মাঘ মাসের শীতের রাত । কয়েকদিন ধরে শৈত্য প্রবাহ চলছে । আজ আবার ঠান্ডাটা একেবারে জাঁকিয়ে পরেছে । স্টেশন চত্বরটা একেবারে সুনসান । শীতের পোশাকের সাথে মাথা থেকে পা অবধি কম্বল জড়িয়ে স্টেশন মাস্টার বংশীলালকে বললেন -- রাত ১১ টার ট্রেনটা পাস করিয়ে দেবার পর আবার সেই রাত ১ টায় ট্রেন । দু ঘন্টার মধ্যে এই ঠান্ডার রাতে আর বাহিরে বেড়োতে হবে না । বংশীলাল জানে রাত ১টার ট্রেনটা চলে যাবার পরে বেশ কিছু সময় বিশ্রাম , আবার সেই সকালে ট্রেন । বংশীলাল বললো -- রাত ১১ টার ট্রেন আসতে এখন দেরি আছে । আমি ঠিক সময় গিয়ে সবুজ সিগন্যাল দেখিয়ে দিয়ে আসবো । সাধারণত এই রাতের ট্রেনে এই স্টেশনে লোকজনের ওঠানামা নেই বললেই চলে ।
বিহার রাজ্যে অবস্থিত একটি অখ্যাত রেলওয়ে স্টেশন । স্টেশন পেরিয়ে কিছুটা এগোলে নানা ধরনের আদিবাসী বেষ্টিত কয়েকটি গ্রাম । চারিদিকে শাল , সেগুন আর বিভিন্ন ধরনের অচেনা গাছের সারি । আর কিছুটা এগোলে ঝোপঝাড়ের জঙ্গল । রাত নামলে বিভিন্ন ধরনের বন্য জন্তু - জানোয়ারের আনাগোনা শুরু হয় ।বনদপ্তরের একটি অফিস আর তাদের লোকজনদের থাকবার জন্য কয়েকটি কোয়াটারস । সারা দিন-রাত মিলে ৫/৬ টা মেল ট্রেন আর কয়েকটি লোকাল ট্রেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য এই স্টেশনটিতে দাড়ায় । স্টেশনমাস্টার হাত ঘড়িটা দেখে বংশীলালকে বললেন -- রাত ১১ টার ট্রেন আসার সময় হয়ে গেছে । তুই প্লাটফর্মে গিয়ে গাড়িটিকে পাস করিয়ে দিয়ে আয় ।
দুরের ছোট আলোর বিন্দুটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে । কালো দৈত্যের মতন বিশাল কয়লার ইঞ্জিনটি বিকট আওয়াজ করতে করতে একরাশ কুণ্ডুলি পাকানো কাল ধুঁয়া ছড়িয়ে স্টেশনে এসে ঢুকলো । বংশীলাল এই হার কাঁপানো শীতের রাতে কোনরকমে সবুজ পতাকা নেড়ে গাড়ীটিকে পাস করিয়ে দিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে সবে বসেছে , হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ । স্টেশন মাস্টার আর বংশীলাল বেশ অবাক হয়েই ভাবলো এই রাতে কে দরজায় আওয়াজ করতে পারে ? আসলে শীতের জন্য তরিঘড়িতে বংশীলালও ভাল করে খেয়াল করে নি কেউ ট্রেন থেকে এই স্টেশনে নেমেছে কিনা !! স্টেশন মাস্টারের ইশারায় বংশীলাল দরজাটা খুলতেই এক অল্প বয়সের সুন্দরী মহিলা ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পরলো । মহিলাটি অপ্রস্তুত আর ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যে ঘটনার কথা বললো , তা শুনে স্টেশন মাস্টার আর বংশীলাল রাদিয়াকে নিয়ে এই নির্জন রাতে বেশ চিন্তায় পরে গেল ।
