শহর থেকে অনেক দূরে, সরলা নদীর ধারে। প্রকৃতির অতি সন্নিকটে। যেখানে কোনো পাকা রাস্তা নেই, আছে কেবল গাঁয়ের মেঠো পথ। যেখানে কোনো হাসপাতাল নেই, আছেন স্বয়ং আলম কবিরাজ। যেখানে কোনো স্কুল নেই, আছে শুধু আনোয়ার মাষ্টারের খড়ের চালার পাঠশালাটা। সে পাঠশালায় গাঁয়ের ছেলেরা পড়তে যায়। অ আ ক খ শিখে। কিন্তু এসব শিখতে শিখতে তারা আর চন্দ্রবিন্দু অবধি পৌঁছতে পারে না। তার আগেই তারা পাঠশালায় আসা বন্ধ করে দেয়। কাজ নেয় ক্ষেতে-খামারে, কাজ নেয় হাটের দিনে বাবার সাথে মাছ বেচতে যাবার, কেউ বা আবার বড় ভাইয়ের নতুন খোলা মুদি দোকানটার গদিতে বসে পড়ে টাকার হিসেব রাখবার জন্য। যত তাড়াতাড়ি সাংসারিক হওয়া যায়, ততই যেন এদের চিন্তা ঘুচে যায়। পড়াশোনার প্রতি এদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, পড়াশোনার মর্ম এরা বোঝে না। এরা বোঝে গায়ে খেটে পেটের খাবার যোগানোর ধান্ধা। দু’পাতার বই পড়লে সাথে সাথে পেট ভরে না, বরং বাবার সাথে কাজে গেলে সংসারে দুটোটাকা বেশি আয় হয়। তাই এরা শুধু শুধু পাঠশালায় বেশি দিন যাওয়া আসা করে, বর্ণমালা শিখে নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে না। সময়ের সদ্ব্যবহার করে।
আর এ গ্রামের মেয়েদের বয়স যখন চার কি পাঁচ, তখনই তাদের পড়াশোনার পর্ব শুরু হয়ে যায়। পড়াশোনার জন্য তারা আনোয়ার মাষ্টারের পাঠশালায় নয়, মক্তবে যায়। রোজ ভোরে যায়। সিপারা পড়ে, আমপারা পড়ে, সবশেষে তারা কুরআন শরীফ খতম দিয়ে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় তাদের ঘরকরনার কাজ শেখার প্রচেষ্টা। মায়ের হাতে হাতে সংসারের বিভিন্ন কাজ করে দেওয়া, দুপুর বেলা বাপ-ভাইয়ের জন্য ক্ষেতে খাবার নিয়ে যাওয়া, বিকেলবেলা সমবয়সীদের সাথে বউছি খেলা- এভাবেই তাদের দিন গড়িয়ে চলে। ধীরে ধীরে তারা বড় হয়ে ওঠে। কৈশোরে পা দেয়। তাদের শরীরে ও মনে আসে এক আমূল পরিবর্তন। তাদের চারপাশে চলতে থাকে নতুন নতুন রঙিন স্বপ্নের আনাগোনা। সেই রঙিন স্বপ্নের জগতে তারা হারিয়ে যায়। হারিয়ে গিয়ে নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পায়, নতুন করে আবিষ্কার করে। এই হারিয়ে-পাওয়ার জগতে শেফালী একজন, যে তার স্বপ্নের জগতের পথ খুঁজে পেয়েছে, খুঁজে পেয়েছে তার পথসঙ্গীকে।
আজ শেফালীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। তার নতুন জীবন তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু এ জীবন যেন তার ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। মনে মনে সে যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল, সে জীবনের চেয়ে হাজার গুন সুন্দর বাস্তব তার জীবনে সে উপহার পেতে চলেছে।
