই ভাবতে পারছি না। আন্টি কাঁদতে - কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আঙ্কেল নিরবে কেঁদে চলেছেন। মা খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু সবাইকে খাওয়াতে ব্যার্থ হন। শোকে ছেয়ে গেছে মন- ঘর। আশে পাশের মানুষ জেনে যায়। প্রেস আসে। পুলিশ আসে । অঙ্কিতা নিরব। আঙ্কেল বাকরুদ্ধ। বাবা কথা বলেন প্রেস এর সাথে, পুলিশ এর সাথে। জেকি আর তাদের দলের সবাই পলাতক। কাউজেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।অভিযান চলছে বলে জানান থানার ওসি। আতস্থ করেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে সব ঘরে - ঘরে। প্রত্যেক ঘর মেয়েদের নিয়ে ভীত। অঙ্কিতা আগের মতোই।তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি আস্তে - আস্তে। সকালে তাকে রেখে আমি বাসায় আসি । প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিতে। আন্টি সার্বক্ষণিক তার পাশে।এর মাঝে ই ফোন আসে।আমি আর মা ছুটে যাই।অঙ্কিতার নিথর দেহটা পরে আছে, বিছানায় । তাকে জড়িয়ে ধরে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।বলি সব দোষ আমার আমি তোকে রেখে চলে গিয়েছিলাম।
যদি না যেতাম তবে আমার ছোট বেলার সখি , আমার খেলার সাথি, আমার সুখ - দুঃখের সাথি, আমার অভিমানে চোখ মুছে দেয়া এই মানুষ টাকে আমি হারাতাম না।নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারব না।অঙ্কিতা দুপুরে ঘুমিয়ে গেলে আন্টি গোসল করতে যান। বারান্দায় কাপড় নাড়বার মোটা রশিটি নিয়ে দরজা চাপিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে । কিন্তু কেউ বোঝেনি তার মনে কি ছিল!সে হয়তো ঘুমায় নি। ঘুমের অভিনয় করেছিলো মাত্র।
অঙ্কিতকে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসি। কেঁদেছে পাড়ার ছোট বড় বৃদ্ধ সবাই । এ পাড়া ও পাড়া থেকে মানুষ এসেছে তাকে দেখতে।
আমার অঙ্কি আমার সখি আমি আর কার সাথে অভিমান করবো? আমার জন্মদিনে কে আর এমন করে পাগলের মত ভালবাসা দিবে? কথার খই ফুটতো যে মুখে সে মুখ এখন কেবল ই ছবি। যে পায়ে ধ্বনিত হতো নৃত্যের সংগীত। সেই পা আর কোন দিন বাজাবে না সুর । এ মেনে নেয়া যে কি কষ্টের তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেঁদে প্রকাশ করা যায় না। মনের ভেতর হাতুড়ি পিটিয়ে চলছে কে সারাক্ষণ।
আমারা তো দুই মায়ের পেটে জন্ম নেয়া দুই বোন। আজ আমি আমার বোন কে হারালাম। হারালাম আমার আর একটি পৃথিবী।
দেখতে দেখতে দিন চলে যাচ্ছে। পাষণ্ড টার খোঁজ পায়নি এখন ও পুলিশ। কোন খবর ও দিতে পারছে না।
কিছুদিন মানববন্ধন হলো স্কুল কলেজ গুলোতে। পত্রিকা, টেলিভিশন এ খবর হলো। দিন গেল অন্য খবরের নিচে চাপা পড়ে গেল আমাদের অঙ্কিতা ।
কয়েক দিন হা হুতাশ করলো সবাই।অঙ্কিতার পরিবার বাসা বদলিয়ে ফেলল।আন্টি এবাসায় এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে পারবেন না। সবাই পরামর্শ দিল বাসা বদলানোর।ওনারা চলে গেলেন। রেখে গেলেন কিছু শুন্যতা আর কিছু স্মৃতি।
আস্তে আস্তে দিন চলে যাচ্ছে। মা আমাকে কলেজ প্রাইভেট সব খানেই নিয়ে যান নিয়ে আসেন।
মার সাথে ঠিক যাই আসি।কিন্তু কোন কিছুতেই আমি আমাকে খুঁজে পাইনা।
পাতাঝরা বসন্তের দিন গুলোতে যখন হাসির স্রোত বয়ে যেত,সেই দুপুর গুলো বিষণ্ন থেকে বিষণ্ন হতে থাকে। মেহগনি পাতা গুলো ঝরে যেতে থাকে যেভাবে মন খারাপ নিয়ে,তখন বাতাস যেমন বিষন্ন মনে বরে যায় তাদের ঝরে পরা দেখে শোক শ্লোক গায়।
দুপুর গুলো এভাবে খাঁ খাঁ করে।কোথায় যেন সুর কেটে গেছে।
মার পরিশ্রম দেখে লুকিয়ে কাঁদি।মনে হয় আজন্ম পাপ আমার মেয়ে হওয়া আর তার প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রকৃতি।মা কে কষ্ট দিয়ে,কে কেড়ে নিয়ে। কি দোষ ছিল অঙ্কিতার? কি দোষ এই মায়েদের, বাবাদের? এই বয়সে সংসারের সব কাজ করেও আমাকে নিয়ে ছুটোছুটির!!