আমি রাদিয়া । আর আমার বোন নাদিয়া । আমরা দুই যমজ বোন । মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে । কলেজের ছুটিতে দুজনে মিলে মামাবাড়ী বেড়াতে যাচ্ছিলাম কয়েকদিন থাকব বলে । হাওড়া স্টেশন থেকে দুপুরবেলায় এই ট্রেনে উঠি । কাল সকালে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা । আমরা যে কম্পারমেন্টে উঠেছিলাম সেটা প্রায় ফাঁকাই ছিল । মাঝের স্টেশনগুলিতে আরো যাত্রী নেমে যাবার ফলে আরো ফাঁকা হয়ে যায় । সন্ধের দিকে একটি স্টেশন থেকে কয়েকজন মধ্য বয়েসী লোক উঠে আমাদের পাশে বসে । একটা সময় আলাপ হবার পর গল্প করার ফাঁকে লোকগুলি আমাদের সুস্বাদু খাবার খেতে দেয় , সরল মনে আমরা সেগুলি খাই । এর কিছুক্ষন পরে লোকগুলি আমাদের নানা ভাবে বিরক্ত করা শুরু করে । সঙ্গে কুপ্রস্তাবের ইঙ্গিত দেয় । এই রকম চলতে চলতে আমি জ্ঞান হারাই , তারপরে আর কিছু মনে নেই । বোধহয় লোকগুলির দেওয়া খাবারের সঙ্গে কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল । যখন জ্ঞান ফেরে তখন বুঝতে পারলাম আমি অত্যাচারিত হয়েছি । লোকগুলিকেও আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না । সঙ্গে বোনকে কাছে দেখতে না পেয়ে খুব চিন্তা হোল । ভাবলাম হয়ত লোকগুলির অত্যাচারের ভয়ে বাধ্য হয়েই কোনক্রমে অন্য কোন স্টেশনে নেমে পরেছে কিংবা লোকগুলি হয়ত জোর করে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে গেছে । আমিও সম্পূর্ণ দিশেহারা , দ্বিধাগ্রস্থ আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে কোন কিছু চিন্তা না করে এই স্টেশনে গাড়ী থামতেই নেমে পরলাম । ভাবলাম এই স্টেশনে নেমে পরে স্টেশন মাস্টারের সাহায্য নিয়ে যদি আমার বোনের কোন সন্ধান করতে পারি । এই ঘটনার বিহ্বললতায় আমার বুদ্ধি এতটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিল অন্য লোকেদের জানবার কথা মাথায়ই আসলো না । এতক্ষন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে আতঙ্কিত মুখে রাদিয়া বললো -- আপনারা আমাকে বাঁচান , আমার বোনকে খুঁজে পাবার ব্যবস্থা করে দিন ।
স্টেশন মাস্টার রাদিয়ার সব কথা শুনে চিন্তিত হয়ে বললেন -- এত রাতে একাকি এই অচেনা অজানা নির্জন স্টেশনে হটাৎ করে ট্রেন থেকে নেমে পরে আপনি ঠিক কাজ করেননি । এতে আবার অন্য কোন নতুন বিপদ ঘটতে পারতো । এখন এই রাতে জনমানবহীন স্টেশনে আপনাকে আমরা কি ভাবে সাহায্য করতে পারি , সেটাই বুঝতে পারছি না । একটুক্ষন চিন্তা করে বললেন -- একটা কাজ করুন । রাত ১ টায় এই স্টেশনে যে ট্রেনটা আসছে আমরা আপনার বিপদের সব ঘটনার কথা টিটি কে বলে ট্রেনে ঠিকমত উঠিয়ে দিচ্ছি । এই ট্রেনটিও আপনার মামাবাড়ী যাবার স্টেশনে থামবে । মামাবাড়ী পৌঁছে তাঁদের সাহায্য নিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে আপনার বোনের খোঁজখবরের ব্যবস্থা করুন । আর আপনার সঙ্গে যোগাযোগের নাম্বার বা ঠিকানাটা রেখে যান । যদি আমরা কোন খবর পাই তবে নিশ্চয় জানাব । কথাবার্তা চলাকালীন হটাৎ স্টেশন মাস্টারের ঘরের টেলিফোনটা বিকট আওয়াজ করে বাজতে শুরু করলো ........