বাপ-মা মরা মেয়ে শেফালী, চাচার কাছে মানুষ। পাঁচ ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি সব মিলিয়ে চাচার সংসার অনেক বড়। কিন্তু সে তুলনায় এ সংসারে আয় অতি যৎসামান্য। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’- অনেকটা এরকম অবস্থা। তার উপরে শেফালী হল আরেক পরগাছা। এরকম এক অভাবের সংসারে থেকে বড় হয়ে উঠেছে শেফালী। কিন্তু এ অভাবের সংসারেও তার নিজের বলতে কিছুই নেই- এটুকুনি বোধ শেফালীর ছিল। তাই নিজের জীবনের কষ্টটুকু সে হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে।অমাবস্যার রাতে চাঁদ দেখতে চাওয়ার মত অপরাধ সে কখনোই করে নি। সবসময় শুধু স্বপ্নে দেখেছে এক চিলতে কুঁড়েঘর আর একজন সাধাসিধে মানুষ, যে তাকে সবসময় আগলে রাখবে।
কিন্তু সে শুনেছে যে বাড়িতে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেটা অনেক বড় বাড়ি। টিনের দোচালা ঘর, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, দেওর- সংসারটা একেবারে ভরপুর। ছেলের গঞ্জে দোকান আছে, ভালো ব্যবসা করে। কোনো অভাব নেই। চাচী বলেন, ‘শেফালী, তোর দুঃখ এইবার গেল রে.. দেহিস তুই অনেক বালো থাকবি। তোর অনেক সুখ হইব।’ সুখ ? সুখ কী শেফালী তা জানে না। ও বাড়িতে বিয়ে হলে সে ভালো খেতে পরতে পারবে, কোনো কিছুরই কোনো অভাব হবে না- এটাই কী সুখ ? না কি সুখের অন্য কোনো গভীর অর্থ আছে ?
ঘরের দক্ষিণের জানালাটা খুলে শেফালী আকাশ দেখে। ভোরের আলো এখনো ফুটে নি। অবশ্য ফুটলেও খুব সম্ভবত তা বোঝা যাবে না। কারণ আকাশ মেঘে ঢাকা। ঘন কালো মেঘ। কাল সন্ধ্যে থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্য থামলেও আবার বৃষ্টি হবে। আগের বারের চেয়েও বেশি বৃষ্টি। আজ দুপুরের পর ও বাড়ির থেকে লোকজন আসার কথা। মসজিদের হুজুর বিয়ে পড়াবেন। শেফালীর মনে বারবার চাচীর বলা কথাগুলো মুচড়ে উঠে। মনের মাঝে অকারণ আনন্দ হয়,শিহরণ জাগে আবার ভয় হয়। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় দ্বিধা-দ্বন্দের। এক মন বলে, শেফালী, তোর সুখের দিন আসছে, তোর পথসঙ্গী তোর হাত ধরতে আসছে। আরেক মন বলে, হায় রে পোড়াকপালী, জনম দুখীর দুঃখ কী আর শেষ হয় ?
শেফালী তার মনের বলা কথাগুলোর কোনোটিরই সঠিক অর্থ খুঁজে পায় না। তার বুক থেকে বেরিয়ে আসে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস।
০০০
ছোটোখাটো এক অনাড়ম্বড় আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেফালী তার স্বপ্নের জগতে পা রাখে। না, না, এটা তার স্বপ্নের জগৎ কীভাবে হয় ? সে তো তার দু’চোখের তারায় এ স্বপ্ন আঁকে নি। সে তার জীবনে স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর এক বাস্তব উপহার পেয়েছে। তার চলার পথের সঙ্গী তাকে কতই না ভালোবাসে! সবসময় আগলে আগলে রাখে। শেফালী ভাবে এমন মানুষ তার কপালে ছিল! সে কি যোগ্য এই এত ভালোবাসা পাওয়ার ? আর এ বাড়ির আর সবাইও তাকে যেন একেবারে আপন করে নিয়েছে।