ইচ্ছে করে এই সমাজ টাকে লন্ডভন্ড করে দেই। ভেঙে দেই সব লোক দেখানো কাঠামো। যারা আমার অঙ্কির শ্লীলতাহানির দোষীদের এখনও ধরতে পারে না!! তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের ধরতে পারে না? এ সমাজ কাঠামো দিয়ে আমি কি করব? আমার অঙ্কির মত আর কয়টি প্রাণ গেলে এই সমাজ বদলাবে? আর কয়টি মার বুক খালি হলে তাদের ঘুম ভাঙ্গবে! এর পরের বলি যে আমি নই তার নিশ্চয়তা কি আমি দিতে পারি? এ সমাজ আমাকে দিতে পারে? যদি দিতেই না পারে তাহলে এসমাজ আমি মানি না। এই ঘুনে ধরা ভঙ্গুর সমাজ দিয়ে আমরা কি করবো? খাঁচায় পোষ মানানো তোতা পাখি হব? খাঁচায় থাক তাহলে তুমি নিরাপদ। তোমাকে বিড়াল খাবে না।
আর পারছি না মাথা টলে টলে উঠছে। পা গুলো অসার অবশ হয়ে আসে আজ কাল। চোখ খুলে দেখবার আগেই চোখ বন্ধ করে দেয়।
সন্ধ্যায় যখন গোধূলির কমলা রঙ ছেয়ে যায় আকাশ, আমি বাড়ি ফিরি মার পাশে পাশে পা ফেলে। নুপুরের সেই ধ্বনি আমার কানে বাজে। মনে হয় রিপার সব টুকু রক্তের লাল রঙ শুয়ে নিয়ে এই গোধূলি এত রক্তিম হয়ে উদয় হয়েছে।অঙ্কিতা কে আমি শেষ বেলায় ফেকাসে হয়ে যেতে দেখেছি।
আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি একটা উচ্ছ্বসিত মন। আমার অঙ্কিকে আমার কাছ থেকেই কেড়ে নিল। এ দায় কার? সমাজ আজ নষ্টের দিকে। এভাবেই কি হারিয়ে যাবে এক একটি অঙ্কি? এক একটি তুমি, আমি?
উওর পাইনি খুঁজে। ব্যাথা ভরা মন নিয়ে চলেছি পথ।
দেখতে দেখতে এইচ.এস. সি টেস্ট পরীক্ষা চলে আসে।
পরীক্ষার প্রথম দিন অঙ্কিতাদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি । তাকালাম বাসা টার দিকে। মন হুহু করে উঠলো। আজ আমার সাথে তার ও যাবার কথা ছিল।
পরীক্ষা শেষ হল। এখন শুধু ফাইনালের জন্য প্রস্তুুতি। কলেজ এ যাওয়া আসা বন্ধ হল।
এর মাঝেই বাবা বাসা খুঁজে ফেলেছেন।
আমারও এ পাড়া থেকে চলে যাবো। আজ বাসা বদলের দিন। দুদিন আগে থেকেই গোছানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। খাট থেকে শুরু করে সব গোছানো শেষ। মাটিতে তোষক পেতে শুয়েছি রাতে সবাই।
গোছগাছ চলছে। আমি মাকে সাহায্য করছি। ইলেক্ট্রিশিয়ান এসেছে। ফ্যান গুলো খুলছে। আমি তাকিয়ে আছি উপরে। এটাতেই তো ঝুলে প্রাণ দিল আমার সখি। সেই থেকে সিলিং ফ্যান দেখলে আমি ভয় পাই। চোখের সামনে অঙ্কিতার ঝুলে থাকার ছবি ভাসে।
বাবা তাই আমার ঘরে সিলিং ফ্যান খুলে টেবিল ফ্যান কিনে দেন।
যাবার সময় যত দূর পর্যন্ত অঙ্কিতাদের বাসাটা দেখা যায় তাকিয়ে চোখ ভিজিয়েছি।
নতুন বাসায় চলে আসলাম। অনেক কাজ।
তিন দিন ধরে সব গুছানো হলো।
সামনে পরীক্ষা পড়ার প্রেসার বেড়ে গেল।অঙ্কিতা আর আমার ছবি বাঁধাই করে টেবিলে রেখে দিয়েছি।
পরীক্ষা শুরু হল আজ থেকে। পরীক্ষা হলে গিয়ে সামনে থেকে পেছেনে তাকাই দেখি মিষ্টি একটা মেয়ে আমাকে দেখে হাসছে। বলছে ভাল করে পরীক্ষা দিবি। আমি হাসতে পারিনা। ছায়া টা হারিয়ে যায়।
বাসায় ফিরি। অঙ্কিতার ছবি টা বুকে জড়িয়ে কাঁদি।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। ভর্তি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি এখন।
টেবিলে বসে পড়ছিলাম।
মা,প্রেরণা.... আজ মেহমান আসবে বিকালে তৈরী হয়ে থেকো।
আমি,কে আসবে মা?