টেলিফোনে কথা শেষ হবার পর স্টেশন মাস্টার বংশীলালকে বললেন -- " ট্রেনে কাটা পরা কেস " , আগের স্টেশন থেকে খবর দিল রাত ১টার ট্রেনটা যেটা এই স্টেশনে আসছে সেই ট্রেনে একটা বেওরিশ ডেড বডি রয়েছে । লাইনের ধারে বডিটা পরে ছিল । আমাদের এখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে গার্ডের হাতে দিতে হবে । এরপরের বড় স্টেশনে বডি নামিয়ে হাসপাতালের মর্গে চালান করা হবে । কার ঘরের যে সর্বনাশ হলো কে জানে ? শোন বংশীলাল , ট্রেন আসার সময় হয়ে এলো । তুই আমার হয়ে এই মহিলার সব ঘটনা জানিয়ে টিটিকে বলে রিজার্ভড কামরায় তুলে দিস । আমি ডেডবডির কাগজপত্র তৈরি করে এদিকের ঝামেলা সামলাই । আজকের রাতটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল ।
ডেডবডির কাগজপত্র তৈরি করে গার্ডের হাতে তুলে দিয়ে একটু যেন স্বস্তি পেলেন । এই ঝামেলার জন্য ট্রেনটা এই স্টেশনে অনেকক্ষন দাড়িয়ে রইলো । ইতিমধ্যে বংশীলালও মহিলাটিকে ঠিকঠাক ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে চলে এসেছে । ট্রেন ছেড়ে দেবার একটু আগে কৌতূহলবশত ডেডবডির মুখের থেকে সাদা কাপড়টা সরাতেই এক ভয়ার্ত আর্তনাদ করে স্টেশন মাস্টার আর বংশীলাল ভীষণ ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকলো । এই রাত ধরে যে মহিলাকে নিয়ে তারা ব্যাস্ত ছিল এতো সেই মহিলারই ডেডবডি !!!!! অবিকল এক মুখ !!! কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ??? তবেকি ডেডবডিটা রাদিয়ার বোন নাদিয়ার !! ....... এখন মনে পরলো রাদিয়া বলেছিল তারা দুই যমজ বোন ....
ঘটনার আকস্মিকতায় এই প্রচন্ড ঠাণ্ডাতেও স্টেশন মাস্টার আর বংশীলাল ঘামতে থাকল । বিকট হুইসেল দিয়ে একরাশ কাল ধুঁয়া ছড়িয়ে ট্রেনটা আস্তে আস্তে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল । একটা সময় ট্রেনের শেষের লাল আলোর বিন্দুটা ফিকে হতে হতে দুরে মিলিয়ে গেল । আর কিছুক্ষন পরেই পূব আকাশে আস্থে আস্থে উঠতে থাকল নতুন আরেক লাল আলো । শুরু হোল নতুন আরও একটা দিন , নতুন করে জীবনের পথ চলা গত মাঝ রাতের ঘটনাকে পেছনে ফেলে .....
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ভাই , গল্পটি আমি আগেই পড়েছি । 2.9..18 আমার ভাল লাগার কথা জানিয়েছি । যাইহোক , আবারও বলি আপনার গল্পটি সত্যি খুব সুন্দর আর চিন্তাধারায় নতুনত্বে ভরপুর । ভাল থাকবেন । অনেক শুভকামনা রইল ।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
গল্পটা দুবার-ই পড়া হয়ে গেল। আপনার গল্পের কাহিনী খুব সরল এবং সাবলীল। অনেক ভালো লেগেছে। তবে গল্পটা এভাবে খোলাখুলি না বলে একটু আলোচনায় প্রবেশ করতে পারতেন। আর যেহেতু ডেডবডীটা একই চেহারার ছিল। যাক গে, সেদিক আর আলোচনা করবো না, তবুও গল্প যে চমৎকার হয়েছে সেটাই বলবো। বরাবরের মতই শুভ কামনা রইল দাদা।
Lutful Bari Panna
গল্পটা ভূতের গল্প হতে পারতো। মেয়েটা জমজ বোনের কথা না বললে, ঐদিকেই টার্ন করতো নিশ্চিত। যদিওেএ ধরনের ভূতের গল্প প্রচুর আছে। আপনার লেখার হাতটির একটা সরল কিন্তু মিষ্টি মাধুর্য আছে। গল্প নির্মানের ভঙ্গিটিও চমৎকার। তো আরো লিখুন এখানে।
আহা রুবন
এমন একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন, যা ভারত-বাংলাদেশে নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাদার হাতে গল্পটি গভীর এক রহস্যের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কখনও মনে হয়েছে আমি স্বয়ং ওখানে উপস্থিত। মুগ্ধতা!
..... রাদিয়ারা হাওড়া স্টেশন থেকে দুপুরবেলায় এই ট্রেনে উঠেছিল .... এই গল্পের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাদিয়া সম্পূর্ণ ভয়ে , দিশেহারা , দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রাতের বেলায় এই অখ্যাত স্টেশনে নেমে পরে ......। গল্পটি পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ । ভাল থাকবেন ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
অনেক মানুষের ক্ষেত্রে কর্মজীবনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় । এই রকম একটি ভিন্ন স্বাদের ঘটনার কথা গল্পের মাধ্যমে লিখতে চেষ্টা করেছি কোন এক অখ্যাত রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কর্মজীবনের মধ্যে দিয়ে ....
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।