সে তার মনকে বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যান তারা আমারে বউ কইরা আনল রে? ক্যান তারা সব্বাই আমারে এত বালো কয় ? আমার মতো পোড়াকপালীর কপালে কী এত সুখ সইব?’ তার জিজ্ঞেস করা এই প্রশ্নগুলো তার মনের ভিতরেই ঘুরপাক খায়। ঘুরতে ঘুরতে মনের অদৃশ্য দেয়ালের গায়ে বারবার ধাক্কা খায়, ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, আবার ধাক্কা খায়। কিন্তু মনের বাইরে বেরোয় না। সে নিজেও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পায় না। শুধু হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সুখটুকুনিকে আঁকড়ে ধরে।
দিন যায়, মাস যায়। এ সংসারে শেফালীর অবস্থান দৃঢ় হতে দৃঢ়তম হয়। সংসারটাকে সে আপন করে নেয়, নিজের মনের মত করে সাজিয়েগুছিয়ে তোলে। ছোটোখাটো সাংসারিক জটিলতা ছাড়া তার রঙীন জীবন নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। এই নির্বিঘ্ন রঙিন জীবনে আরও এক ছটাক রঙ এসে লাগে বছর খানেক পরে, যখন সে প্রথমবারের মতো মা হয়। কিন্তু এ রঙ যেন কেবলমাত্র তারই। আর কারো নয়। আর কেউ এ রঙ গায়ে মুখে মাখে নি। এমনকি তার পথচলার সঙ্গীও না। বরং তার জীবন নদীর নানা রঙের স্রোত দিক পরিবর্তন করেছে। দিক পরিবর্তন করে এই নানা রঙের স্রোত এক কালো রঙের স্রোতে এসে মিশেছে, যার ফলে হারিয়ে গিয়েছে আর সব রঙের অস্তিত্ব।
গ্রামের রীতি অনুসারে শেফালীর প্রথম সন্তান বাপের বাড়িতেই হয়। সন্তান জন্মের আগ পর্যান্ত তার জীবন নদীর স্রোত আপনমনেই চলছিল। তার স্বামী তার পাশে পাশে ছিল। সবসময়ই যেন তাকে একেবারে চোখে হারিয়েছে। কিসে তার সুবিধা, কিসে অসুবিধা, সে কী চায়- সমস্তকিছুর প্রতিই আলাদা এক সুক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছে। ও বাড়ির থেকেও লোকজন এসেছিল কয়েকদফা। শেফালীর শ্বাশুড়ী নিজে এসে দশটি ছোটো কাঁথা দিয়ে গেছেন নতুন অতিথির জন্য।
যে রাতে শেফালীর ব্যথা উঠল, সে রাতে ও বাড়ির কেউ সেখানে ছিল না। চাচী বসেছিল মাথার কাছে। সেদিন বিকেলেই তার স্বামী ব্যবসার কাজে দূরে চলে গিয়েছিল। যাবার সময় তার কানের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘আইয়া জানি আর তরে একলা না পাই। পতের তন জানি কান্দনের আলাপ পাই।’ কথাগুলো শুনে সে শুধু ঠোঁট টিপে হেসেছিল। কিন্তু ব্যথা উঠার সময় তাকে অনেকবার ডেকেছিল শেফালী। তীব্র যন্ত্রনায় ভুলে গিয়েছিল বিকেলের ঘটনাটা। ভুলে গিয়েছিল যে সে এখানে নেই, ব্যবসার কাজে দূরে গিয়েছে।
যন্ত্রনার শেষে যখন একটি নতুন প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, তখনই সে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ল। জ্ঞান ফিরল অনেক পরে। তখন সে নিজের শরীরের সাথে একটি ছোট্ট, নরম শরীরের স্পর্শ টের পেল। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির আভাস পাওয়া গেল। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে তাকাতেই দেখল চাচী ঘরে ঢুকছেন।
-কী রে, তোর শরীরের অবস্তা কী ? এহন কী এট্টু ভাল ঠেকে ?
-চাচী, হে এহনও আহে নাই ?