মা,তোমার বাবার বন্ধুর পরিবার।
সন্ধ্যায় মেহমান এসেছে। আমি নাস্তা নিয়ে গেলাম। সালাম দিলাম।
আন্টি, বেশ মিষ্টি মেয়ে ভাবি আপনার।
মা, আপনাদের দোয়ায়।
আন্টি আমার ঘরে ঢুকলেন।অঙ্কিতা আর আমার ছবিটা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথে এ কে?
আমি, আমার বান্ধবী।
আন্টি, বেশ মিষ্টি মেয়ে। বুঝলাম আন্টির কাছে ওনার সব মেয়ে ই মিষ্টি। মুখে একটা চিলতে হাসি দিয়ে ভাবলাম মা রা এমনি হয়।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম , মা চোখের ইশারায় বারণ করলেন।
বুঝলাম মা চান না তিনি এই সম্পর্কে জ্ঞাত হন।
বেপার টা মোটেও ভাল লাগলো না আমার। লুকাতে হবে কেন?
মেহমান রাতের ভোজ শেষে চলে গেলেন।
বিদায় দিয়ে রুমে ডুকেছি।
মা এসে পাশে দাঁড়ালেন।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যে চলে গেছে তাকে নিয়ে এত ভাবলে শুধু দুঃখ বাড়ে বৈকি কমে না।
আমি আজ মায়ের কোন কিছুর অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। তখন চোখের ইশারা অঙ্কিতার কথা এড়িয়ে যাওয়া। এখন এসব কেন বলছেন মা।
আমি, কি হয়েছে মা তোমার। চাইলেই কি ভুলে যাওয়া যায় মা।
মা, শোক বাড়তে দিতে নেই।
আমি তো শোক করছি না মা।
মা, সারা দিন এই ছবি দেখে তুই বিমর্ষ হয়ে থাকিস। কোন কিছুতেই তোর মন নেই। এভাবে তো চলে না তুলি।
মার কন্ঠে রাগ।
ছবিটা আর এখানে রাখা চলবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি। অ্যালবাম এ রেখে দিচ্ছি।
মা এক সাথে কথা গুলো বলে আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে ছবি টা নিয়ে চলে গেলেন।
আমি মায়ের চলে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। চোখ ভিজে এল। ফুঁপিয়ে - ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
কেউ শুনতে পেলনা এই মনের চাপা আকুতি। অথবা কেউ শুনতেই চায় না।
দুদিন কেটে গেল।
অভিমান বক্ষে ধারণ করে গোপণে কেঁদে চলেছি।
কাউকেই আর কিছু বলিনি। কেউ কথা তোলেনি।
রাতে খাবার টেবিল এ সবাই খেতে বসেছি।
মা, প্রেরণা তোর সাথে কথা আছে আমাদের।
আমি, বলো মা ...
সেদিন যারা এসেছিলেন তোর বাবার বন্ধু তারা আজ কল করেছে তোর বাবাকে।
আমি, কি হয়েছে মা, খারাপ কিছু। ভাল আছেন তো সবাই? মনে খারাপ কিছুর চিন্তায় ভীত হলাম। এমন হয়েছে এখন আর ভালো কিছু ভাবতে পারিনা!
মা, না খারাপ কিছু না। খুশির সংবাদ।
আমি, কি মা?
মা, ওনারা তোকে খুব পছন্দ করেছে। সামনের মাসেই তুলে নিতে চায়। তোর সাথে কথা বলে আমাদের পাকা কথা জানাতে বলেছে।
আমি,মা সামনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা।আমি এখন এসব নিয়ে ভাবতে পারছি না।
বাবা, দেখ মা তুলি আমরা তোমার মনের অবস্থা বুঝি। তোমার ভালোর জন্যই এটা চাই আমরা। তুমি বিয়ের পর পড়তে পারবে। এটাতে তোমার অসুবিধা হবে না।
আমি মনে মনে, এটাতে আমার কি ভালো হবে আমার ঈশ্বর জানেন!!
কিন্তু বাবা, বিয়ের পর তো পড়া লেখা চালিয়ে যাওয়া কষ্ট ...
বাবা, সময় ই সব ঠিক করে দেবে। ওনারা অনেক ভাল মানুষ। তোমার ইচ্ছের প্রাধান্য দিবেন।
ছেলে ভাল। শিক্ষিত। চাকুরী করে। আমরা কথা দিচ্ছি। সামনের সপ্তাহে আংটি বদল হবে তোমাদের।
তোমার মার কাছে ছেলের ছবি আছে। দেখে নিও। আর ওনাদের পছন্দ ই ছেলের পছন্দ।
ছেলে তোমার ছবি দেখেই সম্মতি দিয়েছে।
যে দিন কাল পড়েছে যুগ ভাল নয়। বিয়ে করেও লেখাপড়া করে সবাই। এটাই এখন সবার জন্য মঙ্গল।
আমি উঠে রুমে আসলাম। মা আমার ছবি ও দিয়েছে!! তাও আমাকে না বলে।
সব যখন ঠিক করা হয়ে গেছে তাহলে আমাকে আর জিজ্ঞেস করবার কি দরকার ছিল!
বিয়ে দিয়ে আমার মঙ্গল চান তারা!
কোন প্রতিবাদ করবার মত শক্তি নেই। আমাকে জন্মের আগেই কেন গলা টিপে মেরে ফেলনি? এই সমাজে আমাদের ভাল চায় আমাদের ইচ্ছে গুলো কে বুড় আঙ্গুল দেখিয়ে।
বাবাদের কি দোষ দিব?অঙ্কিতার অবস্থা দেখবার পর সব বাবাই ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তুু বিয়ে দিকেই কি নারী সমাজের মুক্তি আসবে!?
এরা কেন বোঝে না বিয়ে তাদের মুক্তি নয়। বিয়ে তাদের মুক্তি দিতে পারে না।
খাঁচায় বন্দি সেই বন্য পশুটা হয়তো খাবার পায় অন্য বন্য পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় কিন্তুু তার মন টা সেই বনেই পড়ে রয়। মুক্ত গগনে ডানা মেলে ওড়া সেই পাখিটাকে যখন খাঁচায় বন্দি করা হয় সে তখন ডানা ঝাপটায়। তার আয়ুস্কাল ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসে।
নারীদের অভিলাষ থাকতে নেই। তা খুন করা হয়েছে জন্ম থেকেই। নয়তো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রতিবাদ করবার অভিলাষ টুকু মনের মাঝেই চাপা দিয়ে রেখেছি। পুড়ে পুড়ে তা আজ ভষ্ম।
শুনি কত নারী দেয় পাড়ি আকাশ সমুদ্র। সে আমার শুধু ই শোনা গল্প হয়েই থাকবে হয়ত।
রাতের বেলা মা আসলেন রুমে হাতে ছবি। খুব জোর করলেন, অনেক প্রশংসার বাণী শোনালেন। আমি দেখিনি। দেখে আর কি হবে। আমার পছন্দ না হলেও কারও কিছু যায় আসবে না।
আজ আমার আংটি বদলের দিন। সকাল থেকে সবাই ব্যস্ত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল।
পাত্র পক্ষ এল। আংটি বদল হয়ে গেল। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে দেখিনি আমি।
আজ বুঝতে পারছি মা কেন অঙ্কিতার কথা লুকিয়ে ছিলেন। ছেলে পক্ষ যদি এটাকে ভালভাবে না নেয়। যদি বিয়ে না দিতে পারে এই আশঙ্কা । ভেবে আমি মনে বড় ব্যাথা পাচ্ছি। আমার সখির কথাও আমাকে লুকিয়ে রাখতে হবে? কি অন্যায় করেছিল সে?