তার প্রশ্ন শুনেই চাচী হচকচিয়ে গেলেন। কী বলবেন তা বুঝতে পারলেন না। ভোরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি তার মনে পড়ল। পাশের বাড়ির করিমকে দিয়ে তিনি ভোরেই ও বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিলেন। আনন্দের সংবাদ শুনে তারা সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল এখানে আসার জন্য। কিন্তু হঠাৎ তারা করিমের কাছে জানতে পারল যে শেফালীর না কি চাঁদের মতো একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। খবরটি শোনামাত্রই যেন তাদের সমস্ত ব্যস্ততা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাদের সমস্ত আনন্দ ওখানেই সমাপ্ত হলো, তারা এখানে আসার যবনিকা টানল চিরতরে। সাথে করিমকেও দু’কথা শুনিয়ে দিল তাদের হাতে পায়ে ধরে বারবার অনুরোধ করার জন্য। করিম তার বিষণ্নতার আঁধারে ঘেরা মুখ নিয়ে ফিরে এল। সমস্ত কথা শোনার পরে চাচা আর চাচী কেবল একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কারণ তখন আর ও বাড়িতে দ্বিতীয় বারের জন্য যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু এখন কী করবেন ? শেফালীর শরীরের অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়। তার উপরে এ কথা শুনলে.....। এ অবস্থায় তাকে কী বুঝ দিবেন ? তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।
-কী, চাচী ? হে আহে নাই ?
-না, এহনো তো আইল না।
- আব্বা- আম্মায়ও আহেন নাই ?
-শেফালী, তর মাইয়া কানতাছে। ওরে শান্ত কর আগে।
এ কথা বলেই চাচী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শেফালীর মনে সন্দেহ জাগে। যত সময় যায় তার সন্দেহও যেন ততই প্রগাঢ় হয়ে উঠে। একটা সময় তার সব সন্দেহের অবসান হয় প্রতিবেশিদের কথায়। আশেপাশের মানুষ আসে আর জিজ্ঞেস করে, ‘শেফালী, তর জামাই বলে মাইয়া অউয়াতে খুশি অয় নাই ? মাইয়া অইছে হুইন্যা বলে ওই বাড়ির তন কেউ আহেও নাই?’ শেফালী তাদের জিজ্ঞাসার কোনো জবাব দেয় না। চাচীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চাচী সামাল দেন। ঘর ফাঁকা হলে চাচীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে যে কী হয়েছে। চাচীর পক্ষে ঘটনাটি আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।
শেফালী সমস্তটা শুনে থ মেরে যায়। কী বলবে তা বুঝতে পারে না। শেষে মেয়েটাকে বুকের কাছে টেনে বলে, ‘হেরা যাই কোক, দেইখেন বাবুর আব্বায় ঠিকই আইব।’ কিছুক্ষণ পর চোখেমুখে হাসির আভাস আনার চেষ্টা করে আবারও সে বলে, ‘মাইয়ার টান হে ছাড়তেই পারব না।’
সেদিনই শেফালীর জীবন নদীর স্রোত দিক পরিবর্তন করেছিল। মিশে গিয়েছিল এক কালো রঙের স্রোতে, যার ফলে বাকি রঙগুলো আর কখনও আলাদা করা যায় নি। বহুদিন সে অপেক্ষা করেছিল ও বাড়ি থেকে লোক আসবে তাকে নিয়ে যেতে। আর কেউ না এলেও তিনি তো আসবেনই। এ ভাবনায় সে দিন কাটিয়েছে। কিন্তু যখন তার সমস্ত ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও বাড়ি থেকে আর কোনো ডাক এল না, তখন সে নিজেই গ্রামের রীতি ভঙ্গ করে কোলের মেয়েকে নিয়ে চাচার সাথে ও বাড়িতে গিয়েছিল নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন ফিরে পাবার আশায়। কিন্তু সে স্বপ্ন আর সে ফিরে পায় নি। শূন্য হাতে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। কারণ তার দেখা স্বপ্ন তখন ছিল অন্য কারো চোখে।
০০০
ও বাড়ি থেকে শেফালীর শূন্য হাতে ফিরে আসার পর আরও অনেক দিন কেটে গিয়েছে। শেফালীর অল্প বয়সের চোখে মুখে অকাল বার্ধক্যের ছোঁয়া লেগেছে। তার মেয়েটাও এখন অনেক বড় হয়েছে; জীবনের রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, যে স্বপ্ন তার মা ও দেখেছিল, কিন্তু পেয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি, ভাগ্যের ফেরে হারিয়েছিল সমস্তটাই।