একমাস কিভাবে চলে গেল টের ই পেলাম না।
আজ আমার বিয়ে। পুরো বাসায় প্রস্তুতি চলছে।
আলপনা আঁকা হয়েছে সারা বাড়ি জুড়ে।
আজ অঙকিতার ছবিটা বের করে দেখলাম। বললাম, তুই থাকলে সব অন্য রকম হতে পারত। আজ সব হিসেব বদলে গেছে। ছবিটা শুধু তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। টানা টানা চোখ দুটি নাচিয়ে কেউ আর কথা বলে না। আমি যাকে ডাকতাম - "অঙ্কি"।
আমাকে সাজানো হয়েছে। বিয়ে বাড়িতে বাজছে বাদ্য। বর পক্ষ চলে এসেছে।
আমাকে কবুল বলতে বলা হলো, তিন বার জিজ্ঞেস করা হয়ে গেছে। আমি কোন কথা বলি না। মা পাশে থেকে বলে যাচ্ছেন কানেকানে, বল মা বল।
শেষ পর্যন্ত মায়ের চোখের পানির কাছে আর একবার হার মানলাম। হয়ে গেলাম বউ।
আমাকে একটি গাড়িতে তোলা হলো পাশে বর। সামনে আমার বরের বড় বোন।
সাথে অন্য গাড়িতে যাচ্ছে আমার ভাই।
আমি যখন পথ চেয়ে বাসার পথ চেয়ে অঝরে অশ্রু বিসর্জন করছি ঠিক তখন পিঠে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। বাড়ি আর দেখা যাচ্ছে না। আমরা বড় রাস্তায় উঠলাম। রাত বাড়ছে আর বাড়ছে মনের ভয়।
বিয়ের বছর না ঘুরতে ই মা হব এই সংবাদ দিতে হলো। বাড়ির সকলে খুশি। শুধু আমার মনে ভয় দানা বাঁধছে।
পড়াশুনার পাঠ চুকিয়েছি অনেক আগেই। সেই সে ছাড়লাম সংসারের যাঁতাকলে আর হল না।
কিভাবে দিন চলে গেল। আমার ঘরে আসল নতুন অতিথি আমার মেয়ে। নাম রেখেছি কুন্তলা।
দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর চলে গেল। আজ আমার মেয়ের স্কুলের প্রথম দিন।
কত সাধ করে তার জন্য ব্যাগ কিনেছে তার বাবা। জুতো ,মুজো, টিফিন বক্স।
আমার মনে সঙ্কা দানা বাঁধে। শেষ পর্যন্ত এরকম থাকবে তো!
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ওঠে কোন না কোন রমনীর, কিশোরীর কালো হাতের থাবায় সম্ভ্রম, জীবন হারানোর চিত্র।
এই সমাজের কালো হাতের ভয়াল থাবা কি সব গ্রাস করে নেবে? আমাদের কি কোন মুক্তি নেই।
কিভাবে রক্ষা পাব আমারা? সেদিন এক খবর বেরুলো বোরখা পড়েও নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি নবম শ্রেণীতে পড়া স্কুল ছাত্রী। এরকম আর ও আর ও কত খবর বলবো।নিজেকে বড় অসহায় লাগে।
মেয়ের জন্য বড্ড বেশি ভয় হয় আমার। তাকে চোখে চোখে রাখি সারাক্ষণ। চোখের আড়াল হলেই বুক ধক করে ওঠে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অঙ্কির ছবি এক হাতে আর এক হাতে মেয়েকে আঁকরে ধরে আছি।
মেয়ে, মা কি হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছো কেন?
মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে গালে আদর করে জাপটে ধরে বলি কিছু হয়নি মা, কিছু হয়নি।
পেছন থেকে মেয়ের বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।
আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, চল ...
আমার হাত টি মুষ্টি বন্ধ করে নিয়ে গেল ঘরে।
দেয়ালে তাকিয়ে দেখি অঙ্কি হাসছে .......
আমার আর অঙ্কির সেই ছবিটি।
তার কাঁধে মাথা রাখি, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরি ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি অপলক।
মেয়ে আমার চোখ মুছে দিচ্ছে .....
স্বপ্ন দেখি পাষণ্ড গুলোর বিচারের।স্বপ্ন দেখি আর কোন নারীর সম্ভ্রম না হারানোর। স্বপ্ন দেখি আর একটি অঙ্কিতা কে যেন হারাতে না হয় মা - বাবার।
রাজপথে মিছিল করে চলেছি ঠিকই কিন্তু বুকে ভয়। নিজের জন্য ভয়,মেয়ের জন্য ভয়,বোনেদের জন্য ভয়। বুকে আশা বাঁধি আমারা এ ভয় করবো একদিন জয়। রুখবো সমাজের ক্ষয়।